শত শত মৃত্যু, বিধ্বস্ত ঘরবাড়ি, গুড়িয়ে যাওয়া জীবিকার উৎস, হারানো স্বজনের জন্য বেদনাময় আর্তি আর ক্ষুধা কাতর রোগাক্রান্ত শিশুই এখন সুনামি-বিধ্বস্ত ইন্দোনেশিয়ার বাস্তব চেহারা। তবুও জীবন থামেনি সেখানে। অস্তিত্ব রক্ষার সহজাত তাড়নায় মৃত্যু আর ভাঙনের বিধ্বস্ত বাস্তবতায় দাঁড়িয়েও আগামীর জন্য স্বপ্নের বীজ বুনছে সেখানকার সহায়হীন মানুষেরা। ধ্বংসস্তূপে জীবনের আশা ক্ষীণ, তবুও উদ্ধার অভিযানের আনুষ্ঠানিক সমাপ্তি ঘোষণা করা হয়নি। মৃত্যুর সংখ্যাতাত্ত্বিক হিসেবে প্রতিক্ষণে যুক্ত হচ্ছে নতুন নাম, আর তার সমান্তরালে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে জীবন গড়ার আশাবাদ। বিধ্বস্ত ঘরবাড়ি পেছনে রেখে নতুন আবাস গড়া, সুনামিতে ভেসে যাওয়া দোকানটিকে আবার নতুন করে শুরু করার মতো স্বপ্নগুলোই এখন সুনামি-আক্রান্ত ইন্দোনেশীয়দের বাঁচার অবলম্বন।
শনিবার উপকূলীয় শহর সুমাত্রা এবং জাভায় পর পর দুটি ঢেউ আঘাত হানে। প্রথম ঢেউ অতটা শক্তিশালী না হলেও দ্বিতীয় ঢেউটি ছিল ভয়াবহ। আনাক ক্রাকাতাও আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাতের ফলে সাগরতলে ভূমিধসের কারণেই এই সুনামির উৎপত্তি। এর সঙ্গে পূর্ণিমার প্রভাব যুক্ত হওয়ায় বিপুল শক্তি নিয়ে সৈকতে আছড়ে পড়েছে সুনামির ঢেউ। নতুন করে আবারও সুনামির আশঙ্কায় আনাক ক্রাকাতাও আগ্নেয়গিরির কাছাকাছি উপকূলীয় এলাকার বাসিন্দাদের সৈকত থেকে দূরে থাকার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।
সেনাবাহিনীর উদ্ধারকর্মীরা উপকূলে সুনামির ভাসিয়ে নিয়ে যাওয়া একটি মঞ্চে খোঁজ করছেন প্রাণের। সুনামির আগে সেখানে অনুষ্ঠান করছিলো রক ব্যান্ড সেভেন্টিন। প্রায় ২০০ অতিথি ছিলো সেখানে। এখন পর্যন্ত ১০৬টি দেহ উদ্ধার করা হয়েছে। এখনও অভিযান চলছে, মাথার ওপরে উড়ছে ড্রোন। ব্যবহার করা হচ্ছে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত কুকুর। কিন্তু সুনামির ঢেউয়ে ভাসিয়ে নিয়ে যাওয়ার পর এখন শুধু কনসার্টে ব্যবহৃত সেই সঙ্গীত সরঞ্জামগুলোই এলোপাতাড়ি পরে আছে। উদ্ধারকারী এক কর্মকর্তা নিজেই স্বীকার করেছেন, যদি সত্যিই আরও কাউকে জীবিত পাওয়া যায় তবে খুবই বিস্মিত হবেন তিনি।
সেই রিসোর্টের পরিচালক কুন্তো উইজোয়ো গার্ডিয়ানকে বলেন, ‘অনুষ্ঠানে নারী,পুরুষ ও শিশুরাও ছিলেন। রবিবার সকাল থেকে তিনি অনেক দেহ সরাতে শুরু করেন। তিনি বলেন, হোটেলের আশপাশে ১০৬ জন নিহত হয়েছেন। ইন্দোনেশীয় কর্তৃপক্ষ এখন পর্যন্ত এই দুর্যোগে নিহতের সংখ্যা নিশ্চিত করেছে ৪২৯ জন। আহত হয়েছেন দেড় হাজারের বেশি। আর নিখোঁজ রয়েছেন ১৫৪ জন।
সুনামির বিশাল ঢেউয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে শত শত বাড়ি, বাস্তুহারা হয়ে পড়েছেন ১৬ হাজারেরও বেশি মানুষ। আশঙ্কা করা হচ্ছে নতুন করে সুনামি হতে পারে, ধ্বংস হতে পারে আরও ঘরবাড়ি। অনেকেই এখন সরকার পরিচালিত শরণার্থী শিবিরে আশ্রয় নিয়েছে। আশ্রিত ৫৬ বছর বয়সী কুসনাদি বলেন, তিনি তার বাড়ির কাঠামো নিয়ে শঙ্কিত। সুনামির আঘাতে ভেঙে না পড়লেও অনেক দুর্বল হয়ে গেছে। রবিবার সকালে তার বাড়ির সামনে দুটি ভেসে আসা মরদেহ দেখেই শঙ্কিত হয়ে পড়েছেন তিনি। তিনি বলেন, ‘আমি ঢেউ দেখিনি, কিন্তু আওয়াজ শুনেছি। ভাবতেও পারিনি এমন কিছু হতে পারে। সবকিছু ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছিলো, সবাই ছুটছিলো, সেই ঢেউ যেন আমাকে তাড়া করছিলো।’
কুসনাদি বলেন, ‘আমি জীবনের জন্য দৌড়াচ্ছিলাম। তবে পরদিন সকালবেলা ফিরে আসি। তখন দুটি মরদেহ চোখে পড়ে আমার। প্রচুর পানি ঢুকে ফুলে গিয়েছিলো দেহগুলো। মাছ ধরার যন্ত্রগুলো তখনও তাদের শরীরে বাঁধা। আমার মনে হয় মরদেহগুলো দেয়ালে ধাক্কা খেয়েছিলো।’ তিনি বলেন, এখন সমুদ্রের দিকে তাকালেই আঁতকে উঠেন তিনি। শান্ত থাকলেও ভীত হয়ে পড়েন। আর এজন্যই উপকূলবর্তী নিজের বাড়িতে ফিরে যাওয়ার সাহস পাচ্ছেন না। আশ্রয় শিবিরের অন্য জায়গাগুলোতেও একই পরিস্থিতি। সুনামির বিভীষিকা কাটিয়ে উঠতে পারেননি কেউই। সুনামি সতর্কতা ব্যবস্থা নিয়ে ইন্দোনেশিয়ায় যথেষ্ট প্রযুক্তি আছে দাবি করা হলেও ২০১২ সাল থেকে সেই ব্যবস্থা কখনোই ঠিকমতো কাজ করেনি।
সরকারি এক কর্মকর্তা দাবি করেন, সামনের বছর থেকেই সাগরতলে ভূমিধসের ফলে সৃষ্ট সুনামির ব্যাপারে সতর্কবার্তা জারি করা সম্ভব হবে। তানজুং লিসাং রিসোর্টের পরিচালক উইজোয়ো বলে, তিনি ওই অঞ্চলে একটি ব্রেকওয়াটার দেখতে চান। সব স্থানীয়দের চাওয়াই একইরকম।
বুধবার সকালে ৫০ বছর বয়সী ল্যামপাং ওমো বলেন, তিনি তার বোনের খাবারের দোকান থেকে কাঠ কুড়িয়ে এনেছেন। কয়েকদিন আগেও এই দোকানটি অক্ষত ছিলো। তিনি বলেন, ‘এটাই তার একমাত্র আয়ের উৎস ছিলো। আমি তার ভবিষ্যত নিয়ে খুবই শঙ্কিত। তবে ভবিষ্যতে আবারও এই দোকানটি তৈরি করতে চাই।’ রাস্তা থেকে দুটি চামচ তুলে নিয়ে তিনি বলেন, আমি এখন খুঁজে দেখছি আর কি কি ব্যবহার করা যায়।
এই মুহূর্তে অনেক স্বেচ্ছাসেবক বাস্তুহারাদের সাহায্য করছে। রেডক্রস, খ্রিস্টান চ্যারিটি ওয়ার্ল্ড ভিশন, আকসি সেপাত তাংগাপের মতো স্থানীয় এনজিওগুলো সরকারকে সহায়তা করছে, ওষুধ ও চিকিৎসা সরবরাহ করছে। রেডক্রসের কর্মী অলা আরিয়ানি বলেন, কর্তৃপক্ষ এখনও বড় ঢেউয়ের আঘাতের আশঙ্কা করছে। ফলে ত্রাণ সরবরাহ করা খুব কঠিন য়ে গেছে। মঙ্গলবার গুজব ওঠে যে আবারও আঘাত আনতে পারে সুনামি। ফলে আতঙ্কে অনেকেই শিশুদের কোলে নিয়ে জায়া গ্রাম থেকে পালাতে শুরু করে। কখন গাড়ির পেছনে করে, কিংবা দৌড়ে যানজট পার হওয়ার চেষ্টা করে। লক্ষ্য একটাই, অপেক্ষাকৃত উঁচু স্থানে গিয়ে নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। দৌঁড়াতে দৌঁড়াতে তারা চিৎকার করছিলো ‘পানি বেড়ে গিয়েছে, পাহাড়ের দিকে যাও।’
পুলিশ ও উদ্ধারকর্মীরাও সবাইকে সাহায্য করতে থাকে। তবে একটা সময় স্থানীয় মসজিদ থেকে মাইকে ঘোষণা দেওয়া হয় যে, সাগরের উচ্চতা বৃদ্ধি ছিলো স্বাভাবিক মাত্রার। তবে এই ভয়াবহ ধ্বংসযজ্ঞের পরও আশার আলো খুঁজছেন স্থানীয়রা। বাহরুদিন নামে ৪০ বছর বয়সী এক স্থানীয় বলেন, তার গাড়িটি সুনামির আঘাতে দেয়ালে ধাক্কা খেয়ে ভেঙে গেছে। তবে তারপরও তিনি বলছেন, তার গাড়ি ইন্স্যুরেন্স করা আছে, নতুন একটি গাড়ি পাবেন এবার তিনি।
নতুন গাড়ির কথা বললেও হাসি ছিলো না তার মুখে। যখন ঢেউয়ের আঘাতে ছিটকে যান সেই কথা মনে করেন। তিনি বলেন, শনিবার রাতে বন্ধুরা সমুদ্র উপকূলে হাটছিলেন। হঠাৎ করেই ঢেউয়ের আঘাতে ছিটকে যান। দেয়ালের চেয়ে উঁচু ঢেউ দেখতে পেয়ে পালানোর চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু পেরে উঠেননি। তিনি বলেন, ‘পুরো ঢেউযেন আমাকে গিলে ফেললো। আমি অচেতন হয়ে গিয়েছিলেন। জ্ঞান ফেরার পর দেখি আমি ২০০ মিটার দূরে একটি ধানক্ষেতে পড়ে আছি। সেখান থেকে দৌড়ে বাড়ি যাই। গিয়ে দেখি আমার পরিবারও বেঁচে আছে।’
শরীরে অনেক ক্ষতের চিহ্ন থাকলেও বেঁচে থাকায় নিজেকে ভাগ্যবান বলে মনে করেন তিনি।