রাষ্ট্রীয় বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসের ৪৭তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী ছিল ৪ জানুয়ারি। ১৯৭২ সালের এই দিনে বিমানের পথচলার সূচনা হয়। স্বাধীন বাংলাদেশের জনগণ নীল আকাশের দিকে তাকিয়ে ভেবেছিল তাদের একটি নিজস্ব এয়ারলাইনস হবে। এই স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। স্বাধীনতা, বিমান ও বঙ্গবন্ধু একই সূত্রে গাঁথা।
১৯৭২ সালে ডাকোটা উড়োজাহাজ দিয়ে বিমানের যাত্রা শুরু হয়েছিল। আর সবশেষ গত বছরের ৫ সেপ্টেম্বর ও ৫ ডিসেম্বর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উদ্বোধনের মধ্য দিয়ে এর বহরে যুক্ত হয় বিশ্বের সর্বাধুনিক বোয়িং-৭৮৭-৮ ড্রিমলাইনার। এখন বিমান বহরে উড়োজাহাজের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১৩টি। ‘গাঙচিল’ ও ‘রাজহংস’ নামের আরও দুটি ড্রিমলাইনার ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বরে যুক্ত হবে বহরে।
২০০৯ সালে বর্তমান সরকার ক্ষমতা গ্রহণের সময় বিমানের অবস্থা ছিল খুবই নাজুক। অতিশয় পুরনো বহর দিয়ে খুবই কায়ক্লেশে দিনাতিপাত করছিল এই সংস্থা। বিপর্যস্ত শিডিউল, জরাজীর্ণ বহর, অন্তহীন অভিযোগে মুখ থুবড়ে পড়ে বিমান। সংকট উত্তরণে প্রয়োজনীয় কর্ম-পরিকল্পনা প্রণয়ন করে নতুন উদ্যমে কাজ শুরু হয়। সত্যিকার অর্থে সর্বাঙ্গসুন্দর একটি এয়ারলাইনস হিসেবে বিমানকে গড়ে তোলার জন্য বিমান পরিচালনা পর্ষদকে নির্দেশ দেন প্রধানমন্ত্রী। পরের ইতিহাস সবার জানা।
২০০৮ সালে বোয়িং ও বিমানের মধ্যে ২১০ কোটি মার্কিন ডলার মূল্যে ১০টি নতুন প্রজন্মের উড়োজাহাজ বেচাকেনার চুক্তিস্বাক্ষর হয়। বোয়িংয়ের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা চালিয়ে নতুন জাহাজ সংগ্রহের দিনক্ষণ এগিয়ে আনা হয়। এরই ধারাবাহিকতায় বহরে যুক্ত হয়েছে পালকি, অরুণ আলো, আকাশপ্রদীপ, রাঙ্গাপ্রভাত, মেঘদূত ও ময়ূরপঙ্খী বিমানগুলো। বিশালাকারের অত্যাধুনিক জাহাজগুলোকে বলা যায় আকাশের বিস্ময়!
একইসঙ্গে অভ্যন্তরীণ গন্তব্যগুলোতে বিমানের কানেক্টিভিটি বৃদ্ধির লক্ষ্যে সরকার গত বছরের আগস্টে কানাডার সঙ্গে তিনটি ড্যাশ-৮ বোম্বারডিয়ার উড়োজাহাজ কেনার চুক্তিস্বাক্ষর করেছে। এছাড়া একটি ড্যাশ-৮কিউ৪০০ ও দুটি বোয়িং ৭৩৭-৮০০ উড়োজাহাজ লিজ গ্রহণের কার্যক্রম চূড়ান্ত হয়েছে।
২০১১ সালে বিমান বহরে প্রথম বোয়িং ৭৭৭-৩০০ ইআর উড়োজাহাজ যুক্ত হওয়ার আগে বিমান বহরে মোট ৮টি উড়োজাহাজের গড় বয়স ছিল ২০ বছরের বেশি। নতুন প্রজন্মের উড়োজাহাজ বহরে যুক্ত করার পর থেকে অবস্থার ক্রমে উন্নতি হতে থাকে। বর্তমানে লিজে সংগৃহীত উড়োজাহাজের বয়স ৭ বছরেরও কম। আর বিমানের নিজস্ব ৮টি উড়োজাহাজের গড় বয়স ৩ বছর ৭ মাস।
বহরের পরিবর্তনের সঙ্গে বিমানের বাণিজ্যিক পট-পরিবর্তনও হয়েছে। ২০১৪-১৫ অর্থবছর থেকে বিমান পরপর তিন বছর মুনাফা অর্জন করতে সক্ষম হয়। নতুন প্রজন্মের উড়োজাহাজ সংযোজনের পর থেকে ক্রমে যাত্রীসেবার মান উন্নত করতে সক্ষম হয়েছে বিমান। ফলে প্রতিযোগিতাপূর্ণ এভিয়েশন বাণিজ্যে একটি যোগ্য প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে বিমানের সক্ষমতা বৃদ্ধি পেয়েছে।
সম্প্রসারিত বহর দিয়ে বিমানের চলমান রুটগুলোতে ফ্লাইটের সংখ্যা বৃদ্ধি ও নতুন গন্তব্য হিসেবে গোয়াংজু, কলম্বো ও মালেতে ফ্লাইট চালুর উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। বাণিজ্যিক ফ্লাইট পরিচালনার পাশাপাশি বিমান বাংলাদেশে একমাত্র গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিং এজেন্ট। নিজস্ব ফ্লাইট পরিচালনার পাশাপাশি বাংলাদেশে ফ্লাইট পরিচালনাকারী সব বৈদেশিক বিমান সংস্থার ফ্লাইটগুলোর গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিং সেবা দিয়ে থাকে বিমান। এই খাতে বিভিন্ন সীমাবদ্ধতা রয়েছে। তবে ধীরে ধীরে তা কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা চলছে। গত একবছরে এই খাত উল্লেখযোগ্য পরিমাণ বিনিয়োগের মাধ্যমে ৬৯টি নতুন গ্রাউন্ড সাপোর্ট ইকুইপমেন্ট সংগ্রহ করা হয়েছে। এছাড়া গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিংয়ের মানোন্নয়নে বিমানবন্দরে সাত শতাধিক নতুন জনবল নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।
বিমান ও পর্যটনমন্ত্রী একেএম শাহজাহান কামাল বিমানের ৪৭তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে দেশবাসীকে শুভেচ্ছা জানিয়েছেন। বিমান ও পর্যটন সচিব মো. মহিবুল হক জানিয়েছেন, প্রবাসে ছড়িয়ে থাকা প্রায় ১ কোটি বাংলাদেশির আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতি সম্মান জানাচ্ছে বিমান। বহরে নতুন উড়োজাহাজ যুক্ত হওয়ার পর এখন আশা করা যাচ্ছে, নতুন নতুন গন্তব্যে উড়ে যাবে বিমান। বিমান ব্যবস্থাপনা সেই লক্ষ্যে কাজ করে চলেছে।
গত ১০ বছরে স্থগিত থাকা অভ্যন্তরীণ রুটে বিমানের ফ্লাইট পরিচালনা শুরু, বিমানের টিকিট বিক্রয়ে পূর্ণ অটোমেশন পদ্ধতি ও বিমানের কলসেন্টার চালু, নতুন নতুন গন্তব্যে ফ্লাইট চালুর উদ্যোগ নেওয়াসহ বিমানের জন্য ১০ বছরের একটি ফ্লিট প্ল্যান প্রণয়ন করা হয়েছে। এসব কার্যক্রমের মধ্য দিয়ে বিমান আস্থা ও গৌরবের প্রতীক হয়ে উঠবে বলে আশা করা হচ্ছে। জাতীয় পতাকাবাহী বিমান হবে যাত্রীদের আস্থার প্রতীক।
লেখক: জনসংযোগ কর্মকর্তা, বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়