X
শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪
১৩ বৈশাখ ১৪৩১

আড্ডাপ্রিয় কবি শহীদ কাদরী

শেখ ফিরোজ আহমদ
৩১ আগস্ট ২০১৬, ১০:৩৪আপডেট : ৩১ আগস্ট ২০১৬, ১০:৫৫

আড্ডাপ্রিয় কবি শহীদ কাদরী ১৯৬৭ সালে প্রকাশিত ‘উত্তরাধিকার’ কবিতার বইয়ে ছাপানো একটি কবিতার নাম ‘অগ্রজের উত্তর’। কবিতাটির মানে করে নেয়া যায়, কোনো বন্ধু শহীদ কাদরীকে খুঁজতে বাড়ি গিয়েছিলেন। তাকে তো পাওয়া গেলই না, উল্টো অগ্রজের কাছ থেকে শুনতে হয়েছে ঝাঁঝালো উত্তর। যাকে বলে চূড়ান্ত নাটকীয়তা। ডায়ালগ আকারে অগ্রজের শেষ কথাটি ছিল এরকম-
‘‘না, না তার কথা আর নয়, সেই
বেরিয়েছে সকাল বেলায় সে তো- শহীদ কাদরী বাড়ি নেই।’’
তাহলে উপায়, শহীদ কাদরীর কি হবে? নিশ্চয়ই কোথাও আড্ডায় জমে গেছে। রাত-বিরাতে বাড়ি ফেরা তো ডালভাতের ব্যাপার, এমনকি এটা দিনের পর দিন পর্যন্ত গড়ায়। এই প্রসঙ্গে ‘আপনি নাকি আড্ডা দিতে যেয়ে বাড়ি থেকে প্রায়ই উধাও হয়ে যেতেন’- আদনান সৈয়দের এই প্রশ্নের জবাবে তুখোড় আড্ডাবাজ শহীদ কাদরী স্বীকারোক্তি দিলেন-
‘‘একবার সাতদিন আড্ডা দিতে যেয়ে লাপাত্তা হয়ে গিয়েছিলাম। তখন আমার বন্ধু আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ ঢাকা কলেজে সদ্য জয়েন করেছেন। আবার ব্যাচেলর। তার বাসায় দিনের পর দিন আমাদের আড্ডা জমত। আড্ডা বসতো বিউটি বোর্ডিং, রেক্সে। কখনো কখনো রেস্টুরেন্টে বসে ঘণ্টার পর ঘণ্টা আড্ডা দিয়েছি। একসময় গভীর রাতে রেস্টুরেন্ট বন্ধ হয়ে যেত তখন আমরা রাস্তায় হাঁটতাম আর আড্ডা দিতাম’’।
আড্ডা হতো সাহিত্য নিয়েই, তবে অন্যান্য বিষয়ও চলে আসতো। আড্ডায় থাকতেন- সৈয়দ শামসুল হক, ফজল শাহাবুদ্দিন, শামসুর রাহমান, শহীদ কাদরী, আবদুল্লাহ্ আবু সায়ীদ, সিকদার আমিনুল হক কখনো কখনো আল মাহমুদ। শেষের দিকে আবদুল মান্নান সৈয়দ, আসাদ চৌধুরী, রফিক আজাদ-সহ আরও অনেকেই আসতেন। আড্ডা চলত রেক্সে, বিউটি বোর্ডিং-এ, হোটেল রেস্তোরায়, পার্কের বেঞ্চে বসে, আবার কখনো কখনো শামসুর রাহমানের বাসায়।

সেইসব আড্ডা ছেড়েছুঁড়ে প্রবাস জীবন; তারপর এখন অন্য ভুবনে রওনা দিলেন

কবি শহীদ কাদরী- যেখানে আগে থেকেই অপেক্ষা করছিলেন অতিশয় ভদ্র ও বিনয়ী কবি শামসুর রাহমান। জীয়ৎকালে যেচে পড়েই যিনি শহীদ কাদরীর সাথে পরিচিত হয়েছিলেন। সে ছিল এক মজার ঘটনা। শহীদ কাদরীর মুখ থেকেই শোনা যাক। এক আড্ডায় তিনি জীবনের সেই রঙিন গল্পটি করেছেন। আদনান সৈয়দ জানাচ্ছেন :

‘‘খোকন ছিল আমার কলকাতার বাল্যবন্ধু। আমি যখন কলকাতা থেকে ঢাকায় চলে এলাম তখন খোকনও ঢাকায় চলে আসে। খোকন জানতো যে আমি একটু-আধটু কবিতা লেখার চেষ্টা করি। শামসুর রাহমানের সাথে তার বেশ জানাশোনা ছিল। শামসুর রাহমানের কানে আগে থেকেই সে আমার কথাটা বলে রেখেছিল। এদিকে ‘জলকন্যার জন্যে’ কবিতাটি ছাপা হবার পর থেকে আমি প্রায়ই পত্রিকার স্টলে দাঁড়িয়ে আমার কবিতাটি বারবার পড়তাম এবং আড় চোখে দেখতাম যে তা অন্য কেউ পড়ছে কিনা? তা রোজই আমাকে এ কাজটা করতে হত। আমি একদিন প্রায় দুপুরবেলা স্টলে দাঁড়িয়ে আছি এবং দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আমার কবিতাটি পড়ছি। আমার পিছনে দাঁড়িয়ে আমাকে যে একজন ভদ্রলোক লক্ষ্য করছিলেন তা আমি বেশ টের পাচ্ছিলাম। আমি ঘাড় ফিরিয়ে দেখি খুব ফর্সামত মানে সর্বঅর্থে সুন্দর একজন পুরুষ ‘স্পন্দন’  খুলে আমার কবিতাটি পড়ছে। তখন আমাদের চোখাচোখি হল। শামসুর রাহমান তখন আমাকে বললেন, আচ্ছা আপনি কী শহীদ কাদরী?’’

সম্ভবত এর আগের একটি ঘটনা। বুদ্ধদেব বসুর ‘কবিতা’ পত্রিকায় শহীদ কাদরীর একটি কবিতা ছাপিয়েছেন মাত্র চোদ্দ বছর বয়সে। কবিতার নাম ‘এই শীতে’। তার আগে থেকেই শামসুর রাহমানের কবিতা ‘দেশ’-এ ছাপা হতো। শহীদ কাদরীকে তার কবিতা ছাপার খবরটি কিন্তু শামসুর রাহমানই দিয়েছিলেন এক বিয়োগান্তক পরিস্থিতিতে, শহীদ কাদরীর মুখ থেকেই শুনে আদনান সৈয়দ লিপিবদ্ধ করেছেন-

‘‘হ্যাঁ, সেদিনটির কথা বেশ মনে আছে। আমার মা সেদিন গত হয়েছেন। স্বাভাবিকভাবেই পরিবারের সবাই সেই শোকে আচ্ছন্ন। আমি তখন নিতান্তই একজন বালক। বয়স মাত্র চৌদ্দ বছর। ঘরের এক কোণে মন খারাপ করে শুধুই মার স্মৃতিতে বিচরণ করছি। হঠাৎ মনে হল পেছন দিক থেকে কেউ একজন দাঁড়িয়ে। কিছু একটা বোঝার আগেই পেছন দিক থেকে শামসুর রাহমান সদ্য প্রকাশিত বুদ্ধদেব বসুর ‘কবিতা’ পত্রিকা ঠিক আমার মুখের সামনে খুলে ধরলেন। দেখি আমার কবিতা ‘এই শীতে’। সেটা ছিল ১৯৫৬ সাল। তখন কবিতাপত্রে কারো কবিতা ছাপা হওয়া মানেই ছিল তাঁর কবি হিসাবে আসরে স্বীকৃতি পাওয়া।’’

কবি মুহম্মদ নূরুল হুদা শহীদ কাদরীর মৃত্যুর পর গণমাধ্যমে প্রতিক্রিয়া জানালেন-

‘কবির কবিতায় শুধু শহুরে জীবন নয়; একই সঙ্গে শহর ও নগরের জীবনধারার অদ্ভুত মিশ্রণ করতে পেরেছিলেন তিনি । ফলে ষাটের দশকে তার হাত দিয়ে বাংলা কবিতার স্বতন্ত্র ধারার উন্মেষ ঘটে’।

আমাদের ছোটোবেলায়, কবিতা লিখতে শুরু করার সময়টাতে যখন আমাদের গড়নপিটনের কাল, তখন থেকেই শুনে এসেছি কবি শহীদ কাদরীর নাম। সবাই বলতো বাংলাভাষার তিন প্রধান কবির অন্যতম তিনি। তাহলে বাকি দু’জন কারা, তারা হলেন শামসুর রাহমান ও আল মাহমুদ। এইখানে নিয়তির একটি মজার ইশারাও ছিলো-শহীদ কাদরীর প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘উত্তরাধিকার’, শামসুর রাহমানের ‘বিধ্বস্ত নীলিমা’ এবং আল মাহমুদের ‘কালের কলস’ নামের তিনটি কাব্যগ্রন্থই ষাটের দশকের মাঝামাঝিতে প্রকাশ করেছে চট্টগ্রামের ‘বইঘর’। এই কবিত্রয়ই সমকালীন বাংলা কবিতায় তিন প্রধান কবিতে পরিণত হন। এই ত্রয়ী কবির দু’জন এখন অন্যভুবনে, এপারে কেবল একজন।   

আমার সেই ছাত্রজীবন থেকেই শহীদ কাদরী গুঞ্জন তুলে মাথার মধ্যে ঢুকে বসে আছেন-‘রাষ্ট্র মানেই লেফট্ রাইট লেফট’, ‘তোমাকে অভিবাদন, প্রিয়তমা’। তরুণতর বয়সে কবি শহীদ কাদরী সেই যে ঢুকলেন আমার মাথায় তার কবিতাগুলো্ নিয়ে। তারপর থেকেই তিনি আছেন। তার প্রবাস জীবনের ছিটেফোটা খবর বা সাক্ষাৎকারও যদি মিডিয়ায় আসতো; চোখে পড়লেই আগ্রহ নিয়ে দেখতাম। আজও সেই আকর্ষণ সমান।

আমি ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হলাম জিয়াউর রহমানের মৃত্যুর পরের বছর। ’৭৫ পরবর্তী এই সময় পর্যন্ত জীবনের স্বতঃস্ফূর্ততাকে অবদমিত করা সামরিক কুশাসনের প্রতি ঘৃণা ও ভীতির কুচকানো সময়টাতেই আমার বেশি মনে পড়তো- ‘রাষ্ট্র মানেই লেফট্ রাইট লেফট’। তখন রাগ লাগতো, অনির্দিষ্ট কারও ওপর- কে জানে! হয়তো এসবই ছিলো তরুণ মনের প্রতিক্রিয়া।

আড্ডা পছন্দ কবি শহীদ কাদরী বরাবরের মতোই আমাদের নিরাশ করেননি। ঠিক সময়টাতেই আরেকবার আমাদেরকে জাগিয়েছেন কিংবা কাঁদিয়েছেন অথবা নির্বোধ চেতনাকে ধিক্কার দিয়েছেন। এই বলে-

‘‘তাদের পরনে ছিল ইউনিফর্ম,
বুট, সৈনিকের টুপি,
বঙ্গবন্ধুর সাথে তাদের কথাও হয়েছিল,
তারা ব্যবহার করেছিল
এক্কেবারে খাঁটি বাঙালির মতো,
বাংলা ভাষা। অস্বীকার করার উপায় নেই ওরা মানুষের মতো
দেখতে, এবং ওরা মানুষই,
ওরা বাঙলার মানুষ


এর চেয়ে ভয়াবহ কোনো কথা আমি আর শুনবো না কোনোদিন।’’ 

 (হন্তারকদের প্রতি/ আমার চুম্বনগুলো পৌঁছে দাও)

 আড্ডার কাছে শহীদ কাদরীর অনেক ঋণ- সমৃদ্ধ হয়েছে কেবল বাংলা সাহিত্য। শহীদ কাদরীর মোট বই ৪টি- ‘কোথাও কোনো ক্রন্দন নেই’, ‘তোমাকে অভিবাদন, প্রিয়তমা’, ‘উত্তরাধিকার’ এবং ‘আমার চুম্বনগুলো পৌঁছে দাও’।

 

পড়ুন-

শহীদ কাদরী : স্মৃতিই যেখানে নায়ক

সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
প্রচণ্ড গরমে দই-ফলের এই ডেজার্ট বানিয়ে খান
প্রচণ্ড গরমে দই-ফলের এই ডেজার্ট বানিয়ে খান
গরুবোঝাই ভটভটির সঙ্গে মোটরসাইকেলের সংঘর্ষে নিহত ২
গরুবোঝাই ভটভটির সঙ্গে মোটরসাইকেলের সংঘর্ষে নিহত ২
ইউক্রেনকে ৫৫০ কোটি ডলারের সহায়তা দেবে সুইজারল্যান্ড
ইউক্রেনকে ৫৫০ কোটি ডলারের সহায়তা দেবে সুইজারল্যান্ড
সবজির বাজার ঊর্ধ্বমুখী, তীব্র গরমকে দুষছেন বিক্রেতারা
সবজির বাজার ঊর্ধ্বমুখী, তীব্র গরমকে দুষছেন বিক্রেতারা
সর্বাধিক পঠিত
দুদকের চাকরি ছাড়লেন ১৫ কর্মকর্তা
দুদকের চাকরি ছাড়লেন ১৫ কর্মকর্তা
খুলনায় এযাবৎকালের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা
খুলনায় এযাবৎকালের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা
চুক্তিতে মাউশির ডিজি হলেন নেহাল আহমেদ
চুক্তিতে মাউশির ডিজি হলেন নেহাল আহমেদ
ব্রাজিল থেকে গরু আমদানি প্রসঙ্গে যা বললেন রাষ্ট্রদূত
ব্রাজিল থেকে গরু আমদানি প্রসঙ্গে যা বললেন রাষ্ট্রদূত
আমরা সবাই ফেরেশতা, বাস করি বেহেশতে: রায়হান রাফী
আমরা সবাই ফেরেশতা, বাস করি বেহেশতে: রায়হান রাফী