X
শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪
৬ বৈশাখ ১৪৩১

শহীদ কাদরী : স্মৃতিই যেখানে নায়ক

সৈকত হাবিব
৩০ আগস্ট ২০১৬, ১১:২০আপডেট : ৩০ আগস্ট ২০১৬, ১১:২৮

তিনি আসলে সেই স্মৃতির শহীদ কাদরী, যিনি পরবর্তীকালে ভক্ত-শুভার্থীদের দ্বারা পুনরাবিষ্কৃত ও পুনর্মূল্যায়িত। কারণ যে সরব-সক্রিয়-সুতীব্র শহীদ কাদরী, কবিতায় যিনি এক আশ্চর্য সম্মোহন প্রজন্মে প্রজন্মে চারিয়ে দেন, তাঁর নীরবতা-সৃজনশূন্যতা-অভিমান-যন্ত্রণা যে অন্যদেরও কাতর করে তাঁর সম্পর্কে তীব্র কৌতূহলী করবে তাই তো স্বাভাবিক

শহীদ কাদরী

চলে গেলেন তিনি। কবি শহীদ কাদরী। চলে তো আগেই গিয়েছিলেন মানসিকভাবে দূর পরবাসে। এবার গেলেন শারীরিকভাবেও, চিরপরবাসে। কারণ যে শহীদ কাদরীর মূর্তি আমাদের মগজে আছে, তিনি কেবলই এক ধূসর স্মৃতি। আমাদের প্রজন্মের কাছে তিনি শারীরিকভাবে অচেনা, আমাদের কৈশোরেই তিনি স্বেচ্ছানির্বাসিত প্রথম জর্মনদেশ, পরে মার্কিন মুল্লুকে। অনেকটাই নির্বাসিত ছিলেন কবিতা থেকেও। ফলে আমাদের প্রজন্মের কাছে তিনি বইপত্রে, গল্পে, আড্ডায় ও সতীর্থদের স্মৃতিচারণসূত্রেই সজীব। কিন্তু যাঁরা পঞ্চাশ-ষাটের মুখর দিনগুলিতে তাঁর গাঢ় সান্নিধ্যলাভ করেছিলেন, তাঁদের অনেকের কাছেই তিনি যেন ছিলেন সশরীর বর্তমান, এমনই উদ্ভাস চোখে পড়ত, যখন তাঁরা সেই সব দিনের স্মৃতির ভেতর ডুব দিতেন। কী ছিল তাঁর ব্যক্তিত্বে যা তাঁকে সমান বয়সীদের কাছেই গুরুতুল্য করেছিল; পাঠে-আড্ডায়-চিন্তায় সবাই তাঁর অধিপতিত্ব গ্রহণ করে নিয়েছিল? এমনকি বিভিন্ন জনের লেখাজোখায় উদ্ধৃত সমকালীনদের ওপর তাঁর নানামাত্রিক যে প্রভাবের বিবরণ পাওয়া যায়, যদিও কালখণ্ড খুব দীর্ঘ নয়, চৈতন্যের দিক থেকে একে হয়তো বাংলাদেশের কবিতায় ‘স্বল্পকালীন শহীদ কাদরী যুগ’ বলা যেতেই পারে। কারণ, পঞ্চাশের একটা পর্ব থেকে ষাটের দশকে আমাদের আধুনিক কবি ও কবিতার যে পাশ্চাত্যমনস্ক উৎকর্ষ, তাতে তাঁর অন্যতম নেতৃ-ভূমিকা সততার খাতিরে স্বীকার করাটা খুবই শোভন হবে। 

অথচ তাঁর উত্তুঙ্গ জীবনে স্বর্ণশস্য বলতে মাত্র তিনটি কাব্যগ্রন্থ : উত্তরাধিকার (১৯৬৭), তোমাকে অভিবাদন প্রিয়তমা (১৯৭৪) ও কোথাও কোনো ক্রন্দন নেই (১৯৭৮)। লক্ষণীয় যে, প্রথম বইটি বেরোচ্ছে ষাটের শেষে। আর বাকি দুটি সত্তরে। অথচ এর মধ্যে তাঁর বন্ধুদের, বিশেষত শামসুর রাহমানের অন্তত এক ডজন এবং আল মাহমুদেরও চারটি কাব্যগ্রন্থ বেরিয়ে গেছে। আর আশির দশকের শুরু থেকেই এ দুজনের কাব্যবেগ যেখানে বন্যার রূপ নিয়েছে, সেখানে শহীদ কাদরী কবিতা থেকেই অনেক দূরে। বহুকাল পর যখন তাঁর চতুর্থ বই যখন বেরোচ্ছে, ততদিনে প্রায় বছর তিরিশ পেরিয়ে গেছে (আমার চুম্বনগুলো পৌঁছে দাও, ২০০৯)। কিন্তু শিল্পের ভুবনে বোধহয় ফিরে আসা বলে কিছু নেই, না থেমে কেবলই তরী বেয়ে যাওয়া, অশেষ গন্তব্যে নিরন্তর যাত্রা। নইলে সেই দৃঢ়, ক্ষিপ্র, তীব্র শহীদ কাদরীকে আর পাওয়া গেল না কেন?
বাংলাদেশের কবিতায় শব্দে-বোধে-উচ্চারণে প্রথম স্মার্ট কবি সম্ভবত শহীদ কাদরী। তাঁর সমকালে এই কাব্য-স্মার্টনেস শামসুর রাহমান ছাড়া আরেক জনের মধ্যে বেশি পাওয়া যায়, তিনি কবি আজীজুল হক। কী বলিষ্ঠ তাঁদের স্বর, সুর ও কথা, যা তীব্রভাবে আমাদের অন্তর্গত ভিতরে গিয়ে ঘূর্ণন তোলে। (মনে হয় প্রকৃত কাব্যপাঠকের জন্য লেখাটিকে উদ্ধৃতিভারাতুর না করাই ভালো। কেননা তাঁদের বহু পঙক্তিই আমাদের অন্তরে জীবিত রয়েছে।)  কিন্তু সেই শহীদ কাদরীই যখন আমার চুম্বনগুলো পৌঁছে দাও লিখলেন, সেখানে তাঁকে আর আগের রূপে পাওয়া যায় না। বরং তিনি যেন তাঁর শরীরের মতোই শ্লথ ও ম্লান। এ-ই বোধহয় সময়ের নিয়তি।
কিন্তু এতে কি তাঁর কিছু আসে যায়!   

২.
কেন তাঁর কিছু যায় আসে না, সে কথাটা বোধহয় একটু খুলে বলা দরকার। কবির পরমায়ুই তাঁর সৃজন-আয়ু নয়। বরং বহু দীর্ঘজীবী কবিকেও দেখা যায় জীবদ্দশাতেই বিস্মৃত হয়ে যেতে কিংবা তাঁর বিপুল সৃষ্টির সামান্যই পাঠকের স্মৃতিতে জাগ্রত থাকতে। আবার অনেকেই জীবিত অবস্থাতেই একটা পর্বের পর আর লেখালেখিই করে না। অন্যদিকে অকালপ্রয়াত কবিদল, যাঁরা বিস্ময়কর প্রতিভা নিয়ে পৃথিবী ছেড়ে চলে যান, তাঁরা তো নিঃসন্দেহে ভাগ্যবান। ভাবুন, আবুল হাসানের কথা। মাত্র ২৯ বছর আর তিনটি কাব্যগ্রন্থ! আজও তিনি সেই ২৯ বছরের দুঃখী করুণ তরুণ! আর সুকান্ত ভট্টাচার্য, একুশ বছরে যক্ষ্মায় মৃত অথচ কী সহাস্য স্বপ্নীল! আর বিশ্বের সেই বিস্ময়কর কবিতাবালক র‌্যাঁবো, যিনি ৩৭ বছর পরমায়ু পেলেও মাত্র ১৯ বছর বয়সেই কবিতা থেকে অবসর নিয়েছিলেন। এই প্রত্যেক কবিই তাঁদের সেই বয়সটাতেই আমাদের হৃদয়ে অমর-অক্ষয় আছেন। তাঁদের আয়ুর জন্য দুঃখ হলেও তাঁদের কৃতীর জন্য আমাদের দুঃখ কম, কেননা যে আশ্চর্য সৃষ্টি করে গেছেন তাঁরা, তারপর আর প্রত্যাশা থাকার কথা নয়। থাকা উচিতও নয়, যদিও ‘যদি’র গোলকধাঁধায় কিছু আক্ষেপ থেকেই যায় (যেমন: আহা, যদি তিনি আরো দীর্ঘায়ু হতেন/যদি আরো লিখতে পারতেন ইত্যাদি)।   
শহীদ কাদরীকে যদি আমরা এই বাস্তবতায় বিচার করি, তাহলে বোধহয় সুবিচার করা হয়। তাঁর আয়ুষ্কাল যদিও ৭৪ বছর, কিন্তু তাঁর সৃজনজীবন তুলনায় বেশ হ্রস্ব। সরল হিসাবে তাঁর প্রবাস শুরুর সঙ্গে সঙ্গে সেই পর্বের সমাপ্তি ঘোষণা করা যেতে পারে। কারণ এরপর থেকে কেবল কবিতার সঙ্গেই নয়, সাহিত্যের সঙ্গেই তিনি এক ধরনের ‘সংশ্রব’ ত্যাগ করেন। এর কারণ বহুবিধ : প্রবাসের বৈরী জীবন, ক্রোধ, ক্ষোভ, মান-অভিমান...। তারপর যদিও তিন দশক পর তিনি ফিরে এলেন, নতুনভাবে, কিন্তু এ ফেরা-না-ফেরার ঊর্ধ্বে তিনি চলে গেছেন বহুকাল আগেই। বরং তিনি যা, যার সাক্ষ্য বহন করছে বিগতকালের তিনটি কাব্যগ্রন্থ, তাতেই তিনি তাঁর বিগ্রহ প্রতিষ্ঠা করে ফেলেছেন। আর তাঁর তাবৎ সার্থকতা যেন সেখানেই চিত্রার্পিত।
তাই আমাদের যে শহীদ কাদরী, তিনি আসলে সেই স্মৃতির শহীদ কাদরী, যিনি পরবর্তীকালে ভক্ত-শুভার্থীদের দ্বারা পুনরাবিষ্কৃত ও পুনর্মূল্যায়িত। কারণ যে সরব-সক্রিয়-সুতীব্র শহীদ কাদরী, কবিতায় যিনি এক আশ্চর্য সম্মোহন প্রজন্মে প্রজন্মে চারিয়ে দেন, তাঁর নীরবতা-সৃজনশূন্যতা-অভিমান-যন্ত্রণা যে অন্যদেরও কাতর করে তাঁর সম্পর্কে তীব্র কৌতূহলী করবে তাই তো স্বাভাবিক। তাই তাদের চাপে-প্রেমে-চাহিদায় হয়তো তিনি ফিরে আসতে চেয়েছিলেন, সাধ্যমতো ফিরেও ছিলেন।
কিন্তু শহীদ কাদরীর ক্ষেত্রে স্মৃতিই নায়ক, তাঁর তারুণ্যের সৃষ্টির স্মৃতি, যার ভেতরেই তিনি সবচে জীবিত। সেই স্মৃতি তাঁর বর্তমানের চেয়েও বেশি সপ্রাণ। তাই শারীরিক মৃত্যু হলেও বাংলা সাহিত্যে তাঁর সেই স্মৃতির কোনো মৃত্যু নেই। বরং বাংলা কবিতার এ এক অক্ষয় সম্পদ, যা পাঠের ভিতর দিয়ে আমরাও হবো তাঁর গভীর স্মৃতিবাহী।
তাঁর সৃষ্টি ও স্মৃতির প্রতি সকৃতজ্ঞ প্রণতি...         

 

আরো পড়ুন-

তাঁর কবিতার জন্য পাঠক প্রস্তুত ছিল না (ভিডিও)

সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
হাসপাতালের বদলে শিশুরা ঘুমাচ্ছে স্বজনের কোলে
হাসপাতালের বদলে শিশুরা ঘুমাচ্ছে স্বজনের কোলে
পারটেক্সের বিপক্ষে হেরে রূপগঞ্জ টাইগার্সের অবনমন
পারটেক্সের বিপক্ষে হেরে রূপগঞ্জ টাইগার্সের অবনমন
সংঘাত বাড়াতে চায় না ইরান, ইসরায়েলকে জানিয়েছে রাশিয়া
সংঘাত বাড়াতে চায় না ইরান, ইসরায়েলকে জানিয়েছে রাশিয়া
বিএনপির বিরুদ্ধে কোনও রাজনৈতিক মামলা নেই: প্রধানমন্ত্রী
বিএনপির বিরুদ্ধে কোনও রাজনৈতিক মামলা নেই: প্রধানমন্ত্রী
সর্বাধিক পঠিত
নিজ বাহিনীতে ফিরে গেলেন র‍্যাবের মুখপাত্র কমান্ডার মঈন
নিজ বাহিনীতে ফিরে গেলেন র‍্যাবের মুখপাত্র কমান্ডার মঈন
আমানত এখন ব্যাংকমুখী
আমানত এখন ব্যাংকমুখী
বৈধ পথে রেমিট্যান্স কম আসার ১০ কারণ
বৈধ পথে রেমিট্যান্স কম আসার ১০ কারণ
ইসরায়েলি হামলা কি প্রতিহত করতে পারবে ইরান?
ইসরায়েলি হামলা কি প্রতিহত করতে পারবে ইরান?
ইরানে হামলা চালিয়েছে ইসরায়েল!
ইরানে হামলা চালিয়েছে ইসরায়েল!