X
সোমবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৪
১৫ বৈশাখ ১৪৩১
 'সোনায় সোহাগা কাহিনি'

গল্পের চিত্রকর্ম

মাহমুদা ইয়াসমিন
২৮ ডিসেম্বর ২০২৩, ১২:৪২আপডেট : ২৮ ডিসেম্বর ২০২৩, ১২:৪২

জিয়া হাশানের ‘সোনায় সোহাগা কাহিনি’ গল্পগ্রন্থকে ঠিক গল্পের বই না বলে বলা যায় এক 'চিত্র প্রদর্শনী'। প্রতিটা গল্প যেন একেকটা চিত্রকর্ম। আর এই চিত্রকর্ম অঙ্কিত হয়েছে লেখকের নিজস্ব ভাষাশৈলীতে। গল্পের বিষয় সোজাসাপ্টা হলেও আশ্চর্য এক ভাষা-দ্রবণে বিষয়বস্তু চমৎকারভাবে দ্রবীভূত হয়েছে—তা যেকোনো পাঠককে অভিভূত করতে সক্ষম। তাই আমার আলোচনা প্রধানত কেন্দ্রীভূত থাকবে লেখকের এই স্বকীয় ভাষা-দক্ষতার ওপর।

জিয়া হাশানের ভাষা বৈশিষ্ট্যে প্রথমেই নজরে পড়ে বস্তু, বিষয় এবং ঘটনাকে ‘পার্সোনিফাই’ করার দিকটি। প্রত্যেক গল্পে এই ভাষা-কৌশল ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়েছে। যেমন, প্রথম গল্পে ‘আবুইল্যার চর’ এর পরিচয় দেয়া হয় ‘দেশের দীর্ঘাঙ্গী স্রোতধারা হিসাবে নাক উঁচু করা মেঘনার বুকে গতর তুলে চারদিকে হাত-পা ছড়ানো ভূভাগ’ বলে।

দীর্ঘতম নদী হিসেবে গৌরবে বয়ে চলেছে মেঘনা, তার মাঝে হাত-পা ছড়িয়ে জেগে উঠেছে এক ভূখণ্ড। নাম ‘আবুইল্যার চর’। অনাড়ম্বর সরল বাক্যে নদী এবং চর হয়ে উঠেছে ব্যক্তি-চরিত্র। বস্তুগত বিষয়ের এই ব্যক্তিকরণ ভাষাকে যেমন উপভোগ্য করেছে, একই সাথে গল্পের বিষয়বস্তুকেও প্রতিফলিত করেছে সফলতার সাথে।

‘সোনায় সোহাগা কাহিনি’ গ্রন্থে বস্তু বা ঘটনা হয়ে উঠেছে ব্যক্তির মতো জীবন্ত, অপরদিকে ব্যক্তি চরিত্রসমূহ আচরণ করছে নিষ্ক্রিয় পুতুলের মতো। লেখক যে সমাজের কথা বলতে চেয়েছেন সেই সমাজের মানুষরা হয়তো এভাবেই সিস্টেমের অপশক্তি দ্বারা চালিত হয় অসহায় পুতুলের মতোই। তাদের সুনির্দিষ্ট ব্যক্তিত্ব নেই, ইচ্ছে কিংবা মতামত নেই। তাই গল্পের প্রধান চরিত্র মানুষ নয় বরং প্রধান চরিত্র হয়ে উঠেছে আমলাতন্ত্র, স্বজনপ্রীতি, দুর্নীতি, কোটাপ্রথা, দখলদারিত্ব, দুর্বলের প্রতি শোষণ এবং সাম্প্রদায়িকতা।

লেখকের বর্ণনা কৌশলে আরেকটি বিষয় লক্ষ‍নীয়—সাধারণ মানুষের ভাষায় গল্প বলা। গল্পের বর্ণনাকারী কোনো চরিত্র নিজে হোক কিংবা তৃতীয় ব্যক্তি, সবার মুখে শোনা যায় দক্ষিণ বাংলার প্রচলিত বুলি। চিরচেনা এবং স্বতঃস্ফূর্ত ভাষায় বলা গল্পগুলোও তাই পাঠকের কাছে ভীষণ চেনা মনে হয়। পাড়ার দোকানে চায়ের আড্ডায় বলা নৈমিত্তিক কাহিনীর মতোই এগুলো জীবন্ত এবং বাস্তব।

পাঠকের উদ্দেশ্যে যেন লেখক বলতে চেয়েছেন ‘যদিও এমনটা হওয়ার কথা নয়, এইসব কাহিনি আমাদের কাম্য নয় তবুও এই অনাকাঙ্ক্ষিত গল্পগুলো আমাদের চারপাশে ঘটছে হরহামেশা।’ চরিত্রের মুখে এবং কথকের বর্ণনায় দক্ষিণ বাংলার আঞ্চলিক ভাষার ছোঁয়া গল্পগুলোকে সাবলীল এবং প্রাঞ্জল করে তুলেছে।

তবে ভাষার আঞ্চলিকতায় দু-এক জায়গায় সামান্য অসামঞ্জস্য চোখে পড়েছে। যেমন, ‘প্রাণ প্রোডাক্ট’ গল্পে এক চরিত্র প্রথমবার দক্ষিণে গিয়েছে অল্প সময়ের জন্য একটা বিশেষ কাজে। গিয়েই সে কথা বলছে সে অঞ্চলের প্রচলিত শব্দ ব্যবহার করে। খুব সূক্ষ্মভাবে খেয়াল না করলে অবশ্য এই বিষয়টি নজরে আসে না। তাই হয়তো লেখকেরও নজর এড়িয়েছে।

অধিকাংশ গল্পের শব্দ, বাক্য এবং বর্ণনায় যৌনতা উপস্থাপিত হয়েছে অপরিশীলিতভাবে। যৌনক্রিয়া বিষয়ক নেতিবাচক শব্দগুলো এতো বেশি ব্যবহার হয়েছে যে তা পাঠকমনে বিবমিষা জাগাতে পারে। গল্পে বর্ণিত সবগুলো শারীরিক সম্পর্ক ছিলো আবেগ, ভালোবাসা এবং আনন্দহীন।

‘গ্রামে তার খাঁটি ও নির্ভেজাল নাম...’, ‘পোয়াতি বানানোর খেলা’, ‘স্যাটারডে ইভিনিংয়ে আসো’, ‘প্রাণ প্রোডাক্ট’ এবং ‘সোনায় সোহাগা কাহিনি’ প্রভৃতি গল্পে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার নারী-পুরুষ পরস্পরের সাথে মিলিত হচ্ছে বা মিলনের আয়োজন করছে। কিন্তু এসব গল্পে তাদের নিজস্ব কোনো আবেগ-অনুভূতি নেই। তারা কোনো না কোনো উদ্দেশ্য নিয়ে এই কাজ করছে বা করতে বাধ্য হচ্ছে। পড়তে গিয়ে মনে এক ধরনের বিতৃষ্ণা আসে।

দু-একটি গল্পপাঠ শেষ করেই টের পাওয়া যায় যে পাঠকের মনে এই বিরূপ প্রতিক্রিয়া তৈরির খেলা লেখক খেলেছেন অনেকটা ইচ্ছাকৃতভাবে। বতর্মান সমাজের মানুষের মাঝে স্বার্থান্বেষী ও আবেগহীন সম্পর্ককে চিত্রায়িত করতেই যেন লেখক এই ‘চরমপন্থা’ অবলম্বন করেছেন।

পাঠ শেষে প্রতিটি গল্প সংবেদনশীল পাঠকের মনে এই ভাবনা তৈরি করে, এমনটা হওয়া ঠিক হয়নি, এমন হওয়া উচিৎ নয়। মানুষের সাথে মানবিক এবং শারীরিক সম্পর্ক হওয়া উচিৎ স্বাভাবিক, স্বতঃস্ফূর্ত, আবেগময় এবং আনন্দময়। ঘটনার প্রতি পাঠকের এই বিতৃষ্ণা তৈরি হয়েছে নেতিবাচক ভাষা ব্যবহারের সুকৌশলে।

‘সোনায় সোহাগা কাহিনি’ গল্পগ্রন্থে লেখক সুস্পষ্টভাবে কটাক্ষ করেছেন রাষ্ট্র ও সমাজের বিভিন্ন অনাকাঙ্ক্ষিত সিস্টেমের প্রতি। যদিও গল্পের মানুষগুলোকে তিনি এককভাবে নেতিবাচক করে তুলেননি। তাদেরকে দেখানো হয়েছে প্রচলিত অপশক্তি দ্বারা চালিত পুতুল হিসেবে। তারা দুনিয়ার কাছে জিততে গিয়ে হেরে যাচ্ছে নিজের বোধ এবং বিবেকের কাছে। প্রতিনিয়ত তারা বলাৎকারের শিকার হচ্ছে বিভিন্ন অশুভ শক্তির কাছে। গল্পকার স্বকীয় এক লেখনি কৌশলে আলোকপাত করেছেন এইসব সামাজিক এবং রাষ্ট্রীয় ভ্রান্তি এবং ত্রুটিবিচ্যুতির উপর।

জিয়া হাশান দীর্ঘদিন ধরে গল্প লিখছেন। দশটি গল্প নিয়ে ‘সোনায় সোহাগা কাহিনি’ তাঁর তৃতীয় গল্পগ্রন্থ। তাঁর কাছ থেকে আমরা এরকম স্বকীয় ভাষার ও অভিনব বিষয়বস্তুর আরো গল্প প্রত্যাশা করি।


প্রকাশক: হাওলাদার প্রকাশনী।
প্রচ্ছদ: মোস্তাফিজ কারিগর।
মূল্য: ৩০০টাকা।

/জেড-এস/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
বাজারে এলো বাংলা ভাষার স্মার্টওয়াচ ‘এক্সপার্ট’
বাজারে এলো বাংলা ভাষার স্মার্টওয়াচ ‘এক্সপার্ট’
চার বছরে আট ফ্লপ, আসছে আরও এক হালি!
চার বছরে আট ফ্লপ, আসছে আরও এক হালি!
জোড়া আঘাতে হায়দরাবাদকে গুটিয়ে চেন্নাইয়ের জয় রাঙালেন মোস্তাফিজ
জোড়া আঘাতে হায়দরাবাদকে গুটিয়ে চেন্নাইয়ের জয় রাঙালেন মোস্তাফিজ
দিনাজপুরে ইউপি নির্বাচনে সংঘর্ষ, পুলিশের গুলিতে চেয়ারম্যান প্রার্থীর চাচা নিহত
দিনাজপুরে ইউপি নির্বাচনে সংঘর্ষ, পুলিশের গুলিতে চেয়ারম্যান প্রার্থীর চাচা নিহত
সর্বাধিক পঠিত
ভূমি ব্যবস্থাপনায় চলছে জরিপ, যেসব কাগজ প্রস্তুত রাখতে হবে
ভূমি ব্যবস্থাপনায় চলছে জরিপ, যেসব কাগজ প্রস্তুত রাখতে হবে
এমন আবহাওয়া আগে দেখেনি ময়মনসিংহের মানুষ
এমন আবহাওয়া আগে দেখেনি ময়মনসিংহের মানুষ
‘হিট অফিসার’: পদ কীভাবে নেতিবাচক হয়ে ওঠে
‘হিট অফিসার’: পদ কীভাবে নেতিবাচক হয়ে ওঠে
স্কুলে আসার আগেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়লেন শিক্ষক
স্কুলে আসার আগেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়লেন শিক্ষক
প্রাথমিক বাদে সোমবার ৫ জেলার সব স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসা বন্ধ
প্রাথমিক বাদে সোমবার ৫ জেলার সব স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসা বন্ধ