শেকড়হীন এক মানুষের স্বগোতক্তি। এই মানুষটি তার গল্প বলে যায়, না-বলার ঢংয়ে গান কবিতা আর নীরবতা মিশিয়ে। রাস্তায় দাঁড়িয়ে চলে যাওয়া চলে আসা মানুষের জন্য একঘেয়ে গান গেয়ে যাওয়ার গল্প আর হেরে যাওয়া এক মানুষের হাল ছেড়ে দেয়ার গল্প। প্রতিটা মানুষের জন্য নির্ধারিত যে খেলা এতদিন তাই সে খেলে এসেছে, আজ সে খুব সম্ভব জানতে চায় কী হবে সেই খেলা না খেলে হেরে যেতে চাইলে! বা হয়ত সে হেরেও যেতে চায় না, সে মুক্তি চায়। পৃথিবীর দিকে দিকে উদ্ধত মানুষেরা বিধ্বস্ত করে চলেছে জনপদ, নদী, বনভূমি, চালাচ্ছে গণহত্যা, বাড়ছে গৃহহীন, শেকড়হীন মানুষ—গিটার হাতের এই লোকটির উচ্চারিত ও অনুচ্চারিত শব্দগুলো তখন আরও বেশি করে প্রাণে বাজে।
মূল নরওয়েজিয়ান থেকে নাটকটি ইংরেজিতে অনুবাদ করেছেন লুইস মুইনজের।
পুরোনো ওভারকোট গায়ে মাঝবয়সী এক লোক ধীরে ধীরে স্টেশনে প্রবেশ করে। হাঁটার সময় সে যেন একটু ঢলে ঢলে হাঁটে। চুল ভেজা, না-আঁচড়ানো। আঙুলহীন উলের দস্তানা দুই হাতে। একটা গিটার-কেইস ডান হাতে—গিটার-কেইসটি বহু ব্যবহারে ক্ষয়ে ক্ষয়ে গেছে বিভিন্ন জায়গায়। বাঁ হাত দিয়ে চুলে হাত বোলায়। চারদিকে তাকায়।
লোকটি : যাক অবশেষে
ভিতরে আসা গেল
আহ কী ঠান্ডা আজকে
হাড় কেঁপে যাচ্ছে
[সামনে-পেছনে, এদিক-ওদিক হাঁটে]
কিন্তু এখান বেশ উষ্ণ
উষ্ণ আর আরামদায়ক
[এক জায়গায় থেমে গিটার কেইসটা মেঝেতে রাখে, নিজেই ওটাতে হেলান দিয়ে বসে। বিরতি]
এখানটায় আরাম লাগছে, বেশ উষ্ণ জায়গাটা
[চারদিক তাকায়]
আমার জন্য অবশ্য সবকিছু
সবসময় একই রকম
অবশ্য এর চেয়ে যদি বেশি
শীত না পড়ে
কারণ [মাথা ঝাঁকায়]
এর চেয়ে আর ঠান্ডা পড়লে
জমে যেতে হবে
এ ছাড়া তেমন কিছুতে
তেমন কিছু বদলাবে না
যাবে আসবে না
প্রতিদিন আমার একই রকম যায়
একই রকম
রাত-দিন দিন-রাত
আমি পাতাল ট্রেন স্টেশনে দাঁড়িয়ে থাকি
আর আমার গিটারটা বাজাই
আমার গানগুলো গাই
একই গান বারবার বারবার প্রতিদিন
আর লোকগুলো
তারা আমার সামনে দিয়ে চলে যায়
সারাদিন ধরে তারা চলে যেতে থাকে
আমার সামনে দিয়ে
কেউ শহরের দিকে
কেউ শহরের থেকে
আমার সামনে দিয়ে
আমাকে পার হয়ে চলে যায়
[এক হাত নেড়ে নেড়ে সে দেখায় কী করে লোকগুলো চলে যায়, চলে যায়]
আমার দিকে আসে
তারপর আমাকে ছাড়িয়ে চলে যায়
সারাদিন লোকজন আমাকে ছাড়িয়ে
চলে যেতে থাকে
পাতাল ট্রেনের স্টেশনে
তারা সবাই আমার সামনে দিয়ে চলে যায়
চলে আসে চলে যায়
পুরোটা সময় আমি ঠায় দাঁড়িয়ে
গিটার বাজাতে থাকি আর
মানুষেরা আমার দিকে আসে
আমার থেকে সরে যায়
প্রতিটি দিন তারা আমার সামনে দিয়ে চলে যায়
এবং এর মধ্যে অধিকাংশ সময় একই মানুষ
হেঁটে আসে হেঁটে যায়
প্রতিটি দিন
আর আমি তাদের জন্য গান গাই
আর সাধারণত আমাকে পার হয়ে যাওয়ার সময়
তারা মাথাটা একটু নোয়ায়
যেন আমার সামনে দিয়ে চলে
যায় বলে তার লজ্জিত
তারা লজ্জা পায় আমাকে গান গাইতে শুনে
শরীর অবশ হয়ে যাওয়া শীতে
আমাকে ওখানে দাঁড়িয়ে গিটারের কর্ডগুলো
বাজিয়ে গান গাইতে শুনে তার লজ্জিত
একই গান বারবার
দিনের পর দিন দিনের পর দিন তারা আমাকে দেখে
ওখানে দাঁড়িয়ে আমি গান গাইছি
একই স্থানে তাদের জন্য
আর তারা
যথারীতি
আমার দিকে আসে
আমার দিক থেকে সরে যায়
আর তারা লজ্জিত হয়
আমার সামনে দিয়ে চলে যাওয়ার সময়
কারণ যারা প্রতিদিন আমার সামনে দিয়ে যায় আসে
তারা প্রায় সময়ই আমার গিটার কেইসে
কোনো পয়সা ফেলে যায় না
শুধু কিছু বিশেষ দিনে
স্বাধীনতা দিবস বা
এমন কোনো দিন
হয়ত তারা একটু ঘুরতে বা খেতে বেরোলো
হয়ত সেদিন কয়েকটা ফুটো পয়সা তারা দেয়
বা এমন দিনে কেউ হয়ত একটু বেশিই দিয়ে ফেলে
কিন্তু সাধারণ দিনগুলোতে একদম কিছু না
মাথা নিচু করে তারা হেঁটে চলে যায়
আমাকে ছাড়িয়ে চলে যায়
লজ্জিত মুখ নিয়ে
মাথা নুইয়ে
আমি গান গাইতে থাকি
আর আমার কর্ডগুলো বাজাতে থাকি গিটারে
[যেন প্রশ্ন করে]
তারা কি আমাকে দেখে লজ্জিত হয়
নাকি নিজেদের দেখে
কেন তারা আমাকে ছাড়িয়ে যাওয়ার
সময় ওভাবে লজ্জা পেতে থাকে
লাইন ধরে ধরে চলে যাওয়ার সময়
প্রতিদিন তারা আমার সামনে দিয়ে
চলে যায় আর শোনে আমি গান গাই
চলে যায় তারা
নারী
পুরুষ
শিশু
বৃদ্ধ
আমি দাঁড়িয়ে পাতাল রেলের স্টেশনে
গিটারটা বাজাই
তারা আমাকে পার হয়ে চলে যায়
আমার পায়ের কাছে গিটার কেইসটা
হাট করে খোলা থাকে
তাদের কেউ কেউ একটা দুটো পয়সা
ফেলে যায় ওখানে
বেশিরভাগই কিছুই দেয় না
আমি গান গাইতেই থাকি
ঘণ্টার পর ঘণ্টা আমি গাইতে পারি
তার মানে এই না যে আমি
ভূরি ভূরি গান জানি
এবং আমার ধারণা আমার গাইতে ভালোও লাগে না
এমনকি আমার মনে হয় আমার গান বাজনাই ভালো লাগে না
[বিরতি]
এখন আর না
একসময় সম্ভবত ভালো লাগত
তখন গান ছাড়া অন্য কিছু ভালো লাগার ছিল না হয়তো
[কষ্ট করে হাসে]
আর এখন আমি খুব সম্ভব গানও আর ভালোবাসি না
গান এমন বিশেষ কিছু না
এখন আর
[আগ্রহ নিয়ে]
কিন্তু প্রতিদিনই গাই আমি
আর দু-একটা ফুটো পাই কামাই
আমার গানগুলো আমি গাই
তাদের জন্য যারা শুনবে
[একটু হাসে]
বা যারা শুনবে না তাদের জন্যও
আর কেউ যখন একটা দুটো পয়সা দেয়
নিজের পকেট ঘেঁটে
কয়েকটা পয়সা বের করে আমার গিটার কেইসে ছুড়ে দেয়
তার প্রতি কৃতজ্ঞতা বোধ করি
টাকার জন্য আমি গান গাই
এটাই আমি [ছোটো বিরতি]
না অন্য রকমও হতে পারত আমার জীবন
যদি না আমি এত উত্তরের এই শহরে এসে জুটতাম
না এলে হয়ত বিশ্বাসই করতাম না কখনো আসব
কিন্তু সেটাই হলো [হাসে]
আমি এখানে এলাম
একজন নারীর জন্য আর থেকে গেলাম আমার ছেলের জন্য
[হাসে এবং মাথা নাড়ে]
এমনই ঘটল আর
ঠিকই তো আছে মনে হয়
আমার অভিযোগ করারও কিছু নেই
কারণ এটাই সত্য
তুমি এক নারীর জন্য এখানে এসে
সন্তানের জন্য এখানে থেকে গেলে
[পুরো ব্যাপারটা ভেবে নেয়]
আর একটা ভয় কীসের একটা ভয়
আমাকে পুরো জিনিসটা বুঝতে দেয় না
তাই আমি ব্যাখ্যাও করতে পারি ঠিক করে
[বিরতি]
কিন্তু বললে কেমন গুরুত্বপূর্ণ কথা বলে মনে হয়
এমনকি
শুনতে খানিকটা ভালোও শোনায় [একটু হাসে]
যদি গানের কথা হতো সব মিথ্যার মতো শোনাত
[আবার বিরতি]
তার মানে আমি একজন রাস্তার গায়ক
রাস্তার শিল্পী
লোকে তাই বলে
সাধারণত লোকে আমাকে
গিটার হাতে লোকটি বা এই জাতীয় কিছু একটা বলে
আমার মা আমাকে এমনই কিছু একটা বলত
তার মানে মা-ই শুরু করেছিল
গিটার হাতে ছেলেটি বা এমন কিছু
যখন ছোটো ছিলাম সবসময়ই গিটার বাজাতাম আমি
স্কুলে যাওয়ার আগে বাজাতাম
স্কুল থেকে ফিরে বাজাতাম
বাজাতাম আর বাজাতাম
কিন্তু কেমন বাজাতাম আসলে
ভালো কি
মনে হয় না
[হাসে। হতাশ হয়ে মাথা নাড়ে]
কোনো কিছুতেই আমি তেমন একটা যুত করতে পারিনি জীবনে
অনেক বাজিয়েছি
চর্চা করেছি গিটার হ্যাঁ
কিন্তু ভালো গিটারবাদক বলা যাবে না আমাকে
ফালতু টাইপের গিটারিস্ট আমি
[ছোটো বিরতি]
ছোটোবেলা থেকে গিটারই বাজিয়েছি
কিন্তু কেউ আমার সাথে দ্বিমত করবে না যে
গিটার বাজানোয় আমি কোনো
জাতে উঠতে পারিনি
ফালতু টাইপের গিটারিস্ট [হাসে]
গায়ক হিসেবে তার চেয়েও বাজে
বাচ্চারা আমাকে দেখে চিৎকার করে বলে
হেই গিটার-ম্যান গিটার-ম্যান
ভিনদেশি গিটারবাদক
চলে যাও
নিজের দেশে
এমন কিছু একটা বা আরও খারাপ কিছু
শীতে যখন তুষার পড়ে
তুষারের দলা তারা ছুড়ে মারে আমার গায়
তুষারের গোলা ছুড়ে মারে
আমার আর আমার গিটারের দিকে
আর চিৎকার করে গালি দেয়
এমনকি তারা আমার টাকাও চুরি করতে চায়
আমার টাকা [কোটের পকেটে বাড়ি মারে, পয়সা ঝনঝন করে ওঠে]
এমন কোনো পাতে দেয়ার মতো মিউজিশিয়ান আমি নই
এমনকি নিজে কখনো এক কলি গানও লিখতে পারিনি
আমি অন্য লোকজনের গান বাজাই আর গাই
পাতাল রেলের স্টেশনে দাঁড়িয়ে
আমি গিটারটা বাজাই আর গাই
যে গলা আপনারা শুনছেন সেই গলায়ই
এমন কিছু না
[মাথা দোলায় কয়েকবার, উঠে গিটার কেইসটা হাতে নেয়। হেঁটে বেড়ায় কিছুটা, হাঁটায় দুলুনি]
নাহ্ আমি এমন ভালো মাপের কোনো গিটারিস্ট না
শুধু গিটার হাতে লোকটাই রয়ে যাব
যে কয়েকটা গানই মাত্র জানে
আর তাই গায় বারবার
[হেঁটে বার-কাউন্টারের কাছে গিয়ে গিটারটা হেলান দিয়ে রাখে। হাতের দস্তানা খুলে রাখে কাউন্টারের ওপর। মুখের কাছে হাত এনে গরম ফুঁ দিতে থাকে। উঁচু বার টুলটা টেনে বসে। কাউন্টারের ওপর রাখা বিয়ারের গ্লাস। পকেট থেকে এক মুঠো পয়সা বের করে টেবিলে রাখে। বোঝার চেষ্টা করে পকেটে আর কিছু অবশিষ্ট আছে কি না, আরও গোটা দুয়েক হাতড়ে বের করে সেগুলোও রাখে কাউন্টারের ওপর]
প্রতিদিনই দু-চারটা পয়সা জোটে অবশ্য
যদি আবহাওয়া কিছুটা উষ্ণ
আর আকাশে খানিকটা সূর্যের আলো থাকে
সেদিন ভালোই আসে
ঠান্ডা ভেজা আর আর আকাশ ম্যাটম্যাটে থাকলে
একদমই না
যেমন আজ
জঘন্যরকম ঠান্ডা আর স্যাঁতস্যাঁতে
[হাতে গরম ফুঁ দিয়ে পয়সা গুনতে শুরু করে]
চার পাউন্ড [গোনা চালিয়ে যায়
পাঁচ [আরও]
ছয় পাউন্ড পঞ্চাশ পেনি
খারাপ না বলতে হবে
এই রকম আবহাওয়ার হিসাবে একদমই খারাপ না
এত কনকনে ঠান্ডা আর ভেজা
দুই ঘণ্টা এই ঠাণ্ডায় দাঁড়িয়ে গিটার বাজিয়েছি আমি
একজনই আমাকে তিন পাউন্ড দিলো
হ্যাঁ অবাক হলেও সত্যি
এই রাস্তায় সে বহু বছর ধরে
বহুবার আমাকে পার হয়ে চলে গেছে
কখনো একটা ফুটো পাইও না দিয়ে
কিন্তু আজ সে দাঁড়াল এসে
বড় বড় গোল গোল বুড়ো চোখ নিয়ে তাকিয়েই থাকল
আমার স্ত্রীর মৃত শরীরটা যখন পুড়ছিল
আমি সেখানে দাঁড়িয়ে ছিলাম
বলল সে
আমি মাথা নোয়ালাম একবার
আর গাইতে থাকলাম
আর বাজাতে থাকলাম গিটারের পুরোনো কর্ডগুলো
আমি দেখলাম ওর শরীরটা
চুল্লির মধ্যে ঢোকানো হলো
বলল সে আবার
চুল্লির ভিতরে
বলে সে হাত দুটো ছুড়ে দিলো দুদিকে
[বলে নিজের হাতই সে দুদিকে ছুড়ে দেয়]
আর সে তাকিয়ে থাকল আমার দিকে
ভেজা নীল চোখ দুটো নিয়ে
চোখ দুটো একটু ধোঁয়াটে হয়ে গেল তখন
একদম চুল্লির অভ্যন্তরে শরীরটা
আবার বলল সে
আর বেরিয়ে এল কিছুটা ছাই
এই এতটুকু
ব্যাস
ব্যাস এটুকুই রয়ে গেল
ওর শরীর আর ওর পুরো জীবনের
বলে সে আবার দু-হাত দুদিকে ছুড়ে দিলো
[নিজের হাত দুদিকে ছুড়ে দেয় আবার]
ব্যাস
লোকটা বলল
আমি তোমার গান শুনেছি এত দিন
এত বছর
কয়েকটা টাকা আমি তোমায় দিই
বলে পকেটে হাত দিলো সে
আর আমাকে তিন পাউন্ড বের করে দিলো
বেশিও না
কমও না
তিন পাউন্ড
বেশিও না কমও না
এই যে
সে বলল
আর পয়সাগুলো গিটার কেইসে ফেলল
আমার গানটা শেষ হয়ে গিয়েছিল তখন
আমি আমার স্ত্রীকে পুড়িয়ে এলাম
তারপর বারে ঢুকে কিছুটা পান করতে হলো
দেখছ না একটু মাতালের মতো লাগছে আমায়
বুড়ো বলল
আমি মাথা নোয়ালাম
তারপর আমি আরেকটা গান শুরু করলাম
আমি তাকে এই পাতাল রেল স্টেশনে
হেঁটে যেতে দেখেছি বহুবার
কখনো একা
আমি তাকে হেঁটে যেতে দেখেছি
কখনো তার স্ত্রীর সাথে
[এক ঢোক বিয়ার গিলে নেয়]
এমনই
জীবন এমনই
[গাইতে শুরু করে, সতর্কভাবে]
হয়তো সেও
কখনো
এসেছিল এই শহরে
ওরই জন্য
ওই নারীর জন্যই
আর থেকে গিয়েছিল
ওরই জন্য
এখন সে নেই
এখন সে হয়ে গেছে ছাই
এক মুঠো
আমিও এসেছিলাম এ শহরে
সেই কবে
এক নারীর জন্য
গল্পটা এমনই [গান বন্ধ করে]
কিন্তু আমি [থামে]
আমি ওর মতো বুড়ো নই
বুড়ো হওয়ার কাছাকাছি অবশ্য [অল্প হাসে]
জি হ্যাঁ
আমার ধারণা আমার বেশিরভাগটা বুড়ো
যুবক তো আর নই
একসময়
কোনো একসময় ছিলাম
তখন এক নারীর জন্য
এই শহরে এসেছিলাম আমি
কত দিন আগের কথা
বহুদিন বহু বছর
[ছোটো উঁচু টুলটা থেকে নামে। নিচু হয় গিটার কেইসটা খুলে গিটারটা হাতে নেয়। আবার টুলে বসে। কয়েকটা কর্ড বাজায়। সতর্ক হয়ে গান শুরু করে]
আমি এসেছিলাম এ শহরে
একজন নারীর জন্য
অনেক দিন আগে
কতদিন আগে
এসেছিলাম আমি
এত উত্তরের এই শহরে
একসাথে থেকেছি আমরা
আমি আর সে
সে আর আমি
এই উত্তরের এত উত্তরের শহরে
আর উপরের ঈশ্বর
আমাদের কোলে দিলেন এক শিশু
আমাদের শিশু
তার আর আমার
[গান বন্ধ করে, গিটারে কয়েকটা কর্ড বাজাতে থাকে, তারপর কর্ড ছেড়ে খোলা তারগুলো বাজায় কয়েকবার, হাসে]
হুম
এভাবেই গল্পটা এগোলো
আমার গল্প
এমনটাই
আর তারপর
এর চেয়ে বেশি সম্ভবত বলার তেমন কিছু নেই
না
বেশি গপ্প মারানোর মতো কিছু নেই
তেমন কোনো মাসালাও না
[বিরতি। কাউন্টারের ওপর হাত রাখে। পয়সাগুলো এদিক ওদিক সামনে পিছনে সরায় নাড়ায়]
আর আজ কিছু পয়সা
যদিও খুব ঠান্ডা আজ
কিন্তু একটু বেশিই কিছু পয়সা
[পয়সাগুলো নাড়ে, ওগুলো দিয়ে একটু খেলে। তারপর দু-একটা কর্ড বাজায় গিটারে এবং আবার কর্ড ছেড়ে খোলা তারগুলো বাজায় কয়েকবার]
সবকিছু যেমন হওয়ার তেমনই হয়েছে
আর সবকিছুরই একটা নির্দিষ্ট সময় আছে
বাইবেলের কোনো এক জ্ঞানী ব্যক্তি
এমন বাণী দিয়েছিলেন
পড়েছি আমি বা শুনেছি
এমনই একটা কিছু হবে [বিরতি]
সবকিছুর একটা সময় থাকে
একটা নির্দিষ্ট সময়
এক সাথে থাকার
এক হয়ে থাকার
একটা নির্দিষ্ট সময়
আলাদা হয়ে যাওয়ার
একা হয়ে থাকার
একটা নির্দিষ্ট সময়
বাঁচার
একটা নির্দিষ্ট সময়
হাল ছেড়ে দেয়ার [ছোটো বিরতি]
সবকিছু একরকম চলতে পারে না
তাই হাল ছেড়ে দিতে হয়
ছেড়ে দিতেই হয় হাল
ধরে রাখা যায় না
[পয়সাগুলো নিয়ে লোফালুফি করে]
দুই পাউন্ড পনেরো পেনস বিয়ারের গ্লাসের জন্য
[গ্লাসটা নিয়ে বড় করে চুমুক দেয়, চুলের মধ্যে দিয়ে হাত চালায় একবার, মাথাটা ঝাঁকায় তারপর দুই পাউন্ড পনেরো পেনি গুনে আলাদা করে কাউন্টারের কোণায় ঠেলে দেয়, অন্য হাত দিয়ে সেগুলো তুলে নেয় এবং কোটের পকেটে রাখে। আরেকবার বিয়ারে চুমুক দেয়]
কামাইটা আজ ভালোই হয়েছে
যে ঠান্ডা বাইরে
বিচ্ছিরি ঠান্ডা আজ
[ওঠে। এদিক-ওদিক হাঁটে, এক হাতে গিটার]
শীতকালগুলো এত ঠান্ডা
আমার মতো একজনের জন্য যাকে
বাইরে দাঁড়িয়ে গিটার বাজাতে হয়
কিন্তু এই টাকাতেই আমার চলতে হয়
এভাবে বাইরে দাঁড়িয়ে গিটার বাজিয়ে
তাই ঠান্ডা হলেও
আমাকে বাজাতে হয়
এমনিতেই যা পাই তাতে চলে না
তাই বাজাতে আমাকে হয়ই
কিন্তু
[হঠাৎ করে সামনে তাকায় যেন কিছু একটা বুঝতে পেরেছে। সেভাবেই তাকিয়ে থাকে, মুখও কিছুটা উজ্জ্বল হয়]
হ্যাঁ
এমনই হওয়ার কথা
এবং এমনিই হচ্ছে
যা হওয়ার তাই
[হাসে। গিটারটা নেয় আবার দু-হাতে, কয়েকটা কর্ড বাজায়। তারপর একটু খুশি ভাব নিয়ে গাইতে শুরু করে]
আমি এক নারীর জন্য
এলাম এ শহরে
অন্য ভাষার অন্য শহর থেকে
থেকে গেলাম এক শিশুর জন্য
আমার সন্তান ছেলের জন্য
[গিটার থামায়, ছোটো বিরতি নেয়, গাইতে শুরু করে আবার]
ভিন্ন ভাষার এক সন্তানের জন্য
আমি শুনি সুর ভেসে আসে
আমি শুনি সুর ভেসে যায়
এখন এখানে আমি আছি
এক শিশুর জন্য
আমার এক সন্তানের জন্য
আমি বাস করি এখানে প্রতিদিন
প্রতিদিন বাজাই গিটার আর বিশ্বাস করি
প্রতিদিন বাইরে দাঁড়িয়ে আমি বাজাই
আর গাই আমার প্রতিটি পুরনো গান
আর কয়েকটা পয়সা আসে
পুরনো একটা ছাউনির নিচে থাকি আমি
চলে যায় কোনো মতে
গান গেয়ে বাজিয়ে গিটার কয়েকটা পয়সা
ভালোই তো আছি
বেশ খাসা আছি
[গান থামায়। গিটার হাতে হাঁটে এদিক-ওদিক, সামনে-পিছনে। হাসে]
এক গাদা টাকা আমি পাইনি
যা পেয়েছি তাই
হতে পারত বেশি
হতে পারত কম
না হয়ে এখন যা পাই তা
[বার কাউন্টারের দিকে যায়। গ্লাসটা নিয়ে আরো কয়েক চুমুক দেয় বিয়ারে। তারপর গিটারটা নিয়ে এদিক-ওদিক হাঁটে, বাজাবে বলে দুহাতে ধরে, সিদ্ধান্ত বদলায়]
না আর বাজাব না
একই কর্ড আমি বাজিয়েই যাচ্ছি বাজিয়েই যাচ্ছি
[গিটারটার দিকে তাকায়, মাথা ঝাঁকায়]
না
না কিন্তু তারপর
তারপর কী
কী তারপর
[গান শুরু করে]
সবকিছু সেরকমই হয় যে-রকম হওয়ার কথা
যা হওয়ার হয় তাই
আর কিছু বলার নেই আমার
আমি এর চেয়ে বেশি কিছু নইও
এই যা দেখছেন তাই
অল্প কিছু চুল মাথায়
শরীরে পুরোনো পোশাক
একটা ভাঙাচোরা মুখ
যে কিছু চুল তাও পড়ে যাবে
হয়ে যাবে ধূসর
একজন ক্লান্ত ধসে পড়া মানুষ
এমনটাই দেখা যায় বোধ করি
একজন ক্লান্ত ক্লান্ত মানুষ
এই তো আপনারা দেখছেন
এর চেয়ে বেশি কিছু না আমি
[গান থামায়। বিরতি। কথা শুরু করে]
আমার বিশেষ কিছু নেইও বলার মতো
কিছু কাপড়চোপড়
একটা গিটার
এক ধরনের সাহস
মহান ধরনের কিছু না
কিন্তু আমার ধারণা আমার একটু সাহস আছে
এক ধরনের সাহস
যখন বিশেষ করে আমি গাই
যারা শুনতে চায় তাদের জন্য
[ছোটো বিরতি। আবার গান শুরু করে]
আমাকে যা দেখছেন ঠিক সেটুকুই আমি
এর চেয়ে বেশি না
আর আমি কিছু গান জানি
অল্প কিছু গান
বেশিরভাগই গেছি ভুলে
আমি যা আমি তাই
আমাকে যা দেখছে সেটুকুই আমি
আমি শুধু ধীর গতি
আমি শুধু বৃষ্টি ও হাওয়া
আমি শুধু গভীর হতাশা আর
[গান থামায় হঠাৎ]
না আমি গভীর হতাশা না
গভীর হতাশা শব্দ দুটো [ছোটো বিরতি]
শুনতে ভালো অবশ্য
[ছোটো বিরতি। আবার গান ধরে]
কিন্তু একটা পুরোনো ঢংয়ের গান আমি
এমন গান যা কখনো গাইনি
আমি আমার নিজের দুঃখের মধ্যে
যেখানে যাই সেখানেই গানগুলো গাই
দুঃখে নীল হওয়া দিনের গান
ক্লান্তিতে ভেঙে পড়া দিনের গান
সবচেয়ে ভালো একটা দিনের গান
আনন্দে ফেটে পড়া গান গাই আমি
আমি গাই ছোটো ছোটো প্রত্যাশার গান
সেই গান যেখানে আমার দুঃখ লেগে থাকে
কিংবা যে দিন আসবে সে দিনের গান
[গান থামিয়ে কথা বলে শুরু করে আবার]
যে দিন শেষ পর্যন্ত অন্য একজনের গানের
মধ্যে ঢুকে যেতে পারব আমি
যে দিন আমাকে নিয়ে বলা আরেকজনের বলা গল্পের
ভিতর দিয়ে নিশ্বাস নেব সেদিন
যে গান শুনব আমরা সবাই
আমি তোমরা আপনারা তুমি
[একটা কোনায় গিয়ে গিটারটা কোলে নিয়ে বসে। বসেই থাকে ওভাবে কিছুক্ষণ। ওঠে, হাঁটে কিছুক্ষণ, বারের দিকে গিয়ে গিটারটা ঠেস দিয়ে রাখে, কোটটা খোলে, পকেটে পয়সার ঝনঝন শব্দ হয়; বার কাউন্টারের ওপর রাখে কোট, তারপর আবার হাঁটে কিছুটা]
এমনই ব্যাপারটা তাই না
[ছোটো বিরতি, নিজেই সায় দেয়]
কিন্তু সবকিছুর একটা নির্দিষ্ট সময় আছে
একটা মানুষ
আর একখণ্ড সুর
[কাউন্টারের কাছে গিয়ে গিটারটা হাতে নেয়, কোনো কর্ড না ধরে এলোমেলো বাজায় তারপর একটা তার খুলতে শুরু করে পেগ ঘুরিয়ে-ঘুরিয়ে, সেই সাথে ঢিলে হতে থাকা তারটা বাজতে থাকে, একসময় সেটা গিটারের শরীরে বাড়ি খায়]
না আমার মনে হয় আমি আর
থাকতে পারব না এখানে
পাতাল রেলের স্টেশনে দাঁড়িয়ে
বছরের পর বছর একই পুরোনো গান
গাইতে পারব না
আমি এখানে এসেছিলাম
[ভাবে কী বলতে চেয়েছিল]
হুম
অনেক বছর আগে অনেক বছর
অন্য একটা দেশের অন্য একটা শহর থেকে
আর থেকে গেলাম এখানে
একজন নারীর সাথে থেকেছি আমি
আর তারপর
[সে হাসে]
সে আর আমাকে চায়নি
চুকে গেল
[আবার হাসে, মাথা ঝাঁকায়]
ততদিনে একটা ছেলে হয়েছে আমাদের
আর একটা ছোট্ট বাড়ি
সমুদ্রের ধারে
জঙ্গলটা যেখানে শুরু হয়েছে সেখানে
কিন্তু আমাকে আর সে চায়নি ততদিনে
[মাথা ঝাঁকায়, হাসে]
ততদিনে আমার সাথে সে আর থাকতে চায়নি
[গাইতে শুরু করে, গিটারটা বাজায়, একটা তার ঢিলা]
আমাকে চায়নি সে আর
কী হতো আমাকে দিয়ে
সে বলত
আমি কেবল বসে থাকি
গিটার কোলে
কোথাও যাওয়া হবে না আমার
কিচ্ছু করার নেই আমার
শুধু গিটার কোলে
বসে থাকা ঘরের কোণায়
একটা টাকাও কামাতে পারি না
একটা পয়সাও দিতে পারি না ঘরে
[গান বন্ধ করে। বিরতি। আবার কথা বলতে শুরু করে]
সে নিজে পড়াত একটা স্কুলে
[ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করে]
সে আসলে চেয়েছিল ছবি আঁকতে
মানে পেশাদার শিল্পী হতে
কিন্তু একটা ছবিও বিক্রি হলো না
তাই শিক্ষকতা
বেশি বেতন ছিল না
চলে যেত আরকি
চলে যেত
যেত চলে
টিকে থাকার মতো
প্রতিদিন সে কাজে যেত
ফিরত কাজ থেকে
প্রতিটা দিন
আমি থাকতাম বাড়িতে
ছেলেটাকে নিয়ে
আমি বসে থাকতাম গিটারটা নিয়ে
সে যেত
সে আসত ফিরে
যেত
আসত
কাজে যেত সে প্রতিদিন
আর বেলা শেষে ফিরত
আমাদের কাছে
আমি আর আমার গিটার আর
আমাদের ছেলে
[ব্যাখ্যার মতো]
ছবি আঁকা বন্ধ করে দিলো সে
তাতে অবশ্য ক্ষতি-বৃদ্ধি হয়নি কিছু
[হাসে]
না আমার সম্ভবত এমন কথা বলা সাজে না
কিন্তু এটাও ঠিক তেমন কিছু ছিল না
ওর ছবিগুলো
যে ছবিগুলো ও আঁকত আরকি
ছবি আঁকার প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা
তার ভালোই ছিল বলতে হবে
এ দেশের উচ্চতর ডিগ্রি
কিন্তু আঁকা ছবিগুলো
[মাথা ঝাঁকায়]
না সেরকম বলা যাবে না
পরিচ্ছন্ন
ওর আঁকা ছবিগুলো
এর বেশি কিছু না
পরিচ্ছন্ন সাদামাটা আর নিপাট
ছবি হয়তো হয়েছে
শিল্প হয়ে ওঠেনি
[ছোটো বিরতি]
সে কেন কেউ বলবে না
যে সেগুলো শিল্প হয়েছে
[অল্প হাসে। বিরতি। নিচে তাকায়, ঢিলে হয়ে থাকা তারটা আরও খুলতে থাকে এবং পেগ থেকে খুলে ফেলে পুরোটা, ঝুলতে থাকে সেটা]
সে ছিল
[ঠিক করে]
না সে আছে মানে
সে একজন ব্যর্থ শিল্পী
এটাই সত্যি
আমার মনে হয় তাদেরও দরকার আছে
হ্যাঁ তাদেরও
কাউকে না কাউকে সফল হতে হলে
কাউকে না কাউকে তো ব্যর্থ হতে হবে
তাই না
সম্ভবত তাই
সম্ভবত এটাই সত্যি
[আবার গান গাইতে শুরু করে, গিটারের একটা তার ঝুলছে, সেভাবেই সে গিটার বাজাতে চেষ্টা করে]
আমার ধারণা ব্যাপারটা এমনি
কিছু লোকজন বাজিমাত করবে
কিছু লোক বাজিমাত করতে চাইবে
কিন্তু পারবে না
খেলাটা এমনি
ছিল ব্যর্থ শিল্পী সে
খেলার নিয়মটা এমনি
একদিন আমাকে সে বলল চলে যেতে
তারপর
আমি টাকার জন্য গাই
পাতাল রেলের স্টেশনে
একজন একা মানুষ
বেশ একা মানুষ আমি
আমি আর আমার গিটার
[বাজানো এবং গাওয়া থামায়]
কিন্তু একটা সময় প্রত্যেককেই হাল ছেড়ে দিতে হয়
আমিও আরামসে হাল দিতে পারি এখন
মনে হয় পারি হাল ছেড়ে দিতে
মনে হয় এখানে আর থাকার দরকার নেই আমার
[গিটারের দিকে তাকায়, হাসে]
আমি বরং
[থামে]
আমি বরং
বলেই ফেলি
আমি বরং এর চেয়ে
[গিটারের অন্য একটা তার বাজায় তারপর সেটা ঢিলা করতে শুরু করে। একটু আত্মবিশ্বাসের সাথে]
এবং আমার মনে হয় আমাকে
বাবা হিসেবে পেয়ে আমার ছেলের
ভিতর লজ্জা জন্ম নিতে শুরু করল
এমন একটা বাপের কথা ভাবুন তো
যে পাতাল রেলের স্টেশনে দাঁড়িয়ে
গিটার বাজায়
একই গান গায় বারবার
[তারটা আরও ঢিলা করে, আঙুল দিয়ে সেটাই বাজায়]
হুম
আমার মনে হয়
হাল ছেড়ে দেয়ার সময় হয়েছে
[আরও ঢিলা করতে করতে তারটা পেগ থেকে খুলে ফেলে, ঝুলতে থাকে সেটা]
হাল ছেড়ে দিতেই হবে
আমার ধারণা আমি কোনো কাজের না
তাই এখন হাল ছেড়ে দেয়াই উত্তম
[গিটারটা হাতে নিয়ে দাঁড়ায়, গিটারটার দিকে দেখে, চার তারেই সেটা বাজাতে থাকে]
এখন ছেড়ে দেয়া উচিত হলে
এখানে আসাই উচিত হয়নি প্রথমত
এত দূরে এত উত্তরে
কিন্তু আমি এসেছি
তারপর আমার একটা ছেলে হলো
আমি থেকে গেলাম
আর এখন আমার ছেলে আমাকে
নিয়ে লজ্জায়
[বাজানো এবং গাওয়া বন্ধ করে। মাথা ঝাঁকায়, হাসে, কথা শুরু করে]
আমি এক ব্যর্থ মানুষ
হ্যাঁ এটাই সত্যি
[গিটারটা রাখে। হাঁটে, হাঁটতে হাঁটতে গিটারটার দিকে তাকায়। এক জায়গায় থামে, তাকিয়ে থাকে গিটারের দিকে। হেঁটে গিটারটার দিকে যায়। হাতে নেয়, চারটা তার খোলা বাজায় কয়েকবার তারপর আরেকটা তার ঢিলা করে, আবার খোলা বাজায়, আরও ঢিলা করে তারটা এবং পেগ থেকে খুলে ফেলে। পরের তারটা টাইট দিতে থাকে, দিতে দিতে একসময় টং করে ছিঁড়ে যায় সেটা। হাসতে শুরু করে। বারের সাথে হেলান দিয়ে রাখে গিটারটা, উঁচু টুলটাতে বসে, বিয়ারের গ্লাসটা হাতে নিয়ে চুমুক দেয়। মাথার পিছনে দুহাত নিয়ে মাথার ভর ছেড়ে দেয়। উপরে তাকায়, সান্ত্বনা দেয়ার সুরে কথা বলে]
একটা পথ তো অন্তত থাকবে
থাকা উচিত
এই শহরে থাকার দরকার নেই আমার
এত উত্তরে [বিরতি]
আর উপরে যিনি আছেন
ঈশ্বর বলি আমি
তিনি নিশ্চয়ই সাহায্য করবেন
করার কথা
[একটু হাসার চেষ্টা করে]
ঈশ্বরের ওপর আমি পূর্ণ
আস্থা রাখছি
ঈশ্বর যদি আমাকে না দেখেন
তখন শেষ পর্যন্ত আমি
[নিজেকে থামায়, ছোটো বিরতি, তারপর গান শুরু করে]
একটা সুরক্ষিত দূর্গ আছে ঈশ্বরের বাগানে
সূর্যের রশ্মির মতো উজ্জ্বল আর মহান
মানুষ সেখানে ধনী কিংবা গরিব নয়
[গান থামিয়ে জোরে হাসে]
বেশ
খুব খারাপ কিছু হয়নি
বেশ তো আছি
অথবা এভাবে বলা যায়
ঈশ্বরের সাথে বেশ একটা সম্পর্ক আছে আছে আমার
অন্তত আছে বলে
বিশ্বাস করতে চাই আমি
জানি না
ঈশ্বরের সাথে
[বিরতি। গোপন কিছু বলে দিচ্ছে এমনভাবে]
আমি কিন্তু অনেক প্রার্থনা করি
আমার আমাদের ঈশ্বরের কাছে
আমার বিশ্বাস ঈশ্বরের করুণা
কিছুটা হলেও বরাদ্দ আছে আমার জন্য
[বিরতি]
আমি যখন ওখানে দাঁড়িয়ে গান গাই
আমার যেন মনে হয় এর সাথে
ঈশ্বরের ইচ্ছার একটা সম্পর্ক আছে
[হাসে]
আমি এমনটাই ভাবি
তাঁর সাথে চমৎকার একটা সম্পর্ক আছে আমার
[বারের দিকে হেঁটে যায়, বিয়ার গ্লাস নিয়ে চুমুক দেয়। পিছনের পকেট থেকে তামাকের প্যাকেট বের করে তামাক এবং কাগজ নিয়ে রোল করে একটা বিড়ি বানিয়ে ধরায়]
আমি হাঁটতে শুরু করব এরপর
যেতে থাকব
যেতে যেতে একটা কিছু ভাবা যায়
[টুলের ওপর বসে, বিড়ি টানতে থাকে]
একটা কিছু ভেবে বের করে ফেলব আমার ধারণা
[গিটারটার দিকে তাকায়]
অনেক বছর ধরে লেগে আছি
[বিড়িটা নিভিয়ে ফেলে কাউন্টারে চাপা দিয়ে, ওঠে, হাঁটে, থামে, দাঁড়িয়ে জুতার দিকে তাকিয়ে থাকে]
বেশ
তাহলে তাই
যথেষ্ট হয়েছে যথেষ্ট হয়েছে
[দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে। বিরতি। এদিক-ওদিক হাঁটতে থাকে, তারপর গাইতে শুরু করে]
আমি ঘুরেছি অনেক দেশে পৃথিবীতে
খুঁজেছি এমন স্থান
যেখানে আমি হয়ে যেতে পারি আমার
অন্যের হাঁটা পথে হেঁটেছি অনেক
অনেক হেঁটেছি
বহু জনপথ বহু লোকালয়
খুঁজেছি মানুষ আর
কিছু কিছু নীরবতা
প্রসন্ন পরিবেশ
বহু লোকালয়ে বহু নগরের পথে
খুঁজেছি বন্ধু
আশ্রয় আর ঘুম
বহু জনপদে বহু পৃথিবীতে
এখন ক্লান্ত হয়েছি আমি
ভাবি পেয়ে যাব কিছুটা নিরিবিলি
কিছুটা সুখ হৃদয়ের
আর জীবনের কিছু সুর
তাই হেঁটে চলি
তাই গাই গান
তাই খুলে দিই জানালা সকল
দুঃখটা দেখি জীবনের
দুঃখটা বুঝে ফেলি আমার যেটুকু
দুঃখটা বুঝে ফেলি তোমার যেটুকু
বুঝি যেতে হবে চলে
দূরের কোথাও
কোথাও দূরের শহরে
চলে যেতে হবে হেঁটে হেঁটে
পথে হেঁটে হেঁটে অবিরাম
কোথাও সে শহর
অনাদি শহর
[গান থামায়, লজ্জা-লজ্জা মুখ নিয়ে চারদিকে তাকায়। বিরতি। আবার গান শুরু করে]
আমি এক ব্যর্থ প্রচেষ্টা
আমি এক ব্যর্থ ধারণা
অদ্ভুত কিছু দুঃখ নিয়ে নিজের
আমি এক ব্যর্থ প্রয়াস
একটা গিটার হাতে নিয়ে
আমি জমে গেছি হিমে আর গেয়েছি
আমার শেষ না হওয়া রাতে
আমি যা রেখে গেছি পিছনে
মনে রাখার মতো না কিছুই
হেঁটেছি শুয়েছি
দাঁড়িয়ে থেকেছি আর দেখেছি
এখন আবার শুরু আমার যাত্রা
যাত্রা হলো শুরু আবার
যাচ্ছি চলে
কোনো নতুন শহরে
নতুন কোনো জনপদে
পয়সার প্রয়োজন যেখানে নেই
এমন এক লোকালয়ে
আমার ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করি
জানি আমি
আমি তার অনন্ত বিশ্রামের থেকে
কিছুটা পেয়ে যাব
[হাসে, মাথা ঝাঁকায়, গান চালিয়ে যায়]
আমি তোমার কাছে ঈশ্বর
এই চাই নাও আমার হাত
নিয়ে চলো তোমার শহরে
তোমার কাছে এই চাওয়া আমার
আমাকে থাকতে দাও
তোমার অনুগ্রহের ঢেউয়ের
দোলায় ভাসতে দাও আমায়
এক সময় আমি যেমন ছিলাম
কিছু না-এর ভিতর কিছু হয়ে
অথবা একদম কিছু না হয়ে
উঠতে দাও আমায়
এবং সেই গান সেই অচেনা চিহ্ন
হয়ে উঠতে দাও আমায়
মানুষ যা বুঝবে না
তবু বুঝতে চাইবে
সেই গান হয়ে উঠতে দাও আমায়
যা গাইবে দেবদূত
এবার আমায় বিশ্রাম দাও
আমার যে বন্ধু কুকুরটি ছিল
যাকে আমি হারিয়েছি
তাকে আমি ফিরে পেতে চাই
আমি এখানে দাঁড়িয়ে
তাকাতে চাই চারদিক
দেখতে চাই না কিছুই
[গান থামিয়ে হতাশা নিয়ে মাথা ঝাঁকায়।]
কিছুই দেখতে চাই না
আকাশের নীল সীমানায়
[হেঁটে কাউন্টারের দিকে গিয়ে গ্লাসটা হাতে নিয়ে চুমুক দেয়। গিটারটা হাতে নেয়। শেষ দুইটা তারও খুলতে শুরু করে। পুরোটা খুলে ফেলে। ও তার দুটো ও ঝুলতে থাকে বাকিগুলোর মতো। ওপরের ডেস্কে রাখে গিটারটা। কোটটা নেয়, গায়ে চড়ায়, দস্তানা হাতে দেয়। গিটার কেইসটা তুলে নেয়, একটু হাঁটে, একটু গুছিয়ে নেয় নিজেকে। গিটার কেইসে ভর দিয়ে দাঁড়ায়]
গল্পটা এমনই
এমনই হওয়ার কথা ছিল
তাই এমনই
[গান শুরু করে]
কিছুই হারানোর নেই আমার
কিছুই চাওয়ার নেই আর
কিছুই পিছনে নেই যা
আমাকে একটা আগামী দিতে পারে
এবং আমি আমার নিজের রাত্রি
এবং এমন একটা ভাষা আমি যা বুঝবে না কেউ
[গান থামায়। মাথা ঝাঁকায়]
কী ধরনের কথা ভাবুন
এমন ভাষা যা কেউ বুঝবে না
[নিজের ওপর হতাশ]
কাউকে বুঝতেই বা হবে কেন
সে ভাষা
সম্ভবত হতে হতো আমাকে এক
[দীর্ঘশ্বাস ফেলে]
না
না এমন কোনো পার্থক্য তৈরি করবে না সেটা
আমার মনে হয় না
[বিরতি]
কিন্তু পয়সা
কিছু পয়সা আমি কামিয়েছি আজ
[কোটের পকেটে হাত দেয়। কয়েনগুলো হাত দিয়ে নাড়ায়। শব্দ হয়]
বেশি না
একজন প্রাপ্ত বয়স্কের জন্য এমন কিছু না
অল্প কিছু পাউন্ড
অল্প কিছু পয়সা
[হাত মুঠ করে পকেট থেকে হাত বের করে। কয়েকটা কয়েন মেঝেতে ফেলে]
কয়েকটা পয়সা
কয়েক গ্লাস বিয়ার হতে পারে বড়জোর
অল্প একটু খাবার
[আরও কয়েকটা পয়সা ফেলে]
না মনে হয় হবে না এতে
[হাঁটু ভেঙে বসে, পয়সাগুলো ওঠায়, আবার কোটের পকেটে চালান করে দেয়। উপরের দিকে তাকায়]
এভাবেই শেষ হওয়ার কথা
অন্য রকম কিছু হলে কোনো
মানেই হতো না
[হাসে]
কিন্তু আমার ধারণা আমার মতো লোকজনই
ঈশ্বরের অনন্ত পথের সন্ধান পাবে
[হাসে, মাথা ঝাঁকায়]
অন্তত সেটাই আমি বিশ্বাস করব
ওইসব চমৎকার গোছানো মানুষেরা না
আমাদের মতো কেউ
অথবা
তারাই
জানি না
[হাসে আবার, মাথা ঝাঁকায়, ওঠে, হাঁটে এলোমেলো, গান শুরু করে]
এবং আমি হেঁটে যাই
শহর আর পথের ভেতর দিয়ে
আমি দেখি মানুষ আসে
আমি দেখি চলে যায় তারা
তারা চলে যায় সবসময়
আমার সামনে দিয়ে
পাতাল রেলের স্টেশনে
আসে আর চলে যায়
তাকায় আমার দিকে
তারপর হেঁটে চলে যায়
নিজেদের চেনা পথে
আসে আর চলে যায়
সবসময় তারা
আসে
আর চলে যায়
[থামে। গান বন্ধ করে। চারপাশে তাকায়, হেঁটে গিয়ে এক কোনায় বসে, হাঁটুর মধ্যে গিটার কেইস। বিরতি। গিটার কেইসটার দিকে তাকায়]
এটা নিয়ে আমি কী করব ভাবছি
এখন আর আমার গিটার নেই
গিটার কেইসও দরকার নেই আর
তাই তো
[বিরতি]
কিন্তু গিটার কেইসটা বেশ
পুরোনো আর
বেশ
আমার উচিত
[ওঠে, দেয়ালের সাথে ঠেস দিয়ে রাখে গিটার কেইসটা]
নাহ্
এটা আর আমার দরকার নেই
[কিছুটা হেঁটে বেড়ায়]
নাহ্ যখন গিটারই নেই
তখন গিটার কেইস দিয়ে হবে কী
[হাসে]
সবকিছুর একটা সময় থাকে
নির্দিষ্ট একটা সময়
গিটার কেইসেরও
হ্যাঁ সেটাই
[দুলে দুলে হাঁটে, হেঁটে বেড়ায়, দেখে মেঝেতে একটা পয়সা পড়ে আছে, হাঁটু গেড়ে বসে পয়সাটা তোলে, কোটের পকেটে রেখে দেয়। ওঠে, গ্লাসে একটু বিয়ার অবশিষ্ট আছে দেখতে পেয়ে ওখানে যায়, এক চুমুকে শেষ করে দেয়। সোজা হয়ে দাঁড়ায়, তামাক রাখার মোড়ানো কাগজটা বের করে পিছনের পকেট থেকে, একটা বিড়ি তৈরি করে, বিড়িটা ধরায় তারপর ধীর পায়ে হেঁটে বের হয়ে যায়]
পর্দা