X
শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪
১৩ বৈশাখ ১৪৩১

‘যৌন হয়রানি’ নিয়ে বিভ্রান্ত পুলিশ!

উদিসা ইসলাম
২৮ নভেম্বর ২০১৬, ০৮:০৬আপডেট : ২৮ নভেম্বর ২০১৬, ২৩:৩৫

‘যৌন হয়রানি’ নিয়ে বিভ্রান্ত পুলিশ!

সালমা (ছদ্মনাম) বাস থেকে নামার সময় তার শরীরে হাত দিয়ে কটূক্তি করে হেলপার। তিনি প্রতিবাদ করেন। এরপর পার্শ্ববর্তী তেজগাঁও থানায় গিয়ে গাড়ির নম্বরহ অভিযোগ করেন তিনি। ডিউটি অফিসার তার কাছে জানতে চান, কী হয়েছে? সালমা বলেন, ‘আমাকে যৌন হয়রানি করা হয়েছে।’ পুলিশ কর্মকর্তা তাকে বলেন, ‘যৌন হয়রানি রাস্তাঘাটে মানুষের মধ্যে হলো কী করে? পরবর্তী সময়ে তাকে নারী শিশু নির্যাতন দমন আইনে মামলা করার পরামর্শ দেওয়া হয় থানা থেকে।’ মামলা না করলে আরও ভালো বলে উল্লেখ করে বলা হয়, ‘খামাখা এতে আপনারই হয়রানি হবে।’ হয়রানির শিকার হয়ে থানায় বিচারপ্রার্থী সালমা এভাবেই তার অভিজ্ঞতার কথা বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন।  

কেবল সালমা নয়, একই ধরনের অভিজ্ঞতার কথা বলেন আগারগাঁ আইডিবি ভবন থেকে শ্যামলী পর্যন্ত হেঁটে কর্মস্থলে যাওয়া যাওয়া নাসিমাও (ছদ্মনাম)।  তিনি জানান, তার আসা-যাওয়ার পথে কয়েকজন বখাটে তাকে প্রায় হয়রানি করে। পেশায় সেলসম্যান নাসিমা যতটা পারেন, সাবধানে চলাচল করেন। তবু গত মাসের মাঝামাঝি সন্ধ্যা সাতটার দিকে তার ওড়না ধরে টান দেয় কয়েকজন বখাটে যুবক। এরপর নাসিমা শেরেবাংলানগর থানায় গিয়ে ঘটনাটি জানাতেই কর্তব্যরত পুলিশ কর্মকর্তা জানতে চান, ওই যুবকদের চেনেন কিনা।  জবাবে নাসিমা তাদের কাউকে চেনেন না বলে জানান। এরপর অজ্ঞাত পরিচয়ে একটি জিডি নেওয়া হলেও তাতে যৌন হয়রানির কথা উল্লেখ করা হয়নি। এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে, থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা বলেন, ‘তার সঙ্গে কোনও যৌন হয়রানি হয়নি, তাকে উত্ত্যক্ত করা হয়েছে।’

এদিকে, কেবল তেজগাঁও শিল্প এলাকায়  বাসাবাড়িতে কাজ করেন রহিমা (ছদ্মনাম)।  বাংলা ট্রিবিউনকে তিনি বলেন, ‘যৌন হয়রানির অভিযোগ নিয়ে থানায় গেলে, থানা থেকে জানতে চাওয়া হয়, আমাকে ধর্ষণ করা হয়েছে কিনা। এরপর আমরা মামলা না করে বাসায় ফিলে আসি।’

কেবল এই তিনজিই নন, যৌন হয়রানির শিকার হয়ে যত নারীই আইনি সহায়তা নিতে থানায় ছুটে যান, তাদের বেশির ভাগেরই একই অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হতে হয়। পুলিশ কর্মকর্তারা তাদের কাছে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই প্রথম প্রশ্ন করেন, ‘আপনার শরীরে হাত দিয়েছে? আপনাকে ধর্ষণ করা হয়েছে?’ উত্তর যদি না হয়, তাহলে এটা যৌন হয়রানি কিভাবে হবে, তা নিয়েই সিদ্ধান্ত নিতে পারেন না তারা।

অথচ হাইকোর্টের নির্দেশনা অনুযায়ী, কাউকে যৌন ইঙ্গিতপূর্ণভাবে কটূক্তি, ব্যঙ্গবিদ্রূপ করা, যৌন উস্কানিমূলকভাবে কুৎসা রটনা করা, স্পর্শ করা, প্রেম বা যৌন সম্পর্ক স্থাপনের জন্য ভয়ভীতি দেখানো, যৌন আক্রমণের ভয় দেখিয়ে স্বাভাবিক জীবনযাপন বিঘ্নিত করা, প্রতারণা, জালিয়াতির সুযোগ নেওয়া, দুর্বল মুহূর্তের ছবি বা ছায়াছবি তোলা এবং তা দিয়ে ব্ল্যাকমেইল করাকে যৌন নিপীড়ন বলে বিবেচিত হবে।  

যৌন হয়রানির কোনও অভিযোগ এলে আপনারা সাধারণত কোন ধরনের মামলা নেন? এমন প্রশ্নের জবাবে তেজগাঁও থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মাজহারুল ইসলাম বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘যদি মেয়েটিকে ধর্ষণ করা না হয়, তার শরীরে কোনও প্রকাশের অত্যাচারের চিহ্ন না থাকে, তাকে যৌন নির্যাতন বলবেন কী করে? আমরা ফৌজদারি মামলা করে দেই। নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন আছে। ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টার আছে, প্রয়োজন হলে সেখানে দেওয়া হয়। নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন থাকার পর আসলে যৌন হয়রানি শব্দটা বাড়তি যোগ করে বিভ্রান্তি তৈরি করা হয়েছে।’

এদিকে, তেজগাঁও শিল্প অঞ্চল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আব্দুর রশীদ বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘নারীদের সুরক্ষার জন্য অনেক আইন আছে। যৌন নিপীড়নবিরোধী নির্দেশনার কথা আমরা জানি। কিন্তু এখনও সেটি আইন হয়নি। ফলে এসব ক্ষেত্রে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনেই মামলা করা হয়। আর যৌন হয়রানি শব্দটার ভেতর যৌন যোগাযোগ মনে হয় বলে বিভ্রান্তির সৃষ্টি হয়। এসব নিয়ে আমাদের বিস্তর প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা আছে।’

মানবাধিকারকর্মী অ্যাডভোকেট এলিনা খান  বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘যৌন নিপীড়ন বলতে আইনে কী আছে তা জানেন না অনেকেই৷ তারা মনে করেন নারী ধর্ষিত না হলে তা যৌন নিপীড়ন হয় না৷ পুলিশ রিফর্ম অনুষ্ঠানে নারীবান্ধব করে আইন পড়ানোর ব্যবস্থা নিয়ে খুব বেশি পরিবর্তন সাধন সম্ভব হয়নি।’ তিনি আরও বলেন, ‘বাংলাদেশে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ অফিস, শিল্প কারখানা, পথেঘাটে, মার্কেটে যৌন নিপীড়নের ঘটনা হরহামেশাই ঘটছে৷ কিন্তু আইন না জানায় আমরা অনেকই তাকে যৌন নিপীড়ন বলছি না।’

পুলিশ রিফর্ম প্রোগ্রামের জেন্ডার বিশেষজ্ঞ প্রশিক্ষক ফৌজিয়া খন্দকার বাংলা টিবিউনকে বলেন, ‘আমরা চেষ্টা করেছি, শব্দগুলোকে ধরে ধরে বোঝানোর। সবকয়টি থানায় সেগুলোর কপি পাঠানো হয়েছে। কিন্তু আমি নিশ্চিত সেগুলো খুঁজলে পাওয়া যাবে না। কারণ তারা এটাকে মনেই করেন না আলাদাভাবে চিহ্নিত করার কিছু আছে।’ তিনি আরও বলেন, ‘প্রশিক্ষণের সময় তাদের যখন বলা হয়েছে, অপরিচিত নারীকে সুন্দরী বলে ডাক দিলেও যৌন নিপীড়নের অফিযোগ আনা যায়। তখন তারা রীতিমতো হাসাহাসির পর্যায়ে নিয়ে যায়। পুরো সিস্টেম যদি না বদলানো যায় তাহলে কোনোভাবেই পরিবর্তন আসবে না।’

বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সভাপতি আয়শা খানম বলেন, ‘পুলিশকে প্রতিনিয়ত এই সংবেদনশীল শব্দগুলো নিয়ে ভাবতে বাধ্য করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব। আটবছর হয়ে যাওয়ার পরও নীতিমালা নিয়ে তাদের কোনও আগ্রহ না থাকার দায় কেবল তাদের একার না। হাইকোর্ট বিষয়টিকে আইনে পরিণত করতে বলেছিলেন। সেটিও হয়নি।’ যৌন নিপীড়ন রোধে সামাজিক সচেতনতাবৃদ্ধি ও দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন জরুরি বলেও মন্তব্য করেন তিনি।

/এমএনএইচ/আপ- এপিএইচ/

আরও পড়ুন: 
শামীম ওসমান থাকলে ভালো, না থাকলে আরও ভালো: আইভী

ড. ইউনূস ও তার স্ত্রীর ব্যাংক অ্যাকাউন্ট তলব
মানবিক কারণে রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেওয়ার আহ্বান খালেদা জিয়ার

সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
সৎ মাকে বটি দিয়ে কোপালো কিশোর, ঢামেকে মৃত্যু
সৎ মাকে বটি দিয়ে কোপালো কিশোর, ঢামেকে মৃত্যু
ধানক্ষেত পাহারা দিতে গিয়ে বুনো হাতির আক্রমণে কৃষক নিহত
ধানক্ষেত পাহারা দিতে গিয়ে বুনো হাতির আক্রমণে কৃষক নিহত
কোনও রান না দিয়ে ৭ উইকেট, টি-টোয়েন্টিতে ইন্দোনেশিয়ার বোলারের বিশ্ব রেকর্ড
কোনও রান না দিয়ে ৭ উইকেট, টি-টোয়েন্টিতে ইন্দোনেশিয়ার বোলারের বিশ্ব রেকর্ড
রাজধানীতে পৃথক সড়ক দুর্ঘটনায় স্কুল শিক্ষার্থীসহ নিহত ২
রাজধানীতে পৃথক সড়ক দুর্ঘটনায় স্কুল শিক্ষার্থীসহ নিহত ২
সর্বাধিক পঠিত
দুদকের চাকরি ছাড়লেন ১৫ কর্মকর্তা
দুদকের চাকরি ছাড়লেন ১৫ কর্মকর্তা
স্কুল-কলেজে ছুটি ‘বাড়ছে না’, ক্লাস শুরুর প্রস্তুতি
স্কুল-কলেজে ছুটি ‘বাড়ছে না’, ক্লাস শুরুর প্রস্তুতি
খুলনায় এযাবৎকালের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা
খুলনায় এযাবৎকালের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা
চুক্তিতে মাউশির ডিজি হলেন নেহাল আহমেদ
চুক্তিতে মাউশির ডিজি হলেন নেহাল আহমেদ
ব্রাজিল থেকে গরু আমদানি প্রসঙ্গে যা বললেন রাষ্ট্রদূত
ব্রাজিল থেকে গরু আমদানি প্রসঙ্গে যা বললেন রাষ্ট্রদূত