X
শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪
১৩ বৈশাখ ১৪৩১

‘আমার নাম শাহান আরা, বীরাঙ্গনা না’

উদিসা ইসলাম
১৮ ডিসেম্বর ২০১৬, ১৭:৪৮আপডেট : ১৯ ডিসেম্বর ২০১৬, ১৪:২৪

শাহান আরা
দেশ স্বাধীনের পর দেখি আমাদের স্বাধীনতা নাই। আমার পেটে চার মাসের বীজ ছিল। বদ বীজ, কিন্তু আমার ভিতরেই তো ছিল। আমরা যশোরে ছিলাম। সারাশরীরে ক্ষত, দাঁত না মাজতে পারায় মুখে দুর্গন্ধ, কানে শুনতে পাই কম। ওইখানে কতদিন ছিলাম বলতে পারব না। তবে যখন-তখন অত্যাচার করে শরীরে আর কিছু রাখে নাই। আমাদের একদিন মাটির নিচে গর্ত করে ঠাসাঠাসি করে রাখা হয়েছিল। ছিলাম ওইভাবেই।
একজন আরেকজনের গায়ের গন্ধ এখনও পাই। একদিন সন্ধ্যার আগে আগে বাইরে থেকে ডাকাডাকি করলো অনেকে। তারা বলতেছিল, ‘যারা আছেন বের হয়ে আসেন।’ বাইরে থেকে কাপড়ও দেওয়া হলো। কিন্তু আমাদের কাপড় বদল করে বাইরে বের হওয়ার মতো অবস্থাও ছিল না। ‘দেশ স্বাধীন হয়েছে, বাইরে আসেন’ বলে অনেকক্ষণ ডাকাডাকির পরও আমরা বের হই নাই। আওয়াজ থেমে গেলে বেরিয়ে এসে দেখি, যারা এসেছিল চলে গেছে।
এক মনে ছোট মাছ কুটতে কুটতে কথাগুলো বলে চলেন প্রায় ৬৭ বছর বয়সী বীরাঙ্গনা নারী শাহান আরা। তাকে বীরাঙ্গনা বলে ডাকতেই বলে ওঠেন, ‘আমার নাম শাহান আরা, বীরাঙ্গনা না।’
মুক্তিযুদ্ধের সময় পাক হানাদার বাহিনীর হাতে চরম নির্যাতনের শিকার শাহান আরা এখন একটি বাসায় গৃহকর্মীর কাজ করেন থাকা-খাওয়ার বিনিময়ে। সেই বাসায় বসেই কথা হয় তার সাথে।
মুক্তিযুদ্ধের সময়ের অভিজ্ঞতা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘কী করবেন এই কথা শুনে?’ তার জীবনের কথা মানুষকে জানাতে চাই বললে তিনি রাজি হন না কথা বলতে। বলেন, ‘আমার পরিচয় যারা জানে তারা আমাকে খাওন দেয়, আশ্রয় দেয় বলেই জানে। আর কেউ জানুক আমি চাই না। এতে কি আপনি মন খারাপ করবেন?’ তাকে বলি, ‘মন খারাপ করব না। কিন্তু চাইলে আপনার পরিচয় গোপন রেখেও তো সবাইকে জানানো যায় আপনার কথা।’ তাতেও রাজি হন না শাহান আরা। প্রায় এক মাস ধরে নিয়মিত যোগাযোগের পর শাহান আরা তার বীরাঙ্গনা জীবনের কথা বলেন বাংলা ট্রিবিউনকে।
শাহান আরার কাছে জানতে চাই, স্বাধীনতার ঠিক পরপর কী ধরনের লড়াই করতে হয়েছে তাকে। জবাবে তিনি বলেন, ‘এখন অনেককিছু মনে নাই। আর কষ্টও কমে গেছে। তবে দেশ স্বাধীনের পর অনেক কষ্ট করেছি। আমরা ১৫/২০ জন বন্দি ছিলাম পাকবাহিনীর হাতে। সবাইরেই বাসা থেকে ধরে নিয়ে গেছিল। আমরা তো স্বেচ্ছায় কোনও অপরাধ করিনি। তারপরও সমাজে ঘৃণার বস্তু হয়ে গেলাম কেন? এ প্রশ্নের জবাব মিলল না এতদিনেও।’
অত্যাচারের মাত্রার কথা আর বলতে চান না শাহান আরা। শুধু বলেন, ‘রোজ একাধিকবার আমাদের শারীরিক নির্যাতন করা হতো। কিন্তু খেতে দিত মাত্র দুই বেলা। পানির জন্য কেবল ছিল একটা মাটির কলসি, একটা মগ পর্যন্ত ছিল না।’
শাহান আরা স্বগতোক্তির মতো করে বলতে থাকেন, ‘আমরা কী এমন করেছিলাম যে যুদ্ধকালে নির্যাতনের শিকার হলাম? যুদ্ধের পর ফিরেও কেন আবার ওই একই যন্ত্রণার মধ্য দিয়েই যেতে হলো?’
বন্দি জীবনের কথা জানাতে গিয়ে শাহান আরা বলেন, ‘আমাদের মধ্যে একজন ছিল অপরূপ সুন্দরী। আমার বয়সী না, আরেকটু ছোটই হবে। নির্যাতনের সময় ও চিৎকার দিয়ে কানতো। ও যখন ঘরের ভিতরে কানতো, আমরা সবাই মিলে বাইরে বসে কানতাম।’
ঢাকায় কবে কীভাবে এলেন জানতে চাইলে একটু চটে যান শাহান আরা। বলেন, একে একে ধীরে ধীরে বলতেছি। মাছ কুটতে কুটতে বলতে থাকেন, ‘যেদিন ওই গর্ত থেকে বের হলাম সেদিন গ্রামের লোকজন সবাইকে খাওয়ালো। আমরাও একপাশে বসে খেলাম রাতের খাবার। ততদিনে আমি টের পেয়ে গেছি, শরীরে বদ বীজ বেড়ে উঠতেছে। ওই গ্রামেরই এক মা বললেন, এ রাখা যাবে না। লবণ-পানি খেয়ে মেরে ফেল। ওইখানেই আমার আর নাসিমা নামে আরেকটা মেয়ের বীজ ফেলার (গর্ভপাতের) ব্যবস্থা করা হলো। কিন্তু তারপরও তো আমরা সেই অচ্ছুতই থেকে গেলাম!’
শাহান আরার কাছে জানতে চাই, নিজের বাড়িতে ফিরেছিলেন কিনা। উত্তরে তিনি বলেন, ‘হ্যাঁ, ফিরেছিলাম। কিন্তু জানতাম কেউ মানবে না। যে গ্রামে আমাদের আটকে রেখেছিল সেটা আমাদের গ্রাম থেকে কয়েক গ্রাম দূরে। দেশ স্বাধীনের তিন দিনের মাথায় হেঁটে রওনা দিলাম। যাইতে যাইতে দেখি আশেপাশে লোকজন নাই, ফাঁকা। বাড়িঘর পুড়িয়ে ফেলা হয়েছে। বাড়ির ভিটেতে গিয়ে কাউকে পাইনি। পাশের বাসার মোড়ল ঘর দখল করেছে ততদিনে। তারাও নানা কু-কথা কইয়া আমারে গ্রামছাড়া করলো। ঠিক করলাম, এমন জায়গায় যাইতে হবে যেখানে কেউ আমাকে যেখানে চিনবে, আমি একা বাঁচব। জিদ করে চলে এলাম ঢাকায়। আর ফেরা হয়নি।’
তাতেও স্বস্তি পাননি শাহান আরা। বলেন, ‘আমাদের শরীরের ক্ষত আর চেহারা দেখেই মানুষ বুঝে গেছে আমরা তাদের মতো না, আমরা ভিন্ন কোনও প্রাণী। আর তাই তো আমাদের নাম রাখছেন বীরাঙ্গনা; এ যেন ডেকে ডেকে মানুষকে বলা, এরাই তারা যাদের ধর্ষণ করেছে পাকবাহিনী।’
এখনও মুক্তিযুদ্ধের সময়ের ওই নির্যাতন আর অপমানের কথা ভুলতে পারেন না শাহান আরা। এখনও তাকে তাড়িয়ে বেড়ায় ওই দুঃসহ স্মৃতি। শাহান আরা বলেন, ‘জীবন খুব কঠিন ছিল কয়েকটা বছর। কোনোভাবেই নিজের মাথা ঠাণ্ডা হতো না, সারাক্ষণ রাগ হতো। আবার পরিবার থেকেও পুরা বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছিলাম। শরীর আর মনের যন্ত্রণা তো ছিলই। রাতের পর রাত ঘুমাতে পারিনি শরীরের ব্যাথায়। আজও ঘুমাতে পারি না, মনের ব্যাথায়।’

আরও পড়ুন-

এখনও মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি পাননি বীরাঙ্গনা বিভা রানী

আশ্রয়ণ প্রকল্পে মুক্তিযোদ্ধা সামছুল হক, বাসাবাড়িতে কাজ করেন স্ত্রী

 

/টিআর/

সম্পর্কিত
নানা আয়োজনে রাজধানীবাসীর বিজয় উদযাপন
বিজয় দিবস উপলক্ষে বঙ্গভবনে রাষ্ট্রপতির সংবর্ধনা
জাবিতে আলোকচিত্র প্রদর্শনী
সর্বশেষ খবর
রাফায় আবারও ব্যাপক হামলা ইসরায়েলের
রাফায় আবারও ব্যাপক হামলা ইসরায়েলের
স্ত্রীকে নিয়ে ঘুমিয়ে ছেলে, রান্নাঘরে পুড়ে মারা গেলেন মা
স্ত্রীকে নিয়ে ঘুমিয়ে ছেলে, রান্নাঘরে পুড়ে মারা গেলেন মা
২৫ দিনেও গ্রেফতার হয়নি কেউ, পুলিশ বলছে সিসিটিভির ফুটেজ পায়নি
কুমিল্লা শিক্ষা প্রকৌশল কার্যালয়ে ঠিকাদারকে মারধর২৫ দিনেও গ্রেফতার হয়নি কেউ, পুলিশ বলছে সিসিটিভির ফুটেজ পায়নি
উপজেলা নির্বাচন: অংশ নিতে পারবেন না পৌর এলাকার ভোটার এবং প্রার্থীরা
উপজেলা নির্বাচন: অংশ নিতে পারবেন না পৌর এলাকার ভোটার এবং প্রার্থীরা
সর্বাধিক পঠিত
দুদকের চাকরি ছাড়লেন ১৫ কর্মকর্তা
দুদকের চাকরি ছাড়লেন ১৫ কর্মকর্তা
স্কুল-কলেজে ছুটি ‘বাড়ছে না’, ক্লাস শুরুর প্রস্তুতি
স্কুল-কলেজে ছুটি ‘বাড়ছে না’, ক্লাস শুরুর প্রস্তুতি
ধানের উৎপাদন বাড়াতে ‘কৃত্রিম বৃষ্টির’ পরিকল্পনা
ধানের উৎপাদন বাড়াতে ‘কৃত্রিম বৃষ্টির’ পরিকল্পনা
খুলনায় এযাবৎকালের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা
খুলনায় এযাবৎকালের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা
চুক্তিতে মাউশির ডিজি হলেন নেহাল আহমেদ
চুক্তিতে মাউশির ডিজি হলেন নেহাল আহমেদ