X
শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪
১৪ বৈশাখ ১৪৩১

শিক্ষিত পরিবারে খুন বেড়েছে কেন?

নুরুজ্জামান লাবু
১০ অক্টোবর ২০২৩, ০০:০৬আপডেট : ১০ অক্টোবর ২০২৩, ০০:০৬

আশরাফুল-আফরোজা দম্পতি থাকতেন কানাডায়। শিক্ষিত পরিবার, সুখের সংসার ছিল তাদের। চলতি বছরের এপ্রিল মাসে দেশে বেড়াতে আসেন তারা। মে মাসের শেষ সপ্তাহ পারিবারিক কলহের জের ধরে স্বামী আশরাফুল নিজ হাতে কুপিয়ে হত্যা করেন স্ত্রী আফরোজাকে। হত্যার পর রাজধানীর দক্ষিণখানের নদ্দাপাড়া এলাকার নিজ বাড়ির দেয়াল ঘেঁষে মাটির নিচে পুতে রাখেন আফরোজার লাশ। প্রথমে আফরোজার নিখোঁজ হওয়ার খবর প্রচার করা হয়। পরে পুলিশি তদন্তে বেরিয়ে আসে স্বামী আশরাফুল স্ত্রীকে হত্যার পর পালিয়ে চলে যান কানাডায়।

বছর দুয়েক আগের আরেকটি ঘটনা। রাজধানীর গুলশানের ধনী ও শিক্ষিত এক পরিবারের সন্তান সাকিব আলম। প্রেম করে বিয়ে করেন হাসনা হেনা ওরফে ঝিলিক নামে এক নারীকে। বিয়ের পর ভালোই চলছিল তাদের সংসার। কিন্তু গৃহবধূ ঝিলিকের পরিবার তার স্বামীর পরিবারের চেয়ে অপেক্ষাকৃত গরীব ছিল। একারণে নানা বঞ্চনা ও গঞ্জনা নিত্যসঙ্গী ছিল তার। এক পর্যায়ে পারিবারিক কলহের জের ধরে খোদ স্বামীর হাতেই নির্মমভাবে খুন হন ঝিলিক। হত্যার পর দুর্ঘটনার নাটক সাজিয়ে পার পেতে চেয়েছিলেন স্বামী সাকিব ও তার পরিবার। কিন্তু পুলিশের তদন্তে বেরিয়ে আসে আসল ঘটনা।

শুধু এই দুটি ঘটনাই নয়, পরিণতি জেনেও শিক্ষিত পরিবারেও হরহামেশাই ঘটছে খুনের মতো নৃশংস ঘটনা। রাজধানীর বাইরে জেলা শহরের শিক্ষিত-সংস্কৃতিবান পারিবারেও ঘটছে খুন-খারাবি। কখনও দাম্পত্য কলজের জের, কখনও বা স্বার্থের দ্বন্দ্ব কিংবা মাদকাসক্ত হওয়ার কারণে ঘটছে এসব ঘটনা।

অপরাধ বিশ্লেষকরা বলছেন, বিচারহীনতার সংস্কৃতির কারণে শিক্ষিত পরিবারেও অপরাধপ্রবণতা ঢুকে গেছে। সাধারণত অশিক্ষিত বা সাধারণ মানুষ খুনের মতো অপরাধ করার পর পরিণতি সম্পর্কে অবগত থাকে না। কিন্তু শিক্ষিত মানুষ জানে কখনও না কখনও এই খুনের রহস্য উন্মোচিত হবেই। তারপরও তারা খুনের মতো অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে। এর কারণ হলো, অর্থকড়ি দিয়ে বিচারের দীর্ঘসূত্রতা তৈরি করে বা পার পেয়ে যাওয়ার নানা সুযোগ থেকে এসব অপরাধ করে যাচ্ছে অনেকেই।

ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার আজহারুল ইসলাম মুকুল দীর্ঘদিন ধরে নানা ধরনের অপরাধ প্রতিরোধ নিয়ে কাজ করছেন। তিনি বলেন, শিক্ষিত পরিবারের খুন বা সহিংসতার অন্যতম কারণ হলো পারিবারিক কাঠামো ভেঙে যাওয়া ও নৈতিক শিক্ষার অভাব। মেট্রোপলিটন শহরগুলোতে সমাজ বা সোসাইটি বলে কিছুই গড়ে ওঠেনি। মানুষ সবসময় আত্মকেন্দ্রিক হয়ে থাকে। এই আত্মকেন্দ্রিকতা কখনও কখনও শিক্ষিত মানুষকেও অপরাধী বানিয়ে দেয়।

পুলিশের এই কর্মকর্তা বলেন, পুলিশ অর্গানাইজড ক্রাইমের বিষয়ে প্রিভেন্টিভ মেজার বা ব্যবস্থা নিতে পারে। কিন্তু পারিবারিক সহিংসতা রোধে প্রিভেন্টিভ ব্যবস্থা নেওয়ার উপায় নেই। এখানে সব স্টেকহোল্ডারদের একসঙ্গে কাজ করতে হবে। যদি একটি সুসংগঠিত সমাজ ব্যবস্থা গড়ে তোলা যায়, তাহলে এই ধরনের অপরাধ প্রবণতা কমে যাবে।

আইন ও সালিশ কেন্দ্রের তথ্য বলছে, ২০২৩ সালের জানুয়ারি থেকে ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ৯ মাসে পরিবারের সদস্যদের হাতেই নির্যাতনের শিকার হয়েছেন ৩৯১ জন নারী। এর মধ্যে ২৩৫ জন নারীকে নির্যাতনের পর হত্যা করা হয়েছে। ২০২২ সালে পারিবারিক নির্যাতনের শিকার হন ৪৭৯ জন নারী। সংশ্লিষ্টরা জানান, পারিবারিক সহিংসতার ঘটনা আগের চাইতে বেশি ঘটছে শিক্ষিত পরিবারে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজ বিজ্ঞান বিভাগের ডিন ও অপরাধ বিজ্ঞানী অধ্যাপক জিয়া রহমান বলেন, মানুষ যত বেশি শিক্ষিত হচ্ছে, তেমনি তাদের মধ্যে লোভ, মাদকাসক্তি, অসহিঞ্চুতা বেড়ে গেছে। আগের মতো এখন আর পারিবারিক বন্ধন নেই। একক পরিবার বেড়েছে। আগে পরিবারে কোনও সমস্যা হলে সবাই মিলে তা মিটিয়ে ফেলতো। এখন পারিবারিক দ্বন্দেও কারণে খুনের মতো ঘটনাও ঘটছে।

অপরাধ বিজ্ঞান বিভাগের সাবেক এই চেয়ারম্যান বলেন, আগে পরিবারের মধ্যে সম্পত্তি নিয়ে বিরোধ থাকলেও সবার মধ্যে ছাড়ের মানসিকতা ছিল। কিন্তু এখন কারও মধ্যে এক চিলতে ছাড় দেওয়ার মানসিকতা নেই। এজন্য সম্পত্তিজনিত কারণেও পরিবারের মধ্যে সহিংসতা বেড়েছে। এজন্য সন্তানের হাতে বাবা-মা, ভাইয়ের হাতে ভাই খুন হচ্ছে।

অধ্যাপক জিয়া রহমান বলেন, প্রতিটি মানুষের ভেতরেই পশুবৃত্তি থাকে। এটি সামাজিক নানা কর্মকাণ্ডের মধ্যে জড়িত থেকে নিয়ন্ত্রণ করতে হয়। কিন্তু এখন মানুষ অতিরিক্ত মাত্রায় প্রযুক্তি ব্যবহারের কারণে একাকী হয়ে পড়ছে। তাদের ভেতরের পশুবৃত্তি মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে। স্যোসাল এক্টিভিটিজ, সামাজিক ও ধর্মীয় শিক্ষার অভাবে পারিবারিক বন্ধন কমে যাওয়ায় সহিংসতা বেড়েছে।

জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ডাক্তার মোহিত কামাল বলেন, হতাশা থেকে মানুষ হিংস্র বা নিষ্ঠুর হয়ে উঠছে। মানুষের মধ্যে সহিষ্ণুতা কমে গেছে। মানুষ আগের চাইতে বেশি অসহিষ্ণু হওয়ার কারণেই পারিবারিক সহিংসতা বেড়েছে।

আরও পড়ুন-

কোহিনূরের রহস্যজনক মৃত্যু

প্রাণভিক্ষা চেয়েও রেহাই পাননি ফাতেমা

/এফএস/
সম্পর্কিত
শীর্ষ নেতাদের নির্দেশে আছিম বাসে আগুন দেয় ছাত্রদলের নেতারা: সিটিটিসি
বউ-শাশুড়ির ঝগড়া থামাতে গিয়ে প্রাণ গেলো একজনের
দ্বিতীয় বিয়ে করায় ছেলের আঘাতে প্রাণ গেলো বাবার
সর্বশেষ খবর
কলকাতা স্টেশনে অর্থ পাচারের অভিযোগে গ্রেফতার বাংলাদেশি
কলকাতা স্টেশনে অর্থ পাচারের অভিযোগে গ্রেফতার বাংলাদেশি
তীব্র গরমে নির্বাচনি প্রচারণায় আ.লীগ নেতার মৃত্যু
তীব্র গরমে নির্বাচনি প্রচারণায় আ.লীগ নেতার মৃত্যু
দেশে আগ্রাসী শাসন চলছে: দিলারা চৌধুরী
দেশে আগ্রাসী শাসন চলছে: দিলারা চৌধুরী
বিকল্প অর্থনীতি ও গ্রাম্য কায়কারবার
উপন্যাসবিকল্প অর্থনীতি ও গ্রাম্য কায়কারবার
সর্বাধিক পঠিত
দক্ষিণে ‘ডায়াবেটিক ধানের’ প্রথম চাষেই বাম্পার ফলন, বীজ পাবেন কই?
দক্ষিণে ‘ডায়াবেটিক ধানের’ প্রথম চাষেই বাম্পার ফলন, বীজ পাবেন কই?
তাপপ্রবাহে যেভাবে চলবে শ্রেণি কার্যক্রম
প্রাক-প্রাথমিক বন্ধই থাকছেতাপপ্রবাহে যেভাবে চলবে শ্রেণি কার্যক্রম
যুদ্ধবিরতি প্রস্তাবে ইসরায়েলের প্রতিক্রিয়া পেলো হামাস
যুদ্ধবিরতি প্রস্তাবে ইসরায়েলের প্রতিক্রিয়া পেলো হামাস
আজকের আবহাওয়া: দুই বিভাগ ছাড়া কোথাও বৃষ্টির আভাস নেই
আজকের আবহাওয়া: দুই বিভাগ ছাড়া কোথাও বৃষ্টির আভাস নেই
বিক্রি না করে মজুত, গুদামে পচে যাচ্ছে আলু
বিক্রি না করে মজুত, গুদামে পচে যাচ্ছে আলু