X
শনিবার, ১১ মে ২০২৪
২৭ বৈশাখ ১৪৩১

কোহিনূরের রহস্যজনক মৃত্যু

জামাল উদ্দিন ও চৌধুরী আকবর হোসেন
০৭ অক্টোবর ২০২৩, ২০:৪২আপডেট : ০৮ অক্টোবর ২০২৩, ০০:০৬

শহীদ পরিবারের সন্তান কোহিনূর বেগম (৬৫)। তার স্বামী কে বি এম মামুন রশীদ চৌধুরী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক। গত ১০ এপ্রিল রাজধানীর ধানমন্ডির ৩২ নম্বর (নতুন-১১) রোডের ২০/এ বাড়ির বি-৬ ফ্ল্যাটের বাসায় রহস্যময় মৃত্যু হয় কোহিনূর বেগমের। তখন অধ্যাপক স্বামী পুলিশকে বলছিলেন, তার স্ত্রী কোহিনূর সিলিং ফ্যানের সঙ্গে ঝুলে আত্মহত্যা করেছেন। ধানমন্ডি থানায় সেভাবেই একটি অপমৃত্যুর মামলা হয়। ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ মর্গে ময়নাতদন্ত শেষে তাকে দাফনও করা হয়। কিন্তু কোহিনূরের মৃত্যুকে সন্দেহজনক বলে তার স্বজনরা অভিযোগ করায় ঘটনাটি তদন্তের দায়িত্ব নেয় পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)।

গত ১৫ জুলাই ময়নাতদন্তের প্রতিবেদন হাতে পেয়ে পুলিশ জানতে পারে, কোহিনূর আত্মহত্যা করেননি। তাকে প্রথমে আঘাত করা হয়েছে। পরে শ্বাসরোধে হত্যা করা হয়েছে।

অপমৃত্যু থেকে হত্যা মামলা
কোহিনূরের বড় ভাই বেসামরিক বিমান চলাচল ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের বিমান দুর্ঘটনা তদন্ত কমিটির প্রধান ক্যাপ্টেন সালাহউদ্দিন মু. রহমতুল্লাহ বাংলা ট্রিবিউনকে জানান, ময়নাতদন্তে কোহিনূরের হত্যাকাণ্ডের বিষয়টি জেনে তিনি বাদী হয়ে ধানমন্ডি থানায় একটি হত্যা মামলা করেন।

ডিএমপি কমিশনারকে পিবিআইয়ের চিঠি
হত্যা মামলা করার পর গত ৩ আগস্ট পিবিআই সদর দফতর থেকে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) কমিশনারকে একটি চিঠি দেওয়া হয়। ওই চিঠিতে বলা হয়, পিবিআইয়ের শিডিউলভুক্ত হওয়ায় ধানমন্ডি থানার ১৪(৭)২৩ নম্বর মামলাটি তদন্তের সিদ্ধান্ত নিয়েছে পিবিআই। এ জন্য একজন তদন্ত কর্মকর্তাও নিয়োগ করা হয়েছে। পিবিআইয়ের সংশ্লিষ্ট তদন্ত কর্মকর্তাকে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দিতে সংশ্লিষ্ট থানার ওসিকে অনুরোধ করা হলো। এরপর ৫ আগস্ট ডিএমপি থেকে নির্দেশনা পেয়ে কোহিনূর হত্যার রহস্য তদন্ত শুরু করেন পিবিআইয়ের উপপরিদর্শক (এসআই) শাহীন মিয়া।

যা বলেছেন কোহিনূরের ভাই
বড় ভাই সালাউদ্দিন রহমতুল্লাহ বাংলা ট্রিবিউনকে জানান, কোহিনূর স্বামী ও দুই সন্তান নিয়ে ধানমন্ডির ৩২ নম্বর (নতুন ১১) সড়কের ভাড়া বাসায় থাকতেন। তার স্বামী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক কে বি এম মামুন রশিদ চৌধুরী (৭২)। তাদের দত্তক মেয়ে ফাইজা রশিদ (৩২) এবং কোহিনূরের গর্ভজাত ছেলের নাম সাবিক নূর রশিদ (২৯)। তখন রমজান মাস ছিল। গত ১০ এপ্রিল কোহিনূর ডাইনিং রুমের সিলিং ফ্যানের সঙ্গে ওড়না পেঁচিয়ে আত্মহত্যা করেছেন বলে জানানো হয় তাদের।

তিনি আরও জানান, স্বামী অধ্যাপক কে বি এম মামুন রশিদ চৌধুরীর ভাষ্য ছিল, বাইরে থেকে দরজা লক করা অবস্থায় কোহিনূর বেগম বাসায় ছিলেন। তিনি বাসার চাবি দিয়ে দরজার তালা খুলে কোহিনূরকে সিলিং ফ্যানের সঙ্গে ঝুলতে দেখে নিজেই ওড়না কেটে নিচে মেঝেতে নামান। সে সময় তিনি ছাড়া আর কেউ বাসায় ছিলেন না। পরে তাদের দত্তক মেয়ে ফাইজা রশিদ ও ছেলে সাবিক নূর রশিদের বক্তব্যের ভিত্তিতে পুলিশ ঘটনাটিকে অপমৃত্যু মৃত্যু বলে শনাক্ত করে। কোহিনূরের লাশ ময়নাতদন্তের জন্য ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের মর্গে পাঠানো হয়। পরদিন ১১ এপ্রিল ময়নাতদন্ত শেষে (নম্বর ৪৫০/২০২৩) তাকে মিরপুর শহীদ বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে মায়ের কবরে দাফন করা হয়।

ক্যাপ্টেন সালাউদ্দিন অভিযোগ করে বলেন, খবর পেয়ে তিনি ওই বাসায় যান। সেখানে দেখেন, কোহিনূরের গলায় ফাঁসের কোনও চিহ্ন ছিল না। ঘাড় ও মেরুদণ্ডের জয়েন্ট ভাঙা ছিল না। চোখ ও জিব বের হয়নি। মুখের লালাও পড়েনি। পরনের কাপড় শুকনা ছিল এবং হাত-পা ও চেহারা স্বাভাবিক ছিল। তবে তার থুতনির নিচে সমান্তরাল আনুমানিক পাঁচ সেন্টিমিটার দূরত্বে অর্ধ সেন্টিমিটার গর্তের দুটি জখম ও ঘাড়ে আনুমানিক ১০ সেন্টিমিটার কাটা জখমের চিহ্ন দেখতে পান। যখমের চিহ্ন দেখে মনে হয়েছে, ব্যাটারিচালিত পোর্টেবল স্ট্যানগান, অথবা টেসার জাতীয় হাইভোল্টেজ প্রয়োগকারী ইলেকট্রিক কোনও ইনস্ট্রুমেন্ট ব্যবহার করে কোহিনূরকে মারাত্মক জখম ও অচেতন করা হয়। পরে শ্বাসরোধে তার মৃত্যু নিশ্চিত করে সিলিং ফ্যানের সঙ্গে ঝুলিয়ে রাখা হয়।

তিনি বলেন, ১৪ জুলাই ময়নাতদন্তের প্রতিবেদন পাওয়ার পর ১৫ জুলাই ধানমন্ডি থানায় একটি হত্যা মামলা করেন তিনি।

কে এই কোহিনূর বেগম
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মেসি অনুষদ থেকে স্নাতকোত্তর পাস করেন কোহিনূর বেগম। দেশের স্বনামধন্য একাধিক ওষুধ কোম্পানিতে চাকরি করেন কোহিনূর। তিনি ছিলেন একজন অবসরপ্রাপ্ত ফার্মাসিস্ট। তার বাবা মুহম্মদ রহমতুল্লাহ যশোরের অবসরপ্রাপ্ত সাব-ডেপুটি কালেক্টর ও যশোর জেলা জজ কোর্টের সম্মানসূচক ম্যাজিস্ট্রেট ছিলেন। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে দুই ছেলেসহ শহীদ হন তিনি। কোহিনূরের বড় ভাই এ বি এম খালেদ তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হিসাববিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ছিলেন। আরেক ভাই ক্যাপ্টেন সালাহউদ্দিন মু. রহমতুল্লাহ বর্তমানে বেসামরিক বিমান চলাচল ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের বিমান দুর্ঘটনা তদন্ত কমিটির প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।

কোহিনূর বেগম প্রথমে টিবিএল ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানিতে প্রোডাক্ট অফিসার হিসেবে যোগদান করেন। পরে এসিআই ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানির মার্কেটিং অফিসার, তারও পরে রেনাটা ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানিতে মার্কেটিং ম্যানেজারের পদে প্রায় ১০ বছর কর্মরত ছিলেন।

ক্যাপ্টেন সালাউদ্দিন মু. রহমতুল্লাহ বলেন, দীর্ঘ দিনেও সন্তান না হওয়ায় চার দিন বয়সী ফাইজা রশিদকে দত্তক নেন কোহিনূর। এর তিন বছর পর তার গর্ভে ছেলে সাবিক নূর রশিদের জন্ম হয়। দুই শিশু সন্তানকে মানুষ করতে তিনি জীবনের সর্বোচ্চ চেষ্টা করেন। কিন্তু চাকরির কারণে সন্তানদের সময় দিতে না পারায় সন্তানরা বিপথে চলে যায়। আর দত্তক মেয়ে পুরোই বিপথে চলে যায়। পরে চাকরি ছেড়ে দিয়ে কোহিনূর সন্তানদের সময় দিতে থাকেন। কিন্তু সেটা আর হয়ে ওঠেনি। উল্টো দত্তক মেয়ে ফাইজা মায়ের গায়েও হাত তুলতো। নীরবে প্রশ্রয় দিতেন বাবা অধ্যাপক মামুন রশীদ।

তদন্ত কর্মকর্তার বক্তব্য
মামলার তদন্ত কর্মকর্তা পিবিআইয়ের এসআই শাহীন মিয়া বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, তদন্তের দায়িত্ব নেওয়ার পর আসামিদের গ্রেফতার করে জেলহাজতে পাঠানো হয়েছে। পরে তাদের জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আদালত এক দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন। নিহতের স্বামী মামুন রশীদকে রিমান্ডে এনে, আর মেয়ে ফাইজা রশিদকে জেলগেটে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। নিহতের ছেলের কাছেও ঘটনার বিষয়টি জানতে চাওয়া হয়েছে।

শাহীন মিয়া বলেন, ময়নাতদন্তের প্রতিবেদন অনুযায়ী কোহিনূর বেগমকে শ্বাসরোধে হত্যা করা হয়েছে বলে জানা গেছে। তবে হত্যাকাণ্ডের রহস্য উদঘাটনে তারা কাজ করছেন। এখনও পর্যন্ত বাইরের কারও সম্পৃক্ততা পাওয়া যায়নি। তদন্ত শেষ করতে কিছু সময় লাগতে পারে বলেও জানান তিনি।

/এপিএইচ/এনএআর/
সম্পর্কিত
পঞ্চগড় সীমান্তে ২ বাংলাদেশিকে হত্যা: মরদেহ ফেরত দিলো বিএসএফ
চাঁদপুরে স্ত্রীকে পুড়িয়ে হত্যায় অভিযুক্ত স্বামী যশোরে গ্রেফতার
সীমান্তে হত্যাকাণ্ড বন্ধ করার দাবি জানিয়েছে বাসদ
সর্বশেষ খবর
গুজরাটের ওপেনিং জুটির রানও করতে পারেনি চেন্নাই
গুজরাটের ওপেনিং জুটির রানও করতে পারেনি চেন্নাই
নিজ মুখে পিএসজি ছাড়ার ঘোষণা দিলেন এমবাপ্পে
নিজ মুখে পিএসজি ছাড়ার ঘোষণা দিলেন এমবাপ্পে
বালবির্নির হাফ সেঞ্চুরিতে পাকিস্তানকে হারালো আয়ারল্যান্ড
বালবির্নির হাফ সেঞ্চুরিতে পাকিস্তানকে হারালো আয়ারল্যান্ড
জমজমাট দ্বিতীয় দিন, পর্দা নামছে আজ
জাতীয় রবীন্দ্রসংগীত উৎসবজমজমাট দ্বিতীয় দিন, পর্দা নামছে আজ
সর্বাধিক পঠিত
২০ মিনিটে লালখানবাজার থেকে বিমানবন্দর, চলবে না অটোরিকশা-বাইক
২০ মিনিটে লালখানবাজার থেকে বিমানবন্দর, চলবে না অটোরিকশা-বাইক
ফোন ছিনতাইয়ের ঘটনায় জিডি নয়, মামলা নেওয়ার নির্দেশ
ফোন ছিনতাইয়ের ঘটনায় জিডি নয়, মামলা নেওয়ার নির্দেশ
চীন বিষয়ে বিশেষজ্ঞকে ঢাকায় রাষ্ট্রদূত হিসেবে পাঠাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র
চীন বিষয়ে বিশেষজ্ঞকে ঢাকায় রাষ্ট্রদূত হিসেবে পাঠাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র
একই গ্রাম থেকে নির্বাচিত হলেন তিন চেয়ারম্যান
একই গ্রাম থেকে নির্বাচিত হলেন তিন চেয়ারম্যান
প্রশ্নফাঁস: বিমানের ডিজিএমসহ ৩০ জনের বিরুদ্ধে সম্পূরক অভিযোগপত্র
প্রশ্নফাঁস: বিমানের ডিজিএমসহ ৩০ জনের বিরুদ্ধে সম্পূরক অভিযোগপত্র