সরকার পতনের এক দফা দাবি আদায়ে বিএনপির ডাকা মহাসমাবেশ সংঘাতের মধ্য দিয়ে পণ্ড হয়েছে। সংঘাত-সংঘর্ষের কারণে থমথমে অবস্থা নয়াপল্টন এলাকায়। রাজধানীর আরামবাগ থেকে নয়াপল্টনের বিএনপির নেতা-কর্মীদের ছত্রভঙ্গ করে দিয়েছে পুলিশ। গ্রেফতার আতঙ্কে নয়াপল্টন এলাকা ছেড়েছেন বিএনপির নেতাকর্মীরা।
শনিবার (২৮ অক্টোবর) সকাল থেকেই দলীয় কার্যালয়ের সামনে সরকার পতনের এক দফা দাবিতে মহাসমাবেশে যোগ দিতে আসেন নেতাকর্মীরা। ফকিরাপুল হতে বিজয়নগর পানির ট্যাংকি ও কাকরাইল মোড় পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ে বিএনপির নেতাকর্মীদের ভিড়।
একদিন আগেই শুক্রবার রাত থেকেই রাজধানীর নয়াপল্টনে দলীয় কার্যালয়ের সামনে জড়ো হয় বিএনপির মাঠ পর্যায়ের কর্মীরা। আগত এসব কর্মীর অধিকাংশ ঢাকার বাইরে থেকে এসেছেন। তবে ঢাকার প্রবেশপথগুলোতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নজরদারি এড়াতে নানান কৌশল অবলম্বন করেছেন অনেকেই।
এদিন বেলা সাড়ে ১১টার দিকে মগবাজারের হয়ে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা পিকআপে গুলিস্তানের দিকে যাচ্ছিলেন। তাদের গাড়ি কাকরাইল মোড়ে আসলে পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। সেই রাস্তায় বিএনপি কর্মীরা অবরোধ করে অবস্থান নেওয়ায় আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের গাড়ি আটকে যায়। তারপর সেখানে দুপক্ষের মধ্যে সংঘর্ষ শুরু হয়। সে সময়ে সংঘর্ষে কয়েকটি গাড়িও ভাঙচুর করা হয়।
পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে কাকরাইল মোড়ে কাঁদানে গ্যাস নিক্ষেপ করে পুলিশ। এরমধ্যে দিয়ে সংঘাত আরও বাড়তে শুরু করে। কাকরাইল মোড়ে ট্রাফিক পুলিশের একটি বক্সে বেলা সোয়া ১টার দিকে আগুন দেয় বিএনপির ক্ষুব্ধ নেতা-কর্মীরা। ইনস্টিটিউট অব ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার্স বাংলাদেশ (আইডিইবি) ভবনের সামনে রাখা গাড়িতেও আগুন দেয় তারা।
যতই সময় গড়িয়েছে, এই সংঘর্ষ বাড়তে থাকে। এক পর্যায়ে প্রধান বিচারপতির বাসভাবনে বিএনপি নেতাকর্মীরা ইট-পাটকেল ছুঁড়তে থাকে। বেশ কয়েকজন ফটক খুলে ভেতরে প্রবেশ করে। পুলিশ বাধা দিতে গেলে বিএনপির নেতাকর্মীদের সঙ্গে সংঘর্ষ বাঁধে। এই ঘটনার রেশ ধরে বিএনপির নেতাকর্মীদের সঙ্গে আইনশৃঙ্খলাবাহিনীর থেমে থেমে সংঘর্ষ চলে। তাদের ছত্রভঙ্গ করতে বেশ কয়েক দফায় টিয়ারশেল ছোড়া হয়। এ সময় বেশ কয়েকটি মোটরসাইকেলেও আগুন দেয় বিএনপি সমর্থকরা।
এদিকে বিকালের দিকে কাকরাইল মোড়ে ছোড়া টিয়ারশেল ও সাউন্ড গ্রেনেডের শব্দে মঞ্চের সামনে নেতাকর্মীরা দাঁড়িয়ে যান। মঞ্চের অপর পাশের রাস্তায় থাকা কর্মীরা সরে ফকিরাপুলের দিকে যেতে থাকেন। পরক্ষণেই আবার কিছু কর্মী লাঠি হাতে সংঘর্ষের স্থানের দিকে যেতে থাকেন। আর কিছু নেতাকর্মী অবস্থা পর্যবেক্ষণের জন্য উদ্বিগ্ন অবস্থায় মঞ্চের সামনেই দাঁড়িয়ে থাকেন। এসময় মঞ্চ থাকা নেতাকর্মীরা বক্তব্য বন্ধ করে দেন।
বেলা ৩টার দিকে পরিস্থিতি আরও অবনতি ঘটতে থাকে। পুলিশ বিএনপির সমাবেশের দিকে টিয়ারশেল নিক্ষেপ করতে থাকে। বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর নয়াপল্টনের মঞ্চ থেকে হ্যান্ডমাইকে হরতালের ঘোষণা দেন। রবিবার (২৯ অক্টোবর) সারা দেশে সকাল-সন্ধ্যা হরতালেল ডাক দেন তিনি। মির্জা ফখরুল ইসলাম অভিযোগ করেন, নয়াপল্টনে বিএনপি’র শান্তিপূর্ণ মহাসমাবেশে ‘আওয়ামী লীগ ও পুলিশের যৌথ হামলা চালিয়েছে’ ।
এদিকে বিএনপি ও সমমনা দলগুলোর সমাবেশকে কেন্দ্র সংঘর্ষে এক পুলিশ কনস্টেবল মারা গেছেন। এছাড়াও আহত হয়েছেন আরও অন্তত ৭০ পুলিশ সদস্য। ডিএমপির মিডিয়া বিভাগ থেকে জানানো হয়, নিহত পুলিশ কনস্টেবলের নাম পারভেজ। তার গ্রামের বাড়ি মানিকগঞ্জে দৌলতপুর।। শনিবার (২৮ অক্টোবর) বিকাল ৪টার দিকে গুরুতর আহত অবস্থায় তাকে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে নিয়ে গেলে চিকিৎসক পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে সোয়া ৪টায় মৃত ঘোষণা করেন।
সন্ধ্যা সাড়ে ৭টার দিকে পল্টন থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ওসি সালাউদ্দিন মিয়া বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, দিনভর দফা দফায় বিএনপি নেতাকর্মীদের সঙ্গে সংঘর্ষের পর এখন পরিস্থিতি স্বাভাবিক রয়েছে। তারপরও নিরাপত্তার স্বার্থে বিভিন্ন জায়গায় অতিরিক্ত পুলিশ নিয়োজিত রয়েছে।
তিনি বলেন, পুলিশ হত্যাসহ বিভিন্ন অপরাধের কারণে একাধিক মামলা হতে পারে। মামলা দায়ের হলে পরে এ বিষয়ে এবং অভিযুক্ত কারা- তা জানানো সম্ভব হবে।
র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেছেন, র্যাবের গোয়েন্দারা গণমাধ্যম থেকে পাওয়া ফুটেজ, সিসিটিভি ফুটেজসহ বিভিন্ন বিষয় বিশ্লেষণ করে সংঘর্ষে এবং হামলার সঙ্গে জড়িত দুষ্কৃতিকারী ও সন্ত্রাসীদের শনাক্ত করে আইনের আওতায় নিয়ে আসতে কাজ করে যাচ্ছে।
এদিকে রাতের রাজধানীতে আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে ১১ প্লাটুন বিজিবি মোতায়েন করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন বিজিবির সদর দফতরের জনসংযোগ কর্মকর্তা শরিফুল ইসলাম। তিনি বলেন, ইতোমধ্যে বিজিবি সদস্যরা রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় কাজ শুরু করেছে।
প্রধান বিচারপতির বাসভবন ঘিরে চার প্লাটুন বিজিবি মোতায়েন রয়েছে। দুপুরের পর থেকেই তারা সেখানে ছিলেন। রাতেও তারা থাকবেন। অন্যদিকে রমনা এলাকায় এক প্লাটুন, নয়াপল্টনসহ আশেপাশের এলাকায় দুই প্লাটুন, সচিবালয়ের নিরাপত্তায় দুই প্লাটুন ও মতিঝিল এলাকায় দুই প্লাটুন বিজিবি সদস্য মোতায়েন রয়েছে। উদ্ভূত যেকোনও পরিস্থিতি মোকাবিলায় তারা প্রস্তুত রয়েছে বলে জানিয়েছে বিজিবি।
সংঘর্ষের জন্য বিএনপিকে দুষছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল। তিনি বলেন, সমাবেশ পণ্ড করা হয়েছে— বিএনপির এই অভিযোগ রাজনৈতিক উদ্দেশ্যেপ্রণোদিত। মানুষের মনে আতঙ্ক সৃষ্টির জন্য সমাবেশ শুরুর আগে সকাল থেকেই তারা সংঘর্ষ শুরু করেছে। প্রধান বিচারপতির বাড়িতে হামলা নজিরবিহীন ঘটনা। হামলায় জড়িতদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।