X
শনিবার, ২৮ জুন ২০২৫
১৩ আষাঢ় ১৪৩২

হাতিরঝিলে ডুবছে ঢাকা!

শাহেদ শফিক
৩০ জুলাই ২০১৭, ১০:০৫আপডেট : ৩০ জুলাই ২০১৭, ১৫:৪৫

হাতির ঝিল রাজধানীর ব্যয়বহুল হাতিরঝিল প্রকল্পের মূল লক্ষ্য ছিল যানজট নিরসন, বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ, জলাবদ্ধতা ও বন্যা প্রতিরোধ, ময়লা পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থার উন্নয়ন এবং সৌন্দর্য বৃদ্ধি করা। কিন্তু এখন জলাবদ্ধতা নিরসনে প্রকল্পটির কোনও ভূমিকা দেখা যাচ্ছে না। উল্টো হাতিরঝিলের কারণে সামান্য বৃষ্টি হলেই নগরের বড় অংশজুড়ে জলজট দেখা দিচ্ছে। নগর পরিকল্পনাবিদ, ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন ও হাতিরঝিল কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলে এ তথ্য পাওয়া গেছে।

হাতিরঝিল প্রকল্প সূত্র জানিয়েছে, ৯টি মেকানিক্যাল স্ক্যানারের মাধ্যমে ঝিলের আশপাশের এলাকার বাসাবাড়ির ও বৃষ্টির পানি ঢাকা ওয়াসার ড্রেনের মাধ্যমে হাতিরঝিলে অপসারিত হয়। কিন্তু নগরজুড়ে ৫০ মিলিমিটারের ওপরে বৃষ্টি কিংবা টানা বর্ষণ হলে এই স্ক্যানারগুলো পানির চাপ সামলাতে পারে না। তখন পানি জমাট বেঁধে পুরো এলাকা প্লাবিত হয়। গত বুধবারের বৃষ্টিতে ঢাকা মহানগরীর প্রধান অংশে যে পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়, তার প্রধান কারণ এটি।

এ বিষয়ে হাতিরঝিল প্রকল্প পরিচালক জামাল আক্তার বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘হাতিরঝিল দিয়ে যে পানি অপসারিত হয়, আমরা তা মেকানিক্যাল স্ক্যানারের মাধ্যমে পরিষ্কার করে হাতিরঝিলে প্রবাহিত করি। কিন্তু অতিবৃষ্টি হলে এই স্ক্যানারগুলো পানির চাপ সামলাতে পারে না। অতিরিক্ত লোডের কারণে তখন বাধ্য হয়েই স্ক্যানারগুলোর ঢাকনা উন্মুক্ত করে দিতে হয়। ফলে বাসাবাড়ির ময়লা আবর্জনাযুক্ত পানি ঝিলে পড়ে তার পরিবেশ নষ্ট করে।’

হাতিরঝিলে ডুবছে ঢাকা!

তিনি আরও বলেন, ‘হাতিরঝিলের পানি দূষণ রোধ করতে হলে স্টর্ম ড্রেনেজ ও রেইন ওয়াটার ড্রেনেজ আলাদা করতে হবে। কিন্তু ওয়াসা সে দিকে নজর দিচ্ছে না। দু’টি লাইন আলাদা করা গেলে সমস্যাটি হতো না। তখন আমরা বৃষ্টির পানি সরাসরি হাতিরঝিলে ছেড়ে দিতে পারতাম। কারণ, বৃষ্টির পানিতে ময়লা আবর্জনা থাকে না। আর স্যুয়ারেজ লাইনের পানি শোধন করতে বেশি সময় লাগত না। এখন স্যুয়ারেজের পানি ও বৃষ্টির পানি এক হয়ে যাওয়ায় সব পানিকেই স্ক্যান (পরিশোধন) করতে হয়।’

তার মতে, রাজধানীতে খাল ও ড্রেনেজ ব্যবস্থা অকেজো হয়ে পড়ায় সামান্য বৃষ্টি হলেই তীব্র জলাবদ্ধতা দেখা দেয়। এতে নগরজুড়ে বৃষ্টি ও স্যুয়ারেজের প্রচুর পানি জড়ো হয়ে যায়। একই সময়ে এত পানি পরিষ্কার করতে পারবে না হাতিরঝিল প্রকল্পের স্ক্যানার।

রাত থেকে শুরু হওযা বৃষ্টিতে ২৬ জুলাই রাজধানীর প্রধান প্রধান সড়কে এভাবে পনি জমেছিল

বুয়েটের সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের প্রধান অধ্যাপক মজিবুর রহমান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আমরা শুরু থেকেই বলে আসছি হাতিরঝিলে পানি প্রবেশে যে ৯টি সংযোগ স্থাপন করা হয়েছে সেই সংযোগে পানি দিতে ওয়াসার ড্রেনগুলোর ক্যাপাসিটি একেবারেই নেই। এতে ঠিকমতো পানি সরবরাহ হয় না। যে কারণে জলজটের সৃষ্টি হয়। ঢাকা ওয়াসার যেসব ড্রেন রয়েছে সেগুলো কঠিন বর্জ্যে ভরাট হয়ে গেছে। গত ৪০ বছরে তারা ড্রেনেজ সিস্টেমের কোনও উন্নয়ন করেনি। যে কারণে বেশি বৃষ্টি হলে মেকানিক্যাল স্ক্যানারগুলো খুলে দিতে হয়। এতে হাতিরঝিলের পরিবেশ ও পানি নষ্ট হয়।’

হাতির ঝিলের স্লুইচ গেট

তিনি আরও বলেন, ‘আমাদের পরামর্শ ছিল, বর্জ্য পানি শোধনের জন্য একটি বর্জ্য ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট স্থাপনের। এটি রামপুরা ব্রিজ থেকে পাঁচ কিলোমিটার দূরে স্থাপনের কথা ছিল। এই প্ল্যান্ট পানি শোধন করে ছেড়ে দেবে। কিন্তু তখন কেউ তা আমলে আনেনি।’ ড্রেনেজ সিস্টেমের উন্নতি করা না হলে মেকানিক্যাল স্ক্যানার ব্যবস্থাটি কতদিন সচল থাকে, তা নিয়েও সংশয় প্রকাশ করেন তিনি।

ঢাকা ওয়াসার তথ্য মতে, বর্তমানে ধানমন্ডি থেকে রামপুরা পর্যন্ত বিশাল এ এলাকা থেকে ওয়াসার স্যুয়ারেজ লাইনের মাধ্যমে প্রতিদিন প্রায় ৬ লাখ ঘন লিটার সলিড বর্জ্য হাতিরঝিলে নির্গত হয়ে ঝিলের মাধ্যমেই রামপুরা ব্রিজের নিচ দিয়ে চলে যেত বালু নদী হয়ে শীতলক্ষ্যায়। গত ১৬ জুলাই ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে কাওরান বাজার ও তার আশপাশের জলাবদ্ধতার জন্য হাতিরঝিল ও কাওরান বাজারের মধ্যবর্তী এফডিসি ফ্লাইওভারকে দায়ী করা হয়। ফ্লাইওভারটির কারণে এই এলাকার পানি অপসারণের সংযোগটি বন্ধ হয়ে গেছে। ফলে বৃষ্টি হলে পুরো এলাকায় জলজটের সৃষ্টি হয়। 

রাস্তায় পানি জমে যাওয়ায় ছিল তীব্র যানজট

হোটেল সোনারগাঁও সংলগ্ন হাতিরঝিলের মেকানিক্যাল স্ক্যানারটির ভেতর দিয়ে কাওরান বাজার, পান্থপথ, ধানমন্ডি, কলাবাগান, কাঁঠালবাগান ও বাংলামটরসহ আশপাশের এলাকার বৃষ্টি ও স্যুয়ারেজ লাইনের পানি অপসারণ হতো। কিন্তু গত বুধবারের মাত্র ৬৫ মিলিমিটার বৃষ্টিতে পুরো এলাকা তলিয়ে যায়। একই চিত্র দেখা গেছে হাতিরঝিল সংলগ্ন মগবাজার, মধুবাগ, উলন, মহানগর প্রজেক্ট, দাসপাড়া, রামপুরা, মেরুল, বাড্ডা, গুলশান ও তেজগাঁও এলাকায়। তখন এই স্ক্যানারগুলো পানির চাপ সামলাতে পারেনি। যে কারণে এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে।

এ বিষয়ে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসির) অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী আসাদুজ্জামান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘হাতিরঝিলে পানি প্রবেশের যেসব স্লুইসগেট (মেকানিক্যাল স্ক্যানার) রয়েছে সেগুলো দিয়ে পর্যাপ্ত পানি যেতে পারে না। এর প্রতিটিতে তিনটি করে পানি স্ক্যানের ব্যবস্থা আছে। এতে পানির স্বাভাবিক গতি একটু বাধাগ্রস্ত হয়। তাছাড়া, গেটগুলোর মুখও যথেষ্ট প্রশস্ত নয়। যে কারণে বেশি বৃষ্টি হলে পানির চাপ নিতে পারে না। পরে মুখ খুলে দিতে হয়। এ কারণে গত বুধবার এই এলাকাজুড়ে এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে।’

কাওরান বাজারে জলাবদ্ধতার কারণে ভোগান্তি পড়েন পথচারীরা

গত বুধবার পুরো নগরীতে যখন ‘বন্যা’ পরিস্থিতি, তখনও হাতিরঝিল ঘুরে দেখা গেছে, ঝিলে পানি প্রবাহের কোনও বেগ নেই। অত্যন্ত ধীরগতিতে পানি প্রবাহিত হচ্ছে। অথচ এ প্রকল্পের লক্ষ্য ছিল ঢাকা শহরের বৃষ্টির পানি হাতিরঝিলে দরকার মতো আটকে রাখা হবে এবং বন্যাপরবর্তী সময়ে তা রামপুরা ব্রিজের অংশ দিয়ে বালু নদী হয়ে শীতলক্ষ্যায় ছেড়ে দেওয়া হবে। এটি ভূগর্ভস্থ পানির নেমে যাওয়া স্তর পূরণে সহায়ক ভূমিকা রাখবে। 

এ বিষয়ে বুয়েটের অধ্যাপক মজিবুর রহমান বলেন, ‘প্রকল্পের ডিজাইনের সময় হাতিরঝিলকে ঢাকার ড্রেনেজ ব্যবস্থার একটা সমাধান হিসেবে ধরা হয়েছিল। বৃষ্টি বা বন্যা হলে পানি আসবে এবং হাতিরঝিল তা ধারণ করবে। পরে নদীর পানি যখন কমবে তখন ছেড়ে দেওয়া হবে। মূলত এটি বিনোদন কেন্দ্র ছিল না। পরে বিনোদন কেন্দ্র হয়ে গেছে।’

রাস্তায় পানি জমে যাওয়ায় ভ্যানে করে পার হয় লোকজন

হাতিরঝিল প্রকল্পটি ২০০৭ সালের অক্টোবরে একনেকে অনুমোদন দেওয়া হয়। ৩ বছর মেয়াদের এ প্রকল্পটি প্রথমে ২০১০ সালের জুনের মধ্যে শেষ হওয়ার কথা থাকলেও এর কাজই শুরু হয় ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে। পরে প্রকল্পটি সংশোধন করে আরও দেড় বছর সময় ও বরাদ্দ বাড়ানো হয়। প্রকল্প ব্যয় এক হাজার ৯৭১ কোটি ৩০ লাখ টাকার মধ্যে বাস্তবায়নকারী সংস্থা রাজউকের এক হাজার ১১৩ কোটি ৭ লাখ, এলজিইডির ২৭৬ কোটি এবং ঢাকা ওয়াসার ৮৬ কোটি ৬৭ লাখ ৫০ হাজার টাকা রয়েছে। ২০১৩ সালের ২ জানুয়ারি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা হাতিরঝিল প্রকল্পের উদ্বোধন ও জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত করেন। এটি বাস্তবায়ন ও তদারকি করছে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর স্পেশাল ওয়ার্কস অরগানাইজেশন (এসডব্লিউও)।

/এসএস/এএম/টিএন/

সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
কেন্দ্রে পদত্যাগপত্র পাঠালেন এনসিপির রাজশাহী জেলার প্রধান সমন্বয়কারী
কেন্দ্রে পদত্যাগপত্র পাঠালেন এনসিপির রাজশাহী জেলার প্রধান সমন্বয়কারী
পড়াশোনার জন্য শাসন করায় স্কুলশিক্ষার্থীর ‘আত্মহত্যা’
পড়াশোনার জন্য শাসন করায় স্কুলশিক্ষার্থীর ‘আত্মহত্যা’
চীন সফর ছিল রাজনৈতিক: দেশে ফিরে মির্জা ফখরুল
চীন সফর ছিল রাজনৈতিক: দেশে ফিরে মির্জা ফখরুল
রাজস্ব বিভাগের সকল কর্মকর্তা-কর্মচারীদের কাজে মনোনিবেশের নির্দেশ
রাজস্ব বিভাগের সকল কর্মকর্তা-কর্মচারীদের কাজে মনোনিবেশের নির্দেশ
সর্বাধিক পঠিত
বিরোধীদের নিষিদ্ধ করা বাংলাদেশের গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের পথ নয়: দ্য ইকোনমিস্ট
বিরোধীদের নিষিদ্ধ করা বাংলাদেশের গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের পথ নয়: দ্য ইকোনমিস্ট
ভাঙা হলো বিজয় সরণির ‘মৃত্যুঞ্জয়ী প্রাঙ্গণ’, হবে জুলাই স্মরণে ‘গণমিনার’
ভাঙা হলো বিজয় সরণির ‘মৃত্যুঞ্জয়ী প্রাঙ্গণ’, হবে জুলাই স্মরণে ‘গণমিনার’
যমুনা সেতু থেকে সরিয়ে ফেলা হচ্ছে রেলপথ
যমুনা সেতু থেকে সরিয়ে ফেলা হচ্ছে রেলপথ
মিরপুরে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে সড়ক বিভাজকে উঠে গেলো বাস, একজন নিহত
মিরপুরে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে সড়ক বিভাজকে উঠে গেলো বাস, একজন নিহত
এনবিআরের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের নিজ দফতরে উপস্থিতি ও সেবা নিশ্চিতের নির্দেশ
এনবিআরের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের নিজ দফতরে উপস্থিতি ও সেবা নিশ্চিতের নির্দেশ