X
শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪
১৪ বৈশাখ ১৪৩১

নরসিংদীতে প্রথম প্রতিরোধ বাগবাড়ী-পাঁচদোনার যুদ্ধ

আসাদুজ্জামান রিপন, নরসিংদী
১২ ডিসেম্বর ২০১৭, ১৯:৪০আপডেট : ১২ ডিসেম্বর ২০১৭, ১৯:৪২

নরসিংদীতে প্রথম প্রতিরোধ বাগবাড়ী-পাঁচদোনার যুদ্ধ রাজনৈতিকভাবে অগ্রসরমান নরসিংদী জেলায় মুক্তিযুদ্ধ সংগঠিত হয়েছিল এক অদম্য শক্তি নিয়ে।পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বর্বতার প্রতিশোধ নিতে একদল তরুণ ছাত্র, কৃষক, শ্রমিক অটুট মনোবল নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন মুক্তিযুদ্ধে। মারণাস্ত্রের চেয়ে মনোবলই যে অধিকতর শক্তিশালী পুরো যুদ্ধকালীন সময়ে তার প্রমাণ রেখেছেন নরসিংদীর বীর মুক্তিযোদ্ধারা।

জেলার মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, নরসিংদীর এমন কোনও স্থান নেই যেখানে ৭১-এ শত্রু সেনাদের নিষ্ঠুর ছোবল পড়েনি। ১৯৭১ সালে নরসিংদী জেলার বেশ কয়েকটি স্থানে নির্মম হত্যাযজ্ঞ চালায় পাকিস্তানি বাহিনীর সদস্যরা। স্বাধীনতা যুদ্ধের শুরু থেকেই নরসিংদী জেলায় প্রতিরোধ গড়ে ওঠে।

ঢাকায় ২৫ মার্চের কালো রাত্রিতে আকস্মিক হামলায় বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে সাধারণ মানুষ। সেসময় কয়েকজন বিদ্রোহী বাঙালি ই.পি.আর. ও বেঙ্গল রেজিমেন্টের সৈনিক কোনওরকমে আত্মরক্ষা করে ক্যাপ্টেন (পরে ব্রিগেডিয়ার) মতিউর রহমানের নেতৃত্বে সামান্য অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে ৩১ মার্চ নরসিংদী পৌঁছান। ৩০ মার্চ ময়মনসিংহে নেওয়া সিদ্ধান্ত অনুযায়ী মেজর কে এম (পরে মেজর জেনারেল ও বাংলাদেশ সেনাবাহিনী প্রধান) শফিউল্লাহর নির্দেশে তারা নরসিংদী আসেন। কয়েকদিন পর (৮ এপ্রিল) ক্যাপ্টেন মতিউর পাকিস্তানি বাহিনীকে প্রতিরোধ করার জন্য ঢাকা-নরসিংদী সড়কের বাগবাড়ী কড়ইতলা নামক স্থানে প্রতিরক্ষা ব্যুহ রচনা করেন। কৌশলগত কারণে পরদিনই হানাদার বাহিনী নরসিংদীকে নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নেওয়ার জন্য সেখানে প্রবেশের চেষ্টা করলে প্রতিরোধ গড়ে ওঠে। প্রথমবারের মতো গর্জে ওঠে মুক্তিযোদ্ধাদের মেশিনগান।

৯ এপ্রিল দুপুরের আগেই শুরু হয়ে যায় যুদ্ধ। সন্ধ্যা পর্যন্ত প্রবল যুদ্ধের পর হানাদার বাহিনীর ভারী অস্ত্রশস্ত্রের কাছে টিকতে না পেরে ই.পি.আর ও বেঙ্গল রেজিমেন্টের বাহিনী পেছনে সরে পালবাড়ীতে ক্যাম্প স্থানান্তর করে।

অপরদিকে বেশকিছু ক্ষয়ক্ষতি হওয়ায় পাকিস্তানি বাহিনীও রাতের অন্ধকারে নরসিংদীর দিকে অগ্রসর না হয়ে পিছু হটে। পরদিন ১০ এপ্রিল দুপুরের দিকে পাকবাহিনী মর্টার, রকেট সেল, মেশিনগানসহ ভারী অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত হয়ে ১৫/১৬টি ট্রাক বহর নিয়ে মাধবদী বাবুরহাট পেরিয়ে পাঁচদোনা মোড়ের কাছাকাছি পৌঁছালে পাল বাড়িতে অবস্থানরত মুক্তিযোদ্ধাদের একটি সাহসী দল তাদের ওপর অতর্কিত আক্রমণ চালিয়ে গতিরোধ করে।

বিকাল পর্যন্ত মরণপণ যুদ্ধ করেও পাকিস্তানিবাহিনী সামনে এগুতো ব্যর্থ হয়ে বাবুরহাটের দিকে পিছু হটে। পরে ঢাকা থেকে আরও সৈন্য এনে শক্তি বৃদ্ধি করলে পাকিস্তানি বাহিনী ফের নরসিংদী শহরের দিকে অগ্রসর হতে থাকে।

সীমিত শক্তি নিয়ে রাত ৮টা থেকে ৯টা পর্যন্ত প্রবল যুদ্ধের পর ই.পি.আর বাহিনীর গোলাগুলি শেষ হয়ে যায়। ফলে বাধ্য হয়ে রাতের অন্ধকারে মুক্তি বাহিনীকে অবস্থান ত্যাগ করতে হয়। এ সুযোগে নরসিংদী দখল করে নরসিংদী শহরের টেলিফোন এক্সচেঞ্জ ভবনে প্রধান ঘাঁটি স্থাপন করে পাকিস্তানি বাহিনী। এ প্রতিরোধ যুদ্ধে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন ছুটিতে আসা নৌ সৈনিক নেহাব গ্রামের সিরাজ উদ্দিন আহমেদ। এ যুদ্ধে পাকিস্তানি বাহিনীর বেশ কিছু সংখ্যক সৈনিক হতাহত হয়।অপরদিকে মুক্তি বাহিনীর মাত্র দুই জন সৈন্য জখম হন। ই.পি.আরসহ মাত্র ১২ জন যোদ্ধা এ যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিল বলে শোনা যায়। তাদের সঙ্গে ছিল মাত্র ১টি মর্টার, ১/২টি মেশিনগান, কিছু রাইফেল ও গুলি।

এ যুদ্ধের খবর আকাশ বাণী ও স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে ফলাও করে প্রচার করা হয়েছিল। ইতোপূর্বে ৩ এপ্রিল আকাশ বাণীতে প্রচার করা হয় যে, নরসিংদী থেকে প্রায় ৪ হাজার বাঙালি সৈন্য ও মুক্তিযোদ্ধা ঢাকা আক্রমণের জন্য রওয়ানা হয়েছেন। এ খবর প্রচারিত হওয়ার পরপরই পাকিস্তানি বাহিনী ৪ ও ৫ এপ্রিল বিমান থেকে প্রায় ১ ঘণ্টাব্যাপী নরসিংদী শহরে বোমা বর্ষণ করে। এতে শহরের বাড়িঘর ও দোকানপাট পুড়ে গিয়ে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। এই বিমান হামলায় নরসিংদী শহরের ৪/৫ জন সাধারণ মানুষও মারা যায়।
৭১-’এ বর্তমান জেলা সদরের বিভিন্ন এলাকা থেকে ২৭/২৮ জনকে ধরে নিয়ে পাকিস্তানি সেনাদের ক্যাম্প নরসিংদীর টেলিফোন এক্সচেঞ্জে আটক রাখা হতো। নির্যাতন শেষে তাদের নিয়ে যাওয়া হতো বর্তমান ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের পাঁচদোনা মোড় সংলগ্ন লোহাপুলের নীচে। সেখানে ৪/৫ জনকে বসিয়ে রেখে তাদের সামনে ২০/২২ জনকে গুলি করে হত্যা করে পাকিস্তানি বাহিনী। হত্যা শেষে লোহারপুলের নীচে সবাইকে একসঙ্গে মাটিচাপা দেওয়া হয়।

বোমা বর্ষণ ও নরসিংদী দখলের পর পাকিস্তানি বাহিনীর নির্মম নির্যাতনের ফলে বিক্ষুদ্ধ জনতা আক্রোশে ফুঁসতে থাকে। নরসিংদীর নেতারা ই.পি.আর, বেঙ্গল রেজিমেন্টের বিদ্রোহী সৈন্য এবং যুবক শ্রেণি দ্রুত নরসিংদী শহর ছেড়ে চলে যায়।

৭১ সালে দীর্ঘ ৯ মাস নরসিংদী জেলার বিভিন্ন স্থানে শতাধিক খণ্ড যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছে। ৭১ এর মার্চে ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের একটি কোম্পানি হানাদার বাহিনীকে প্রতিরোধ করতে নরসিংদীতে ই.পি.আর, আনসার ও পুলিশ বাহিনীর সঙ্গে মিলিত হয়। এতে হাজার হাজার ছাত্র জনতা তাদেরকে স্বাগত জানায়। নরসিংদী জেলার বিভিন্ন স্থানে প্রশিক্ষণ কেন্দ্র খুলে শত শত যুবকদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। পরে শুরু হয় প্রতিবাদ. প্রতিরোধ ও চোরাগুপ্তা হামলা। স্থল পথে মুক্তিবাহিনীর প্রবল প্রতিরোধে টিকতে না পেরে৭১ সালের ১২ ডিসেম্বর পাকিস্তানি বাহিনীর পরাজয় ও আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে নরসিংদী পাকিস্তানি হানাদার মুক্ত হয়।

বিভিন্ন খণ্ড যুদ্ধে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর নির্মমতার শিকার হয়ে শহীদ হন নরসিংদীর ১১৬ জন বীর সন্তান। এর মধ্যে নরসিংদী সদরে ২৭, মনোহরদীতে ১২, পলাশে ১১, শিবপুরে ১৩, রায়পুরায় ৩৭ ও বেলাব উপজেলায় ১৬ জন।

মুক্তিযুদ্ধে নরসিংদী জেলা ছিল ২নং সেক্টরের অধীনে সেক্টর কমান্ডার ছিলেন তৎকালীন মেজর জেনারেল সফিউল্লাহ। নরসিংদীকে ৩ নং সেক্টরের অধীনে নেওয়া হলে কামান্ডার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন মো. নূরুজ্জামান।

যুদ্ধকালীন থানা কমান্ডার মুহম্মদ ইমাম উদ্দিন বলেন, ‘বাংলাদেশের অন্যান্য এলাকার মতো নরসিংদী এলাকাও স্বাধীনতা যুদ্ধে বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করে। দেশের উত্তর ও দক্ষিণ পূর্বাংশের সংযোগস্থল মেঘনা বিধৌত নরসিংদী ছিলো মুক্তিযুদ্ধের একটি প্রাণকেন্দ্র। এখানকার জাগ্রত জনতার সচেতনতার জন্যই ২৫ মার্চের কালো রাত্রির সঙ্গে সঙ্গেই স্বতস্ফূর্তভাবে দুর্বার প্রতিরোধ গড়ে উঠেছিল।’

নরসিংদী জেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের কমান্ডার আব্দুল মোতালিব পাঠান বলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে নরসিংদীর মুক্তিযোদ্ধাদের ভূমিকা রয়েছে। সশস্ত্র যুদ্ধে জেলার বিভিন্ন স্থানে শত শত নারী পুরুষকে নির্বিচারে হত্যা করে গণকবর দিয়েছিল পাকিস্তানি বাহিনী। সেই নির্মম হত্যাযজ্ঞের কথা মনে হলে এখনও শিউরে ওঠেন এলাকাবাসী।’

/এআর/
সম্পর্কিত
নানা আয়োজনে রাজধানীবাসীর বিজয় উদযাপন
বিজয় দিবস উপলক্ষে বঙ্গভবনে রাষ্ট্রপতির সংবর্ধনা
জাবিতে আলোকচিত্র প্রদর্শনী
সর্বশেষ খবর
টিভিতে আজকের খেলা (২৭ এপ্রিল, ২০২৪)
টিভিতে আজকের খেলা (২৭ এপ্রিল, ২০২৪)
সাদি মহম্মদ: ভাইয়ের কান্না, বন্ধুর স্মৃতি, সতীর্থদের গানে স্মরণ…
সাদি মহম্মদ: ভাইয়ের কান্না, বন্ধুর স্মৃতি, সতীর্থদের গানে স্মরণ…
খালি বাসায় ফ্যানে ঝুলছিল কিশোরী গৃহকর্মীর লাশ
খালি বাসায় ফ্যানে ঝুলছিল কিশোরী গৃহকর্মীর লাশ
গরমে রেললাইন বেঁকে যাওয়ার শঙ্কায় ধীরে চলছে ট্রেন
গরমে রেললাইন বেঁকে যাওয়ার শঙ্কায় ধীরে চলছে ট্রেন
সর্বাধিক পঠিত
পুলিশের সব স্থাপনায় নিরাপত্তা জোরদারের নির্দেশ
পুলিশের সব স্থাপনায় নিরাপত্তা জোরদারের নির্দেশ
সরকারি না হলেও সলিমুল্লাহ কলেজে অধ্যাপক ১৪ জন
সরকারি না হলেও সলিমুল্লাহ কলেজে অধ্যাপক ১৪ জন
মৌসুমের সব রেকর্ড ভেঙে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা চুয়াডাঙ্গায়
মৌসুমের সব রেকর্ড ভেঙে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা চুয়াডাঙ্গায়
এগিয়েছে ‘ওমর’, চমকে দিলো ‘লিপস্টিক’!
ঈদের ছবিএগিয়েছে ‘ওমর’, চমকে দিলো ‘লিপস্টিক’!
কুষ্টিয়ায় এযাবৎকালের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা
কুষ্টিয়ায় এযাবৎকালের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা