X
শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪
১৩ বৈশাখ ১৪৩১
আন্দামান ভ্রমণ

কালাপানির কেচ্ছা ।। পর্ব ০২

মুহম্মদ মুহসিন
১৩ ডিসেম্বর ২০১৮, ১৩:০৪আপডেট : ১৩ ডিসেম্বর ২০১৮, ১৩:০৮

কালাপানির কেচ্ছা ।। পর্ব ০২ খোলাসা গল্প হলো- ১৮০০ লক্ষ বছর আগে এক মহাপ্রলয়ের মধ্য দিয়ে সাগরবুকে ঠাঁয় নেওয়া এই ভূখণ্ডটি পঞ্চাশ হাজার বছর আগে নিজেকে সমর্পণ করেছিলো মানুষ নামক প্রাণীর কাছে। কিন্তু সেই মানুষগুলো সমর্পিত হয়েছিল কোন রাজ-আজ্ঞার কাছে? এ বিষয়ে অবশ্য খুব বেশি গালগল্প নেই। কারণ সত্যিকার অর্থে এই দ্বীপে নরখাদকদের বাস মর্মে প্রচলিত আদি গল্পটি এ দ্বীপকে বহির্দেশীয় রাজা ও রাজবাহিনী থেকে হাজার বছর ধরে সুরক্ষা দিয়েছে। ফলে বলতে হয় যে, মহাজ্ঞানী  টলেমি এই গল্পটি জারি করে এ দ্বীপের জন্য একটি মহোপকারই করেছিলেন। টলেমির কাছ থেকে পাওয়া এই গল্পের জ্ঞান নিয়ে পরবর্তীতে যারাই এ মুখো হয়েছে তারাই দেখে কিংবা না দেখেই ঐ এক গল্পে ডিটো মেরেছে। তৃতীয় শতাব্দীতে কাশ্মীরি কবি ক্ষেন্দ্র (Kshendra) তার ‘বোধিসত্ত্বা ভাবদশাকল্পতা’ বইয়ে লিখলেন—আন্দামানের লোকেরা উলঙ্গ এবং বুনো। ৬৭৩ সালে চীনা পরিব্রাজক ইৎসিং লিখলেন—আন্দামানের লোকেরা উলঙ্গ ও নরখাদক। ১২৯০ সালে মার্কো পোলো লিখলেন—আন্দামানে পশুর মতো এক জাতীয় মানুষ থাকে। মহাজ্ঞানীদের দ্বারা বিতরণকৃত এইসকল জ্ঞানের ওপর আস্থা থাকার কারণেই আন্দামানের পশুদের রাজা হওয়ার জন্য বহিবিশ্বের মানুষের রাজারা খুব একটা কেউ খায়েশ করেনি।

তবে আমাদের দক্ষিণ ভারতের এক রাজা রাজেন্দ্র চোল সম্পর্কে শোনা যায় যে, উনি নাকি অনেক খায়েশ নিয়ে বিশাল সাগরের ঐ দিকটায় পাড়ি দিয়েছিলন। তবে মনে হয় ভয়-টয় পেয়েই তার বাহিনী ফিরে এসেছিল। কারণ, ১০৫০ সালের তাঞ্জোর লিপিতে দেখা যায়, সেখানে লেখা আছে—আন্দামান হলো এক অসভ্যতার দেশ এবং নরখাদকদের দেশ। অবশ্যই অসভ্য নরখাদকদের রাজা হওয়ার খায়েশ তার বেশিদিন টেকেনি।

আন্দামান নিয়ে দুনিয়ার বড় বড় ছত্তার ভাইদের বলা এই গল্প উল্টে দিয়ে আরেক ধরনের ছত্তার ভাই ধাঁচের গল্প ফাঁদার প্রয়াস পেয়েছিলেন ড. জে. এ্যান্ডারসন। ড. গোমিলি ক্যারোরির বরাতে তিনি তাঁর বইয়ে লিখেছিলেন যে, আন্দামান হলো এক স্বর্ণ উৎপাদনকারী দ্বীপ। এই কথা শুনে ১৭১১ সালে প্রথম এই দেশে ফরাসিরা উপনিবেশ স্থাপনের লোভ করলো। কিন্তু বৈরী আবহাওয়া তাদেরকে তাড়িয়ে দিলো। ১৭৫৬ সালে ডেনমার্ক এই দ্বীপের প্রথম দখল নিয়েছিল এবং নিকোবরের উত্তর-পূর্ব উপকূলে উপনিবেশ স্থাপন করেছিল। কিন্তু এরাও জলবায়ুর বাধা আর বৈরিতায় সরে যেতে বাধ্য হয়েছিল। ১৭৭৮ সালে অস্ট্রিয়ানরা এখানে উপনিবেশ স্থাপন করেছিল। কিন্তু ইউরোপের অভ্যন্তরীণ যুদ্ধের তাড়নায় শেষ পর্যন্ত তাদেরও চলে যেতে হয়। এদের সবার চলে যাওয়ার পরে আসলো আসল পারঙ্গম কর্তারা। তারা ইংরাজ। কলিকালের আর্য। ১৭৮৯ সালে এসে এই ইংরাজ আর্যরাই শেষ পর্যন্ত স্থায়ী হলো এতদিনের গল্পের নরখাদকদের দেশে। মার্চ ১৯৪২ থেকে ডিসেম্বর ১৯৪৩ পর্যন্ত জাপানিদের হাতে কয়েকদিন জিন্দা-মরা দিয়ে থাকার পরে ব্রিটিশরা আবার এর মালিক হয়ে দাঁড়ালো। আর সেই ব্রিটিশদের কাছ থেকে উত্তরাধিকার সূত্রে ৪৭ এর আগস্টে আন্দামানের মালিক হলো আজকের রামরাজ্য ভারত।

সেই ভারতের আন্দামানে আমি হাওয়াই জাহাজে চড়ে রওয়ানা হয়েছি গল্প দেখতে—সেই সব গল্প, যা এতদিন পড়েছি কেতাবে এবং শুনেছি ছত্তার ভাইয়ের মতো অনেক মুরুব্বিদের বয়ানে। সেই সব গল্প চোখে দেখার বাসনা। কামরূপ কামাখ্যার অভিজ্ঞতা জলজ্যান্তভাবে উদাহরণসহ জানিয়ে যাচ্ছে যে, ও-সব পুরাণের গল্প কেতাবেই থাকে, ওগুলো চোখে দেখা যায় না। তারপরও চলছি চোখে কুহকের স্বপ্ন নিয়ে। তবে এবার যাকে ঘিরে গল্প দেখার ইচ্ছা সেই আন্দামানের সব গল্প কুহকের নয় কিংবা জাদুর নয়। পাড়া-প্রতিবেশীদের চোখে দেখা গল্পেরও এর সাথে কিছুটা যোগ ছিল বলে এবারে ভরসার জায়গাটা একটু বড় ছিল।

আন্দামান নিয়ে আমার প্রতিবেশীদের গল্পে একটি বহুল উচ্চারিত নাম ছিল জোহরা। যারা আমার ‘যবনের তীর্থদর্শন’ পড়েছেন তারা জানেন যে ছোটবেলায় আমার এক অশীতিপর দোস্ত  ছিল যার নাম সেবন খাঁ। তার সূত্রেই আমি  রাবন খাঁর নাতি, সে কথা আগেই বলছি। আমার এই সেবন খাঁ দোস্ত তার বুড়ির সাথে সাথে যখন রেগে যেতেন তখনই তার মুখ থেকে একটা বাক্য বারবার শুনতাম ‘চ্যাচ্ছো কৈলোম অনেক-ঠান্ডা অও, ঠান্ডা অও, না অইলে কৈালো এ্যাকছের জোহরা কোপ কোপামু।’ এই বাক্যের জোহরাটা কে এই নিয়ে এক পর্যায়ে আমার খুব কৌতূহল হলো। ঐ বাড়ির মামা-মামীদের সুবাদে সহজেই জানা গেল এই জোহরা-গল্পের সাথে আমার ছত্তার ভাইয়ের কালাপানির গল্পের সাথে এক সাক্ষাৎ যোগাযোগ রয়েছে।

জোহরা নামক এই মহিলার বাড়ি ছিল আমাদের বাড়ি থেকে দুই তিন বাড়ি পরে। তার জামাতা অর্থাৎ তার মেয়ের স্বামীর নাম ছিল ঈমান খাঁ। জোহরার স্বামী মারা যাওয়ার পরে এক লোকের সাথে তার দ্বিতীয় বিয়ে হওয়ার কথাবার্তা হচ্ছিলো। জামাতা ঈমান খাঁ দেখলো যে, তার শাশুড়ির নতুন ঘরে ছেলে মেয়ে হলে তার (ঈমান খাঁর) স্ত্রী মায়ের পূর্ণ সম্পত্তি পাবে না অর্থাৎ শাশুড়ির নতুন বিয়ে মানেই শ্বশুরবাড়ি থেকে ঈমান খার প্রাপ্য সম্পত্তির একটা বড় অংশ হাত ফস্কে চলে যাওয়া। ফলে ঈমান খাঁ তার শাশুড়িকে বিয়ে করতে সরাসরি নিষেধ করলো। কিন্তু শাশুড়ি শুনলো না। সে বিয়ে করে ফেললো। ক্ষুব্ধ ঈমান খাঁ শশুর বাড়ির উঠানে ওপর ফেলেই খেজুর গাছ কাটা দা দিয়ে তার শাশুড়িকে কোপাতে শুরু করলো। শাশুড়ি যতক্ষণ নড়লো ঈমান খাঁ র দায়ের কোপ ততক্ষণ চললো। কেস হলো, মামলা হলো। বিচারে ঈমান খাঁর কালাপানি হলো। অর্থাৎ ঈমান খাঁকে জাবজ্জীবন কারাদণ্ড ভোগ করতে হবে আন্দামানে। ঈমান খাঁ সুযোগ পেলো তার বউ ছেলে মেয়ে নিয়ে কালাপানিতে দ্বীপান্তরিত হওয়ার। বলা যায় ঈমান খাঁর ভাগ্য খুলেই গেল। শুনেছি ঈমান খাঁর তৃতীয় প্রজন্মের বংশধরেরা কালাপানিতে সম্পন্ন জীবন যাপন করছে। পাশের বাড়ির এই জ্যান্ত গল্প মাথায় অনুরণিত হচ্ছিলো আর ভাবনা হচ্ছিলো—পোর্ট ব্লেয়ারের রাস্তায় সত্যিই যদি এই গল্প আমি কুড়িয়ে পাই! সত্যিই যদি বাজারের ভীড়ে কিংবা বাস টার্মিনালের ছাউনিতে দাঁড়িয়ে হঠাৎ পরিচয় হয়ে যায় এমন একজনের সাথে যে আমাদের পাশের বাড়ির এই ঈমান খাঁর বংশধর!

এমন ভাবছিলাম আর রোমাঞ্চিত হচ্ছিলাম। আমাদের জাহাঙ্গীর ভাইয়ের (Go Air এয়ার লাইনসের প্রতিষ্ঠাতা Jehangir Wadia) হাওয়াই জাহাজখানা ততক্ষণে ভারতের মুখ্যভূমি ছেড়ে বঙ্গোপসাগরের মেঘগুলোর আড়াল ধরে আকাশ ফুঁড়ে ধেয়ে চলছে। শ্লেষ-হাসি ও স্মিত-হাসির গো-এয়ার তন্বীরা খাবারের পসরা নিয়ে প্যাসেঞ্জার-ওয়েতে হাঁটতে শুরু করেছে। দেখে বুকে-জিভে একটু পানিরও উদয় হলো টের পেলাম। কিন্তু সে পানি শুকোতে খুব সময় লাগলো না। আমার খাবারের প্যাকেটটি পেতে  হাত বাড়াবো ভাবছি এমন সময়ই সুরেলা কন্ঠে সুদৃশ্য রমণীটি বললো—Would you like to buy any of our food items? শোনার সাথে সাথে বাড়ানো হাতখানা আপনা আপনি বুকের কাছে চলে এলো। আর ভিতরে মেজাজটা চিলিক মেরে উঠলো। ইচ্ছে হচ্ছিল খাস বরিশাইল্যা ভাষায় বলি- ‘ও মাতারি, তুমি মোর লগে আসতামসা হরো? মোর টিকিটখান যে সোমায় কেনলাম হেই সোমায় এই সব বাহুতরা টাহা সব কাইট্যা রাখতে তোমারে মানা হরছেলে কেডা? হে সোমায় রাহো নায় তো এ্যাহোন এই রহোম নাহের ধারে খাওন ঝুলাইয়া লুচাইয়া লুচাইয়া তোমাগো আইড্যা যাইতে কইছে কেডা?’ কথাগুলো অবশ্য বুক থেকে আর মুখে আনা হয়নি। কারণ, এমনিতেই সবাই বলে বরিশাইল্যাদের মুখ খারাপ। কিছু একটা বলে সেই ধারণাটাকে আরও শক্ত করার দরকার নেই।

বুকের পানি এভাবে শুকিয়ে যাওয়ার পরে তলপেটের পানিও বের হয়ে যাওয়ার সাধ করলো। সেই সাধে সিট থেকে উঠলাম। জাহাজটার পিছনের দিকে টয়লেট। যেতে যেতে দেখলাম অনেকগুলো আসনের সারি খালি। সেখানে পোর্টহোলের পাশের সিটও খালি। যেকাজে উঠেছিলাম, সেটা তড়িঘড়ি করে সেরে এসে বসলাম নতুন শেখা শব্দ ‘পোর্টহোল’র পাশেরই একটা সিটে। নিচের দিকে তাকিয়ে সাগর দেখবো, পানি দেখবো। কিন্তু নিচে তাকিয়ে কিছুতেই বুঝে উঠতে পারছিলাম না নিচে যা দেখছি তা জল নাকি স্থল। ফলে কিছুক্ষণেই ঘাড় বাঁকিয়ে সুনীল সাগররাজ্য দেখার সাধ খতম হলো। ভাবনারাজ্যে আবার ফিরে এলো ১৭৮৯ সালে ইংরেজদের আন্দামান দখলের কর্মকাণ্ড।

ইংরেজদের আন্দামান দখলের ব্যাপারটা ছিল অনেকটা কাঁটা দিয়ে কাঁটা তোলার মতো একটি কাণ্ড। আন্দামানে সোনা মিলবে দিনেমারদের মতো এমন কোনো ধান্ধায় তারা আন্দামানে নেমেছিলো না। আন্দামান থেকে মসলা নিয়ে ব্যবসা করা যাবে এমন ধান্ধাও ইংরেজদের ছিল না। তারা চেয়েছিল দীর্ঘ সমুদ্র যাত্রায় আন্দামানের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় বা আন্দামানে একটু বিশ্রাম নেয়ার সময় আন্দামানিজদের হাত থেকে এবং আন্দামানের বাহির থেকে আসা জলদস্যুদের হাত থেকে নিজেদের নিরাপদ রাখার একটি পাকাপাকি ব্যবস্থা করতে। এমন নিরাপত্তা ব্যূহ নেটিভদের দিয়েই রচনা করা যায় মর্মে ইতোমধ্যেই ১৭৮৭ সালে ইংরাজরা নজির দেখিয়েছেন সুমাত্রার বেংকুইলিনে। এজন্য তাদের দরকার হয়েছে কিছু দুর্ধর্ষ কিন্তু বশংবদ প্রজা যাদেরকে তারা সংগ্রহ করেছে জেল থেকে। সুমাত্রার সফলতাকে পুঁজি করে ঠিক হলো আন্দামানেও এমনটাই করা হবে। ঠিক হলো জেল থেকে বেছে বেছে দুর্ধর্ষ প্রজা ধরে এনে আন্দামানে রাখতে হবে। তাদেরকে দিয়েই আবাদ করা হবে দুনিয়ার সকলের কাছে ভীতিকর এই ভূমি। আন্দামানিজ দুর্ধষদের সাথে এরা লড়াই করবে এবং মরবে। আন্দামানের জঙ্গল পরিস্কার করতে এরা হাড়ভাঙ্গা শ্রম দিবে এবং মরবে। আর এই সব মরামরি ও মারামারি মধ্য দিয়েই গড়ে উঠবে ইংরেজদের নতুন উপনিবেশ আন্দামান। ১৭৮৭ সালে বেংকুইলিনে স্থাপিত পেনাল সেটেলমেন্টের সফলাতার ধারাবাহিকতায় গর্ভনর জেনারেল লর্ড কর্নওয়ালিসের নির্দেশে ১৭৮৯ সালের সেপ্টেম্বর মাসে আন্দামানের চাথাম দ্বীপে ক্যাপ্টেন আর্চিবল্ড ব্লেয়ার ও কর্নেল কোলব্রুক কয়েকটি কয়েদি নিবাস পত্তনের উদ্যোগ নেন। চাথাম দ্বীপ ও আশপাশের কয়েদি পত্তনের পুরো এলাকার তখন নামকরণ হয় পোর্ট কর্নওয়ালিস। পরবর্তীতে এই কয়েদি নিবাস তথা শহরের পরিবর্তিত নাম হয় পোর্ট ব্লেয়ার, যে পোর্ট ব্লেয়ারের উদ্দেশ্যে চলছে আমাদের হাওয়াই জাহাজ।

১৭৮৯ সালের কয়েদি উপনিবেশের উদ্যোগে শেষ পর্যন্ত সফল হয়েছিল না। ১৭৯৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে ভারতীয় বৃটিশ সরকার আন্দামানের এই প্রথম কয়েদি উপনিবেশ বাতিল করে। বাতিল করার এই দিনে পোর্টব্লেয়ারের কয়েদির সংখ্যা ছিল ২৭০ এবং কয়েদি অবস্থা থেকে মুক্তি পেয়ে আন্দামানে বসতির জন্য অনুমতিপ্রাপ্ত বাঙালি ছিল ৫৫০ জন। আন্দামানের কয়েদি উপনিবেশ বাতিল হওয়ায় ২৭০ কয়েদিকে মালেশিয়ার পেনাঙে কয়েদি উপনিবেশে নিয়ে যাওয়া হলো এবং ৫৫০ জন বাঙালিকে বঙ্গদেশে নিয়ে ছেড়ে দেয়া হলো।

পোর্ট ব্লেয়ারে কয়েদি উপনিবেশ পত্তনের দ্বিতীয় দফা উদ্যোগ শুরু হলো ১৮৫৮ সালে, ভারতের প্রথম স্বাধীনতা সংগ্রামের পরের বছর। এ উদ্যোগের শুরুটা হয়েছিল অবশ্য ১৮৫৫ সালের ২৮ নভেম্বর বঙ্গ সরকারের সচিবের নিকট লিখিত এক চিঠির মাধ্যমে। চিঠিতে বলা হয়েছিল যে, আন্দামানের পাশে ইংরেজ জাহাজ ও মাঝে মাঝে বিধ্বস্ত হয়ে যাওয়া জাহাজের নাবিকদেরকে হিংস্র আন্দামানিজদের হাত থেকে এবং জলদস্যুদের হাত থেকে রক্ষার জন্য ব্যবস্থা গ্রহণ প্রয়োজন। এই চিঠির বিপরীতে সরকার ক্যাপ্টেন হেনরি হপকিনসনকে দায়িত্ব দেয় এ বিষয়ে একটি প্রতিবেদন দাখিলের। হপকিনসন ১৮৫৬ সালের ২৯ ফেব্রুয়ারি রিপোর্ট জমা দেন। রিপোর্টে এতদঞ্চলে পুনরায় কয়েদি উপনিবেশ অর্থাৎ পেনাল সেটেলমেন্ট স্থাপনের সুপারিশ করা হয়। যে তারিখে এই রিপোর্ট জমা হয় সেই দিনই আন্দামান উপকূলে কয়েকজন চাইনিজ নাবিক হত্যার এক প্রতিবেদনও জমা হয়। সিদ্ধান্ত হলো পেনাল সেটেলমেন্টর পক্ষে অনুসন্ধান চালানো হবে। এর মধ্যে ১৮৫৭ সালের সিপাহী বিদ্রোহ শুরু হলো। বিদ্রোহ দমন হলে ইংরেজদের হাতে এলো দুর্ধর্ষ কয়েদিদের এক বিশাল ভাণ্ডার, যারা ছিলেন ১৮৫৭ সালে বিদ্রোহী। ফলে পরিকল্পনা জোর-কদম এগোলো। ৪ঠা মার্চ ১৮৫৮ সালে ডা.জে.পি. ওয়াকারের নেতৃত্বে আন্দামানে বসতিস্থাপনের উদ্দেশ্যে কোলকাতা থেকে রওয়ানা হলো ২০০ জন কয়েদি, ১জন ভারতীয় ওভারসীয়ার ও ২জন ভারতীয় ইঞ্জিনিয়ার। সাথে ইন্ডিয়ান নেভির ১ জন অফিসারের পরিচালনায় নেভাল ব্রিগেডের ৫০ জন জওয়ান। এবারও তারা প্রথমে বসতি স্থাপনের চেষ্টা করলো সেই চ্যাথাম দ্বীপে। ডা. জে পি ওয়াকার হলেন আন্দামানের কয়েদি উপনিবেশের প্রথম সুপারইনটেন্ডেন্ট। পরবর্তীতে এই পদের নাম হয় চিফ কমিশনার।

ডা. ওয়াকার ছিলেন যথেষ্ট কামেল ও কাবেল ইংরাজ। তিনি জানতেন কীভাবে হাড্ডিসার দেশীয় বন্দিগুলোর কাছ থেকে কাজ আদায় করতে হয়। দ্বীপে নেমেই সেই হাড্ডিসার কয়েদিগুলোকে তিনি লাগিয়ে দিলেন আল্লাহর জঙ্গল সাফ করে মানুষের জন্য জায়গা তৈরীর কাজে। একদলকে লাগিয়ে দিলেন চ্যাথাম দ্বীপ সাফ করার কাজে। পঁচিশ পঁচিশ করে তিন পঁচিশ পঁচাত্তর জনকে লাগালেন রস আইল্যান্ড সাফ করার কাজে। ১৮৫৮ সালের ৭ মে রস আইল্যান্ড আন্দামানের সদর দপ্তর বা রাজধানী হিসেবে স্বীকৃত হলো। ১৮৫৮ সালের ৮ অক্টোবর ভাইপার আইল্যান্ডও ওয়াকারের কয়েদী কর্মীরা দখলে আনে। তবে প্রথম বসতির তিন দ্বীপ—চ্যাথাম, রস ও ভাইপারের মধ্যে চ্যাথাম থেকে ওয়াকারকে অল্প দিনেই ওয়াক আউট করতে হলো। কারণ ওয়াকার তার কঠিন সাহেবি হুকুম দিয়েও চ্যাথাম দ্বীপে পানির খোঁজ মিলাতে পারলেন না। প্রথম ছোট ছোট তিন দ্বীপে বসতির পরে যখন  ওয়াকারের মনে এ মর্মে সাহস হলো যে, মাশাল্লাহ কয়েদি যা আছে তার দু-দশটা আন্দামানি আদিবসীদের তীরে নাই হয়ে গেলে তাতে কয়েদির মজুদে টান ধরবে না তখন অল্প কিছু করে কয়েদি তিনি ‘মূল ভূখণ্ড’ বর্তমান পোর্ট ব্লেয়ারেও পাঠানো শুরু করলেন। শুরু হলো খুচরো খুচরো দ্বীপ থেকে উঠে এসে আন্দামানের মূল ভূখণ্ডে কয়েদি বসতির কাজ।

সিটের পাশের পোর্টহোলের সুবাদে হঠাৎ টের পেলাম চোখের সামনে থেকে ইতিহাস সরে গিয়ে সবুজ গাছপালার সারি জেগে উঠতে শুরু করেছে। তার মানে বোঝা গেল আমাদের জাহাঙ্গীর ভাইয়ের হাওয়াই জাহাজখানা এবার নিচে নামতে যাচ্ছে। আকাশে দেখার থাকে মেঘ। সেদিনের আকাশে মেঘেরও আনাগোনা ছিল না বলে এতক্ষণ  সত্যিকার অর্থে দেখাদেখির কিছুই ছিল না। এবার নিচে জল-জমি-বৃক্ষের সমাহার দেকে চোখদুটোয় এক পিটপিটে পুলকের অনুভব টের পেলাম। ছোট ছোট দ্বীপগুলোর বৃক্ষরাজির বৃত্তাকার ও অধিবৃত্তাকার পরিধির চারপাশে সাগরের সাদা ফেনাদের  যে অলঙ্কারের কারুকাজে রচনা করতে দেখতে পেলাম তা যুৎসই কোনো কবির চোখে পরড়লে নিশ্চিত কেলেঙ্কারি কাণ্ড হয়ে যেত বলে আমার বিশ্বাস। কারণ, অমন কোনো দৃশ্যের ওপর কোনো কবির চোখ পড়লে সেখানে প্রকৃতির প্রেমভাব, অতপর প্রেমজনিত কবি কল্পনার কামভাব, এবং সেই কামভাবনার মধ্য দিয়ে কাব্যউপমার ডিম্বাণুদের নিষিক্তকরন এবং সবশেষে এই সকল যৌনাচারের স্বাভাবিক নতিজায় কাব্যতনয়-তনয়াদের প্রসবকর্ম ইত্যাদি কেলেঙ্কারি কর্মকাণ্ডের কোনো কিছুই আর রোধ করার সুযোগ থাকতো না। ভাগ্য ভালো, আমার এহেন চোখের অযোগ্যতার সুবাদে এই সকল অযাচার থেকে মুক্ত মস্তিষ্কজগৎ নিয়েই আমি আমার হাওয়াই জাহাজখানার সাথে নেমে আসতে পারলাম আন্দামানের বীর সাভারকার বিমানবন্দরে। (চলবে)

আরো পড়ুন: কালাপানির কেচ্ছা ।। পর্ব ০১ 

//জেডএস//
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
ঘোড়াঘাটে মালবোঝাই দুই ট্রাকের মুখোমুখি সংঘর্ষে ২ জন নিহত
ঘোড়াঘাটে মালবোঝাই দুই ট্রাকের মুখোমুখি সংঘর্ষে ২ জন নিহত
নির্বাচনের সময় জাপায় কী হয়েছিল, জানাবেন জিএম কাদের
শনিবার জাতীয় পার্টির বর্ধিত সভানির্বাচনের সময় জাপায় কী হয়েছিল, জানাবেন জিএম কাদের
১০ কোটি টাকা অনিয়মের অভিযোগে অগ্রণী ব্যাংকের ৩ কর্মকর্তা আটক
১০ কোটি টাকা অনিয়মের অভিযোগে অগ্রণী ব্যাংকের ৩ কর্মকর্তা আটক
থাই প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে শেখ হাসিনাকে উষ্ণ অভ্যর্থনা
থাই প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে শেখ হাসিনাকে উষ্ণ অভ্যর্থনা
সর্বাধিক পঠিত
দুদকের চাকরি ছাড়লেন ১৫ কর্মকর্তা
দুদকের চাকরি ছাড়লেন ১৫ কর্মকর্তা
স্কুল-কলেজে ছুটি ‘বাড়ছে না’, ক্লাস শুরুর প্রস্তুতি
স্কুল-কলেজে ছুটি ‘বাড়ছে না’, ক্লাস শুরুর প্রস্তুতি
খুলনায় এযাবৎকালের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা
খুলনায় এযাবৎকালের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা
ধানের উৎপাদন বাড়াতে ‘কৃত্রিম বৃষ্টির’ পরিকল্পনা
ধানের উৎপাদন বাড়াতে ‘কৃত্রিম বৃষ্টির’ পরিকল্পনা
চুক্তিতে মাউশির ডিজি হলেন নেহাল আহমেদ
চুক্তিতে মাউশির ডিজি হলেন নেহাল আহমেদ