ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ফুলবাড়িয়া বাস টার্মিনালের সাবেক তত্ত্বাবধায়ক ও সহকারী ব্যবস্থাপক মো. গোলাম সরোয়ার। অর্থ আত্মসাৎসহ নানা অনিয়মের অভিযোগে কর্তৃপক্ষ তার বিরুদ্ধে তিনটি বিভাগীয় মামলা দায়ের করে। সেইসব মামলায় আত্মপক্ষ সমর্থন না করে দীর্ঘ পাঁচ বছর আত্মগোপনে থাকেন তিনি। অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় তাকে দোষী সাব্যস্ত করে সরকারের অতিরিক্ত সচিব পর্যায়ের সাবেক দু’জন প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা তার বিরুদ্ধে তিন মামলায় তিনটি চূড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিল করেন। কিন্তু সেই প্রতিবেদন সম্প্রতি উল্টে দেন ডিএসসিসিতে কর্মরত উপসচিব পর্যায়ের একজন বিভাগীয় প্রধান। অভিযুক্ত গোলাম সরোয়ারের বিরুদ্ধে উত্থাপিত অভিযোগের কোনও সত্যতা খুঁজে পাননি তদন্ত কর্মকর্তা! এ নিয়ে নানা প্রশ্ন ওঠায় কর্তৃপক্ষ বিষয়টি ফের তদন্তের উদ্যোগ নিয়েছে বলে জানা গেছে।
অনুসন্ধানে দেখা গেছে, দুর্নীতির অভিযোগ থাকায় দীর্ঘ পাঁচ বছর আত্মগোপনে ছিলেন ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) পরিবহন বিভাগের ফুলবাড়িয়া বাস টার্মিনালের তত্ত্বাবধায়ক গোলাম সরোয়ার। সাময়িক বরখাস্ত থাকা এই কর্মচারী এর আগে সায়েদাবাদ বাস টার্মিনালের তত্ত্বাবধায়ক ও সহকারী ব্যবস্থাপক ছিলেন। অসুস্থতার কারণ দেখিয়ে তার বিরুদ্ধে অভিযোগের শুনানিতে উপস্থিত হতে পারেননি বলে গত বছরের ৬ আগস্ট ও ৯ সেপ্টেম্বর পৃথক দু’টি আবেদন করেন গোলাম সরোয়ার। করপোরেশনের লোকজন তার স্থায়ী বা অস্থায়ী ঠিকানায় গিয়েও তাকে পাননি। প্রসঙ্গত, এই গোলাম সরোয়ারকে নিয়ে গত ৯ মার্চ ‘তিনি পাঁচ বছর পর আবির্ভূত হলেন’ শিরোনামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে বাংলা ট্রিবিউন।
এর আগে গোলাম সরোয়ারের আবেদনের বিষয়ে তদন্ত করার জন্য ডিএসসিসির প্রধান সম্পত্তি কর্মকর্তা মো. আসাদুজ্জামানকে তিনটি বিভাগীয় মামলায় তদন্ত কর্মকর্তা হিসেবে নিযুক্ত করে ডিএসসিসি। ওই কর্মচারী গত ৩ মার্চ তদন্ত কর্মকর্তার কাছে আত্মপক্ষ সমর্থনের জন্য উপস্থিত হন। কিন্তু তদন্ত কর্মকর্তা মো. আসাদুজ্জামান অভিযুক্ত গোলাম সরোয়ারের বিরুদ্ধে উত্থাপিত অভিযোগের কোনও সত্যতা খুঁজে পাননি! আত্মপক্ষ সমর্থনের মাত্র দুই দিনের মাথায় তার বিরুদ্ধে উত্থাপিত তিনটি বিভাগীয় মামলায় আনা অভিযোগগুলো ‘সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয়নি’ বলে গত ৫ মার্চ ১৫ পৃষ্ঠার একটি প্রতিবেদন জমা দেন তদন্ত কর্মকর্তা। যদিও ডিএসসিসির (অতিরিক্ত সচিব পর্যায়ের) সাবেক দুই প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (আনছার আলী খান ও খান মোহাম্মদ বিলাল) সরোয়ারের বিরুদ্ধে উত্থাপিত অভিযোগের সত্যতা পেয়ে প্রতিবেদন দাখিল করেছিলেন। অভিযোগ আছে, ডিএসসিসির সচিবের দফতর দীর্ঘদিন ধরে সরোয়ারের ব্যক্তিগত ফাইল চূড়ান্ত সিদ্ধান্তের জন্য উত্থাপন না করে ফেলে রাখে।
সরোয়ারের দুর্নীতির বিষয়ে ডিএসসিসির কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের মধ্যেও ক্ষোভ রয়েছে। তারা বলছেন, যেখানে দুজন প্রশাসনিক প্রধান তার বিরুদ্ধে উত্থাপিত অভিযোগের সত্যতা পেয়েছেন, সেখানে একজন বিভাগীয় প্রধান কীভাবে সেই প্রতিবেদন সঠিক নয় বলে প্রমাণ করেন? এতে করে দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তারা উৎসাহিত হবেন। এছাড়া তিনটি মামলায় একজন কর্মকর্তাকে পুনঃতদন্তের দায়িত্ব দেওয়ায় সন্দেহ প্রকাশ করেন তারা।
গোলাম সরোয়ারের বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল, তিনি সংস্থার স্বার্থরক্ষা না করে আদালতে মিথ্যা সাক্ষ্য দিয়ে করপোরেশনের হাজার কোটি টাকার সম্পত্তির ক্ষতি, সংস্থার গুরুত্বপূর্ণ দলিলপত্র গায়েব ও ব্যক্তিস্বার্থের জন্য রাজস্ব আদায়ে গাফিলতি করেছেন। এ নিয়ে তার বিরুদ্ধে তিনটি বিভাগীয় মামলার তদন্তেও অভিযোগের সত্যতা পাওয়া গেছে। তাকে আত্মপক্ষ সমর্থনের জন্য একাধিকবার তলব করা হলেও তিনি শুনানিতে হাজির হননি।
ডিএসসিসি সূত্র জানায়, এ অবস্থায় সংস্থার বিধিমালা অনুযায়ী, গোলাম সরোয়ারের চাকরি থাকার কথা নয়। গত পাঁচ বছর কর্মস্থলে অনুপস্থিত থেকে হঠাৎ করে তিনি মেয়র বরাবর আবেদন করে নিজের উপস্থিতি জানান দেন। কর্তৃপক্ষ তার বিরুদ্ধে আবারও তদন্ত শুরু করেছে।
প্রসঙ্গত, গোলাম সরোয়ারের বিরুদ্ধে তিনটি বিভাগীয় মামলা হচ্ছে— সায়েদাবাদ বাস টার্মিনালের ক্যান্টিনের ভাড়া আদায় না করা, সায়েদাবাদ বাস টার্মিনালের মূল নকশা মামলার প্রয়োজনে সঠিক সময়ে সরবরাহ না করা এবং আদালতে মিথ্যা সাক্ষ্য দিয়ে করপোরেশনের ক্ষতি করা। করপোরেশনের রাজস্ব তছরুপ, রাজস্ব আদায়ে ব্যর্থতা এবং ব্যক্তিস্বার্থে সায়েদাবাদ বাস টার্মিনালের বিভিন্ন কাউন্টার বিভিন্ন পরিবহনের নামে অবৈধভাবে বরাদ্দ দেওয়া। কর্তৃপক্ষের অনুমোদন ছাড়া নিজের পছন্দের ব্যক্তিদের নিয়োগ দিয়ে রাজস্ব আদায় করে সংস্থার তহবিলে জমা না দেওয়ারও অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে তদন্ত কর্মকর্তা আসাদুজ্জামান বলেন, ‘এটি সংস্থার অভ্যন্তরীণ বিষয়। আপনাকে বলতে হবে কেন?’ অভিযুক্ত গোলাম সরোয়ারের বক্তব্য জানার জন্য বারবার চেষ্টা করেও তাকে পাওয়া যায়নি।
ডিএসসিসি’র সচিব মোস্তফা কামাল মজুমদার বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘সরোয়ারের বিরুদ্ধে উত্থাপিত অভিযোগের তদন্ত প্রতিবেদনটি আমার কাছে গতকালই (সোমবার) এসেছে। আমরা এখনও সিদ্ধান্ত দিইনি। ফাইলটি আমি ভালো করে স্টাডি করবো।’
আরও পড়ুন: