তার কল্পনার স্পর্শে অদেখা ভুবন থেকে নিশ্চল চরিত্ররা মর্ত্যলোকে নেমে আসে রক্ত মাংসের মানুষ হয়ে, তারপর তীব্রভাবে প্রভাবিত করতে শুরু করে আমাদের দৈনন্দিন জীবনের প্রতিটি ক্ষণকে! আমরা মুগ্ধ হতে থাকি। কখনও না দেখা একজনকে ধারণ করতে শুরু করি নিজের মধ্যে। আমাদের জীবনযাপনের সঙ্গে জড়িয়ে যাওয়া এ ক্ষমতাশালী জাদুকর হচ্ছেন সাহিত্যের কিংবদন্তী হুমায়ূন আহমেদ।
নিজের প্রখর রহস্যময়তার একটি অংশ তিনি ফুটিয়ে তুলেছিলেন সাদাসিধা মিসির আলির মধ্যে। জন্ম নিয়েছিলেন মিসির আলি রূপে। আবার জোছনা ও বৃষ্টি যে হাহাকার সৃষ্টি করে আমাদের মনে, তার সবটুকু উজাড় করে জন্মেছিলেন হিমুর মধ্যে। শুভ্র রূপে জন্মানো পৃথিবীর শুদ্ধতম মানুষ তিনি।
‘যখন হিমুকে নিয়ে কিছু লিখি- নিজেকে হিমু মনে হয়, এক ধরনের ঘোর অনুভব করি’- হিমুকে নিয়ে লেখা এক বইয়ে এভাবেই বলেছিলেন তিনি। হিমুর সঙ্গে তিনি জীবনের মানে খুঁজে বেড়াতেন বৈরাগ্যের বেশ ধরে। তীব্র জোছনার রাতে কল্পনার নদী ময়ূরাক্ষীর পারে হিমুর সঙ্গে মুগ্ধ হয়ে হাঁটতেন। কখনও আষাঢ়ের জলধারায় নিজেকে সমর্পণ করতেন হিমু রূপে। হলুদ পাঞ্জাবি পরা ভবঘুরে হিমুকে ধারণ করেননি, এমন তরুণের সংখ্যা হাতে গোনা। খালি পায়ে ঝাঁ ঝাঁ রোদের দুপুরে উদ্দেশ্যহীন হাঁটা একজন হিমু লাখো তরুণকে নিয়ে যায় এক যুক্তিহীন স্বপ্নের জগতে; যেখানে রয়েছে বর্ণনাতীত স্বাধীনতা, যুক্তি না মানাই সেখানে আসল যুক্তি !হিমুর উড়নচন্ডী স্বভাব, পাগলামি কী এক অদ্ভুত কারণে তীব্র ঘোর সৃষ্টি করে আমাদের মধ্যে।
হিমুর একেবারে উল্টো চরিত্রেও আত্নপ্রকাশ করেছেন হুমায়ূন আহমেদ। তিনি মিসির আলি। প্রখর চিন্তাশক্তি কাজে লাগিয়ে সব ঘটনার পেছনের যুক্তি দাঁড় করান মিসির আলি। মধ্যবয়স্ক এ মানুষটি চিরকাল সব রহস্যের সমাধান করেও আমাদের কাছে এক অমীমাংসিত রহস্য!
পৃথিবীর শুদ্ধতম মানুষটি হচ্ছে শুভ্র। মোটা ফ্রেমের চশমা পরা কানাবাবা অসম্ভব মেধাবী ও সত্যবাদী। কোন অন্যায় কখনও স্পর্শ করেনি তাকে। শিশুর মতই সহজ সরল সুদর্শন শুভ্র হওয়ার স্বপ্ন দেখে কতশত তরুণ!
হুমায়ূনের সৃষ্টি চরিত্রগুলো প্রবলভাবে প্রভাবিত করে আমাদের। মৃন্ময়ীর মন খারাপ থাকলে মুষড়ে পড়ি আমরাও। বৃষ্টি বিলাসের শামার কষ্ট অনুভর করি প্রচণ্ডভাবে। দারুচিনি দ্বীপের জরি হওয়ার ইচ্ছা ধারণ করি হৃদয় দিয়ে। শ্রাবণ মেঘের দিনের কুসুমকে ভালোবেসে ফেলি। হুমায়ূন আহমেদ নিজের সৃষ্টি করা চরিত্রগুলোর পাশাপাশি তীব্র ভালোবাসা ধারণ করেছিলেন প্রকৃতির জন্য। কখনও তেঁতুল বনে ঝরে পরেছেন জোছনা হয়ে। কখনোবা বৃষ্টি বিলাস করেছেন ছায়াবীথির তলে। মধ্যাহ্নের মেঘ রৌদ্র ছায়াকে জুড়িয়ে দিয়েছেন লিলুয়া বাতাসে।
মেঘের উপর বাড়ি বানিয়ে হয়তো এখন অন্যভুবনে বাস করছেন হুমায়ূন আহমেদ। কিন্তু এ রহস্যময় পৃথিবীতে তিনি জন্ম নেন বারবারই। যখনই আকাশে রূপার থালার মতো চাঁদ ওঠে, শ্রাবণের ঝুম বৃষ্টিতে ভেসে যায় প্রকৃতি, সে জোছনা ও বৃষ্টিতে তিনি লাখো তরুণ হয়ে মিশে যান। গভীর রাত কিংবা ঝাঁ ঝাঁ রোদের দুপুরে হাঁটেন হিমুপ্রেমী তরুণের সঙ্গে। তিনি এভাবেই ফিরে আসেন আমাদের জীবনে, বিভিন্ন রূপে।
ছবি: ফয়সাল মাসুম