X
শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪
১৩ বৈশাখ ১৪৩১

চীনের বন্দিশিবিরে যেভাবে সংঘবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হচ্ছেন উইঘুর নারীরা

বিদেশ ডেস্ক
০৫ ফেব্রুয়ারি ২০২১, ১৮:৪৬আপডেট : ০৫ ফেব্রুয়ারি ২০২১, ২০:২৬

চীনের জিনজিয়াংয়ে উইঘুর মুসলিমদের জন্য যেসব 'পুনঃশিক্ষণ' কেন্দ্র পরিচালিত হচ্ছে সেগুলোতে পরিকল্পিতভবে ধর্ষণের শিকার হচ্ছে মুসলিম নারীরা। এই নারীদের একজন হচ্ছেন তুরসুনে জিয়াউদুন। বিবিসি-কে দেওয়া তার এই বর্ণনা কোনও কোনও পাঠককে বিচলিত করতে পারে।

তুরসুনে জিয়াউদুন-এর ভাষায়, ‘তখন কোনও মহামারি চলছিল না। কিন্তু ওই লোকগুলো সবসময়ই মুখোশ পরে থাকতো। তারা স্যুট পরতো, পুলিশের পোশাক নয়। কখনও কখনও তারা আসতো মধ্যরাতের পর। সেলে এসে তারা ইচ্ছেমতো কোনও একজন নারীকে বেছে নিতো। তাদের নিয়ে যাওয়া হতো করিডোরের আরেক মাথায় 'কালো ঘর' বলে একটি কক্ষে। ওই ঘরটিতে নজরদারির জন্য কোনও ক্যামেরা ছিল না।’

জিয়াউদুন বলেন, বেশ কয়েক রাতে তাকে এভাবেই নিয়ে গিয়েছিল ওরা। তার ভাষায়, ‘হয়তো এটি আমার জীবনে এমন এক কলঙ্ক - যা আমি কখনও ভুলতে পারবো না। এসব কথা আমার মুখ দিয়ে বের হোক- এটাও আমি কখনও চাইনি।’

জিনজিয়াং প্রদেশে চীনের এইসব গোপন বন্দি শিবিরের একটি তুরসুনে জিয়াউদুন বাস করেছেন মোট ৯ মাস। তিনি বলছেন, ওই সেলগুলো থেকে প্রতিরাতে নারীদের তুলে নিয়ে যাওয়া হতো, তারপর মুখোশ পরা এক বা একাধিক চীনা পুরুষ তাদের ধর্ষণ করতো। তিনি নিজে তিন বার সংঘবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হয়েছেন। প্রতিবারই দুই বা তিন জন লোক মিলে এ কাজ করে।

‘কোনও দয়ামায়া দেখানো চলবে না’

এসব বন্দিশিবিরে আনুমানিক ১০ লাখেরও বেশি নারী পুরুষকে রাখা হয়েছে। চীনের বক্তব্য, উইঘুর ও অন্য সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের লোকদের পুন:শিক্ষণের জন্যই এসব শিবির। উত্তর পশ্চিম চীনের জিনজিয়াং প্রদেশে তুর্কিক মুসলিম সংখ্যালঘু এই উইঘুরদের সংখ্যা প্রায় ১ কোটি ১০ লাখ।

মানবাধিকার গোষ্ঠীগুলো বলছে, চীনা সরকার উইঘুরদের ধর্মীয় ও অন্য স্বাধীনতা ক্রমেই হরণ করেছে। গণ-নজরদারি, বন্দিত্ব, মগজ ধোলাই এবং জোরপূর্বক বন্ধ্যাকরণ পর্যন্ত করানোর একটি ব্যবস্থা গড়ে তুলেছে তারা।

চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং এই নীতির উদগাতা। ২০১৪ সালে স্বাধীনতাকামী উইঘুরদের চালানো এক সন্ত্রাসী হামলার পর তিনি জিনজিয়াং সফর করেন। এর পরপরই মার্কিন দৈনিক নিউইয়র্ক টাইমসের পাওয়া গোপন দলিল অনুযায়ী, তিনি স্থানীয় কর্মকর্তাদের নির্দেশ দিয়েছিলেন যে, এর জবাবে ব্যবস্থা নেওয়ার সময় ‘কোনও রকম দয়ামায়া দেখানো চলবে না।’

মার্কিন সরকার গত মাসে বলেছে, জিনজিয়াংয়ে চীনের এসব কর্মকাণ্ড গণহত্যার শামিল। চীন একে মিথ্যা ও উদ্ভট অভিযোগ বলে বর্ণনা করেছে। এসব বন্দি শিবিরের ভেতর থেকে বাসিন্দাদের কারও বক্তব্য খুবই দুর্লভ। তবে সাবেক বন্দি ও প্রহরীদের বেশ কয়েকজন বিবিসিকে বলেছেন, তারা পরিকল্পিত সংঘবদ্ধ ধর্ষণ, যৌন নিপীড়ন ও অত্যাচারের শিকার হয়েছেন বা এর প্রমাণ পেয়েছেন।

তুরসুনে জিয়াউদুন এখন যুক্তরাষ্ট্রে থাকেন। জিনজিয়াং থেকে পালিয়ে গিয়ে প্রথম কিছুকাল তিনি ছিলেন কাজাখস্তানে। সেখানে তিনি সার্বক্ষণিক ভয়ের মধ্যে ছিলেন যে, তাকে বোধহয় আবার চীনে ফেরত পাঠানো হবে। তার মনে হতো, তিনি বন্দি শিবিরে যে পরিমাণ যৌন নির্যাতন দেখেছেন ও তার শিকার হয়েছেন- সে কাহিনী সংবাদমাধ্যমকে বললে তাকে জিনজিয়াং ফেরত পাঠানোর পর আরও নির্যাতনের শিকার হতে হবে। তার ওপর এসব ঘটনা বর্ণনা করাও ছিল একটা লজ্জার বিষয়।

জিয়াউদুন যা বলছেন, তা পুরোপুরি যাচাই করা অসম্ভব, কারণ চীনে রিপোর্টারদের ওপর কঠোর বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়। তবে তার বর্ণনার খুঁটিনাটির সঙ্গে জিনজিয়াং বন্দি শিবির সম্পর্কে বিবিসি-র হাতে থাকা অন্যান্য তথ্য ও বর্ণনা মিলে যায়।

কাজাখ নারী গুলজিরা

জিনজিয়াং-এর বন্দি শিবিরে ১৮ মাস ছিলেন, এমন আরও একজনের সঙ্গে বিবিসি-র কথা হয়েছে। তিনি হচ্ছেন কাজাখ নারী গুলজিরা আউয়েলখান। তাকে বাধ্য করা হয়েছিল উইঘুর নারীদের কাপড় খুলে তাদের অর্ধনগ্ন করতে, তারপর তাদের হাতকড়া লাগাতে। তিনি ওই নারীদের একটি ঘরে রেখে যেতেন- যেখানে থাকতো কয়েকজন চীনা পুরুষ। পরে তার কাজ ছিল ঘরটা পরিষ্কার করা।

তার ভাষায়, ‘আমার কাজ ছিল ওই মেয়েদের কোমর পর্যন্ত কাপড়চোপড় খোলা এবং এমনভাবে হাতকড়া লাগানো যাতে তারা নড়তে না পারে। তাদের ঘরে রেখে আমি বেরিয়ে যেতাম। তারপর সেই ঘরে একজন পুরুষ ঢুকতো। সাধারণত বাইরে থেকে আসা কোন চীনা লোক বা পুলিশ। আমি দরজার পাশে নীরবে বসে থাকতাম। লোকটি ঘর থেকে বেরিয়ে গেলে আমি ওই নারীটিকে গোসল করাতে নিয়ে যেতাম।’

গুলজিরা বলছিলেন, ‘বন্দিদের মধ্যে সবচেয়ে সুন্দরী ও কমবয়স্ক মেয়েদের পাবার জন্য চীনা পুরুষরা অর্থকড়ি দিতো।’ এতে বাধা দেওয়া বা হস্তক্ষেপ করার কোনও ক্ষমতা তার ছিল না। কিছু সাবেক বন্দিকেও বাধ্য করা হতো প্রহরীদের সাহায্য করতে।’

জিয়াউদুন বলেন, কিছু মেয়ে- যাদের সেল থেকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল- তারা আর কখনও ফিরে আসেনি। যারা ফিরে এসেছিল তাদের হুমকি দেওয়া হয়েছিল- কি ঘটেছে তা যেন তারা কাউকে না বলে।

জিনজিয়াং প্রদেশে চীনের নীতি বিষয়ে একজন বিশেষজ্ঞ এ্যাড্রিয়ান জেঞ্জ। তিনি বলেন, এই রিপোর্টের জন্য যেসব সাক্ষ্যপ্রমাণ উঠে এসেছে তা ভয়াবহ এবং তারা আগে যা ভেবেছিলেন - তার চেয়ে অনেক বেশি গুরুতর।

জিয়াউদুনের কাহিনি

জিনজিয়াং প্রদেশের ওই এলাকাটি কাজাখস্তান সীমান্তের পাশেই এবং সেখানে বহু জাতিগতভাবে কাজাখ লোকও বাস করে। জিয়াউদুনের বয়স ৪২। তার স্বামীও একজন কাজাখ। ২০১৬ সালে তারা কাজাখস্তানে পাঁচ বছর থাকার পর জিনজিয়াং ফিরে গেলে তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়, পাসপোর্ট জব্দ করা হয়। কয়েক মাস পরে পুলিশ তাদের বলে যে, তাদেরকে উইঘুর ও কাজাখদের একটি সভায় যোগ দিতে হবে। সেখানেই তাদের গ্রেফতার ও বন্দি করা হয়।

প্রথম দিকে তাদের বন্দি অবস্থায় ভালো খাবার দেওয়া হতো, ফোনও দেয়া হতো। এক মাস পরে তার পেটে আলসার ধরা পড়লে জিয়াউদুন ও তার স্বামীকে ছেড়ে দেওয়া হয়। তার স্বামীর পাসপোর্ট ফেরত দেওয়া হলে তিনি কাজাখস্তানে ফিরে যান। কিন্তু জিয়াউদুনের পাসপোর্টটি দেওয়া হয়নি। ফলে তিনি জিনজিয়াং-এ আটকা পড়েন।

এ অবস্থায় ২০১৮ সালের মার্চ মাসে তাকে একটি থানায় রিপোর্ট করতে বলা হয়। সেখানে গেলে পুলিশ তাকে জানায়, তার আরও শিক্ষা (কারাবাস) দরকার। জিয়াউদুন জানান, এরপর তাকে কুনেস কাউন্টিতে সেই একই বন্দিশিবিরে নিয়ে যাওয়া হয়।

তিনি বলেন, ততদিনে কেন্দ্রটি আরও উন্নত করা হয়েছে। তার সামনে নতুন বন্দি নামানোর জন্য সব সময় বাসের ভিড় লেগে থাকতো। শিবিরে আনার পর তাদের অলংকার খুলে ফেলা হয়। জিয়াউদুনের কানের দুল ছিঁড়ে নেওয়া হলে তার কান দিয়ে রক্ত পড়তে থাকে।

একজন বয়স্ক নারী- যার সঙ্গে পরে জিয়াউদুনের বন্ধুত্ব হয়- তার মাথার হিজাব টেনে খুলে নেওয়া হয়। রক্ষীরা লম্বা পোশাক পরার জন্য তার প্রতি চিৎকার করতে থাকে।

জিয়াউদুনের ভাষায়, ‘সেই বয়স্ক নারীর অন্তর্বাস ছাড়া আর সব কাপড় খুলে নেওয়া হয়। তিনি দুই হাত দিয়ে তার লজ্জাস্থান ঢাকার চেষ্টা করতে থাকেন। তিনি অঝোরে কাঁদছিলেন, আর তার অবস্থা দেখে আমিও কাঁদছিলাম।’

বন্দি অবস্থায় কয়েক মাস ধরে তাদের বিভিন্ন প্রচারণামূলক অনুষ্ঠান দেখানো হতো। তাদের চুলও কেটে ছোট করে দেওয়া হয়েছিল। জিয়াউদুনকে তার স্বামী সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ করতো পুলিশ। বাধা দিলে তাকে একবার এমনভাবে পেটে লাথি মেরেছিল যে তার রক্তপাত হতে থাকে। অন্য বন্দিরা প্রহরীদের ব্যাপারটা জানালে তারা বলেছিল, মেয়েদের এ রকম রক্তপাত স্বাভাবিক ব্যাপার।

বাংকবেড-বিশিষ্ট একেকটি কারাকক্ষে ১৪ জন নারীকে রাখা হতো। তাতে ছিল একটি বেসিন ও একটি টয়লেট। প্রথম দিকে যখন রাতে মেয়েদের তুলে নিয়ে যাওয়া হতো তখন জিয়াউদুন ব্যাপারটা বুঝতে পারেননি। তিনি ভেবেছিলেন হয়তো এই মেয়েদের অন্য কোথাও নিয়ে যাওয়া হচ্ছে।

পরে ২০১৮ সালের মে মাসের কোন এক দিন, জিয়াউদুন এবং আরেকটি মেয়েকে - যার বয়স ছিল ২০-এর কোটায়- তুলে নিয়ে একজন মুখোশপরা চীনা পুরুষের হাতে তুলে দেওয়া হয়। দুই জনকে নেওয়া হয় দুইটি আলাদা ঘরে।

যে নারীটি তাদের সেল থেকে নিয়ে এসেছিল- সে ওই লোকদের জানায় যে, সম্প্রতি জিয়াউদুনের রক্তপাত হয়েছে। এ কথা বলার পর একজন চীনা লোক তাকে গালাগালি করে। মুখোশ পরা লোকটি বলে, ‘ওকে অন্ধকার ঘরে নিয়ে যাও।’

জিয়াউদুন বলেন, ‘ওই নারী আমাকে সেই অন্ধকার ঘরে নিয়ে যায়। তাদের হাতে একটা ইলেকট্রিক লাঠির মতো ছিল- সেটা কি জিনিস আমি জানি না। সেটা আমার যৌনাঙ্গে ঢুকিয়ে দেওয়া হলো। আমাকে বৈদ্যুতিক শক দিয়ে নির্যাতন করা হলো।’ আমার শারীরিক অবস্থার কথা বলে বাধা দেওয়ায় নির্যাতন বন্ধ হলো, সেলে ফেরত পাঠানো হলো। ঘন্টাখানেক পর দ্বিতীয় মেয়েটিকেও সেলে ফিরিয়ে আনা হলো- যাকে জিয়াউদুনের পাশের ঘরে পাঠানো হয়েছিল। তার পর থেকে মেয়েটি একেবারে অন্য রকম হয়ে যায়। সে কারও সঙ্গে কথা বলতো না। এক একা বসে শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতো। ওই সেলের অনেকেই এমন হয়ে গিয়েছিল।

শিক্ষাদানের স্কুল

সেলের পাশাপাশি বন্দিশিবিরগুলোর আরেকটা অংশ ছিল কথিত স্কুলের শ্রেণীকক্ষ। সেখানে শিক্ষক এনে বন্দিদের ‘নতুন করে শিক্ষাদান’ করা হতো। অধিকারকর্মীদের মতে, যার লক্ষ্য ছিল উইঘুর ও অন্য সংখ্যালঘুদের নিজস্ব সংস্কৃতি, ভাষা ও ধর্ম ভুলিয়ে দিয়ে চীনা সংস্কৃতির মূলধারায় তাদের দীক্ষিত করা।

বন্দিদের চীনা ভাষা শিক্ষা দিতে যাদের বাধ্য করা হতো তাদের একজন ছিলেন কেলবিনুর সেদিক। তিনি জিনজিয়াং-এর একজন জাতিগতভাবে উজবেক নারী। সেদিক পরে চীন থেকে পালিয়ে যান এবং তার অভিজ্ঞতা প্রকাশ্যে বর্ণনা করেন।

বিবিসিকে তিনি বলেন, ‘নারীদের ক্যাম্পগুলো কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রিত হলেও তিনি ধর্ষণের কথা শুনতে পেতেন, এর আভাসও পেতেন। একদিন পরিচিত একজন চীনা নারী পুলিশকে তিনি জিজ্ঞেস করেছিলেন যে ব্যাপারটা সত্যি কিনা। সেই পুলিশ সদস্য তাকে বলেন, হ্যাঁ, সংঘবদ্ধ ধর্ষণ এখানকার সংস্কৃতিতে পরিণত হয়েছে। চীনা পুলিশ শুধু যে ধর্ষণ করে তাই নয়, মেয়েদের ইলেকট্রিক শক দেয়, ভয়াবহ সব নির্যাতন করে। সেই রাতে সেদিক ঘুমাতে পারেননি, শুধু কেঁদেছেন।

উইঘুর হিউম্যান রাইটস প্রজেক্টের সামনে দেওয়া জবানবন্দিতে সেদিক বলেন, তিনি মেয়েদের নির্যাতনের জন্য ইলেকট্রিক স্টিক নামে একটা জিনিসের কথা শুনেছেন- যা মেয়েদের শরীরে ঢুকিয়ে দেয়া হতো। ঠিক যেমনটা জিয়াউদুন বর্ণনা করেছেন। সেদিক জানান, ‘‌চার রকম করে ইলেকট্রিক শক দেয়া হতো। চেয়ার, দস্তানা, হেলমেট- আর পায়ুপথে স্টিক দিয়ে ধর্ষণ। পুরো ভবনজুড়ে মেয়েদের আর্তনাদের প্রতিধ্বনি শোনা যেতো। আমি দুপুরের খাবারের সময় বা কখনও কখনও ক্লাস থেকেও তা শুনতে পেতাম।’

ক্যাম্পে শিক্ষক হিসেবে কাজ করতে বাধ্য হওয়া আরেক নারী সায়রাগুল সাউৎবে বিবিসিকে বলেন, ধর্ষণ ছিল খুবই সাধারণ ঘটনা। রক্ষীরা যাকে চাইতো, তাকেই তুলে নিয়ে যেতো।

সায়রাগুল সাউৎবে বলেন, তিনি নিজেই একটি ভয়াবহ ও প্রকাশ্য সংঘবদ্ধ ধর্ষণের স্বাক্ষী। তার ভাষায়, ‘একটি ২০-২১ বছরের মেয়েকে ১০০ জন বন্দির সামনে নিয়ে আসা হয়, তাদের বাধ্য করা হয় স্বীকারোক্তি দিতে। তারপর পুলিশ পালাক্রমে মেয়েটিকে ধর্ষণ করে সবার সামনে। সে সময় তারা অন্য বন্দিদের ওপর নজর রাখছিল। তাদের কেউ বাধা দেবার চেষ্টা করলে, চোখ বন্ধ করলে, অন্যদিকে তাকালে, বা হাতের মুঠি শক্ত করলেই তাকে তুলে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল শাস্তি দেবার জন্য।’ সায়রাগুল বলেন, ‘মেয়েটির চিৎকার শুনে মনে হচ্ছিল যেন আমি মরে যাচ্ছি।’

জোরপূর্বক বন্ধ্যাকরণ

জিয়াউদুন সেই বন্দিশিবিরে ছিলেন মাসের পর মাস। বন্দিদের সেখানে চুল কেটে দেওয়া হতো। তারা কথিত ক্লাসে যেতো, এমন সব ডাক্তারি পরীক্ষা করা হতো যার কোনও ব্যাখ্যা পাওয়া যেতো না। তাদের বড়ি খেতে হতো, প্রতি ১৫ দিনে একবার করে 'টিকা' দেওয়া হতো- যার ফলে তাদের বমি বমি লাগতো, শরীর অসাড় হয়ে যেতো।

কোনও কোনও নারীর দেহে জোর করে জন্মনিরোধক আইইউডি লাগিয়ে দেওয়া হতো, কাউকে বা বন্ধ্যাকরণ করানো হতো। এ নিয়ে বার্তা সংস্থা এপি একটি অনুসন্ধান চালানোর পর চীনা সরকার বিবিসির কাছে একে 'সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন' বলে দাবি করে।

বন্দিদের চীনা দেশপ্রেমের গান গাইতে হতো ঘণ্টার পর ঘণ্টা। দেখতে হতো শি জিনপিংকে নিয়ে তৈরি দেশপ্রেমমূলক টিভি অনুষ্ঠান। শি জিনপিং সংক্রান্ত বইয়ের অনুচ্ছেদও মুখস্ত করতে হতো তাদের। মুখস্ত বলতে না পারলে খাবার দেওয়া হতো না।

জিয়াউদুন বলছিলেন, ‘ক্যাম্পের বাইরের জীবনের কথা ভাবতে ভুলে যাবেন আপনি। এটা কি মগজ ধোলাইয়ের জন্য নাকি ইনজেকশনের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া- তা আমি জানি না। কিন্তু পেট ভরে খাবার ইচ্ছে ছাড়া আর কিছুই আপনি চিন্তা করতে পারবেন না। না খাইয়ে রাখাটা এতই ভয়াবহ।’

বই মুখস্থ করার পরীক্ষায় ফেল করলে বিভিন্ন রঙের কাপড় পরিয়ে আলাদা করা হতো বন্দিদের, তারপর চলতো মারধর এবং অনাহারে রাখা। বন্দিশিবিরের একজন সাবেক রক্ষী চীনের বাইরের একটি দেশ থেকে ভিডিও লিংকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে এসব কথা বলেছেন। তার এসব বক্তব্য যাচাই করা যায়নি, তবে তার বর্ণনা অন্য একটি ক্যাম্প থেকে পাওয়া দলিলপত্রের সঙ্গে মিলে যায়।

এই রক্ষী দাবি করেন, তিনি বন্দিশিবিরে ধর্ষণ সম্পর্কে কিছু জানেন না, তবে বন্দিদের বৈদ্যুতিক শক দেয়া হতো এটা স্বীকার করেন।

চীনে কাজ করা একজন সাবেক ব্রিটিশ কূটনীতিক চার্লস পার্টন বলেন, এতে কোনও সন্দেহ নেই যে, শি জিনপিং-এর নীতি অনুযায়ীই এগুলো করা হচ্ছে। শি অথবা অন্য শীর্ষ কমকর্তারা কি ধর্ষণ ও নির্যাতনের নির্দেশ বা অনুমোদন দিয়েছেন? এ প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, ‘তারা নিশ্চয়ই এ ব্যাপারে অবহিত।’

তারা সারা শরীরে কামড়াতো

জিয়াউদুন বলেন, নির্যাতনকারীরা শুধু ধর্ষণই করতো না, সারা শরীরে কামড়াতো। আপনি বুঝবেন না যে তারা মানুষ না পশু। শরীরের কোনও অংশই তারা বাকি রাখতো না। সবখানে কামড়াতো আর তাতে বীভৎস সব দাগ হয়ে যেতো। তিনবার আমার এ অভিজ্ঞতা হয়েছে।

তার সেলে থাকা আরেকটি মেয়ে জিয়াউদুনকে বলেছিল, তাকে আটক করা হয়েছিল বেশি বেশি সন্তান জন্ম দেওয়ার কারণে। এই মেয়েটিকেও তুলে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল এবং তিন দিন বাদে সেলে ফিরে আসার পর দেখা যায়- তার শরীরেও একই রকম কামড়ের দাগ। জিয়াউদুন বলেন, ‘সে কোনও কথা বলতে পারছিল না, আমাকে জড়িয়ে ধরে শুধু কাঁদছিল।’

চীন সরকারের প্রতিক্রিয়া

চীনা সরকার ধর্ষণ ও নির্যাতন সম্পর্কে বিবিসির প্রশ্নের সরাসরি জবাব দেয়নি। একজন মুখপাত্র এক বিবৃতিতে বলেছেন, এগুলো বন্দিশিবির নয় বরং বৃত্তিমূলক শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের কেন্দ্র। চীন সরকার সব জাতিগত সংখ্যালঘু গোষ্ঠীর অধিকার সমানভাবে রক্ষা করে এবং নারী অধিকারকে ব্যাপক গুরুত্ব দেয়।’

বন্দি শিবিরের পর জিয়াউদুনের জীবন

জিয়াউদুন মুক্তি পান ২০১৮ সালে। তার পাসপোর্ট ফেরত দেওয়া হয় এবং তিনি কাজাখস্তানে পালিযে যান। পরে উইঘুর মানবাধিকার প্রকল্পের সহায়তায় তিনি আমেরিকায় যান এবং সেখানেই থাকার পরিকল্পনা করছেন। তার স্বামী এখনও কাজাখস্তানে রয়েছেন।

যুক্তরাষ্ট্রে যাবার এক সপ্তাহ পরই তার জরায়ু কেটে বাদ দেওয়া হয়- তার ওপর চালানো নির্যাতনের চিকিৎসার অংশ হিসেবে। তিনি আক্ষেপ করে বলেন, ‘আমি মা হওয়ার সুযোগ হারিয়েছি।‌’

কিছু স্বাধীন গবেষণায় দেখা গেছে, জিনজিয়াং প্রদেশে গত কয়েক বছরে জন্মহার অনেকটা কমে গেছে। বিশ্লেষকরা অনেকে একে 'জনসংখ্যাগত গণহত্যা' বলে অভিহিত করেছেন। উইঘুর জনগোষ্ঠীর অনেকে মদ্যপানের দিকে ঝুঁকে পড়েছেন।

জিয়াউদুন বলেন, ‘তারা বলে, লোকজনকে মুক্তি দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু আমি বলবো, যারা ক্যাম্প থেকে ছাড়া পাচ্ছে তারা আসলে শেষ হয়ে গেছে।’ তার মতে, আসলে পরিকল্পনা ছিল এটাই- নজরদারি, বন্দিত্ব, বিমানবিকীকরণ, বন্ধ্যাকরণ, নির্যাতন, ধর্ষণ।

জিয়াউদুন বলেন, ‘তাদের লক্ষ্য হচ্ছে সবাইকে ধ্বংস করা। আর সবাই সেটা জানে।’ সূত্র: বিবিসি।

/এমপি/
সম্পর্কিত
পশ্চিমাদের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখতে চীনকে যা করতে হবে
ভারতে লোকসভা নির্বাচনের দ্বিতীয় ধাপের ভোট শুরু
চীনে আমেরিকার কোম্পানিগুলোর প্রতি ন্যায্য আচরণের আহ্বান ব্লিঙ্কেনের
সর্বশেষ খবর
বাংলাদেশ ও থাইল্যান্ডের মধ্যে বিভিন্ন ক্ষেত্রে সহযোগিতা বাড়ানোর সুযোগ রয়েছে: প্রধানমন্ত্রী
বাংলাদেশ ও থাইল্যান্ডের মধ্যে বিভিন্ন ক্ষেত্রে সহযোগিতা বাড়ানোর সুযোগ রয়েছে: প্রধানমন্ত্রী
মারা গেলো গাজায় নিহত মায়ের গর্ভ থেকে জন্ম নেওয়া শিশুটি
মারা গেলো গাজায় নিহত মায়ের গর্ভ থেকে জন্ম নেওয়া শিশুটি
বিক্রির জন্য সবজি কিনে ফেরার পথে দুই ব্যবসায়ী নিহত
বিক্রির জন্য সবজি কিনে ফেরার পথে দুই ব্যবসায়ী নিহত
টিভি ধারাবাহিকে খলনায়িকা রিনা খান
টিভি ধারাবাহিকে খলনায়িকা রিনা খান
সর্বাধিক পঠিত
খুলনায় এযাবৎকালের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা
খুলনায় এযাবৎকালের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা
চুক্তিতে মাউশির ডিজি হলেন নেহাল আহমেদ
চুক্তিতে মাউশির ডিজি হলেন নেহাল আহমেদ
আমরা সবাই ফেরেশতা, বাস করি বেহেশতে: রায়হান রাফী
আমরা সবাই ফেরেশতা, বাস করি বেহেশতে: রায়হান রাফী
মৈত্রী ট্রেনে তল্লাশি, মুদ্রা পাচারের অভিযোগে আটক দুই বাংলাদেশি
মৈত্রী ট্রেনে তল্লাশি, মুদ্রা পাচারের অভিযোগে আটক দুই বাংলাদেশি
এগিয়েছে ‘ওমর’, চমকে দিলো ‘লিপস্টিক’!
ঈদের ছবিএগিয়েছে ‘ওমর’, চমকে দিলো ‘লিপস্টিক’!