X
শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪
৭ বৈশাখ ১৪৩১

এক বছরে করোনা কত কী দেখালো!

জাকিয়া আহমেদ
০৮ মার্চ ২০২১, ১১:০০আপডেট : ০৯ মার্চ ২০২১, ০০:৫৬

বাংলাদেশ করোনা মহামারির এক বছর পার করলো আজ (৮ মার্চ)। গতবছরের এই দিনে দেশে তিনজন করোনা আক্রান্ত রোগীর খবর জানায় স্বাস্থ্য অধিদফতর। এর ঠিক ১০ দিন পর করোনা আক্রান্ত হয়ে প্রথম একজনের মৃত্যুর কথা জানায় অধিদফতর। এরপর থেকে প্রতি মাসেই কোনও না কোনও ঘটনার জন্ম দিয়েছে করোনা।  

২০১৯ সালের ডিসেম্বরে চীনের উহানে প্রথম করোনাভাইরাস ধরা পড়ে। ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়ে বিশ্বজুড়ে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা মহামারি ঘোষণা করে ১১ মার্চ। দুনিয়াজুড়ে ছড়িয়ে পড়ে আতঙ্ক। দেশে দেশে দেওয়া হয় লকডাউন। শক্তিশালী দেশ হতে শুরু করে দরিদ্রতম দেশটিও রেহাই পায়নি এর ভয়াল থাবা থেকে।

৮ মার্চ প্রথম তিনজন করোনা শনাক্ত রোগীর মধ্যে দুজন ছিলেন পুরুষ, একজন নারী। তাদের মধ্যে দুজন ইতালি ফেরত ছিলেন। বাকি একজন ছিলেন তাদের একজনের পরিবারের সদস্য।

দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা নিয়ে আগে থেকেই জনমনে ক্ষোভ ছিল। করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবে সেটা আরও জোরালো হয়। উঠে আসে স্বাস্থ্যখাতের দুর্নীতির নানা চিত্রও। শুরুতে সমন্বয়হীনতা প্রকট আকার ধারণ করে। যার কারণে দেশজুড়ে করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়ার সুযোগ পেয়েছে বলেও মন্তব্য করেছেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা।

শুরুর আড়াই মাস কাজে লাগাতে পারেনি মন্ত্রণালয়। উল্টো চিকিৎসকদের দেওয়া হয় নিম্নমানের পিপিই। সুরক্ষা উপকরণ কেনাকাটায় ধরা পড়ে দুর্নীতি। অনুমোদনহীন হাসপাতালকে করা হয় করোনার জন্য ডেডিকেটেড। হাসপাতালগুলোতে ছিল না ট্রায়াজ ব্যবস্থাপনাও। এসব কারণে প্রায় প্রতিদিনই রোগী থেকে আক্রান্ত হয়েছেন চিকিৎসক, নার্সসহ স্বাস্থ্যকর্মীরা। লকডাউন করতে হয়েছে পুরো হাসপাতাল। শুরুর দিকে নমুনা পরীক্ষা, রিপোর্ট দিতে দেরি করা, নমুনা পরীক্ষায় রোগীর ভোগান্তি; মোটকথা, করোনা ব্যবস্থাপনার আগাগোড়া ছিল প্রশ্নের মুখে।

নকল মাস্ক সরবরাহের বিষয়টি প্রকাশ হওয়ায় বিব্রত হয় কেন্দ্রীয় ওষুধ প্রশাসন অধিদফতর। সুরক্ষা সামগ্রীর অভাবে চিকিৎসকদের আক্রান্ত হওয়ার হার বেশি বলেও জানায় চিকিৎসকদের জাতীয় সংগঠন বাংলাদেশ মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশন (বিএমএ)।

করোনাভাইরাসের নমুনা পরীক্ষা, চিকিৎসা, নকল রিপোর্ট নিয়ে হাসপাতালের জালিয়াতিতে খোদ স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় এবং স্বাস্থ্য অধিদফতরের সর্বোচ্চ পদে রদবদল হয়। মহামারির সময়ে মুখোমুখি অবস্থানে দাঁড়ায় মন্ত্রণালয় এবং অধিদফতরকে। বদল হয় স্বাস্থ্য সচিব এবং স্বাস্থ্যের মহাপরিচালকের পদ।

শুরুতে সংকট ছিল ভেন্টিলেটর, হাইফ্লো ন্যাজাল ক্যানুলা, সেন্ট্রাল অক্সিজেন সিস্টেম, অক্সিজেন সিলিন্ডার, আইসিইউ শয্যাসহ জরুরি সব চিকিৎসা সামগ্রীর। যদিও ধীরে ধীরে এসব সংকট কাটিয়ে ওঠে বাংলাদেশ।

স্ক্রিনিং ও প্রথম তিন রোগী

গতবছরের ২১ জানুয়ারি শুধু চীন ফেরত এবং সাত ফেব্রুয়ারি থেকে সব যাত্রীরই স্ক্রিনিং বাধ্যতামূলক করে সরকার। দেশের সব বিমান, স্থল ও সমুদ্রবন্দরে বসানো হয় থারমাল স্ক্যানার।

৩১ জানুয়ারি থেকে ৮ মার্চ পর্যন্ত ১১৬ জনের নমুনা পরীক্ষা করে আইইডিসিআর। সেসময় প্রতিষ্ঠানটি প্রতিদিন দুপুরে সংবাদ সম্মেলন করে করোনা বিষয়ে নিয়মিত তথ্য জানাতো। ৮ মার্চ প্রথম রোগী শনাক্ত হবার কথা জানায় প্রতিষ্ঠানটি। প্রথম যিনি মারা যান, তিনি একজন পুরুষ। পরিবারের সদস্যদের মাধ্যমে তিনি করোনায় সংক্রমিত হয়েছিলেন।

গতবছরের ৮ মার্চ থেকে শুরু করে শনিবার (৬ মার্চ) পর্যন্ত দেশে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন পাঁচ লাখ ৪৯ হাজার ৭২৪ জন। এখন পর্যন্ত মারা গেছেন আট হাজার ৪৫১ জন। গত ২৪ ঘণ্টায় করোনা থেকে সুস্থ হয়েছেন ৮২২ জন। মোট আক্রান্ত হয়ে সুস্থ হয়েছেন পাঁচ লাখ এক হাজার ৯৬৬ জন।

৮ মার্চে করোনা ধরা পড়ায় মানুষ যতটা না ভয় পায়, তারচেয়ে কয়েকগুণ বেশি আতঙ্কিত হয় ১৮ মার্চ- প্রথম মৃত্যুর খবরের দিন। সেদিন বিকাল হতেই জনশূন্য হতে থাকে পথ। সন্ধ্যার পর বলতে গেলে ফাঁকা হয়ে যায় রাজধানীর রাস্তা। মানুষ হুমড়ি খেয়ে মজুদ করতে শুরু করে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য। রাতারাতি বেড়ে যায় মাস্ক, স্যানিটাইজারের দাম।

হোম কোয়ারেন্টিন ছিল ভুল সিদ্ধান্ত

দেশে রোগী বাড়ার অন্যতম কারণ ছিল হোম কোয়ারেন্টিন। এটি বাংলাদেশের জন্য প্রযোজ্য ছিল না বলে জানিয়েছেন জনস্বাস্থ্যবিদরা। আক্রান্তদের সংস্পর্শে আসা ব্যক্তিদের ১৪ দিন পর্যন্ত আলাদা রাখা তথা কোয়ারেন্টিনে পাঠানোর ওপর গুরুত্ব দিয়ে আসছিল ডব্লিউএইচও। আমাদের দেশেও রোগীকে আইসোলেশন (বিচ্ছিন্নকরণ) এবং তার সংস্পর্শে আসাদের কোয়ারেন্টিনে (সঙ্গ নিরোধ) থাকতে বলা হয়। কিন্তু শুরু থেকেই এ নিয়ে বিশেষজ্ঞদের সংশয় ছিল। বিশেষ করে বিদেশফেরত ব্যক্তিদের কোয়ারেন্টিনে থাকার নির্দেশনা কতটুকু কার্যকর হয়েছে তা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছিলেন জনস্বাস্থ্যবিদরা। এ ছাড়া হোম কোয়ারেন্টিন মানার মানসিকতাও আমাদের ছিল না বলে জানিয়েছেন তারা।

উপসর্গ গুরুতর না হলে করোনা রোগীকে হোম আইসোলেশনে রাখার কথা গাইডলাইনে বলা হয়েছে। কিন্তু জনস্বাস্থ্যবিদরা বলছেন, বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে মধ্যবিত্ত, নিম্নবিত্ত ও খেটে খাওয়া মানুষদের জন্য এমন গাইডলাইন বাস্তবসম্মত হবে কিনা তা আগেই আমলে নেওয়ার দরকার ছিল।

প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টিন বাদ দিয়ে হোম কোয়ারেন্টিন করাই ছিল প্রথম ভুল, এতেই সংক্রমণ বেড়েছে। এমন মন্তব্য করেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ও কোভিড-১৯ বিষয়ক জাতীয় পরামর্শক কমিটির সদস্য অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম।

লকডাউন

প্রথম রোগী শনাক্তের ৩৯তম দিনে গতবছরের ১৬ এপ্রিল পুরো দেশকে করোনাভাইরাসের জন্য ঝূঁকিপূর্ণ ঘোষণা করে স্বাস্থ্য অধিদফতর। সেদিনের ঘোষণায় অধিদফতর জানায়, ‘বাংলাদেশের বিভিন্ন এলাকায় কোভিড ১৯-এর সংক্রমণ ঘটেছে। সংক্রামক রোগ (প্রতিরোধ, নিয়ন্ত্রণ ও নির্মূল) আইন, ২০১৮-এর ১১ (১) ধারার ক্ষমতাবলে সমগ্র বাংলাদেশকে সংক্রমণের ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা ঘোষণা করা হলো।’

করোনায় আক্রান্ত হয়ে প্রথম যিনি মারা যান, তিনি ছিলেন মাদারীপুর জেলার শিবচর উপজেলার বাসিন্দা। মার্চের তৃতীয় সপ্তাহের দিকে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক জানান, তখন পর্যন্ত যতজন শনাক্ত হয়েছেন তাদের বেশিরভাগেই ফরিদপুর এবং মাদারীপুরের শিবচর উপজেলার। ১৭ জনের মধ্যে আটজনই ছিলেন শিবচরের।

১৯ মার্চ প্রথম শিবচর উপজেলায় লকডাউন ঘোষণা করে সরকার। ৫ এপ্রিল রাজধানীর টোলারবাগ ও বাসাবো, নারায়ণগঞ্জ, সাদুল্যাপুর (গাইবান্ধা) এই পাঁচ জায়গাকে সংক্রমণের ক্লাস্টার (কাছকাছি একই জায়গায় অনেক আক্রান্ত) হিসেবে চিহ্নিত করে আইইডিসিআর। এই পাঁচ স্থানের চারটিতে সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে রাখা গেলেও নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায় নারায়ণগঞ্জ। ৭ এপ্রিল নারায়ণগঞ্জে লকডাউন ঘোষণা করা হয়। কিন্তু তাতেও কাজ হয়নি। ছড়িয়ে পড়ে সংক্রমণ। ১০ এপ্রিল নারায়ণগঞ্জকেই সংক্রমণের কেন্দ্রস্থল হিসেবে চিহ্নিত করে আইইডিসিআর।

মার্চের শেষ দিকে দেশজুড়ে লকডাউন শুরু হয়। সরকারিভাবে একে বলা হয় সাধারণ ছুটি। কয়েকদফায় বাড়ানো হয় এ ছুটি। দেশের সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয় ১৭ মার্চ থেকে। ২৬ মার্চ থেকে অফিস-আদালতও। দেশজুড়ে সব ধরনের যান চলাচলে জারি হয় নিষেধাজ্ঞা। সবাইকে যার যার বাড়িতে থাকার নির্দেশ দেওয়া হয়। কোটি কোটি মানুষ হয়ে পড়ে ঘরবন্দি।

এর ঠিক এক মাস পর ২৬ এপ্রিল পোশাক কারখানা খুলে দেওয়া হয়। সংক্রমণের দশম সপ্তাহে (১০ থেকে ১৬ মে) দেশে করোনা পরিস্থিতির দ্রুত অবনতি শুরু হয়।

৬৬ দিন পর ৩১ মে থেকে অফিস খোলার পাশাপাশি গণপরিবহন চলাচলের অনুমতিও দেওয়া হয়। শিথিল করা হয় বিধিনিষেধ। চালু হয় অভ্যন্তরীণ ফ্লাইট। আগস্টে খুলে দেওয়া হয় বিনোদন কেন্দ্রগুলোও।

এরপর জুনে জোনভিত্তিক লকডাউনের ঘোষণা দেয় সরকার। প্রথমে ১৪ জুন ও পরে ১৮ জুলাই লকডাউনের গাইডলাইন তৈরি করে স্বাস্থ্য অধিদফতর। আক্রান্তের সংখ্যার ভিত্তিতে লাল, হলুদ ও সবুজ এলাকা নির্ধারণের নীতিমালার কথা বলা হয়।

রাজধানীতে প্রাথমিক পর্যায়ে প্রথমে পূর্ব রাজাবাজার ও ওয়ারি-এ দুটো এলাকা এবং ঢাকা বিভাগের কয়েকটি জেলায় জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে লকডাউন কার্যকর করা হলেও এক পর্যায়ে জোনিং সিস্টেম মুখ থুবড়ে পড়ে।

 ভ্রাম্যমাণ আদালত

শুরু থেকেই করোনা সংক্রমণ রোধে মাস্ক পরা, হাত ধোয়া ও জনসমাগমে না যাওয়ার কথা বলে রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান। কিন্তু মানুষকে মাস্ক পরাতেই গলদঘর্ম হয় প্রশাসন। মাস্ক না পরার নানান অজুহাত দাঁড় করায় মানুষ। এরপর স্বাস্থ্য অধিদফতরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (প্রশাসন) অধ্যাপক ডা. নাসিমা সুলতানা স্বাক্ষরিত বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, নির্দেশ অমান্যকারীদের বিরুদ্ধে সংক্রামক রোগ (প্রতিরোধ, নিয়ন্ত্রণ ও নির্মূল) আইন-২০১৮ অনুসারে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। ৩১ মে নিয়মিত অনলাইন বুলেটিনে অধ্যাপক নাসিমা সুলতানা বলেন, ‘লকডাউন উঠে গেছে। এখন সবাইকে সাবধান থাকতে হবে। সঠিকভাবে মাস্ক পরতে হবে।’ এরপর মাস্ক পরা নিশ্চিত করতে আগস্টে ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে শাস্তি দেওয়ার সিদ্ধান্তও নেওয়া হয়। নীলফামারীতে করোনা মোকাবিলায় সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে প্রশাসন ও সাংবাদিকদের সঙ্গে মতবিনিময়

সচেতনতায় সেনাবাহিনী

২০২০ সালের ২ এপ্রিল থেকে কোয়ারেন্টিন ও সামাজিক দূরত্ব নিশ্চিত করতে কঠোর অবস্থানে যায় বাংলাদেশ সেনাবাহিনী। ১ এপ্রিল আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদফতর (আইএসপিআর) সংবাদ বিজ্ঞপ্তি দিয়ে জানায়, সেনাবাহিনী দেশের সব স্থানে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা এবং হোম কোয়ারেন্টিনের বিষয়টি কঠোরভাবে নিশ্চিত করবে। সরকারের দেওয়া নির্দেশাবলী অমান্যকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে। সেনাবাহিনীর ৪৯৬টি দল পুরো দেশজুড়ে স্থানীয় প্রশাসনের সঙ্গে বিভিন্ন কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করে সচেতনতা বৃদ্ধিতে কাজ করে।

হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের কাছে আশকোনা হজক্যাম্প এবং উত্তরা দিয়াবাড়ি প্রকল্প এলাকায় করা কোয়ারেন্টিনের দায়িত্ব দেওয়া হয় সেনাবাহিনীর হাতে।

কুমিল্লা লকডাউন লকডাউনে সরকারি সহায়তা

লকডাউনে দারুণ বিপদে পড়ে খেটে খাওয়া নিম্ন আয়ের মানুষ। অনেকের চাকরি চলে যায়। ঢাকা ছেড়ে যেতে বাধ্য হন অনেকে। তাদের জন্য সরকারের পক্ষে সহযোগিতার উদ্যোগ নেওয়া হয়। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা অনুযায়ী দেশের সব কর্মহীন মানুষের তালিকা করে সেই অনুযায়ী ত্রাণ সহায়তা দেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া হয়। দেশের সব ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান, পৌরসভার মেয়র, সিটি করপোরেশনের মেয়রদের কাছ থেকে করোনায় কর্মহীন মানুষদের তালিকা সংগ্রহ করার নির্দেশ দেয় ত্রাণ ও দুর্যোগ মন্ত্রণালয়। নকল এন-৯৫ মাস্ক

 সুরক্ষাসামগ্রী নিয়ে নয়-ছয়

করোনাভাইরাস সংক্রমণ শুরুর পর থেকেই চিকিৎসকরা মাস্ক ও ব্যক্তিগত সুরক্ষা পোশাক (পিপিপি) নিয়ে অভিযোগ করেন। তাদের যেসব সুরক্ষা সামগ্রী দেওয়া হচ্ছে সেগুলো মানসম্পন্ন নয় বলে জানান তারা। যার কারণে অনেক চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মী করোনা আক্রান্ত হন। মারাও যান অনেকে।

গতবছরের মার্চে মুগদা জেনারেল হাসপাতালে সরবরাহ হওয়া এন-৯৫ মাস্কের প্যাকেটে সাধারণ সার্জিক্যাল মাস্ক থাকার বিষয়ে স্বাস্থ্য অধিদফতর ও কেন্দ্রীয় ওষুধাগারের পরিচালককে চিঠি দেন হাসপাতালের ব্যবস্থাপনা কমিটির সভাপতি ও সংসদ সদস্য সাবের হোসেন চৌধুরী।

এরপর ২ এপ্রিল ওষুধাগারের পরিচালক প্রয়াত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল শহিদ উল্লাহ স্বাস্থ্য অধিদফতরের সংবাদ সম্মেলেন জানান, সেগুলো এন-৯৫ ছিল না। ছিল সাধারণ সার্জিক্যাল মাস্ক। ভুল করে প্যাকেটের গায়ে এন-৯৫ লেখা হয়েছিল।

১৬ এপ্রিল করোনা পরীক্ষার জন্য একটি পূর্ণাঙ্গ পিসিআর ল্যাব ও এন-৯৫ মাস্ক চান নারায়ণগঞ্জের খানপুর ৩০০ শয্যা বিশিষ্ট হাসপাতালের মেডিসিন বিভাগের আবাসিক চিকিৎসক ডা. মো. শামসুদ্দোহা। তিনি বলেন, এন-৯৫ মাস্ক একটাও পাইনি। অথচ করোনা চিকিৎসায় থেমে থাকিনি আমরা। মাস্ক ছাড়াই খানপুর ৩০০ শয্যা হাসপাতাল করোনা চিকিৎসা দিয়ে যাচ্ছে।

এরপর শিল্প-প্রতিষ্ঠান অধ্যুষিত বন্দরনগরী ও জনবহুল নারায়ণগঞ্জ জেলায় কোনও গবেষণাগার নেই শুনে অবাক হন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। গণভবন থেকে ভিডিও কনফারেন্সে ডা. শামসুদ্দোহার বক্তব্যের জবাব দিতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমি অবাক হচ্ছি। সেখানে কোনও গবেষণাগার নেই?’ বিষয়টি তদন্ত করার নির্দেশ দেন তিনি।

নকল মাস্কসহ করোনাভাইরাসের পরীক্ষা ও চিকিৎসার নামে রিজেন্ট হাসপাতাল এবং জেকেজি হেলথকেয়ারের প্রতারণাও ছিল ব্যাপক আলোচিত ঘটনা।

২১ মার্চ করোনা রোগীদের চিকিৎসার জন্য বেসরকারি রিজেন্ট হাসপাতালের সঙ্গে চুক্তি করে স্বাস্থ্য অধিদফতর। চুক্তি স্বাক্ষর অনুষ্ঠানে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক, স্বাস্থ্য অধিদফতরের তৎকালীন মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল কালাম আজাদ ও রিজেন্ট হাসপাতালের চেয়ারম্যানের মো. সাহেদ করিমের সঙ্গে চুক্তি হয়। কিন্তু নমুনা পরীক্ষা না করেই রিপোর্ট দেওয়া, সরকারের সঙ্গে ‍চুক্তির পরও রোগীর কাছ থেকে বিল নেওয়াসহ নানা অভিযোগে হাসপাতালটিতে ৭ ও ৮ জুলাই অভিযান চালায় র‌্যাব। বন্ধ করে দেওয়া হয় মিরপুর ও উত্তরার শাখা। জানা যায়, রিজেন্ট হাসপাতালের লাইসেন্সের মেয়াদও ছিল না। সেসব জেনেও অধিদফতর চুক্তি করে তাদের সঙ্গে।

অপরদিকে, ওভাল গ্রুপের প্রতিষ্ঠান জোবেদা খাতুন হেলথ কেয়ারকে (জেকেজি হেলথ কেয়ার) নমুনা পরীক্ষার অনুমোদন দেয় স্বাস্থ্য অধিদফতর। ভুয়া রিপোর্ট দেওয়ার অভিযোগে গত ২৪ জুন স্বাস্থ্য অধিদফতর তাদের অনুমোদন বাতিল করে। সাহেদ করিম ও জেকেজির কর্ণধাররা বর্তমানে কারাগারে আছেন।

স্বাস্থ্য অধিদফতরের সাবেক মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল কালাম আজাদ
করোনায় যত বদলি

প্রথমে মাস্ক কেলেঙ্কারি নিয়ে স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল কালাম আজাদকে নিয়ে সমালোচনা শুরু হয়। এরপর রিজেন্ট হাসপাতালের সঙ্গে চুক্তি, জেকেজির মতো প্রতিষ্ঠানের ভুয়া নমুনা পরীক্ষার পর তীব্র সমালোচনার মুখে পড়েন তিনি। রিজেন্ট হাসপাতালকে ওপর মহলের নির্দেশে করোনা ডেডিকেটেড করা হয়েছে জানিয়ে মন্ত্রণালয়ের শোকজ নোটিস পান তিনি। অবশেষে গত ২১ জুলাই পদত্যাগ করেন ডা. আজাদ। ইতোমধ্যে তাকে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) তলব করেছে।

তারও আগে ৪ জুন কোভিড-১৯ নিয়ে মন্ত্রণালয়ের নানা সমালোচনামূলক কাজের মধ্যে স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের সচিব আসাদুল ইসলামকে পরিকল্পনা বিভাগে বদলি করা হয়। আট জুন বদলি হন মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের হাসপাতাল অনুবিভাগের অতিরিক্ত সচিব সিরাজুল ইসলাম ও ওষুধ প্রশাসন অনুবিভাগের অতিরিক্ত সচিব ইসমাইল হোসেন। ১৮ জুন বদলি করা হয় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের কোভিড-১৯ বিষয়ক মিডিয়া সেলের প্রধান ও মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব মো. হাবিবুর রহমান খানকে। একইদিনে কোভিড-১৯ ইমার্জেন্সি রেসপন্স প্রকল্প থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয় অধ্যাপক ডা. ইকবাল কবীরকে। তিনি ওই প্রকল্পের পরিচালক ছিলেন। পাশাপাশি স্বাস্থ্য অধিদফতরের পরিচালক (পরিকল্পনা ও গবেষণা) পদ থেকেও তাকে সরিয়ে দেওয়া হয়। তার পরিবর্তে প্রকল্পের পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব দেওয়া হয় অধিদফতরের পরিচালক (হাসপাতাল ও ক্লিনিক) ডা. আমিনুল হাসানকে। তবে রিজেন্টের সঙ্গে চুক্তির বিষয়ে আমিনুলের দিকে অভিযোগের আঙুল ওঠায় তাকেও সরিয়ে দেয় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। আমিনুল হাসানই চুক্তি বিষয়ক চিঠিতে লেখেন, ‘সচিব স্যারের নির্দেশে রিজেন্ট হাসপাতালের সঙ্গে চুক্তি করা হয়।’

পিসিআর ল্যাব নমুনা পরীক্ষা

শুরুর দিকে দেশে শুধু একটি প্রতিষ্ঠানে (আইইডিসিআর) আরটি-পিসিআর পদ্ধতিতে করোনার নমুনা পরীক্ষা হয়। সক্ষমতা থাকলেও শুধু একটি প্রতিষ্ঠানে পরীক্ষা নিয়ে সমালোচিত হয় আইইডিসিআর। পরে বাড়তে থাকে ল্যাব। এখন দেশের ২১৯টি পরীক্ষাগারে করোনার নমুনা পরীক্ষা হচ্ছে জানিয়ে অধিদফতর জানায়, এরমধ্যে আরটি-পিসিআরের মাধ্যমে পরীক্ষা হচ্ছে ১১৮টি ল্যাবে, জিন-এক্সপার্ট মেশিনে পরীক্ষা হচ্ছে ২৯টিতে আর র‌্যাপিড অ্যান্টিজেনের মাধ্যমে পরীক্ষা হচ্ছে ৭২টি পরীক্ষাগারে।

 বিশেষজ্ঞদের সুপারিশ অবহেলিত

‘করোনা মোকাবেলায় বাংলাদেশ প্রথম থেকেই ভুল পথে হেঁটেছে। তবে সেটা ভুল করে নয়। সিদ্ধান্ত নিয়েই ভুল পথে হেঁটেছে।’ এমন মন্তব্য করেছেন জনস্বাস্থ্যবিদ চিন্ময় দাস। তিনি আরও বলেন, ‘মহামারি যখন আসে তখন মহামারি বিশেষজ্ঞদের নিয়েই কাজ করতে হয়। তাদের মতামত, অভিজ্ঞতা শুনে এগোতে হয়। কোভিড নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব প্রশাসনিক ক্যাডারদের হাতে ছিল। এভাবে মহামারি নিয়ন্ত্রণ করা যায় না।’

 

 

/এফএ/এফএএন/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
বাঘ ছাড়ায় নিজ গ্রামে শেষবার ভোট, আবেগে আচ্ছন্ন বাসিন্দারা!
বাঘ ছাড়ায় নিজ গ্রামে শেষবার ভোট, আবেগে আচ্ছন্ন বাসিন্দারা!
তীব্র তাপপ্রবাহে পুড়ছে যশোর, জনশূন্য রাস্তাঘাট
তীব্র তাপপ্রবাহে পুড়ছে যশোর, জনশূন্য রাস্তাঘাট
মুখোমুখি ইরান-ইসরায়েল, পরীক্ষার মুখে মার্কিন সামরিক কৌশল
মুখোমুখি ইরান-ইসরায়েল, পরীক্ষার মুখে মার্কিন সামরিক কৌশল
শহীদ মিনারে বীর মুক্তিযোদ্ধা শিব নারায়ণ দাসের প্রতি শেষ শ্রদ্ধা
শহীদ মিনারে বীর মুক্তিযোদ্ধা শিব নারায়ণ দাসের প্রতি শেষ শ্রদ্ধা
সর্বাধিক পঠিত
বাড়ছে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মানি, নতুন যোগ হচ্ছে স্বাধীনতা দিবসের ভাতা
বাড়ছে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মানি, নতুন যোগ হচ্ছে স্বাধীনতা দিবসের ভাতা
দুর্নীতির অভিযোগ: সাবেক আইজিপি বেনজীরের পাল্টা চ্যালেঞ্জ
দুর্নীতির অভিযোগ: সাবেক আইজিপি বেনজীরের পাল্টা চ্যালেঞ্জ
ইরান ও ইসরায়েলের বক্তব্য অযৌক্তিক: এরদোয়ান
ইস্পাহানে হামলাইরান ও ইসরায়েলের বক্তব্য অযৌক্তিক: এরদোয়ান
সংঘাত বাড়াতে চায় না ইরান, ইসরায়েলকে জানিয়েছে রাশিয়া
সংঘাত বাড়াতে চায় না ইরান, ইসরায়েলকে জানিয়েছে রাশিয়া
সারা দেশে স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসা বন্ধ ঘোষণা
সারা দেশে স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসা বন্ধ ঘোষণা