X
শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪
১৩ বৈশাখ ১৪৩১

কাপ্তাই হ্রদের বুকে শায়িত যে বীরশ্রেষ্ঠ

জিয়াউল হক, রাঙামাটি
২১ মার্চ ২০২১, ১৭:০৩আপডেট : ২২ মার্চ ২০২১, ০৩:৪৫

‘আমি মুক্তিযুদ্ধ দেখিনি। তবে এই বীরশ্রেষ্ঠের সমাধিস্থলটা দেখাশোনা করতে পারাই আমার মুক্তিযুদ্ধ।’ -এ মন্তব্য বিনয় কুমার চাকমা নামে এক মধ্যবয়সী ব্যক্তির। মধ্যবয়স হলেও মুক্তিযুদ্ধ তার জন্যও দূরের বিষয়। মহান স্বাধীনতার যুদ্ধ দেখেননি তিনিও। তবে বাবার কাছে শুনেছেন সেই যুদ্ধে বাঙালির প্রাণপণ লড়াইয়ের কথা। ঠিক ৫০ বছর আগে আমাদের স্বাধীনতা এনে দেওয়ার সেই যুদ্ধে তার বাবা দয়াল কৃষ্ণ চাকমাকে শেষবেলায় যা হাতে তুলতে হয়েছিল তা তিনি কোনোদিনই চাননি। সেটি ছিল এক অকুতোভয় বীর সেনানীর মরদেহ। তার নাম মুন্সী আবদুর রউফ। বাংলাদেশের স্বাধীনতা এনে দেওয়া সাত বীরশ্রেষ্ঠর অন্যতম মুন্সী আবদুর রউফের দেহ পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর গোলায় ছিন্নভিন্ন হয়ে গেলে তা তুলে এনে রাঙামাটির নানিয়ারচরের এক নির্জন দ্বীপে তাকে সমাহিত করেন এই দয়াল কৃষ্ণ চাকমা। সেই থেকে এই বীরশ্রেষ্ঠর কবরটি পরম মমতায় আগলে রেখেছেন তিনি। এখন বয়স হয়েছে, তবে ছেলেকে এই বীরশ্রেষ্ঠ’র বীরত্বের গল্প শোনাতে ভোলেননি। বিনয় কুমারও তাই মুক্তিযুদ্ধ মানে বোঝেন মুন্সী আবদুর রউফের কবর। হৃদয় থেকে উৎসারিত ভালোবাসায় তিনিও আজীবন দেখাশোনা করে যেতে চান এই কীর্তিমানের কবর-যার বীরত্বের গল্পে ৫০ বছর পর আজও শিহরিত হয়ে ওঠে পুরো জাতি।

বীরশ্রেষ্ঠ ল্যান্সনায়েক মুন্সী আব্দুর রউফ (সংগৃহীত ছবি)

রাঙামাটির নানিয়ারচরের বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে কাপ্তাই হ্রদ। তার ভেতরে ছোট বড় অসংখ্য দ্বীপচর। এই নানিয়ারচরের একটি ইউনিয়নের নাম বুড়িঘাট। ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরুর পর মহালছড়িতে ঘাঁটি গাড়ে মুক্তিবাহিনী। একারণে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী যাতে মুক্তিবাহিনীর ঘাঁটিতে হামলা করতে না পারে সেজন্য তৎকালীন পার্বত্য চট্টগ্রামের রাঙামাটি-মহালছড়ি পানিপথ প্রতিরোধ করার জন্য এই বুড়িঘাটে একটি চৌকি স্থাপন করে মুক্তিবাহিনী। ২৬ মার্চ যুদ্ধ শুরু হলে ৮ম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের এক কোম্পানি সৈন্যের সঙ্গে ল্যান্স নায়েক মুন্সী আবদুর রউফও ছুটে আসেন পার্বত্য চট্টগ্রামে। এই বুড়িঘাটের চৌকিতে ন্যস্ত হয়ে দায়িত্ব পালন করছিলেন তিনি।  

কাপ্তাই লেকের বুড়িঘাটে বীরশ্রেষ্ঠ ল্যান্সনায়েক মুন্সী আব্দুর রউফের সমাধি (ছবি: সুপ্রিয় চাকমা শুভ)

১৯৭১ সাল ২০ এপ্রিল। মহালছড়িসহ মুক্তিবাহিনীর ক্যাম্প হামলার উদ্দেশ্যে কাপ্তাই লেকের পানিপথ দিয়ে ঢুকে পড়ে পাক হানাদার বাহিনীর দ্বিতীয় কমান্ডো ব্যাটালিয়নের এক কোম্পানিরও বেশি সৈন্য। ৬টি তিন ইঞ্চি মর্টার ও অন্যান্য ভারী অস্ত্রসহ তিনটি লঞ্চ ও দুটি স্পিড বোট নিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের এলাকায় ঢুকে তাদের অবস্থানকে চতুর্দিকে ঘিরে ফেলে।

সেই যুদ্ধে অংশ নেওয়া মুক্তিযোদ্ধারা পরে জানান,  ‘মুক্তিযোদ্ধাদের অবস্থানের ওপর হানাদার বাহিনীর আচমকা মর্টার শেল ও অন্যান্য ভারী অস্ত্র দিয়ে গোলাবর্ষণে আমাদের প্রতিরক্ষা সম্পূর্ণ ভেঙে পড়ে। কিন্তু, প্রতিরক্ষা ব্যূহতে দায়িত্বরত ল্যান্সনায়েক মুন্সী আব্দুর রউফ শত্রুপক্ষের প্রবল গোলাবর্ষণের মুখেও ছিলেন অবিচল। তিনি তাঁর অবস্থানে থেকে মেশিনগান দিয়ে শত্রুর ওপর গোলাবর্ষণ অব্যাহত রাখেন এবং সহযোদ্ধা সব সদস্যকে নিরাপদে পশ্চাদপসারণে যাওয়ার নির্দেশ দেন।’

কাপ্তাই লেকের বুড়িঘাটে বীরশ্রেষ্ঠ ল্যান্সনায়েক মুন্সী আব্দুর রউফের সমাধি। (ছবি: সুপ্রিয় চাকমা শুভ)

সেই যুদ্ধের বয়ান আছে মুক্তিযুদ্ধের সব ইতিহাস বইয়ে। তার সহযোদ্ধারা যখন প্রাণ বাঁচাতে পিছু হটছিলেন তখন মুন্সী আব্দুর রউফ তার পরিখা থেকে বেরিয়ে মেশিনগান দিয়ে অনবরত গুলি ছুড়তে থাকেন সরাসরি শত্রুর স্পিডবোটগুলোকে লক্ষ্য করে। তার গুলির আঘাতে শত্রুপক্ষের দুটি লঞ্চ ও একটি স্পিডবোট পানিতে ডুবে যায় এবং দুই প্লাটুন শত্রুসৈন্যের সলিল সমাধি হয়। এ অবস্থা দেখে শত্রুসেনাদের বাকি একটি লঞ্চ ও একটি স্পিডবোট দ্রুত পিছিয়ে মুন্সী আব্দুর রউফের মেশিনগানের রেঞ্জের বাইরে চলে যায়। সেখান থেকে সমগ্র প্রতিরক্ষা ব্যুহ এলাকায় গুলিবর্ষণ শুরু করে। এদিকে, অবস্থান পাল্টাতে দেরি করায় তার মেশিনগানের গুলির উৎস লক্ষ্য করে হানাদার বাহিনী মর্টারের গোলা ছোড়ে। সেই গোলার আঘাতে তার শরীর ছিন্নভিন্ন হয়ে যায় এবং তিনি শাহাদাৎ বরণ করেন।

কাপ্তাই লেকের ভেতরে বীরশ্রেষ্ঠ মুন্সী আব্দুর রউফের সমাধি।

শহীদ মুন্সি আব্দুর রউফের অসীম সাহস ও বীরত্বপূর্ণ পদক্ষেপের ফলে শত্রুবাহিনী মহালছড়িতে মুক্তিবাহিনীর মূল অবস্থানের দিকে অগ্রসর হতে পারেনি। তিনি তাঁর জীবন উৎসর্গ করে কর্তব্যপরায়ণতা ও দেশপ্রেমের এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করে গেছেন। বিজয় অর্জনের পর এই মহান দেশপ্রেমিককে বীরত্ব ও দেশপ্রেমের অমর স্বীকৃতি হিসেবে ‘বীরশ্রেষ্ঠ’ উপাধিতে ভূষিত করে সরকার।

কাপ্তাই লেকের বুড়িঘাটের একটি দ্বীপে বীরশ্রেষ্ঠ মুন্সী আব্দুর রউফের সমাধি। (ছবি: জিয়াউল হক জিয়া)

সেই যুদ্ধে তার সঙ্গী ছিলেন বীর মুক্তিযোদ্ধা রবার্ট রোনাল্ড পিন্টু। তিনিও এখন আর বেঁচে নেই। তবে জীবদ্দশায় পিন্টু জানিয়েছিলেন সেই যুদ্ধের স্মৃতি। তিনি বলেছিলেন, ‘‘সেই সময় পাকিস্তানি বাহিনীর গোলার আঘাতে আমাদের নৌযানও ধ্বংস হয়েছিল। আমরা বেশ কয়েকজন সাঁতরে পার্শ্ববর্তী পাহাড়ে আশ্রয় নেই। মুন্সি আব্দুর রউফকেও সেখান থেকে সরে যাওয়ার জন্য অনেক ডাকাডাকি করি। কিন্তু তিনি বললেন, ‘তোমরা নিরাপদে সরে যাও। আমি যুদ্ধ চালিয়ে যাবো।’ একসময় পাকিস্তানি বাহিনীর ছোড়া মর্টারের আঘাতে শহীদ হন মুন্সি আব্দুর রউফ।’’

কাপ্তাই লেকের বুড়িঘাটের একটি দ্বীপে বীরশ্রেষ্ঠ মুন্সী আব্দুর রউফের সমাধি। (ছবি: জিয়াউল হক জিয়া)

পাকিস্তান হানাদারবহিনী সরে যাওয়ার পর মুন্সী আব্দুর রউফের দেহ খণ্ডগুলো কুড়িয়ে এনে এই নানিয়ারচরের বুড়িঘাট দ্বীপে তাকে সমাহিত করেন স্থানীয় দয়াল কৃষ্ণ চাকমা। তারপর থেকে পরের ২৫ বছর এই কবর আগলে রাখার কাজটি একাই করেছিলেন তিনি। এই ২৫ বছরে এই বীরশ্রেষ্ঠর কবরটি আর কেউ শনাক্তের চেষ্টা করেননি। তবে ১৯৯৬ সালে তৎকালীন বাংলাদেশ রাইফেলস (বিডিআর)-এর উদ্যোগে দয়াল কৃষ্ণ চাকমার মাধ্যমে কবরটি আবারও চিহ্নিত হয় এবং সেই দ্বীপে নির্মিত হয় বীরশ্রেষ্ঠ মুন্সি আব্দুর রউফের সমাধি সৌধ। এরপর এর দেখভালের দায়িত্ব কেয়ারটেকার হিসেবে আবারও দেওয়া হয় দয়াল কৃষ্ণ চাকমাকে। রাঙামাটি শহর থেকে ২৫ কিলোমিটার উত্তরে নানিয়ারচর উপজেলার বুড়িঘাট ইউনিয়নের কাপ্তাই হ্রদের চারিদিকে ঘেরা চিংড়িখাল এলাকায় অপরূপ সৌন্দর্য্যমণ্ডিত একটি ছোট ঢিলার ওপর গড়ে তোলা হয়েছে বীর শ্রেষ্ঠ মুন্সী আব্দুর রউফের স্মৃতিসৌধটি।

বীরশ্রেষ্ঠ মুন্সি আব্দুর রউফ সমাধি সৌধের কেয়ার টেকার দয়াল কৃষ্ণ চাকমার ছেলে বিনয় কুমার চাকমা বলেন, আমি মুক্তিযুদ্ধ দেখিনি। বাবাকে দেখেছি দেশের এই বীরশ্রেষ্ঠের কবর দীর্ঘদিন দেখাশোনা করতেন। এখন তার শারীরিক অবস্থা খারাপ হয়ে যাওয়ায় আমিই দেখাশোনা করি। এই সমাধি স্থলটা দেখাশোনা করতে পারাই যেন আমার মুক্তিযুদ্ধ।

কাপ্তাই লেকের বুড়িঘাটের একটি দ্বীপে বীরশ্রেষ্ঠ মুন্সী আব্দুর রউফের সমাধি। (ছবি: জিয়াউল হক জিয়া)

প্রসঙ্গত, ফরিদপুরের মধুখালী উপজেলার সালামতপুর গ্রামে ১৯৪৩ সালের ১ মে জন্মগ্রহণ করেন বীরশ্রেষ্ঠ মুন্সি আব্দুর রউফ। বাবা মেহেদী হোসেন স্থানীয় একটি মসজিদে ইমামতি করতেন। মাতার নাম মুকিদুন নেছা। তিন ভাই-বোনদের মধ্যে আব্দুর রউফ ছিলেন বড়। উপজেলার কামারখালী হাইস্কুলে নবম শ্রেণিতে পড়াবস্থায় ১৯৬৩ সালের ৮ মে তৎকালীন ইপিআর বর্তমানে বিজিবিতে যোগ দেন তিনি। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে তিনি অষ্টম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সঙ্গে যুক্ত হয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। তার সৈনিক নম্বর ছিল ১৩১৮৭।

/টিএন/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
মেলা থেকে অস্ত্রের মুখে দুই নারীকে তুলে নিয়ে ধর্ষণ
মেলা থেকে অস্ত্রের মুখে দুই নারীকে তুলে নিয়ে ধর্ষণ
তীব্র গরমে সিল্কসিটি ট্রেনে আগুন
তীব্র গরমে সিল্কসিটি ট্রেনে আগুন
দ্বিতীয় বিয়ে করায় স্বামীর অঙ্গহানি করলেন স্ত্রী
দ্বিতীয় বিয়ে করায় স্বামীর অঙ্গহানি করলেন স্ত্রী
প্রচণ্ড গরমেও ভোটকেন্দ্রে ভোটার, ভোটদানের হার ৬১ শতাংশ
ভারতে দ্বিতীয় দফায় ভোটপ্রচণ্ড গরমেও ভোটকেন্দ্রে ভোটার, ভোটদানের হার ৬১ শতাংশ
সর্বাধিক পঠিত
সরকারি না হলেও সলিমুল্লাহ কলেজে অধ্যাপক ১৪ জন
সরকারি না হলেও সলিমুল্লাহ কলেজে অধ্যাপক ১৪ জন
মৌসুমের সব রেকর্ড ভেঙে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা চুয়াডাঙ্গায়
মৌসুমের সব রেকর্ড ভেঙে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা চুয়াডাঙ্গায়
এগিয়েছে ‘ওমর’, চমকে দিলো ‘লিপস্টিক’!
ঈদের ছবিএগিয়েছে ‘ওমর’, চমকে দিলো ‘লিপস্টিক’!
হোটেল রুম থেকে এই ৫ জিনিস নিয়ে আসতে পারেন ব্যাগে ভরে!
হোটেল রুম থেকে এই ৫ জিনিস নিয়ে আসতে পারেন ব্যাগে ভরে!
ট্রাকেই পচে যাচ্ছে ভারত থেকে আনা আলু, বাজারে ৫৫ টাকা কেজি
ট্রাকেই পচে যাচ্ছে ভারত থেকে আনা আলু, বাজারে ৫৫ টাকা কেজি