X
শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪
১৩ বৈশাখ ১৪৩১

বাড়তি বডির ‘অন্ধ’ লরি!

হুমায়ুন মাসুদ, চট্টগ্রাম
১২ এপ্রিল ২০২১, ২২:১৪আপডেট : ১২ এপ্রিল ২০২১, ২২:১৬

নিয়ম হচ্ছে, একটি লরিতে একটি ডাকটাইল পাইপ পরিবহন করতে হবে কিন্তু, করা হচ্ছে তিনটি পাইপ। একটির ওজন ৮টন, ফলে প্রতিটি লরিতে বাড়তি টানা হচ্ছে আরও ১৬ টন ওজন। গন্তব্যও কাছে-পিঠে নয়, সরকারি টেন্ডারে চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে আনা এসব পাইপ নিয়ে ‘অন্ধ’ লরিগুলো চলছে নারায়ণগঞ্জের পথে। সরকারি কাজে ‘অন্ধ’ বাহন! ‘অন্ধ’ কারণ একটির বেশি ডাকটাইল পাইপ ওঠালে চালক গাড়ির লুকিং গ্লাসে পেছনের অংশ দেখতে পারেন না। যদি পথে কোনোভাবে পাইপ বেঁধে রাখা বেল্টটি ছিঁড়ে যায় তাহলে কেল্লা ফতে। লরির মুরোদ নেই বাঁধন খোলা তিনটি পাইপ নিয়ে যাওয়ার। তাহলে লরি থেকে পাইপ হয় খসে পড়বে না হয় ব্রেক ফেল! তাহলে কীভাবে?

যেভাবে হচ্ছে তা হলো, লরির মূল বডির সঙ্গে সংযুক্ত হচ্ছে ক্লাম, তাই দিয়ে বডি কিছুটা বাড়ালেই রাখা যায় তিনটি ডাকটাইল পাইপ। ঝুঁকিপূর্ণ এবং আইনসম্মত নয়, তবে রাখা যায় এবং পরিবহন করাও হচ্ছে রীতিমতো। সারা পথে আইন মানানোর জন্য সরকারের ট্রাফিক পুলিশসহ আরও ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নজরদারি আছে, তবে এমন লরির স্ফীত বডি দেখে তাদের কেউ আর এগিয়ে আসছেন না।

ডাকটাইল পাইপ নিয়ে আসা এই লরির বডি দুই পাশে বাড়ানো হয়েছে দুই ফুট করে চার ফুট। বিপরীত দিক থেকে যে গাড়িগুলো আসবে এমন বিসদৃশ মাপের কারণে সেগুলোর দুর্ঘটনায় পড়ার সম্ভাবনা অনেক বেশি।

মোটরযান নির্মাণের সোজা আইন হচ্ছে, যানবাহনের মোট দৈর্ঘ্য (বডি) চাকার মাপের খুব বাইরে যেতে পারবে না। আর চালকের কেবিন ও মালামাল বহনের অংশের মাপ সমান হবে। কিন্তু এই নিয়মের তোয়াক্কা না করেই ঢাকা ওয়াসার একটি প্রকল্পের জন্য আনা ডাকটাইল পাইপগুলো পরিবহনের জন্য লরির বডি দুই পাশে দুই ফুট করে বাড়িয়ে দিব্বি চালাচ্ছে ‘আর এম মোটরস’। একটি লরিতে যেখানে একটি ডাকটাইল পাইপ পরিবহনের কথা, সেখানে এমন ক্লাম লাগানো শেপে (আকার), দিব্বি মেপে তুলে দিচ্ছে তারা ৮ টন ওজনের একের বদলে তিনটি ডাকটাইল। যাচ্ছে ‘অন্ধ’ লরি নারায়ণগঞ্জ। 

তবে এমন করে পরিবহন যে বিধিসম্মত নয় সে কথা শুনতেই চান না আর এম মোটরস’র ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা। সরকার গাড়ি নির্মাণ ও চলাচলের আইন বানালেও এসব বিশাল ওজনের পাইপ পরিবহনে নাকি আবার ছাড় দিয়েছে! প্রতিষ্ঠানটির চট্টগ্রামস্থ গ্যারেজের ম্যানেজার মোরশেদ বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘সরকারের মাল আমাদেরকে যেভাবে পরিবহন করতে বলেছেন আমরা সেইভাবে পরিবহন করছি। আমাদেরকে এক সাথে তিনটা ডাকটাইল পাইপ পরিবহন করতে বলেছেন, আমরা তাই করছি।’

তার কাছে উদাহরণও আছে। বলেন, ‘এর আগে আলী এন্টারপ্রাইজ এভাবে দেড় হাজার পাইপ পরিবহন করেছে। আমরাও সেইভাবে পরিবহন করছি।’

তখন মোটরযান আইনটি সামনে আনা হয় তার। এই আইন অনুসারে, ‘মূল কাঠামো বা আকৃতি পরিবর্তন ও পরিবর্ধন অবৈধ’ তাহলে আপনাদের প্রতিষ্ঠানের লরির দুই পাশে দুই ফুট করে চার ফুট বডি কেন বাড়ানো জিজ্ঞেস করতেই একেবারে মুখবন্ধ করে ফেলেন তিনি। আর কোনও মন্তব্য করতে রাজি হননি।

এদিকে ‘সরকারের মাল’ বলে আর এম মোটরস নিজেদের দায় এড়ানোর চেষ্টা করলেও পরিবহন ব্যবসার সঙ্গে জড়িতরা জানিয়েছেন, বডি বাড়িয়ে এভাবে ডাকটাইল পাইপগুলো পরিবহন করার কারণে যে কোনও সময় ঘটতে পারে ছোট-বড় দুর্ঘটনা। কারণ একটি গাড়ি যখন মূল বডির বাইরে মালামাল পরিবহন করে তখন ওই গাড়ি খুব সর্তকর্তার সঙ্গে চালাতে হয়। না হয়, সড়কে অন্য গাড়ির সঙ্গে লেগে যেকোনও সময় দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। আবার ওই গাড়ি সতর্কতার সঙ্গে চালালেও সড়কে থাকা অন্য পরিবহনগুলোও যেহেতু দ্রুতগতিতে চলাচল করে থাকে তাই স্বাভাবিক মাপের চেয়ে বড় লরিতে অনিচ্ছায় তারা আটকে গিয়ে বা ধাক্কা লেগে বড় দুর্ঘটনা ঘটতে পারে।’

এ সম্পর্কে জানতে চাইলে ট্রেইল শ্রমিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক আবু বকর ছিদ্দিক বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, বডি বাড়িয়ে মালামাল পরিবহন করলে সেখানে দুর্ঘটনা ঘটবেই। ডাকটাইল পাইপ পরিবহনের ক্ষেত্রে ইতোমধ্যে বেশ কয়েকটা দুর্ঘটনা ঘটেছেও। নিয়ম মেনে পাইপগুলো পরিবহন করার জন্য আমরা প্রতিষ্ঠানটিকে একাধিকবার বলেছি। কিন্তু তারা সেটি না করে পুলিশ এবং সড়ক ও জনপদের কর্মকর্তাদের ম্যানেজ করে একটি লরিতে একটির জায়গায় তিনটি পাইপ পরিবহন করছে।’

তিনি আরও বলেন, ‘চালকরাও একসঙ্গে তিনটি পাইপ পরিবহন করতে রাজি নয়। তিনটি পাইপ একসঙ্গে নিতে গেলে চালকরা গাড়ির লুকিং গ্লাসে পেছনের অংশ দেখতে পারেন না। এতে গাড়ির মুভমেন্ট করানো অনেক কঠিন হয়ে যায়, যে কারণে যে কোনও সময় দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। কিন্তু মালিক পক্ষ তাদেরকে চাকরিচ্যুত করার হুমকি দিয়ে পাইপগুলো পরিবহন করাচ্ছে।’

লম্বায় ২৮ ফুট, ৭২ ইঞ্চি গোলাকৃতির প্রতিটি ডাকটাইল পাইপের ওজন ৮ টন। নিয়ম অনুযায়ী একটি ট্রেইলরে করে একটি পাইপ পরিবহনের কথা। এই নিয়ম মেনেই তারা পাইপগুলো বন্দর থেকে বের করে টোল রোডের পাশে একটি লোকাল শেডে রাখে। সেখান থেকে তারা এক লরিতে তিনটি করে পাইপ নিয়ে নারায়ণগঞ্জ যাচ্ছে।  লুকিং গ্লাসে গাড়ির পেছনের অংশ দেখতে না পাওয়া অবস্থায় নির্ধারিত ওজনের তিনগুণ বেশি ওজন নিয়ে চট্টগ্রাম থেকে নারায়ণগঞ্জ আসছে এসব লরি!

গতকাল নগরীর টোল রোড এলাকায় গিয়ে এ ধরনের বেশ কয়েকটি লরি দেখা যায়। প্রত্যেকটি লরিতে তিনটি করে পাইপ পরিবহন করা হচ্ছে। ভালো করে তাকালে বোঝা যায়, তিনটি পাইপ পরিবহন করার জন্য লরির দুই পাশে অ্যাঙ্গেল লাগিয়ে লরির বডি দুই ফুট করে চার ফুট করে বাড়ানো হয়েছে। এভাবে বাড়ানো বডিতে দুইটি এবং তার ওপর আরও একটি পাইপ রেখে বেল্ট দিয়ে বেঁধে পাইপগুলো পরিবহন করা হচ্ছে। যে কোনোভাবে যদি বেল্ট ছিঁড়ে যায় তাহলে এই লরির পক্ষে ৮ টন ওজনের পাইপগুলো আর আটকে রাখা সম্ভব হবে না। আর এগুলো রাস্তার ওপরে পড়ে যে কোনও মুহুর্তে দুর্ঘটনার সৃষ্টি হতে পারে। জানা গেছে, এভাবে পরিবহন করায় গত ডিসেম্বর মাসের মাঝামাঝি ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের ফৌজদারহাট এলাকায় একটি দুর্ঘটনাও ঘটেছে।

ডাকটাইল পাইপ বোঝাই লরি। সাধারণ মাপের চেয়ে বডি বাড়ানোতে এসব লরির চালক লুকিং গ্লাস দিয়ে পেছনটা দেখতে পান না।

পাইপগুলো পরিবহনের জন্য চট্টগ্রামে হক্কানী মোটরসকে বলা হলেও ঝুঁকি থাকায় কাজটি এভাবে করতে রাজি হয়নি প্রতিষ্ঠানটি। যোগাযোগ করা হলে হক্কানী মোটরসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. সুজা উদ্দিন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘একটি লরিতে তিনটি ডাকটাইল পাইপ পরিবহন করা অনেক ঝুঁকির কাজ। তাই আমাদেরকে পাইপগুলো পরিবহন করতে বলার পরও আমরা কাজটি নেইনি।’

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, এই ডাকটাইল পাইপগুলো নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে ঢাকা ওয়াসার ‘গন্ধর্বপুর পানি শোধনাগার’ প্রকল্পের জন্য নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। চীনে তৈরি এসব ডাকটাইল পাইপ নিয়ে আসে ঢাকা ওয়াসার ওই প্রকল্পের কাজ পাওয়া ফ্রান্সভিত্তিক কোম্পানি ‘সুয়েজ’। চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে নিয়ে আসা এই পাইপগুলো ‘এডিটর’ নামে ঢাকার একটি কনস্ট্রাকশন কোম্পানি বন্দর থেকে খালাস করে।  এরপর প্রতিষ্ঠানটি পাইপগুলো পরিবহনের জন্য ‘আর এম মোটরস’কে দায়িত্ব দেয়। আর এম মোটরস পাইপগুলো চট্টগ্রাম থেকে নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে ঢাকা ওয়াসার গন্ধর্বপুর পানি শোধনাগার প্রকল্প এলাকায় নিয়ে যাচ্ছে। ওই প্রকল্পের জন্য মোট ২ হাজার ৯০০টি পাইপ নিয়ে আসা হয়েছে। নভেম্বর মাসে কিছু পাইপ পরিবহনের পর গত দুই মাস পাইপগুলো পরিবহন বন্ধ ছিল। গত পরশু থেকে ফের এভাবেই ঝুঁকিপূর্ণভাবে পাইপগুলো পরিবহন শুরু করেছে আর এম মোটরস।

আর এম মোটরসকে কী চুক্তিতে ডাকটাইল পাইপগুলো পরিবহনের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে জানতে চাইলে কনস্ট্রাকশন কোম্পানি এডিটরের প্রকৌশলী আতিক এ বিষয়ে কোনও মন্তব্য করতে রাজি হননি। বাংলা ট্রিবিউনকে তিনি বলেন, পাইপগুলো কিভাবে ম্যানেজমেন্ট হচ্ছে এ বিষয়ে আমার কাছে বিস্তারিত কোনও তথ্য নেই। এ বিষয়ে কিছু বলতে তিনি অপারগতা প্রকাশ করেন।

এ সম্পর্কে জানতে চাইলে চট্টগ্রাম নগর ট্রাফিক পুলিশের উপ কমিশনার (বন্দর) শাকিরা সোলতানা বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, এ ধরনের ঘটনা আমার জানা নেই। আমি খোঁজ নিচ্ছি।

/টিএন/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
ব্রাজিলিয়ানের গোলে আবাহনীতে স্বস্তি
ব্রাজিলিয়ানের গোলে আবাহনীতে স্বস্তি
স্নাতক অনুষ্ঠান বাতিল করল ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়
যুক্তরাষ্ট্রে ইসরায়েলবিরোধী বিক্ষোভস্নাতক অনুষ্ঠান বাতিল করল ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়
বৈশাখী মেলায় গানের আয়োজন, কমিটির সঙ্গে দর্শকদের সংঘর্ষে নিহত ১
বৈশাখী মেলায় গানের আয়োজন, কমিটির সঙ্গে দর্শকদের সংঘর্ষে নিহত ১
হলিউডের প্রস্তাব ফিরিয়ে দিলেন ক্যাটরিনা!
হলিউডের প্রস্তাব ফিরিয়ে দিলেন ক্যাটরিনা!
সর্বাধিক পঠিত
খুলনায় এযাবৎকালের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা
খুলনায় এযাবৎকালের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা
চুক্তিতে মাউশির ডিজি হলেন নেহাল আহমেদ
চুক্তিতে মাউশির ডিজি হলেন নেহাল আহমেদ
মৈত্রী ট্রেনে তল্লাশি, মুদ্রা পাচারের অভিযোগে আটক দুই বাংলাদেশি
মৈত্রী ট্রেনে তল্লাশি, মুদ্রা পাচারের অভিযোগে আটক দুই বাংলাদেশি
আমরা সবাই ফেরেশতা, বাস করি বেহেশতে: রায়হান রাফী
আমরা সবাই ফেরেশতা, বাস করি বেহেশতে: রায়হান রাফী
এগিয়েছে ‘ওমর’, চমকে দিলো ‘লিপস্টিক’!
ঈদের ছবিএগিয়েছে ‘ওমর’, চমকে দিলো ‘লিপস্টিক’!