X
শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪
১৩ বৈশাখ ১৪৩১

কবির হুমায়ূনের কবিতার চকিত পাঠ

বীরেন মুখার্জী
২৮ এপ্রিল ২০২১, ০০:০১আপডেট : ২৮ এপ্রিল ২০২১, ০০:০১

‘আমরা ঘর থেকে জীবন পাল্টাই; জীবন থেকে ঘর। আমরা ক্ষুধা থেকে চাহিদা পাল্টাই; চাহিদা থেকে ক্ষুধা।’—জীবনের এ এক পরম সত্য, বৈপরীত্য, উপলব্ধি এবং বাস্তবতা, যা কবির হুমায়ূনের কবিতায় উঠে এসেছে গভীরভাবে। কবিতাটিতে জীবনের উত্থান-পতন, আলোছায়ার চিত্রায়ন ঘটতে দেখি। জীবন যে কত বেদনা ও কষ্টের, সে অনুভূতি প্রবলভাবে কবিকে কষ্টে ভিজিয়ে তোলে। ‘শিলালিপি স্তম্ভলিপি’ কবিতার অন্তঃস্থলে দুলে ওঠা এই অনুভূতি কবির আত্মমগ্নতা ছুঁয়ে সব মানুষের প্রাণের উপলব্ধি হিসেবে মান্যতা পেতে পারে এ কারণে যে, আধুনিকতার অবক্ষয়ী চেতনার বিপরীতে নৈঃসঙ্গ ও আত্মমগ্নতা কবির হুমায়ূনের কবিতার প্রধান উপজীব্য। তার কবিতা শুধু নৈরাশ্য কিংবা অচরিতার্থ জীবনের হাহাকার নয়, স্বকালচেতনায়ও প্রোজ্জ্বল। জীবন ও কবিতাকে তিনি অভিন্ন দৃষ্টিতে দেখেছেন। ফলে কবির একাধিক কবিতায় এ দুটি বিষয় একীভূত হতে দেখি।

কবির হুমায়ুনের কবিতাপাঠে এটা স্পষ্ট যে, তিনি জীবনের যে ক্ষরণ ও সৌন্দর্য উপলব্ধি করেছেন, তা কবিতায় মূর্ত করে তোলার চেষ্টা করেছেন। জীবন থেকে পাওয়া এই অনুভূতি সবার কাছে স্পষ্ট করে তুলতে প্রকৃতি, পুরাণ, মিথ, পারিপার্শ্বিকতা ও সমকালকে যতটুকু ছুঁতে হয় ঠিক ততটুকুই ছুঁয়েছেন। বলা যেতে পারে, অনুভূতি যেখানে বেদনাকে ছুঁয়ে যায় সম্পূর্ণত, সেখানেই হৃদয়-বীণায় ঝংকৃত হয় ভিন্নসুর; পাঠকও যেন নিজেকে খুঁজে পান কবির শব্দ-সরোবরে। তখন মনে হয়, হৃদয় খুঁড়ে বেদনা জাগানোই বুঝি কবিতাশিল্পের ধর্ম! কবি যখন উচ্চারণ করেন—‘আমরা আলোর ভিতর দিয়ে জীবনকে ফুটো করি; সভ্যতা থেকে রাষ্ট্র। জন্ম থেকে অধিকার।’— তখন কবির অভিব্যক্তি সমষ্টিচেতনায় এসে মিশে যে রূপকের সৃষ্টি করে, তাতে সামগ্রিক জীবনের প্রতিফলন লক্ষ করা যায়। কবির আত্মকথন গোপন ব্যথার মতো বেজে উঠলে পাঠক তাতে আকণ্ঠ ডুব দিয়ে জীবনেরই রসাস্বাদন করেন। এ প্রসঙ্গে বলা যায়, মানুষ মূলত স্বপ্নচারী। স্বপ্নচারিতার সীমা অনির্দিষ্ট হলেও স্বপ্নের গন্তব্য সীমিত। মানুষ স্বপ্নের জগতেও মূলত তার পরিচিত পরিমণ্ডলে বিচরণ করে। আর অভিজ্ঞতার বাইরে মানুষ খুব বেশি সফল হতে পারে না। তবে ‘চিন্তার সততা এবং কল্পনার স্বচ্ছতায়’ ব্যক্তি কবির ‘আমি’র উত্তরণ ঘটে নৈর্ব্যক্তিক সত্তায়; বিশেষ ‘আমি’ রূপান্তরিত হয় নির্বিশেষে। কবির হুমায়ূনের কবিতায়ও এর স্বাক্ষর মেলে। 

বলা বাহুল্য, আধুনিক বাংলা কবিতা গভীরতর অর্থে ঐতিহ্যের পরম্পরা এবং সংস্কৃতির রূপায়ণের ফল এবং আধুনিক কবিতার একটি গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ সংকট ও বিচ্ছিন্নতাবোধ। এ দৃষ্টিকোণ থেকে বিবেচনা করা হলে কবির হুমায়ূনের কবিতা এর ব্যতিক্রম নয়। আধুনিক সভ্যতায় গণমানুষের মৌল চারিত্র্য যেমন অবদমনের বিপরীতে উপভোগ এবং অনুশোচনায় পরিবর্তে আহ্বান এবং তৃষ্ণা নিবারণের; সেখানে কবির সভ্যতা ভিন্ন চারিত্র্যে সমুজ্জ্বল। কবির ‘নিজস্ব সভ্যতা’য় উঠে আসে ‘আমারও সভ্যতা আছে। এমন হয়-অবসরে প্রহরের/ চাকা ঘোরে। বাতি লয়ে একচোখ হেঁটে যাবে—ভুবনের সমূহ ভূমি,/ কী বুভুক্ষু সাম্রাজ্যের অভিলাষ। বিরতিশূন্য তীরের ফলায়/ ছুটে আসা আলোর ফণা, অন্ধকারের আল টপকায়।’ কবিতাটি যেন নিরাশ্রয়ী ও হতোদ্যম মানুষের আশা-নিরাশার দোলাচলে দোলে। এই পরস্পরবিরোধী সত্তাই যেন আধুনিককালের কবিকে সময়ের কাছে কখনো-কখনো জটিল, অস্পষ্ট করে তোলে, সেসঙ্গে দুর্বোধ্যও। গবেষক আহমদ রফিকের মতে, ‘বাংলাদেশের কবিতা এখন ব্যক্তিবৃত্তে আবদ্ধ এবং তা বিচ্ছিন্ন কাব্যব্যক্তিত্বের প্রকাশে।’ কবির হুমায়ূনের ‘নিজস্ব সভ্যতা’ শিরোনামের কবিতাটিতে বিচ্ছিন্নতার প্রকাশ লক্ষ করা যায় তীব্রভাবে।   

‘স্পর্শ-এক’ কবিতায় তিনি বলেছেন, ‘মাটির ভাঁজ—সেইখানে বেজে চলে রবিদার সেতার। কালাচাঁদ বাঁশিবাজে আজানের শূন্য চরে। সিলিকার নাক ফুলে মা; প্রথম অন্ধকার পৃথিবী ধাক্কা খায়। জোনাক আগুনে চোখ মেরে নেমে আসে ভালুকের কালোজাম লোম।’ কবিতাটি অনুভবে যেটুকু বোঝা যায় সেটুকুই সার, মর্মোদ্ধার সহজ হয় না; অর্থও উদ্ধার হয় না। এখানে বলা হয়েছে ‘জোনাক আগুনে চোখ মেরে নেমে আসে ভালুকের কালোজাম লোম’, এটি অবাস্তব ব্যাপার, তাই অলঙ্কার-অধিকাররূঢ়বৈশিষ্ট্য রূপক। কবির হুমায়ূনের কবিতায় এরূপ রূপকের উপস্থিতি সর্বাধিক। এজাতীয় কবিতাকে বোদ্ধাগণ উত্তর-আধুনিক (পোস্ট-মডার্নিজমের) কবিতা হিসেবে শনাক্ত করেন। অস্বীকার করা যাবে না যে, ‘পৃথিবীতে যতদিন মানুষ আছে, তাদের মন আছে, মনে জোয়ার-ভাটার খেলা আছে, প্রেম আছে, প্রকৃতি আছে, ততদিন কবিতাও আছে। অর্থাৎ, কবিতার জন্মও এক অবিসংবাদী সত্য। কারণ কবিতা হচ্ছে ‘অনুভূতিসঞ্জাত এক রূপময় ভাবশিল্প’।” সুতরাং, কবির হুমায়ূনের কবিতাশিল্পের ভাব থেকেই পাঠককে রসাস্বাদন করতে হয়।

এখানে একটি কথা বলা প্রয়োজন যে, বাংলাদেশের আধুনিক বাংলা কবিতা নানান ইজমের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত। এর মধ্যে অ্যাবসার্ড কবিতার প্রাবল্যই বেশি। বর্তমান যুগ যান্ত্রিক, প্রযুক্তিনির্ভর এবং অবক্ষয়ের। ফলে কবিরা এই অবক্ষয়কে উদ্দেশ্যহীন, যুক্তিহীন এবং অর্থহীনতার নিরিখে দেখেছেন। সংগত কারণেই বর্তমানের কবিতায় অর্থ খুঁজে পাওয়া যায় না। বেশিরভাগ কবিতায় যুক্তির শৃঙ্খলার অনুপস্থিতি থাকে। এ জাতীয় কবিতার ব্যাখ্যা দাঁড় করানো সম্ভব নয়, অনুচিতও বটে। বিশ্লেষকরা বলেছেন, কবিতার ব্যাখ্যা নিষ্প্রয়োজন। কবিতা উপলব্ধির বিষয়। কবির হুমায়ূনের বেশিরভাগ কবিতা উপলব্ধি করা যায়, ব্যাখ্যা করা যায় না। তবে সহজে ব্যাখ্যা বা উপলব্ধি করা যায় এমন কবিতা যে তিনি লিখেননি তা নয়। এ প্রসঙ্গে ‘মা’ কবিতাংশ থেকে পাঠ নেওয়া যেতে পারে।

হেমন্তেই ঝরাপাতা ঝরে। মানুষ ঝরাপাতা নয় যে
হেমন্তেই ঝরবে। সুতরাং ঝরে সারাটি বছর।
ভোরে, মধ্যরাতে, মধ্যদুপুর কিংবা সন্ধ্যায়।
এতোসব ঝরাঝরি রেখে তাকাই,
কেউ হাসে; মলিন মুখে মাথাসহ অবনত হয়
হবেই তো... মানুষ যে!

‘মা’ কবিতাটি অত্যন্ত সরল ও মমতার মাধুর্যে চিত্রায়ন করেছেন কবি। মানুষ সারা বছর ঝরে রূপকের মাধ্যমে ‘মৃত্যু’র প্রসঙ্গটি তুলে ধরেছেন। একজন মা সন্তানের কাছে কতটুকু উচ্চতায় আসীন, সেবিষয়টি ভাবে ও প্রজ্ঞায়, তুলনা-প্রতিতুলনার মধ্য দিয়ে সামনে আনতে সচেষ্ট হয়েছেন। কবি বলেছেন, ‘তিনি মানে মা, বন্ধু, সহজন-প্রিয়জন’; একজন মা সন্তানের পৃথিবীজুড়ে, কীভাবে সবকিছু দখল করে সর্বত্র বিরাজিত থাকেন—তারই সবিশেষ বর্ণনা পাই কবিতাটিতে। কবির হুমায়ূনের কবিতার বর্ণনা অত্যন্ত কাব্যিক এবং ব্যঞ্জনাঋদ্ধ।

তবে মোটাদাগে কবির হুমায়ূনের কবিতায় এক ধরনের কাব্যিক ঘোর উপলব্ধ হয়। কবির শব্দ প্রক্ষেপণের মায়াজাল থেকে মর্মার্থ অনুভূত হলেও তা ব্যাখ্যাত হয় না। কেননা, তিনি অধিকাংশ কবিতায় যৌগিক বাক্যের প্রয়োগ ঘটিয়েছেন। বর্তমান আধুনিক বিশ্বে সভ্যতার নানাবিধ সংকট লক্ষ করা যায়। কবির হুমায়ূনের কাব্যবোধ বৈশ্বিক এ ভাবনায়ও সমুজ্জ্বল। তার কবিতাপাঠে একইসঙ্গে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে পরিভ্রমণেরও সুযোগ ঘটে।

আরও পড়ুন:
রটে গেছে তোর মুখ ।। কবির হুমায়ূন

/জেডএস/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
ফ্যানে ঝুলছিল কিশোরী গৃহকর্মীর লাশ
ফ্যানে ঝুলছিল কিশোরী গৃহকর্মীর লাশ
গরমে রেললাইন বেঁকে যাওয়ার শঙ্কায় ধীরে চলছে ট্রেন
গরমে রেললাইন বেঁকে যাওয়ার শঙ্কায় ধীরে চলছে ট্রেন
মন্দিরে সেলফি তুলতে গিয়ে প্রদীপে দগ্ধ নারীর মৃত্যু
মন্দিরে সেলফি তুলতে গিয়ে প্রদীপে দগ্ধ নারীর মৃত্যু
প্রতিবন্ধী শিল্পীদের আয়োজনে মঞ্চস্থ হলো ‘সার্কাস সার্কাস’ নাটক
প্রতিবন্ধী শিল্পীদের আয়োজনে মঞ্চস্থ হলো ‘সার্কাস সার্কাস’ নাটক
সর্বাধিক পঠিত
সরকারি না হলেও সলিমুল্লাহ কলেজে অধ্যাপক ১৪ জন
সরকারি না হলেও সলিমুল্লাহ কলেজে অধ্যাপক ১৪ জন
পুলিশের সব স্থাপনায় নিরাপত্তা জোরদারের নির্দেশ
পুলিশের সব স্থাপনায় নিরাপত্তা জোরদারের নির্দেশ
মৌসুমের সব রেকর্ড ভেঙে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা চুয়াডাঙ্গায়
মৌসুমের সব রেকর্ড ভেঙে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা চুয়াডাঙ্গায়
এগিয়েছে ‘ওমর’, চমকে দিলো ‘লিপস্টিক’!
ঈদের ছবিএগিয়েছে ‘ওমর’, চমকে দিলো ‘লিপস্টিক’!
হোটেল রুম থেকে এই ৫ জিনিস নিয়ে আসতে পারেন ব্যাগে ভরে!
হোটেল রুম থেকে এই ৫ জিনিস নিয়ে আসতে পারেন ব্যাগে ভরে!