X
বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪
১১ বৈশাখ ১৪৩১

যে পণ্যে করারোপ মঙ্গলজনক

শফিকুল ইসলাম
২৮ এপ্রিল ২০২১, ১৫:০০আপডেট : ২৮ এপ্রিল ২০২১, ১৬:৩১

বাংলাদেশে তামাক পণ্যে করারোপ জনসাধারণের জন্য মঙ্গলজনক। ২০১৮ সালে তামাকজনিত রোগে প্রায় এক লাখ ২৬ হাজার মানুষ মৃত্যুবরণ করেন। একই বছর তামাক ব্যবহারে সরকারের অর্থনৈতিক ক্ষতির (চিকিৎসা ব্যয় এবং উৎপাদনশীলতা হারানো) পরিমাণ ৩০ হাজার ৫৬০ কোটি টাকা। অথচ একই সময়ে (২০১৭-১৮) তামাক খাত থেকে সরকারের অর্জিত রাজস্বের পরিমাণ মাত্র ২২ হাজার ৮১০ কোটি টাকা। পরিবেশ এবং কৃষকের জীবন-জীবিকার ওপরও তামাক চাষের বিরূপ প্রভাব ব্যাপক রয়েছে। এমন সব মন্তব্য বিশেষজ্ঞদের। 

জানা গেছে, বাংলাদেশের ৩৫ দশমিক ৩ শতাংশ অর্থাৎ ৩ কোটি ৭৮ লাখ প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ যাদের বয়স ১৫ বছরের বেশি তারা তামাক ব্যবহার করে। একই সঙ্গে নিজে ধূমপান না করে কর্মক্ষেত্রসহ পাবলিক প্লেস ও পরিবহনে পরোক্ষ ধূমপানের শিকার হয় ৩ কোটি ৮৪ লক্ষ প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, তামাক পণ্যের ওপর অধিক হারে কর আরোপ করা হলে পণ্যের দাম বাড়বে, এতে তামাক পণ্য কেনার সামর্থ্য সীমিত হবে এবং এতে ব্যবহার কিছুটা কমতে পারে। 

এদিকে সরকারের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) অর্জনে তামাক পণ্যের ব্যবহার নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে তামাকজনিত রোগে মানুষের মৃত্যুর হার কমিয়ে আনার লক্ষ্যে আগামী ২০৪০ সালের মধ্যে তামাকমুক্ত বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্ন দেখছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ২০১৬ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০৪০ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে তামাকমুক্ত করার ঘোষণা দিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণার পর দেশে তামাকবিরোধী কর্মকাণ্ড বিশেষ গতি পেয়েছে। 

বিশেষজ্ঞদের অভিমত, প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণা বাস্তবায়ন, এসডিজি অর্জনের জন্য তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন সংশোধন করা জরুরি। এক্ষেত্রে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ফ্রেমওয়ার্ক কনভেনশন অন টোব্যাকো কন্ট্রোলের (এফসিটিসি) প্রস্তাবনাগুলো কার্যকর হতে পারে। এগুলোর মধ্যে গণপরিবহন ও রেস্তোরাঁয় তামাক পণ্য ব্যবহার নিষিদ্ধ করা, ধূমপানের জন্য নির্ধারিত স্থান নিষিদ্ধ করা, খুচরা সিগারেট বিক্রি বন্ধ, তামাক পণ্যের দৃশ্যমান প্রচারণা বন্ধ করা, তামাক পণ্যে সচিত্র স্বাস্থ্য সতর্ক বার্তাকে গুরুত্ব দেওয়া এবং তামাক কোম্পানির সিএসআর কার্যক্রম বন্ধ করার বিষয়গুলো বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। আরেকটি হলো, তামাক পণ্যে কর বৃদ্ধি করা। তামাক পণ্য ব্যবহারকারীদের নিরুৎসাহিত করতে তামাক পণ্যে সুনির্দিষ্ট করারোপ করার মাধ্যমে মূল্যবৃদ্ধি একটি আন্তর্জাতিকভাবে অনুসৃত পদ্ধতি। এ থেকে রাজস্ব আয়ের সুযোগও অনেক বেশি। 

বিশেষজ্ঞরা আরও মনে করেন, আসন্ন ২০২১-২২ অর্থবছরে বাজেটে সুনির্দিষ্ট কর বাস্তবায়নের মাধ্যমে ৮ লাখ তরুণকে নতুন করে ধূমপায়ী হতে বিরত রাখা সম্ভব। এর মাধ্যমে ৩ হাজার ৪০০ কোটি টাকা অতিরিক্ত রাজস্ব আয়ের সুযোগও রয়েছে। এর জন্য প্রয়োজন একটি সঠিক শুল্ক-নীতি প্রণয়ন। শুধু তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন সংশোধন বা কর বৃদ্ধিই নয়। নতুন যুগের ইলেকট্রিক্যাল সিগারেট বা ভেপ, যা কিনা ই-সিগারেট হিসেবে পরিচিত, তা নিষিদ্ধ করার বিষয়েও কার্যকর উদ্যোগ নেওয়া জরুরি বলে মনে করেন তারা। 

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে স্বাস্থ্য সুরক্ষা ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান জাতীয় সংসদ সদস্য অধ্যাপক ডা. হাবিবে মিল্লাত জানিয়েছেন, সবাইকে নিয়ে তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন বিষয়ে কাজ করছি। স্বাস্থ্যমন্ত্রী বরাবর বর্তমান তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন সংশোধনে চিঠি দিয়েছি। যেখানে সর্বমোট ১৫২ জন সংসদ সদস্য স্বাক্ষর করেছেন। আমরা প্রধানমন্ত্রীর নিকট ই-সিগারেট আমদানি, তৈরি ও ব্যবহার নিষিদ্ধের দাবিতে চিঠি দিয়েছি, যেখানে ১৫৩ সংসদ সদস্য এর পক্ষে নিজেদের সুপারিশ জানিয়েছেন। আসছে বাজেটে আমরা তামাক পণ্যে কর বাড়ানোর জন্য অর্থমন্ত্রীকে চিঠি দিয়েছি। এখানে আমরা ৫২ জন সংসদ সদস্যকে পাশে পেয়েছি। বাজেটে করারোপের বিষয়টিকে গুরুত্ব দিয়ে, আসন্ন বাজেট অধিবেশনে তামাক পণ্যে সুনির্দিষ্ট কর বাস্তবায়নের বিষয়ে কথা বলার অনুরোধ জানিয়ে সংসদ সদস্যদের চিঠিও পাঠিয়েছি।  তিনি মনে করেন, শুধু প্রধানমন্ত্রী, অর্থমন্ত্রী বা স্বাস্থ্যমন্ত্রীই নয়। এসব ক্ষেত্রে যারা দেশের সংশ্লিষ্ট পর্যায়ে রয়েছেন, আমরা সরাসরি তাদের কাছে যাচ্ছি। তাদের তামাকের ক্ষতিকর প্রভাবের বিষয়ে সকলকে সচেতন করার চেষ্টা করছি। আমাদের উদ্যোগের পাশে থাকতে অনুরোধ করছি। তাদের কাছ থেকে পরামর্শ নিচ্ছি।

এদিকে স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ জাতীয় অধ্যাপক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) ডা. আব্দুল মালিক জানিয়েছেন, তামাকের ব্যবহার কমানোর সবচেয়ে কার্যকর উপায় হচ্ছে কর বৃদ্ধির মাধ্যমে তামাক পণ্যের মূল্য বাড়ানো। কার্যকরভাবে কর বাড়ালে তামাক পণ্যের মূল্য বৃদ্ধি পায় এবং সহজলভ্যতা হ্রাস পায়। উচ্চমূল্য তরুণদের তামাক ব্যবহার শুরু নিরুৎসাহিত করে এবং বর্তমান ব্যবহারকারীদের তামাক ছাড়তে উৎসাহিত করে। সেজন্যই তামাক পণ্যে করারোপের বিষয়ে আমরা জোর দিচ্ছি। 

এ প্রসঙ্গে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান প্রজ্ঞা’র (প্রগতির জন্য জ্ঞান) নির্বাহী পরিচালক এবিএম জুবায়ের জানিয়েছেন, টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট এবং অসংক্রামক রোগ প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণে বৈশ্বিক কর্মপরিকল্পনায় তামাক নিয়ন্ত্রণ সংক্রান্ত লক্ষ্য অর্জনে বাংলাদেশ বদ্ধপরিকর। এই লক্ষ্য অর্জনে তামাক পণ্যে কর বৃদ্ধি হচ্ছে একটি সাশ্রয়ী পদক্ষেপ। একইসাথে ২০৪০ সালের মধ্যে তামাকমুক্ত বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্য অর্জনে অন্যতম কার্যকর উপায় তামাক পণ্যে কর বৃদ্ধি। প্রস্তাবিত তামাক কর সংস্কারের ফলে অতিরিক্ত রাজস্ব আয় অর্জিত হবে, যা দিয়ে সরকার দেশের স্বাস্থ্য খাত ও উন্নয়ন অগ্রাধিকারসমূহে অর্থায়ন করতে পারবে। এটি সরকার এবং জনগণ উভয়ের জন্যই লাভজনক। সে কারণেই আমরা আমাদের সংগঠনের পক্ষ থেকে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের চেয়ারম্যান বরাবরে সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব পাঠিয়েছি। আমরা বিশ্বাস করি, প্রস্তাবগুলো এনবিআর গ্রহণ করলে প্রধানমন্ত্রীর স্বপ্ন ২০৪০ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে তামাকমুক্ত করার ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা রাখবে।

তিনি জানান, আমাদের প্রস্তাব হচ্ছে ২০২১-২০২২ অর্থবছরে সকল সিগারেট ব্রান্ডে অভিন্ন করভারসহ (এক্সাইজ অংশ চূড়ান্ত খুচরা মূল্যের ৬৫%) মূল্যস্তরভিত্তিক সুনির্দিষ্ট এক্সাইজ (সম্পূরক) শুল্ক প্রচলন করা। বিড়ির ক্ষেত্রে ফিল্টারবিহীন ২৫ শলাকা বিড়ির খুচরা মূল্য ২৫ টাকা নির্ধারণ করে ১১ দশমিক ২৫ টাকা সুনির্দিষ্ট সম্পূরক শুল্ক আরোপ করা। এবং ফিল্টারযুক্ত ২০ শলাকা বিড়ির খুচরা মূল্য ২০ টাকা নির্ধারণ করে ৯ টাকা সুনির্দিষ্ট সম্পূরক শুল্ক আরোপ করা। এর ফলে উভয় ক্ষেত্রে সুনির্দিষ্ট সম্পূরক শুল্কের হার হবে চূড়ান্ত খুচরা মূল্যের ৪৫ শতাংশ। বিড়ির খুচরা মূল্যের ওপর ১৫ শতাংশ মূল্য সংযোজন কর (ভ্যাট) এবং ১ শতাংশ স্বাস্থ্য উন্নয়ন সারচার্জ বহাল থাকবে। আর ধোঁয়াবিহীন তামাক পণ্য বিশেষ করে জর্দা ও গুলের ক্ষেত্রে প্রতি ১০ গ্রাম জর্দার খুচরা মূল্য ৪৫ টাকা নির্ধারণ করে ২৭ টাকা সুনির্দিষ্ট সম্পূরক শুল্ক আরোপ করা। এবং প্রতি ১০ গ্রাম গুলের খুচরা মূল্য ২৫ টাকা নির্ধারণ করে ১৫ টাকা সুনির্দিষ্ট সম্পূরক শুল্ক আরোপ করা। এর ফলে উভয় ক্ষেত্রে সুনির্দিষ্ট সম্পূরক শুল্কের হার হবে চূড়ান্ত খুচরা মূল্যের ৬০ শতাংশ। জর্দা ও গুলের খুচরা মূল্যের ওপর ১৫ শতাংশ মূল্য সংযোজন কর (ভ্যাট) এবং ১ শতাংশ স্বাস্থ্য উন্নয়ন সারচার্জ বহাল থাকবে।

/এসআই/এফএএন/

/এফএএন/এমওএফ/
সম্পর্কিত
তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন শক্তিশালী করার বিকল্প নেই
তামাকপণ্যের দাম বাড়ানোর দাবি
তামাকে বিষ, তবুও ঝুঁকছেন কৃষক 
সর্বশেষ খবর
ছাত্রলীগের ‘অনুরোধে’ গ্রীষ্মকালীন ছুটি পেছালো রাবি প্রশাসন
ছাত্রলীগের ‘অনুরোধে’ গ্রীষ্মকালীন ছুটি পেছালো রাবি প্রশাসন
সাজেকে ট্রাক খাদে পড়ে নিহত বেড়ে ৯
সাজেকে ট্রাক খাদে পড়ে নিহত বেড়ে ৯
বার্সেলোনার সঙ্গে থাকছেন জাভি!
বার্সেলোনার সঙ্গে থাকছেন জাভি!
চার বছরেও পাল্টায়নি ম্যালেরিয়া পরিস্থিতি, প্রশ্ন নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি নিয়ে
চার বছরেও পাল্টায়নি ম্যালেরিয়া পরিস্থিতি, প্রশ্ন নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি নিয়ে
সর্বাধিক পঠিত
সিয়াম-মেহজাবীনের পাল্টাপাল্টি পোস্টের নেপথ্যে…
সিয়াম-মেহজাবীনের পাল্টাপাল্টি পোস্টের নেপথ্যে…
‘মারামারি’র ঘটনায় মিশা-ডিপজলের দুঃখপ্রকাশ
‘মারামারি’র ঘটনায় মিশা-ডিপজলের দুঃখপ্রকাশ
মিয়াবতী থেকে পিছু হটলো মিয়ানমারের বিদ্রোহীরা?
মিয়াবতী থেকে পিছু হটলো মিয়ানমারের বিদ্রোহীরা?
আজকের আবহাওয়া: কোথায় কেমন গরম পড়বে
আজকের আবহাওয়া: কোথায় কেমন গরম পড়বে
ছয় দিনের সফরে ব্যাংকক গেলেন প্রধানমন্ত্রী
ছয় দিনের সফরে ব্যাংকক গেলেন প্রধানমন্ত্রী