পুলিশ সদস্য হত্যা মামলায় আসামি না হয়েও সাত মাস ধরে কারাগারে থাকা চাঁদপুরের কচুয়া উপজেলার আবু ইউসুফ ওরফে লিমনকে (২১) মামলা থেকে অব্যাহতি দিয়েছেন আদালত। তবে তাতেও মুক্তি মিলছে না এই যুবকের। ওই হত্যা মামলার এক আসামির পরিচয় ধারণ করে আদালতে আত্মসমর্পণ করতে এসে জেলে গিয়েছিলেন লিমন- এমন অভিযোগে এবার তার বিরুদ্ধে প্রতারণার মামলা হয়েছে।
আইনজীবী মো. শামীম সরদার জানান, ইউসুফের মুক্তির জন্য করা আবেদনের ওপর শুনানি নিয়ে বৃহস্পতিবার (৩ জুন) এ আদেশ দেন ঢাকার এক নম্বর অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ আদালত। তবে এ আদেশের দু’দিন আগে আদালতের নির্দেশে প্রতারণার অভিযোগ এনে দণ্ডবিধির ৪১৯/১০৯ ধারায় অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ ১ আদালতের বেঞ্চ সহকারী এএসএম শাহাদাৎ আলী বাদী হয়ে কোতয়ালি থানায় দুজনের নাম উল্লেখ করে একটি মামলা দায়ের করেছেন। এ মামলার কারণে পুলিশ সদস্য হত্যা মামলা থেকে অব্যাহতি পেলেও মুক্তি দেয়া হয়নি লিমনকে। মামলায় অপরাধ হিসেবে দেখানো হয়েছে, অন্যের পরিচয় ধারণ করে জামিনের জন্য আদালতে আত্মসমর্পণ এবং সহায়তা করার অপরাধ।
১ জুন দায়েরকৃত নতুন মামলার এজাহারে উল্লেখ করা হয়, মো. আবু ইউসুফ লিমন নিজেকে মেট্রো দায়রা ৯৫০৭/২০২০নং মামলার আসামি মো. রবিউল ইসলাম আপন ওরফে সোহাগ ওরফে হৃদয় দাবি করে গতবছরের ২০ অক্টোবর আদালতে স্বেচ্ছায় আত্মসমর্পণ করে জামিনের প্রার্থনা করলে আদালত জামিন আবেদন নামঞ্জুর করে জেলহাজতে প্রেরণ করেন। পরে গত ২৪ ফেব্রুয়ারি ইউসুফের বাবা দরখাস্ত দিয়ে তার ছেলে মামলার আসামি নয় দাবি করে জামিনের আবেদন করেন।
এ বিষয়ে আদালতের তলবে ডিবির এসআই মনিরুজ্জামান প্রতিবেদন দাখিল করেন। ওই প্রতিবেদন উল্লেখ করা হয়, ‘আবু ইউসুফ নিজের পরিচয় গোপন করে এ মামলার প্রকৃত আসামি রবিউল ইসলাম আপনের পরিচয়ে আদালতে আত্মসমর্পণ করে ফৌজদারী অপরাধ করেছে। কাজেই, এ অপরাধের সুবিধাভোগী মূল আসামি রবিউল ইসলাম আপন এবং আবু ইউসুফসহ অন্যান্য ব্যক্তি জড়িত থাকতে পারে।’ এ অবস্থায় স্পেশাল ব্রাঞ্চের পুলিশ পরিদর্শক মো. মামুন ইমরান খানকে হত্যায় বনানী থানায় দায়ের হওয়া মামলা থেকে উদ্ভূত আরেক মামলার প্রকৃত আসামি রবিউল ইসলাম আপন এবং আবু ইউসুফসহ জড়িতদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেয়ার আবেদন জানানো হয়।
এ বিষয়ে অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ ১ আদালতের বেঞ্চ সহকারী এএসএম শাহাদাৎ আলী বলেন, অন্যের পরিচয় ধারণ করে জামিনের জন্য আদালতে আত্মসমর্পণ এবং সহায়তা করার অপরাধে আদালতের নির্দেশে আমি মামলাটি দায়ের করেছি।
চাঁদপুরের কচুয়ার পরিবার পরিকল্পনা অফিসে কর্মরত আবু ইউসুফের বাবা নুরুজ্জামান বলেন, আমার নিরপরাধ ছেলে হত্যা মামলা থেকে অব্যাহতি পাওয়ায় আমরা খুশি হয়েছিলাম। কিন্তু পরবর্তীতে আরেকটি মামলা হওয়ার খবর পেয়ে আমি হতাশ। তিনি বলেন, আমার পুরো পরিবারটাই শেষ হয়ে গেছে। ৬০ হাজার টাকায় জমি বিক্রি করে আগের মামলাটির খরচ চালিয়েছি। কিন্তু এখন আমি যে ঢাকা যাবো সেই টাকাও আমার কাছে নেই। এ অবস্থায় মামলার মোকাবিলা কীভাবে করবো বুঝতে পারছি না। তিনি বলেন, সরকার ও বিচার বিভাগের কাছে আমার দাবি, দ্রুত এ মামলাটি প্রত্যাহার করে সন্তানকে আমার বুকে ফিরিয়ে দেয়া হোক।
উল্লেখ্য, ক্রিকেটার হওয়ার স্বপ্ন নিয়ে এক বছর আগে ঢাকায় গিয়েছিলেন চাঁদপুরের কচুয়া উপজেলার আবু ইউসুফ ওরফে লিমন (২১)। মিরপুরের সিটিক্লাব মাঠে প্রশিক্ষণ নিতেন তিনি। ২০২০ সালের সেপ্টেম্বর মাসে নিখোঁজ হন তিনি। খোঁজ না পেয়ে ২০২১ সালের ১৪ জানুয়ারি কচুয়া থানায় ডায়েরি করেন তার বাবা। কিছুদিন পর জানতে পারেন একটি হত্যা মামলায় তার ছেলে লিমন কাশিমপুর কারাগারে বন্দি আছেন।
ওই মামলার ৬ নম্বর আসামি ছিল রবিউল ইসলাম ওরফে আপন নামের একজন। লিমনের পরিবারের অভিযোগ, তাকে নানা হুমকি-ধামকি দিয়ে আপনের পরিবর্তে আসামি হিসেবে আদালতে আত্মসমর্পণ করতে লিমনকে বাধ্য করা হয়েছে। এ ঘটনায় দ্রুত ‘নিরপরাধ’ সন্তানের মুক্তি চায় তার পরিবার।
২০১৮ সালে গাজীপুরে হত্যার শিকার হন পুলিশের সিআইডিতে কর্মরত উপপরিদর্শক মামুন ইমরান খান। ঘাতকরা পেট্রোল দিয়ে পুড়িয়ে নির্মমভাবে তাকে হত্যা করে। তার মরদেহ গজারির বন থেকে উদ্ধার করে পুলিশ। সেই ঘটনায় ওই বছরের অক্টোবরে মামলা হলে পরের বছর আদালতে আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র জমা দেয় পুলিশ। ওই মামলার ৬ নম্বর আসামি রবিউল ইসলাম ওরফে আপনের প্ররোচণায় নিজের পরিচয় গোপন করে আদালতে আত্মসমর্পণ করেন যুবক আবু ইউসুফ লিমন। তারপর থেকে গত ৭ মাস ধরে গাজীপুরের কাশিমপুর কেন্দ্রীয় কারাগারে বন্দি লিমন। কিন্তু এরপর থেকে প্রতারক রবিউল ইসলাম ওরফে আপনকেও আর খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।
লিমনের বোন আয়েশা আক্তার লিজা বলেন, ‘আমার ভাই কুমিল্লার ঠাকুরপাড়া মেটসে পড়ালেখা করতেন। সিটিক্লাবে ক্রিকেট খেলার সূত্র ধরে ঢাকায় অবস্থান করছিলেন। আমার ভাইকে তারা ঢাকায় ছুরি-বন্দুক দেখিয়ে অপহরণ করে। পরে ক্রসফায়ার এবং বোনকে তুলে হত্যার হুমকি দেওয়ায় ভাই আদালতে হাজির হতে বাধ্য হয়েছেন। তাকে দেড় মাসের মধ্যে বের করে নেওয়ারও আশ্বাস তারা দেয়।’ প্রকৃত আসামি রবিউল ইসলাম আপন এখন বিদেশে অবস্থান করছে বলেও দাবি করেন তিনি।
আবু ইউসুফের বাবা নুরুজ্জামান বলেন, ‘গত বছর রবিউল ইসলাম আপন নামের এক ব্যক্তি আমার নম্বরে ফোন দিয়ে বলে, আপনার ছেলে বিকেএসপিতে আছে। আপনারা চিন্তা করবেন না, আপনার ছেলে ডিসেম্বরের মধ্যে বাড়িতে চলে আসবে। কিছুদিন পর খবর পেয়ে ছেলের সঙ্গে কাশিমপুর কারাগারে দেখা করি। তার কাছ থেকে জানতে পারি লিমনকে হত্যার হুমকি ও টাকার লোভ দেখিয়ে কোর্টে পাঠায় রবিউল ইসলাম ওরফে আপন। আদালতে ইউসুফ নিজেকে রবিউল হিসেবে পরিচয় দেয়। এরপর আদালত তাকে কারাগারে পাঠায়। ছেলের মুক্তি চেয়ে ঢাকার প্রথম অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ আদালতে আবেদন করি।
আদালত আবেদনটি আমলে নিয়ে গত ২ মার্চ ডিবি পুলিশকে তদন্ত করার দায়িত্ব দেন। বিষয়টি তদন্ত করে ডিবি পুলিশ গত ২ মে আদালতে প্রতিবেদন দাখিল করে। ওই প্রতিবেদনে ঘটনার সত্যতা মিলেছে। তদন্তে বেরিয়ে এসেছে বদলি সাজা খাটার চাঞ্চল্যকর এ তথ্য। ইমরান খান হত্যা মামলার ৬ নম্বর আসামি শেখ হৃদয় ওরফে রবিউল ইসলাম আপনের স্থলে মো. আবু ইউসুফ ওরফে লিমনকে তার পরিচয় দিয়ে আদালতে আত্মসমর্পণ করায়।
হত্যা মামলা সূত্রে জানা যায়, আসামি রবিউল ইসলাম আপন গোপালগঞ্জ জেলার কোটালিপাড়া উপজেলার আসুতিয়া গ্রামের মতিউর রহমান মোল্লার ছেলে। নারীদের টোপ হিসেবে ব্যবহার করে বিত্তশালীদের ফাঁদে ফেলে অর্থ হাতিয়ে নিতেন রবিউল ও তার সহযোগীরা। তাদের কবলে পড়েছিলেন সিআইডি পুলিশের এসআই মো. মামুন ইমরান খান। এরপর তাকে ধরে নিয়ে হত্যার পর পেট্রোল ঢেলে লাশ পুড়িয়ে গাজীপুর বনে ফেলে দেয় হত্যাকারীরা। এ ঘটনায় নিহত এসআইয়ের ভাই বাদী হয়ে ঢাকার বনানী থানায় ২০১৮ সালের ১০ জুলাই মামলা করেন। এই মামলায় ২০১৯ সালের ৩১ মার্চ অভিযোগপত্র দাখিল করে পুলিশ। এরপর ঢাকার ১ নম্বর অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ আদালতে বিচার শুরু হয় মামলাটির। এরই মধ্যে বেশ কয়েকজনের সাক্ষ্য নেওয়া হয়েছে। একই মামলার ৬ নম্বর আসামি রবিউল ইসলাম ওরফে আপন, তিনি পলাতক। কিন্তু তার পরিবর্তে রবিউল সেজে চাঁদপুরের এক দরিদ্র পরিবারের সন্তান আবু ইউসুফ লিমন গত ২০ অক্টোবর ঢাকার আদালতে আত্মসমর্পণ করেন। রবিউলের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা ছাড়াও রাজধানীর বিভিন্ন থানায় তিনটি মামলা রয়েছে। সে সব মামলাও বর্তমানে বিচারাধীন।
