কয়েক সপ্তাহ ভুগে মে মাসের মাঝামাঝি করোনা থেকে সেরে ওঠেন ৫০ বছরের কালা বাই। এর কয়েক দিনের মধ্যে শরীরের ডান দিকটা দুর্বল লাগতে থাকে তার। এক সার্জনের পরামর্শে মস্তিষ্কে সিটি স্ক্যান করানো হয়। সেখানে বাদাম আকৃতির একটা টিউমার ধরা পড়ে। মধ্য প্রদেশের ধর জেলার বাড়িতে বসে কয়েক দিন বিশ্রাম নিতে থাকেন তিনি। কিন্তু ডান পাশের দুর্বল ভাবটা অসহনীয় হয়ে উঠলো তার।
এরপরই ইন্দোরের মেডিকেয়ার হাসপাতালে নিউরোসার্জন দীপক কুলকার্নির কাছে চেকআপে যান কালা বাই। ডা. কুলকার্নি জানান, ‘আমরা তার মস্তিষ্কের একটা সিটি স্ক্যান করালাম। দুই সপ্তাহের ব্যবধানে বাদামের মতো টিউমারটি প্রায় ২০ গুণ বড় হয়ে গেছে।’
গত জুলাইতে নিউরোসার্জন হিসেবে কাজের ২৫ বছর পূর্ণ করেছেন কুলকার্নি। মস্তিষ্কে অসংখ্য অপারেশন করেছেন, অসংখ্য টিউমার সরিয়েছেন, রোগীর খুলি থেকে গুলি, এমনকি কুঠারও বের করেছেন তিনি।
কালা বাইয়ের মস্তিষ্কের এমআরআই দেখে কুলকার্নি অবিলম্বে টিউমারটি অপসারণ করতে অপারেশনের সিদ্ধান্ত নেন। তার ধারণা ছিলো এটি আর দশটি সাধারণ ম্যালিগন্যান্ট টিউমারই। নিজের টিম নিয়ে গত ৮ জুলাই অপারেশন করেন তিনি। টিউমারটি সরিয়ে ফেলেন। আরও পরীক্ষার জন্য তিনি এটি বায়োপসি করতে পাঠান। বায়োপসি করতে গিয়ে দেখা গেলো এটি আসলে কোনও টিউমারই নয়-এটা একটা হোয়াইট ফাঙ্গাস।
হোয়াইট ফাঙ্গাস বা অ্যাসপারজিলাসিস মূলত অ্যাসপারজিলাস ছত্রাকের সংক্রমণে হয়ে থাকে। সাধারণ এই ফাঙ্গাস মানুষ প্রতিদিনই শ্বাস-প্রশ্বাসের মাধ্যমের নিয়ে থাকে কিন্তু অসুস্থ হয় না। কিন্তু প্রতিরোধ ক্ষমতা দুর্বল হয়ে গেলে বা করোনার মতো ফুসফুসের রোগে ভোগার পর সুস্থ হয়ে ওঠা ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে স্বাস্থ্য সমস্যা তৈরির ঝুঁকি হয়ে উঠতে পারে।
কালা বাইয়ের ক্ষেত্রে পাওয়া হোয়াইট ফাঙ্গাসটির আকার ৮.৪ X ৪ X ৪.৬ সেন্টিমিটার। ডা. কুলকার্নির দাবি কোনও রোগীর শরীরে পাওয়া পৃথিবীর সবচেয়ে বড় হোয়াইট ফাঙ্গাস এটি। তিনি বলেন, ‘আমরা যখন মস্তিষ্কের ভেতরে গেলাম, তখন এটাকে আমরা টিউমারের মতো করে অপারেশন করেছি। এমআরআই-তে এটাকে ঠিক টিউমারই দেখা গেছে, মস্তিষ্কের অস্বাভাবিক কোষগুলোও টিউমারের মতো ছিলো। বায়োপসি রিপোর্ট দেখার পরই আমরা জানতে পারলাম এটা ছিলো হোয়াইট ফাঙ্গাস।’
২৫ বছরের ক্যারিয়ারে কুলকার্নি গিনেজ বুক অব ওয়ার্ল্ড রেকর্ড বইয়ে দুইবার নাম তুলেছেন। প্রথমবার ২০০১ সালে চার বছরের এক শিশুর মাথা থেকে ৫৭০ গ্রাম ওজনের টিউমার সরিয়ে আর আরেকবার ২০১১ সালে ৬৫ বছর বয়সী এক রোগীর মস্তিষ্ক থেকে ১.৪ কেজি টিউমার সরিয়ে। পরের অপারেশনের জন্য তার নাম লিমকা বুক অব রেকর্ডসেও ওঠে।
কিন্তু কালা বাইয়ের মতো কোনও ঘটনা আগে কখনও দেখেননি দীপক কুলকার্নি। তিনি বলেন, ক্যারিয়ারের বিভিন্ন সময় আমি আলাদা আলাদা রোগীর মাথা থেকে ১৬টি বুলেট বের করেছি। এছাড়া রোগীর মাথায় গেথে যাওয়া কুঠারও বের করেছি। কিন্তু কখনওই রোগীর মস্তিষ্কে এতো বড় হোয়াইট ফাঙ্গাস দেখিনি। এটা নিশ্চিতভাবেই এক অনন্য জিনিস।
ভারতের বিভিন্ন অংশে ব্ল্যাক ফাঙ্গাসে আক্রান্তের ঘটনা জানা গেলেও হোয়াইট ফাঙ্গাসের ঘটনা তুলনামূলকভাবে কম। গত ২৭ মে দিল্লিতে প্রথম হোয়াইট ফাঙ্গাসের কথা জানা যায়। সেটি এক রোগীর পেটে পাওয়া যায়।
করোনা এবং হোয়াইট ফাঙ্গাস সংক্রমণ নিয়ে আগে বেশ কয়েকটি গবেষণা হয়েছে। তাইওয়ানে পরিচালিত এক গবেষণায় দেখা গেছে, তীব্র করোনায় ভোগা ৩৩ শতাংশম রোগী হোয়াইট ফাঙ্গাসে আক্রান্ত হয়েছেন। যুক্তরাষ্ট্র, আর্জেন্টিনা এবং স্পেনে পরিচালিত গবেষণায় দেখা গেছে অ্যাসপারজিলাস সংক্রমণ করোনায় তীব্র ভোগা রোগীদের হতে পারে।
চিকিৎসকরা সতর্ক করে দিয়ে বলেছেন, প্রাথমিক পর্যায়েই হোয়াইট ফাঙ্গাস সংক্রমণের চিকিৎসা করা উচিত। না হলে এটির আকার বাড়তে পারে আর রক্তের মধ্য দিয়ে তা মস্তিষ্কে গিয়ে পৌঁছাতে পারে।
কালা বাইয়ের ছেলে রমেশ পাওয়ার জানান তার মা এখন অ্যান্টি ফাঙ্গাল ওষুধ এবং ফিজিওথেরাপি নিচ্ছেন। তিনি বলেন, ‘সুস্থ হতে তার কিছুটা সময় লাগবে, কিন্তু তাকে চিকিৎসা করাতে পেরে আমরা কৃতজ্ঞ।’
সূত্র: দি প্রিন্ট