X
শুক্রবার, ১৭ মে ২০২৪
৩ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১

করোনা নিয়ন্ত্রণে গোঁজামিল

জাকিয়া আহমেদ
২৫ জুন ২০২১, ১৫:০০আপডেট : ২৫ জুন ২০২১, ১৫:০০

দেশে বৃহস্পতিবার (২৪ জুন) নতুন করে করোনা শনাক্ত হয়েছেন ৬ হাজার ৫৮ জন। এর মধ্য দিয়ে আবারও দেশে একদিনে শনাক্ত ছয় হাজার ছাড়িয়েছে। এ নিয়ে দেশে সরকারি হিসাবে শনাক্তের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৮ লাখ ৭২ হাজার ৯৩৫ জনে। বৃহস্পতিবার করোনায় মারা গেছেন ৮১ জন। এই ৮১ জন নিয়ে এখন পর্যন্ত মারা গেছেন ১৩ হাজার ৮৬৮ জন। এ পরিস্থিতিতে কোভিড-১৯ বিষয়ক জাতীয় কারিগরি পরার্মশক কমিটি দেশে মহামারিকালে এই প্রথম শাটডাউন দেওয়ার সুপারিশ করেছে।

পরামর্শক কমিটি বলছে, স্বাস্থ্য অধিদফতরের তথ্য বিশ্লেষণে সারাদেশেই উচ্চ সংক্রমণ এবং ৫০টিরও বেশি জেলায় অতি উচ্চ সংক্রমণ লক্ষ করা যায়। কিন্তু করোনাভাইরাস প্রতিরোধের জন্য খণ্ড খণ্ডভাবে নেওয়া কর্মসূচির উপযোগিতা প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। দেশে করোনাভাইরাসের বিশেষ করে ডেলটা প্রজাতির সামাজিক সংক্রমণ চিহ্নিত হয়েছে এবং ইতোমধ্যেই রোগের প্রকোপ অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে। ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের জীবাণুর সংক্রমণ ক্ষমতা তুলনামূলকভাবে অনেক বেশি।

পরামর্শক কমিটির বিজ্ঞপ্তিতে আরও বলা হয়েছে, বর্তমান পরিস্থিতিতে সারাদেশে কমপক্ষে ১৪ দিন সম্পূর্ণ শাটডাউন দেওয়া দরকার। জরুরি সেবা ছাড়া যানবাহন, অফিস-আদালতসহ সবকিছু বন্ধ রাখা প্রয়োজন। এ ব্যবস্থা কঠোরভাবে পালন করতে না পারলে আমাদের যত প্রস্তুতিই থাকুক না কেন, স্বাস্থ্য ব্যবস্থা অপ্রতুল হয়ে পড়বে। 

এদিকে, চলমান লকডাউন ও বিধিনিষেধ মানাতে দেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে কঠোর হতে অনুরোধ করেছে স্বাস্থ্য অধিদফতর। স্বাস্থ্য অধিদফতরের মুখপাত্র অধ্যাপক রোবেদ আমিন জানিয়েছেন, সীমান্তবর্তী এলাকাসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় এর বিস্তার ছড়িয়ে পড়ছে। শনাক্ত রোগীর সংখ্যা বাড়ছে, আশঙ্কাজনকহারে বাড়ছে মৃত্যু।

‘সংক্রমণ কমিয়ে আনার জন্য চলমান লকডাউন ও বিধিনিষেধ কঠোরভাবে মেনে চলার জন্য সবাইকে অনুরোধ করা হচ্ছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে প্রয়োজনে কঠোর হতে অনুরোধ করা হলো।’—বলেন অধ্যাপক রোবেদ আমিন।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, গত বছর করোনা মহামারি শুরুর পর থেকে নিয়ন্ত্রণে কোনও সমন্বিত পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও অধিদফতরের সঙ্গে সমন্বয়হীনতা এবং ভুল পদক্ষেপের কারণে দেশে মহামারি প্রকট আকার ধারণ করেছে। তারা বলছেন, একের পর এক যেসব সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে সেগুলোর অনেকটাই বিজ্ঞানভিত্তিত ছিল না। সেইসঙ্গে রয়েছে সাধারণ মানুষের স্বাস্থ্যবিধি প্রতিপালনে অনিহা।

বিশেষজ্ঞরা আরও বলছেন, হোটেল রেস্তোরাঁ খোলা রেখে বলা হচ্ছে স্বাস্থ্যবিধি মেনে সেখানে খাবার খাওয়া যাবে, কাঁচাবাজারসহ প্রতিটি বড়বড় শপিং মল খোলা রয়েছে। নো মাস্ক নো সার্ভিস বলে ঘোষণা দেওয়া হলেও সেখানে ক্রেতা এবং বিক্রেতা কারও মুখে মাস্ক নেই। গণপরিবহনে অর্ধেক যাত্রী তোলার নিয়মে ভাড়াও বেড়েছে, যাত্রীও উঠছে আগের মতো। এসব মনিটরিং হচ্ছে না।

শাটডাউন বলতে কী বোঝানো হয়েছে জানতে চাইলে অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ সহিদুল্লাহ বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘শাটডাউন মানে হচ্ছে সবকিছু বন্ধ থাকবে, শুধু জরুরি সেবা ছাড়া।’ ‘অফিস-আদালত, বাজারঘাট, গণপরিবহনসহ সব বন্ধ থাকবে। সবাই বাসায় থাকবে।’—বলেন তিনি।

করোনা নিয়ে সিদ্ধান্ত নিতে শুরু থেকেই ভুল পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে জানিয়ে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশে রোগী বাড়ার অন্যতম কারণ ছিল হোম কোয়ারেন্টিন। এটি বাংলাদেশের জন্য প্রযোজ্য ছিল না।

আক্রান্তদের সংস্পর্শে আসা ব্যক্তিদের ১৪ দিন পর্যন্ত আলাদা রাখা তথা কোয়ারেন্টিনে পাঠানোর ওপর গুরুত্ব দিয়ে আসছিল ডব্লিউএইচও। আমাদের দেশেও রোগীকে আইসোলেশন (বিচ্ছিন্নকরণ) এবং তার সংস্পর্শে আসাদের কোয়ারেন্টিনে (সঙ্গ নিরোধ) থাকতে বলা হয়। কিন্তু শুরু থেকেই এ নিয়ে বিশেষজ্ঞদের সংশয় ছিল। বিশেষ করে বিদেশফেরত ব্যক্তিদের কোয়ারেন্টিনে থাকার নির্দেশনা কতটুকু কার্যকর হয়েছে তা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছিলেন জনস্বাস্থ্যবিদরা।

‘প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টিন বাদ দিয়ে হোম কোয়ারেন্টিন করাই ছিল প্রথম ভুল, এতেই সংক্রমণ বেড়েছে।’ এমন মন্তব্য করেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ও কোভিড-১৯ বিষয়ক জাতীয় পরামর্শক কমিটির সদস্য অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম।

গত বছরে ৮ মার্চ প্রথম তিন জন রোগী শনাক্ত হওয়ার পর মার্চের শেষ দিকে দেশজুড়ে লকডাউন শুরু হয়। সরকারিভাবে একে বলা হয় সাধারণ ছুটি। কয়েক দফায় বাড়ানো হয় এ ছুটি। দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ হয় ১৭ মার্চ থেকে। ২৬ মার্চ থেকে অফিস-আদালতও। দেশজুড়ে সব ধরনের যান চলাচলে জারি হয় নিষেধাজ্ঞা। সবাইকে যার যার বাড়িতে থাকার নির্দেশ দেওয়া হয়।

এর ঠিক এক মাস পর ২৬ এপ্রিল পোশাক কারখানা খুলে দেওয়া হয়। সংক্রমণের দশম সপ্তাহে (১০ থেকে ১৬ মে) দেশে করোনা পরিস্থিতির দ্রুত অবনতি শুরু হয়।

৬৬ দিন পর ৩১ মে থেকে অফিস খোলার পাশাপাশি গণপরিবহন চলাচলের অনুমতিও দেওয়া হয়। শিথিল করা হয় বিধিনিষেধ। চালু হয় অভ্যন্তরীণ ফ্লাইট। আগস্টে খুলে দেওয়া হয় বিনোদন কেন্দ্রগুলোও। এরপর জুনে জোনভিত্তিক লকডাউনের ঘোষণা দেয় সরকার। আক্রান্তের সংখ্যার ভিত্তিতে লাল, হলুদ ও সবুজ এলাকা নির্ধারণের নীতিমালার কথা বলা হয়। কিন্তু রাজধানীতে প্রাথমিক পর্যায়ে প্রথমে পূর্ব রাজাবাজার ও ওয়ারি—এ দুটো এলাকা এবং ঢাকা বিভাগের কয়েকটি জেলায় জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে লকডাউন কার্যকর করা হলেও একপর্যায়ে জোনিং সিস্টেম মুখ থুবড়ে পড়ে। এরপর সংক্রমণ বেড়ে যায় জুন-জুলাই থেকে আগস্টের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত।

শীতের সময়ে সংক্রমণের ঊর্ধ্বগতির ধারণা করা হলেও সেটা কমতে থাকে। তবে এ বছরের মার্চ থেকে সেটা আবার বেড়ে যায়। সে সময় দৈনিক শনাক্ত রোগীর সংখ্যা হাজারের ওপরে চলে যায়, বাড়তে থাকে মৃত্যুর সংখ্যাও। শনাক্ত ও মৃত্যু বাড়তে থাকায় পাঁচ এপ্রিল থেকে মানুষের চলাচলে বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়।

এ বিধিনিষেধের ফলে সংক্রমণ পরিস্থিতি কিছুটা নিয়ন্ত্রণে এলেও ঈদুল ফিতর উপলক্ষে বিধিনিষেধ শিথিল হয়ে পড়ে। শহর ছেড়ে মানুষ গ্রামমুখী হয়, যেখানে স্বাস্থ্যবিধির কোনও বালাই ছিল না। এতে করে জনস্বাস্থ্যবিদরা আশঙ্কা করেন ঈদের পর সংক্রমণ আবার বেড়ে যাবে। সেইসঙ্গে দেশে ভারতীয় তথা ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট শনাক্ত হয়। সীমান্তবর্তী জেলাগুলোতে রোগী বাড়তে শুরু করে। হাসপাতারে জায়গা দিতে করোনা বেড বাড়াতে বাধ্য হয়েছে সীমান্তবর্তী জেলা হাসপাতালগুলো। এ অবস্থায় সরকার গত ৫ এপ্রিল থেকে বিধিনিষেধ আরোপ করে, যা এখনও চলছে। তবে গত এক সপ্তাহ ধরেই সংক্রমণের এই ঊর্ধ্বগতিতে সরকার ২২ জুন ঢাকা বিভাগের সাত জেলায় লকডাউন ঘোষণা করে।

‘করোনা মোকাবিলায় বাংলাদেশ প্রথম থেকেই ভুল পথে হেঁটেছে। তবে সেটা ভুল করে নয়। সিদ্ধান্ত নিয়েই ভুল পথে হেঁটেছে।’ এ মন্তব্য করেন জনস্বাস্থ্যবিদ চিন্ময় দাস। তিনি বলেন, ‘মহামারি যখন আসে তখন মহামারি বিশেষজ্ঞদের নিয়েই কাজ করতে হয়। তাদের মতামত, অভিজ্ঞতা শুনে এগোতে হয়। কোভিড নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব প্রশাসনিক ক্যাডারদের হাতে ছিল। এভাবে মহামারি নিয়ন্ত্রণ করা যায় না।’

স্বাস্থ্য অধিদফতরের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ডা. বে-নজির আহমেদ বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘এই শাটডাউন হয়তো বাস্তবায়ন করা যাবে না, আর যেটা বাস্তবায়ন করা যাবে না সে সুপারিশ দেওয়ার দরকার নেই। যেমনটা লকডাউনের সময় আমরা দেখেছি।’

‘কোথায় কতটুকু সংক্রমণ বাড়ছে, সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া যেত। ঢাকার ভেতরে সংক্রমণ বাড়ছে। সেটা যদি ছড়াতে থাকে, তবে তা কমানোর ব্যবস্থা না নিয়ে ঢাকাকে অবরুদ্ধ রেখে লাভ হবে নেই।’—বলেন বে-নজির আহমেদ।

স্বাস্থ্য অধিদফতরের সাবেক পরিচালক বলেন, ‘ভারত থেকে ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট দেশে আসবে, এটা ধরেই নেওয়া দরকার ছিল। সেইসঙ্গে চাঁপাইনবাবগঞ্জে যখন সংক্রমণ বাড়তে শুরু করে তখন সেটা ছড়াতেও ১৪ দিন সময় নিয়েছে। এরপর সেটা বাড়তে শুরু করে। কিন্তু তখন যদি যাতায়াত সীমিত, রোগী শনাক্ত করে আইসোলেশন, কোয়ারেন্টিন, হাসপাতাল উন্নত করার ব্যবস্থা নেওয়া হতো, তাহলে সেটা রাজশাহীতে আসতো না। সীমান্তবর্তী জেলাগুলোতে প্রস্তুতি নেওয়া দরকার ছিল, কিন্তু সেটা করা হয়নি।’

তিনি বলেন, ‘সংক্রমণ প্রতিরোধে যে কার্যকরী ব্যবস্থা নেওয়া দরকার ছিল, সেটা নিতে ব্যর্থতার কারণেই সীমান্তবর্তী এলাকাতে এটা ব্যাপকভাবে ছড়িয়েছে এবং এখন সেটা সীমান্তবর্তী জেলার সীমানা ছাড়িয়ে পুরো দেশেই ছড়িয়েছে। কেবল ব্যবস্থাপনার অভাবে পুরো দেশের ৪১ জেলায় সংক্রমণের হার এখন ১০ শতাংশের বেশি।’

 

/আইএ/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
বাজারে অপরিপক্ব লিচু, খেলে মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকি
বাজারে অপরিপক্ব লিচু, খেলে মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকি
টিভিতে আজকের খেলা (১৭ মে, ২০২৪)
টিভিতে আজকের খেলা (১৭ মে, ২০২৪)
ইউপি চেয়ারম্যানকে গ্রেফতারের প্রতিবাদে মহাসড়ক অবরোধ
ইউপি চেয়ারম্যানকে গ্রেফতারের প্রতিবাদে মহাসড়ক অবরোধ
ব্রিটেনে আশ্রয় আবেদন বাতিল, বাংলাদেশিদের দ্রুত ফেরত পাঠাতে চুক্তি
ব্রিটেনে আশ্রয় আবেদন বাতিল, বাংলাদেশিদের দ্রুত ফেরত পাঠাতে চুক্তি
সর্বাধিক পঠিত
সিলেটে বছরের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা
সিলেটে বছরের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা
জাহাজে ওঠার পর কোরআনের সুরা শুনিয়ে দস্যুদের নিবৃত্ত করা হয়
জাহাজে ওঠার পর কোরআনের সুরা শুনিয়ে দস্যুদের নিবৃত্ত করা হয়
এমপিও আবেদন সরাসরি অধিদফতরে পাঠানো যাবে না
এমপিও আবেদন সরাসরি অধিদফতরে পাঠানো যাবে না
ফুল দিয়ে বরণ, রিট দিয়ে শুরু কোন্দল!
চলচ্চিত্র শিল্পী সমিতিফুল দিয়ে বরণ, রিট দিয়ে শুরু কোন্দল!
ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা সনদধারীদের বিরুদ্ধে আসতে পারে আইনি ব্যবস্থা
ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা সনদধারীদের বিরুদ্ধে আসতে পারে আইনি ব্যবস্থা