X
বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪
১২ বৈশাখ ১৪৩১

‘অরাষ্ট্রীয় কর্তৃপক্ষও মতপ্রকাশের স্বাধীনতাকে সংকুচিত করছে’

বাংলা ট্রিবিউন রিপোর্ট
২৭ জুন ২০২১, ০২:৪৯আপডেট : ২৭ জুন ২০২১, ০২:৫২

কেবল রাষ্ট্রই নয়; স্থানীয়-আন্তর্জাতিক সংস্থা, সংগঠন, করপোরেট প্রতিষ্ঠানের মতো বিভিন্ন অরাষ্ট্রীয় কর্তৃপক্ষও (নন-স্টেট অ্যাক্টরস) বাংলাদেশে মতপ্রকাশের স্বাধীনতাকে সংকুচিত করছে বলে মন্তব্য করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. শান্তনু মজুমদার। সেই সঙ্গে প্রভাবশালী পরিবারের সদস্য, ধর্মীয় নেতা, উগ্র-সংরক্ষণবাদী প্রভৃতি সামাজিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি ও সমষ্টির মতো সামাজিক-সাংস্কৃতিক কর্তৃপক্ষও (নট-স্টেট অ্যাক্টরস) এ কাজের (মত প্রকাশের স্বাধীনতা সংকুচিত) অনুঘটক হিসেবে কাজ করছে বলে মত তার।

শনিবার (২৬ জুন) বিকালে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ল’ অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল অ্যাফেয়ার্স (বিলিয়া) আয়োজিত ‘বাংলাদেশে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা : সম্ভাবনা এবং চ্যালেঞ্জে’ শীর্ষক ওয়েবিনারে বক্তৃতা প্রদানকালে তিনি এমন মন্তব্য করেন। এটি ছিল স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তী উপলক্ষ্যে বিলিয়া আয়োজিত বক্তৃতামালার চতুর্থ বক্তৃতা। অনুষ্ঠানে আলোচক হিসেবে উপস্থিত ছিলেন, বাংলাদেশ প্রেস ইনস্টিটিউটের (পিআইবি) মহাপরিচালক জাফর ওয়াজেদ এবং বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের সাবেক সভাপতি মনজুরুল আহসান বুলবুল। অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য দেন বিলিয়ার পরিচালক অধ্যাপক ড. মিজানুর রহমান এবং এতে সভাপতিত্ব করেন বিলিয়ার চেয়ারম্যান ব্যারিস্টার এম. আমীর-উল ইসলাম।

মূল বক্তৃতায় অধ্যাপক শান্তনু মজুমদার বলেন, ইতিহাসে ‘সকলের জন্য’ মতপ্রকাশের স্বাধীনতা বলতে কিছু ছিল না। মতপ্রকাশের অধিকার কেবল ক্ষমতাসীন অভিজাতদের জন্য একচেটিয়াভাবে সংরক্ষিত ছিল। ইউরোপে রেনেসাঁ, মুদ্রণযন্ত্রের আবিষ্কার এবং পরবর্তীকালে আমেরিকান স্বাধীনতা, ফরাসী বিপ্লবের মাধ্যমে ‘সকলের জন্য মতপ্রকাশের অধিকারের ধারণা সামনে আসে এবং ১৯৪৮ সালের সার্বজনীন মানবাধিকার সনদের মাধ্যমে তা সাধারণ স্বীকৃতিলাভ করে। জাতীয়-আন্তর্জাতিক সনদসমূহে বিধৃত মতপ্রকাশের স্বাধীনতার সংজ্ঞায় আলোচনা কেবল নাগরিকের অধিকার ও রাষ্ট্র কর্তৃক লঙ্ঘনের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখা হয়, যার মাধ্যমে বাংলাদেশের মতো রাষ্ট্রে মতপ্রকাশের স্বাধীনতার পরিস্থিতির যথাযথ ব্যাখ্যা পাওয়া যায় না।

বাংলাদেশে ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্টের মাধ্যমে নাগরিকদের মধ্যে এক ধরনের ভয়ের সংস্কৃতি তৈরি হচ্ছে অভিযোগ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এই অধ্যাপক আরও বলেন, সরকার দাবি করছে, জনগণের ডিজিটাল নিরাপত্তা এবং তরুণরা যাতে বিপথে না যেতে পারে এবং রাষ্ট্রবিরোধী কর্মকাণ্ডে যুক্ত না হয়, সেজন্য এমন আইনের প্রয়োজন রয়েছে। তাতে জনগণের মধ্যে আশঙ্কা কমছে না। সরকারের উচিত সেই ভয় তাড়ানোর জন্য পদক্ষেপ নেওয়া এবং এটা মাথায় রাখা যে, কোনও আইনের ব্যাপারে আশঙ্কা প্রকাশ করা মানেই সেই আইনের প্রয়োজনীয়তা অস্বীকার করা নয়। আর বাংলাদেশে ধমকের সংস্কৃতি রাজনীতি ছাড়িয়ে সমাজ-সংস্কৃতিও ধর্মীয় ক্ষেত্রেও বিস্তৃতি লাভ করেছে। রাষ্ট্রীয় কর্তৃপক্ষকে দায়ী করতে গিয়ে আমরা অরাষ্ট্রীয় ও সামাজিক-সাংস্কৃতিক কর্তৃপক্ষসমূহকে দায়মুক্তি দিচ্ছি।

তিনি বলেন, ‘ফ্রিডম অব রিলিজিয়ন’কে আমরা অনুবাদ করি ‘ধর্ম পালনের স্বাধীনতা’ অথচ তা হওয়া উচিত ‘ধর্ম-সংক্রান্ত, পালন বা পালন না করা ইত্যাদি যাবতীয় বিষয়ে স্বাধীনতা’। তবে আশা জাগানিয়া ব্যাপার হলো- ইন্টারনেট ও স্মার্টফোনের ব্যাপক প্রসার, সামাজিক মাধ্যমের নেটিজেনদের কার্যকলাপ, সামাজিক পরিসরে ক্রমশ দৃশ্যমান বিক্ষুব্ধ ও প্রতিবাদী কণ্ঠস্বর। যদিও আমরা দেখি সামাজিক মাধ্যমে ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট, তৃতীয় লিঙ্গ অধিকার ও নাস্তিকতা নিয়ে আলোচনার ক্ষেত্রে সতর্কতা দেখা যায়। এই পরিস্থিতির পরিবর্তনের জন্য প্রতিবাদ জরুরি, তবে প্রতিবাদের প্রথাগত ভাষা অকার্যকর প্রমাণিত হয়েছে, নতুন ভাষা উদ্ভাবনের প্রয়োজন রয়েছে। গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলো শক্তিশালীকরণ প্রয়োজন, অরাষ্ট্রীয় ও সামাজিক-সাংস্কৃতিক কর্তৃকপক্ষগুলোকে চিহ্নিত করা প্রয়োজন। সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন দল বা শাসনামল-নিরপেক্ষ (রেজিম-নিউট্রাল) আলোচনা।

বর্তমানে ভিন্ন ধর্ম তো বটেই, নিজের আচরিত ধর্ম নিয়েও কোনও ভিন্নমত সহ্য করা হয় না। ‘আমাদের বা চিরায়ত কিংবা নিজস্ব’ সংস্কৃতি এবং প্রত্যাশিত সামাজিক আচার-আচরণের নামেও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা হরণ করা হচ্ছে। যারা ‘শালীনতা’র নামে নারী অধিকারের উপর ভয়াবহ হস্তক্ষেপ করছেন, তারা প্রথমে নমনীয় প্রচারের কৌশল নিলেও বিরোধিতার মুখে ‘ভেড়ার আড়ালে বাঘের চেহারা’ নিয়ে হাজির হন। এখন হেডমাস্টার, স্কুল কমিটি সভাপতি, স্থানীয় সরকারি কর্মকর্তা কিংবা আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য শিক্ষার্থীদের হেয়ার স্টাইলের জন্য শাস্তি দিচ্ছেন। রাষ্ট্রীয় দমন-পীড়নের সঙ্গে সঙ্গে এই ধরনের ‘আরোপিত সামাজিক সমন্বয়ের চেষ্টা (সোশ্যাল টিউনিং)’ ও ‘নৈতিক পুলিশিং’ মতপ্রকাশের স্বাধীনতার চেতনার ভয়াবহ লঙ্ঘন হিসেবে বিবেচিত হওয়া উচিত বলেও মনে করেন ড. শান্তনু মজুমদার।

ওয়েবিনারে পিআইবি-এর মহাপরিচালক জাফর ওয়াজেদ বলেন, পাকিস্তানে সমাজতন্ত্রের কথা বললে জেলে নেওয়া হতো, ছয় দফা ঘোষণার পর প্রতিটি সমাবেশের পর বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করা হতো। আমরা স্বাধীনতার পর ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতার কথা বলেছি। কিন্তু ধর্মনিরপেক্ষতার ধারণা জনগণের কাছে পরিষ্কার করতে পারিনি। বঙ্গবন্ধু নিজে ধর্মনিরপেক্ষতার কথা বলেছেন, কিন্তু তার দল আওয়ামী লীগ জনগণের সামনে তা সঠিকভাবে পৌঁছে দিতে পারেনি। বঙ্গবন্ধুকে সব সংবাদপত্র বন্ধ করে চারটি জাতীয় সংবাদপত্র চালু রাখার পরামর্শ তোয়াব খান প্রমুখ সিনিয়র সাংবাদিকরাই দিয়েছিলেন। এরশাদের সময় ‘হরতাল’ শব্দটি উচ্চারণ করা যেতো না, সংবাদপত্রে আমরা লিখতাম ‘কর্মসূচি’, ‘দুর্ভিক্ষে’র পরিবর্তে লিখতে হতো ‘ভিক্ষার অভাব’। তবে স্বাধীনতা, জাতির পিতা, জাতীয় পতাকা, মুক্তিযুদ্ধের মৌল চেতনা নিয়ে বিদ্বেষমূলক বক্তব্যকে নিয়ন্ত্রণ করা উচিত জাতীয় স্বার্থে।

বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের সাবেক সভাপতি মনজুরুল আহসান বুলবুল বলেন, যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক ফ্রিডম হাউজের সূচকে বাংলাদেশ বিগত কয়েক বছর ধরে ‘পার্শিয়ালি ফ্রি কান্ট্রি’ হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আসছে। এর কারণ এই নট-স্টেট অ্যাক্টর বা সামাজিক-সাংস্কৃতিক কর্তৃপক্ষ। তা ছাড়া, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা নিয়ে আইনপ্রণেতা ও সাধারণ জনগণের মধ্যে সচেতনতার অভাব রয়েছে। আমলা ও সংসদ সদস্যদের তথ্য অধিকার আইনের প্রয়োজনীয়তা বোঝাতে বেগ পেতে হয়েছে। আমাদের অনেক বিষয়ে প্রয়োজনীয় আইন তৈরি হয়নি, সম্প্রচার নীতিমালা থাকলেও সম্প্রচার আইন নেই।

/বিআই/ইউএস/
সম্পর্কিত
নুরের বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মামলায় গ্রেফতারি পরোয়ানা
মামলা থেকে অব্যাহতি পেলেন জবি শিক্ষার্থী খাদিজা
লেখক মুশতাক আহমেদের মৃত্যুর ৩ বছর: স্বাধীন তদন্তের দাবি
সর্বশেষ খবর
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে করারোপ: আইনের বিশ্লেষণ
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে করারোপ: আইনের বিশ্লেষণ
ইউক্রেনের মার্কিন সামরিক সহায়তা আইনে স্বাক্ষর বাইডেনের
ইউক্রেনের মার্কিন সামরিক সহায়তা আইনে স্বাক্ষর বাইডেনের
নামাজ শেষে মোনাজাতে বৃষ্টির জন্য মুসল্লিদের অঝোরে কান্না
নামাজ শেষে মোনাজাতে বৃষ্টির জন্য মুসল্লিদের অঝোরে কান্না
আজকের আবহাওয়া: দুই বিভাগে বৃষ্টির আভাস
আজকের আবহাওয়া: দুই বিভাগে বৃষ্টির আভাস
সর্বাধিক পঠিত
সিয়াম-মেহজাবীনের পাল্টাপাল্টি পোস্টের নেপথ্যে…
সিয়াম-মেহজাবীনের পাল্টাপাল্টি পোস্টের নেপথ্যে…
বাংলাদেশ ব্যাংকের চাকরি ছাড়লেন ৫৭ কর্মকর্তা
বাংলাদেশ ব্যাংকের চাকরি ছাড়লেন ৫৭ কর্মকর্তা
‘মারামারি’র ঘটনায় মিশা-ডিপজলের দুঃখপ্রকাশ
‘মারামারি’র ঘটনায় মিশা-ডিপজলের দুঃখপ্রকাশ
মিয়াবতী থেকে পিছু হটলো মিয়ানমারের বিদ্রোহীরা?
মিয়াবতী থেকে পিছু হটলো মিয়ানমারের বিদ্রোহীরা?
‘বয়কট’ করা তরমুজের কেজি ফের ৬০ থেকে ১২০ টাকা
‘বয়কট’ করা তরমুজের কেজি ফের ৬০ থেকে ১২০ টাকা