X
শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪
১৩ বৈশাখ ১৪৩১

মাস্তুলে বাঁধিনি ক্রন্দন

জাহিদ সোহাগ
২৯ জুন ২০২১, ১০:৩৬আপডেট : ২৯ জুন ২০২১, ১০:৩৯

মিছিলের কবি, যিনি নিজেকে ঘোষণা করেছিলেন মিছিলের সমান বয়সী হিসেবে, তিনি করোটির রৌদ্র মুছে বসেছেন স্তব্ধতার কাছে। কিছু বলবেন বলে? কিছু শুনবেন বলে?
কবি চিরদিন নয় শব্দসৈনিক, তাকেও বসতে হয় জানু ভাঁজ করে, তার পেছনে কাঁপে অশ্বত্থের পাতা, তিনি নৈঃশব্দ্যের কানে কানে বলেন তার না-বলা যত কথা, যে কথারা কখনও হয় না ধ্বনিত, কখনও যা স্ববিরোধীও : এমন অস্পষ্ট আর্তনাদ শুনছি ‘স্তব্ধতা যারা শিখে গেছে’ তাদের হৃদয়পথের শ্রমণ হয়ে।
অনিত্য পৃথিবীতে কিছুই অপেক্ষা করে না, কোনো দুঃখ-বেদনায় কাতর মানুষ শুধু পূর্ণ করে যায় রাশি রাশি শূন্যপৃষ্ঠা, যা চিরকাল রয়ে যায় পাঠহীন, যা চিরদিন দূরের অস্পষ্ট তারার মতো আমাদের জেগে থাকা পৃথিবীতে আলোর মতো এসে গান গায়; সেই জেগে থাকা পৃথিবীতে আমরাও ছিলাম। যেমন, এখানে দরজা ছিল কথাটা বললে আমরা পোড়াবাড়ির স্মৃতির ভেতর ঢুকে পড়ি সবাই। এই স্মৃতি কখনো-বা যৌথ, কখনো-বা একার। স্তব্ধতায় কান পেতে সেই একার অপ্রকাশ্য পাথর বয়ে বেড়াচ্ছি আমরা। কবির সাথে। কবি কি বয়ে বেড়ান এখনো? কবি কি ডুবে আছেন অস্তমিত সূর্যের দিকে তাকিয়ে? সেই মানুষ কি কেবল যুক্তিকাঠামো ভেঙে শূন্যমুখী এক কবি?
যিনি একাকী শালিকের মতো উচ্চারণ করেন দৃশ্যাবলি:

‘তবু চিৎকার করছে হালটের নিঃসঙ্গ শালিক

কোলাহলের আগের গল্পে ভেসে যাচ্ছে বিষণ্ণ বৃষ্টিরেখা
ভেসে যাচ্ছে প্রতিফলনের স্মৃতি, গোরখাদকের নির্বিকার মাটি,
ভেসে যাচ্ছে শববাহকের কাঁধ!’

শববাহকের কাঁধ থেকে কেউ লাফিয়ে নামে না, নামবে না, বলবে না, সামান্য তন্দ্রায় তোমরা এত ভীত? আমাকে মুছে ফেলছ অনন্ত নক্ষত্রতিমিরে? কেবল নির্বিকার মাটি ঝরে পড়ে, কবির কাছে এই মাটি শুধু মাটি নয়, এই মাটি মুছে ফেলে সকল দৃশ্যমানতা, করতলের স্নেহ। কবি, বা একজন কামাল চৌধুরীকে দেখি হালটে নির্বিকার দাঁড়িয়ে থাকা একটা শালিক। যে শালিক বিস্মরণের বৃষ্টির আগে খুলে রাখতে চান পৃথিবীর হারানো জানালা। যিনি অন্ধকার লিখতে চান না, লিখতে চান মাটির প্রদীপ : ‘জানালাটা খুলে দাও, জবুথবু বৃষ্টির আগে নির্দিষ্ট বিন্দুতে/আমি তোমাকেই দেখি/তুমি দেখতে পাবে না, তবু এই ভোর তোমার জন্য লেখা/হেঁটে হেঁটে আমি যেখানে এসেছি, সেখানে নদীর তীরে/অন্ধকার লিখি না আমি,/শ্রুত লিখি, স্মৃতি লিখি, বিস্মরণ লিখি/মাটির প্রদীপ লিখি।/ভালোবেসে খুলে রাখি পৃথিবীর হারানো জানালা।’
রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন:
‘মরণরে,
তুঁহুঁ মম শ্যাম সমান!
মেঘবরণ তুঝ, মেঘ জটাজুট,
রক্ত কমল কর, রক্ত অধর-পুট,
তাপ-বিমোচন কৰুণ কোর তব,
মৃত্যু অমৃত করে দান!
তুঁহুঁ মম শ্যাম সমান।’

মৃত্যু কী অমৃত করে দান? কাকে করে এই দান? কে গ্রহীতার পাত্র ভরে নেয় এই দান, এই অমৃত? এই উত্তর প্রশ্নের মতো প্রশ্নহীন উত্তরহীন। যিনি যান অসীমের পান্থশালায়, ঘোড়াটিকে বেঁধে স্মৃতির আস্তাবলে তিনি কি সেই অমৃতের ভোগী, একা, পরিজনহীন?
‘স্তব্ধতা যারা শিখে গেছে’র প্রথমেই আমরা শুনতে পাই, প্রস্তুত করে রাখি আমাদের হৃদয়, কবির অশ্রুকণা আমাদের চোখে বাষ্প হয়ে ওঠে, যে কবি পাঠকেরও সমান বয়সী, যে কবি নিস্ফলা মাঠে এতকাল রচনা করে গেছেন আশ্চর্য পঙক্তিমালা। ওই তো তিনি, আর্তনাদের লাগাম টেনে ধরছেন আশ্চর্য নক্ষত্রপুঞ্জ রচনা করে:
‘খুঁজতে খুঁজতে বহু জীবন যাবে, আমি খুঁজে পাবো না তোকে

আমাদের কোনো জন্ম হয়নি, আমাদের
নাম-ঠিকানা নেই—
সম্পর্কের ভেতরে সমুদ্র, সূর্যাস্ত, লবণ আর অশ্রুবিন্দু

একটা উপকূলের ক্রন্দন মাস্তুলে বাঁধতে পারিনি বলে
দিগন্তের পরপারে রেখে এসেছি তোর অস্পষ্ট অবয়ব

তুমি বলছ শূন্যতা, তুমি বলছ নীরবতা, তুমি বলছ নিদ্রা
আমি বলছি হাহাকার!

না, আমাদের জন্মই হয়নি, আমরা কোথাও ছিলাম না
আমাদের পূর্বপুরুষেরা কোথাও ছিলো না
কারো মৃত্যু হয়নি, কারো জন্ম হয়নি
শোক পালন করতে করতে পুকুরপাড়ের বাঁশঝাড় নড়ে ওঠেনি কারো জন্য
একটা পাতা খসে পড়েনি সপ্রাণ আকুলতায়

তবু কেন অশ্রু হয়ে যাচ্ছে পৃথিবী!’

কবি কামাল চৌধুরী রবীন্দ্রনাথের মতো মৃত্যুতে অমৃত মেনে নেননি। তিনি জন্ম-মৃত্যু, নাম-ঠিকানা সবকিছু অস্বীকার করছেন, যেন কিছু ছিল না, কিছু নেই। কিন্তু সেই না থাকা, সেই শূন্যতা, নিদ্রা কবির কাছে হাহাকার জাগায় কেন? কেনো খসে পড়ে পুকুরপাড়ের বাঁশপাতা? কেন তিনি যেদিকেই তাকান, তার পৃথিবী, বেঁচে থাকার বা থাকা পৃথিবী অশ্রুকণা হয়ে আছে? অমোচনীয় এই অশ্রু তিনি রুখবেন কি দিয়ে? তিনি তো মাস্তুলে বাঁধতে পারেননি ক্রন্দন।
কবি এই ব্যর্থতা নিয়ে বসে আছেন স্তব্ধতার সামনে।

স্তব্ধতা যারা শিখে গেছে। প্রথম প্রকাশ : ২০২১। প্রকাশক : পাঞ্জেরী পাবলিকেশন্স। প্রচ্ছদ : রাজীব রাজু। মূল্য: ১৭৩ টাকা।

/জেডএস/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
বিএনপি গণতন্ত্রে অকার্যকর ডামি রাজনৈতিক দল: ওবায়দুল কাদের
বিএনপি গণতন্ত্রে অকার্যকর ডামি রাজনৈতিক দল: ওবায়দুল কাদের
চারতলা ভবনের ছাদ থেকে পড়ে মাদ্রাসাছাত্রীর মৃত্যু
চারতলা ভবনের ছাদ থেকে পড়ে মাদ্রাসাছাত্রীর মৃত্যু
বাংলাদেশে চিকিৎসা খাতে থাইল্যান্ডের বিনিয়োগ চান প্রধানমন্ত্রী
বাংলাদেশে চিকিৎসা খাতে থাইল্যান্ডের বিনিয়োগ চান প্রধানমন্ত্রী
এবার ঘুমটা ভালো হবে ডু প্লেসির
এবার ঘুমটা ভালো হবে ডু প্লেসির
সর্বাধিক পঠিত
দুদকের চাকরি ছাড়লেন ১৫ কর্মকর্তা
দুদকের চাকরি ছাড়লেন ১৫ কর্মকর্তা
খুলনায় এযাবৎকালের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা
খুলনায় এযাবৎকালের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা
চুক্তিতে মাউশির ডিজি হলেন নেহাল আহমেদ
চুক্তিতে মাউশির ডিজি হলেন নেহাল আহমেদ
ব্রাজিল থেকে গরু আমদানি প্রসঙ্গে যা বললেন রাষ্ট্রদূত
ব্রাজিল থেকে গরু আমদানি প্রসঙ্গে যা বললেন রাষ্ট্রদূত
আমরা সবাই ফেরেশতা, বাস করি বেহেশতে: রায়হান রাফী
আমরা সবাই ফেরেশতা, বাস করি বেহেশতে: রায়হান রাফী