X
শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪
১৩ বৈশাখ ১৪৩১

‘জীবনডা হাতে নিয়া রশি বাইয়া ছাদ থিকা নিচে নামছি’

নুরুজ্জামান লাবু
০৯ জুলাই ২০২১, ১৯:২১আপডেট : ০৯ জুলাই ২০২১, ২০:৪৭

‘জীবনডা হাতে নিয়া রশি বাইয়া ছয়তলার ছাদ থিকা নিচে নামছি। মনে হইছে রশি ছুইটা গেলেই সব শেষ। শক্ত কইরা রশিডা ধইরা ছিলাম। হাত ছিলা গেছে তবু রশি ছাড়ি নাই। তিনতলা পর্যন্ত নাইমা ফায়ার সার্ভিসের মইয়ের লাগাল পাইছিলাম। তারপর মই বাইয়া নিচে নামছিলাম।’

ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল মর্গের সামনে এভাবেই নিজের ভয়াবহ অভিজ্ঞতা বর্ণনা করছিলেন ১৭ বছরের তরুণ ফজলু। নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে হাসেম গ্রুপের অঙ্গপ্রতিষ্ঠান সজীব জুস লিমিটেডের চতুর্থতলায় কাজ করছিলেন তিনি। ছয়তলা ওই ভবনে আগুন লেগে ৫২ জনের মৃত্যু হয়েছে। বৃহস্পতিবার (৮ জুলাই) বিকাল সাড়ে ৫টার দিকে লাগা আগুন ২৪ ঘণ্টা পর নিয়ন্ত্রণে আনে ফায়ার সার্ভিসের ১৮টি ইউনিট। আগুনে পুড়ে যাওয়া ভবনের পঞ্চম ও ষষ্ঠতলায় এখনও তল্লাশি চালাচ্ছেন ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা।

ফজলু জানান, তারা চতুর্থ তলার একপাশে লাচ্ছা সেমাই তৈরির বিভাগে মোট ১৮ জন কাজ করছিলেন। আগুন লাগার খবর পেয়ে তাড়াহুড়ো করে ১২ জন সিঁড়ি বেয়ে নিচের দিকে নেমে যান। তাদের কাউকেই এখন আর খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। বাকি ছয়জন প্রথমে সেমাই তৈরির চুল্লির গ্যাস লাইন বন্ধ করেন। তারপর তারাও একসঙ্গে সিঁড়ি বেয়ে নিচের দিকে নামার চেষ্টা করেন। কিন্তু ধোঁয়ার কারণে নিচে না নেমে দৌড়ে ছাদে উঠে যান।

ফজলু বলেন, ‘ছাদে উইঠা দেখি আরও মানুষ। সব মিলায়ে ৩০-৩৫ জন হবে। সবাই চিৎকার চেঁচামেচি করতেছে। কেউ কেউ কান্নাকাটি করতেছে। পাশের বিল্ডিংয়ের ছাদ থিকা কেউ একজন একটা রশি ছুইড়া মারছে। আমরা রশিডা নিয়া প্রথমে একটা পিলারের সঙ্গে বানছি। তারপর সেইটা বাইয়া বাইয়া নিচে নামছি। সবার হাত ছিল্যা গেছে। তিনতলা পর্যন্ত বাইয়া ফায়ার সার্ভিসের মইয়ের লাগাল পাইছিলাম। তারপর মই দিয়া নিচে নামলাম।’

নোয়াখালীর হাতিয়ার বাসিন্দা ফজলু এক মাস ধরে কাজ করতেন হাসেম ফুড লিমিটেডে। তার সঙ্গে লাচ্ছা সেমাই তৈরির বিভাগে কাজ করতেন ২০ বছরের ইউসুফ। ইউসুফ বলেন, ‘নামার সময় প্রত্যেকটা মুহূর্তে মনে হইছে এই বুঝি পইড়া যামু। পইড়া গেলেই তো সব শেষ। শক্ত কইরা রশিডা ধইরা ঝুলতে ঝুলতে নামছি। হাত ছিল্যা শেষ, কিন্তু জীবনডা বাঁচাইতে তো পারছি।’

ফজলু-ই্উসুফসহ তারা ছয় সহকর্মী মিলে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের মর্গে গিয়েছিলেন তাদের নিখোঁজ সহকর্মীদের খোঁজে, যারা আগুনের ঘটনার পরপরই দৌড়ে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমেছিলেন। আব্বাস নামে ২৪ বছর বয়সী তাদের আরেক সহকর্মী বলেন, ‘কাজ করতেছিলাম। হঠাৎ আগুন আগুন কইরা চিৎকার শুরু করলো সবাই। কই আগুন লাগছে কিছুই বুঝতেছিলাম না। সবাই দেখি দৌড়াইয়া নিচের দিকে নামতেছে। যারাই নিচের দিকে নামতে গেছে তারাই ধোঁয়া খাইছে। আমরা ওপরের দিকে উঠছিলাম বইলা বাঁচছি।’

‘ওপরের দিকে ওঠার সময় দেখি গেটে তালা। ইট দিয়া বাইরাইয়া তালা ভাঙছি। তারপর ছাদে উঠছি। ছাদে না উঠতে পারলে হয়তো বাঁইচা ফিরতে পারতাম না’-ভয়ার্ত চোখে বলছিলেন আব্বাস।

লাচ্ছা সেমাই বিভাগের প্রধান মোতালেব জানান, তিনি আগুন লাগার একটু আগে ভবনের বাইরে এসেছিলেন। বাইরে আসার পরপরই আগুন লাগার খবর পান। তার বিভাগের ১২ জনের খোঁজ পাচ্ছেন না তিনি। এই ১২ জন হচ্ছেন—রাকিব, আকাশ, মইনুদ্দিন, রাশেদ, বাদশা, জিহাদ, হাসান, আইনুদ্দি, শামিম, নোমান, শাকিল রাকিব (২)। মোতালেব বলেন, ‘এরা সবাই ১৭ থেকে ২৭ বছর বয়সী। এই ১২ জন আগুন লাগার পর সিঁড়ি বেয়ে নিচের দিকে নেমেছিল।’

শুক্রবার (৯ জুলাই) দুপুরে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল মর্গে আনা হয় আগুনে পোড়া ৪৮টি মৃতদেহ। এর আগে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা গেছেন একজন। মর্গে রাখা মৃতদেহগুলো দেখে চেনার কোনও উপায় নেই। আগুনে পুড়ে অঙ্গার হয়ে আছে কারও দেহ, কারো মুখসহ সারা শরীর ঝলসানো।

নিহত ব্যক্তিদের পরিচয় শনাক্ত করতে শুক্রবার বিকাল থেকে স্বজনদের ডিএনএ নমুনা সংগ্রহ শুরু করেছেন পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ-সিআইডির ডিএনএ ফরেনসি ল্যাবের সদস্যরা।

ফরেনসি ল্যাবের দায়িত্বশীল কর্মকর্তা সহকারী অ্যানালিস্ট আশরাফুল আলম জানান, যারা স্বজনদের খোঁজে আসবেন, তাদের ডিএনএ নমুনা সংগ্রহ করা হবে। একইসঙ্গে মৃতদেহগুলোর ডিএনএ নমুনা সংগ্রহ করা হবে। ডিএনএ নমুনায় মিল পাওয়া গেলে স্বজনদের হাতে লাশ তুলে দেওয়া হবে।

প্রসঙ্গত, রূপগঞ্জে সজীব গ্রুপের অঙ্গপ্রতিষ্ঠান হাসেম ফুড অ্যান্ড বেভারেজের সেজান জুস কারখানায় বৃহস্পতিবার (৮ জুলাই) বিকাল সাড়ে ৫টায় আগুনের সূত্রপাত হয়। এ সময় কারখানার ছয় তলা ভবনটিতে তখন প্রায় চারশ’র বেশি কর্মী কাজ করছিলেন। কারখানায় প্লাস্টিক, কাগজসহ মোড়কিকরণের প্রচুর সরঞ্জাম থাকায় আগুন মুহূর্তে ছড়িয়ে পড়ে সব ফ্লোরে।

প্রচুর পরিমাণ দাহ্য পদার্থ থাকায় কয়েকটি ফ্লোরের আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে ফায়ার সার্ভিসের ১৮টি ইউনিটের ২০ ঘণ্টার বেশি সময় লাগে। শুক্রবার (৯ জুলাই) দুপুরে কারখানার ভেতর থেকে ৪৯ জনের লাশ উদ্ধার করা হয়। এর আগে, আগুনে পুড়ে তিন জনের মৃত্যু হয়। সবমিলে এ পর্যন্ত ৫২ জনের লাশ উদ্ধার হয়েছে। কারখানায় আগুনের ঘটনায় প্রায় অর্ধশতাধিক ব্যক্তি নিখোঁজ রয়েছেন। ঘটনা তদন্তে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে কমিটি গঠন করা হয়েছে।

আরও পড়ুন:

ফায়ার সার্ভিসের গাড়িতে ৪৯ লাশ 

আগুনে পোড়া লাশের সারি, স্বজনদের আহাজারি

দীর্ঘ সময়েও আগুন নেভাতে না পারায় স্থানীয়দের হামলা

যে কারণে দীর্ঘ সময়েও নিয়ন্ত্রণে আসেনি জুস ফ্যাক্টরির আগুন

১৭ ঘণ্টায় নেভেনি জুস কারখানার আগুন, নিহত ৩

কান্না চোখে স্বজনের খোঁজ (ফটো স্টোরি)

নারায়ণগঞ্জে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা তদন্তে ৭ সদস্যের কমিটি

/এপিএইচ/এমওএফ/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
হোটেল রুম থেকে এই ৫ জিনিস নিয়ে আসতে পারেন ব্যাগে ভরে!
হোটেল রুম থেকে এই ৫ জিনিস নিয়ে আসতে পারেন ব্যাগে ভরে!
ভোট গণনা প্রক্রিয়ায় কোনও পরিবর্তন হবে না: ভারতীয় সুপ্রিম কোর্ট
ভোট গণনা প্রক্রিয়ায় কোনও পরিবর্তন হবে না: ভারতীয় সুপ্রিম কোর্ট
ঘোড়াঘাটে মালবোঝাই দুই ট্রাকের মুখোমুখি সংঘর্ষে ২ জন নিহত
ঘোড়াঘাটে মালবোঝাই দুই ট্রাকের মুখোমুখি সংঘর্ষে ২ জন নিহত
নির্বাচনের সময় জাপায় কী হয়েছিল, জানাবেন জিএম কাদের
শনিবার জাতীয় পার্টির বর্ধিত সভানির্বাচনের সময় জাপায় কী হয়েছিল, জানাবেন জিএম কাদের
সর্বাধিক পঠিত
দুদকের চাকরি ছাড়লেন ১৫ কর্মকর্তা
দুদকের চাকরি ছাড়লেন ১৫ কর্মকর্তা
স্কুল-কলেজে ছুটি ‘বাড়ছে না’, ক্লাস শুরুর প্রস্তুতি
স্কুল-কলেজে ছুটি ‘বাড়ছে না’, ক্লাস শুরুর প্রস্তুতি
খুলনায় এযাবৎকালের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা
খুলনায় এযাবৎকালের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা
চুক্তিতে মাউশির ডিজি হলেন নেহাল আহমেদ
চুক্তিতে মাউশির ডিজি হলেন নেহাল আহমেদ
ব্রাজিল থেকে গরু আমদানি প্রসঙ্গে যা বললেন রাষ্ট্রদূত
ব্রাজিল থেকে গরু আমদানি প্রসঙ্গে যা বললেন রাষ্ট্রদূত