X
শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪
১২ বৈশাখ ১৪৩১
বাড়ছে নদীভাঙন

শুধু বরাদ্দে ভাঙন থামবে?

আমানুর রহমান রনি
১১ জুলাই ২০২১, ১৩:০০আপডেট : ১১ জুলাই ২০২১, ১৩:০০

ভাঙন ঠেকাতে প্রতিবছর বরাদ্দ হয় কোটি কোটি টাকা। তারপরও আগের কয়েক বছরের চেয়ে এ বছর নদীভাঙন বেড়েছে রেকর্ড পরিমাণ। ভাঙন নিয়েও সক্রিয় রয়েছে স্বার্থাণ্বেষী একটি মহলও। আর এসব নিয়ে তিনপর্বের ধারাবাহিক প্রতিবেদনের প্রথম পর্ব থাকলো আজ।

গত তিন বছরে দেশের প্রধান নদীসহ ছোটবড় প্রায় সব নদীর ১৬৫৮ পয়েন্টের প্রায় সাড়ে ছয় শ’ কিলোমিটার ভূমি বিলীন হয়েছে। তীরবর্তী মানুষ হারিয়েছে ঘরবাড়ি, আবাদি জমি, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। বেড়েছে উদ্বাস্তুর সংখ্যা। বস্তিতে বেড়েছে চাপ। লাখ লাখ মানুষের জীবিকা পড়েছে অনিশ্চয়তায়। মূলত নির্বিচারে বালু উত্তোলন ও নদীর প্রবাহে বাধা পড়াতেই নদীভাঙন এখন বেশি দেখা যাচ্ছে।

বাংলাদেশের মোট আয়তনের প্রায় ৮০ ভাগ ভূমিই নদ-নদী অববাহিকার মধ্যে পড়ে। ছোটবড় মিলিয়ে নদ-নদী আছে তিন শতাধিক। আর এগুলোর কোথাও না কোথাও সারাবছর ভাঙতেই থাকে। বর্ষা মৌসুমে ভারত থেকে আসা ঢলে এ ভাঙন আরও তীব্র হয়।

পানি উন্নয়ন বোর্ডের হিসাব অনুযায়ী ২০১৮, ২০১৯ ও ২০২০ সালে দেশের ১৬৫৮ পয়েন্টে ৬৪২.৯৪৮ কিলোমিটার ভেঙে নদীগর্ভে বিলীন হয়েছে। এসময় মেরামত বা ভাঙন ঠেকাতে ২৮৫ পয়েন্টের ৪৬.৯৫৩ কিলোমিটার সংস্কার হয়েছে। যা ভাঙনের তুলনায় খুবই কম।

২০১৮ সালে ৫২৭টি পয়েন্টে ২৯১.২৮১ কিলোমিটার ভেঙেছিল। এর মধ্যে মেরামত হয় ১৫৭টি পয়েন্টের ২৪.৩২৫ কিলোমিটার।

২০১৯ সালের ৪০৫টি পয়েন্টে ভাঙনে ক্ষতি হয় ১৫৮.০৫৩ কিলোমিটার ভূমি। যার বিপরীতে ৬৮টি পয়েন্টে ১২.৬২৮ কিলোমিটার সংস্কার করা হয়।

২০২০ সালে ৭২৬টি পয়েন্টের ১৯৩.৬৫ কিলোমিটার ভাঙনের কবলে পড়ে। এরপর ওই বছর ১৬০টি পয়েন্টের মাত্র ১০ কিলোমিটার সংস্কার করা হয়।

প্রতিবেশীদের উন্নয়নে বাংলাদেশে ভাঙন

ভারত, নেপাল, ভুটান ও চীনের উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের ফলে উজানের পানিতে পলি ও বালু আসছে বেশি। এতে আমাদের উত্তরাঞ্চলের নদীগুলোর গভীরতা কমছে।

এক জরিপে দেখা গেছে, বছরে ভারত, নেপাল, ভুটান ও চীন থেকে এক লাখ ২২ হাজার ৪০০ কোটি টন পলি বাংলাদেশের নদীগুলোতে জমছে।

সম্প্রতি ভারতের মেঘালয় ও সিকিমে উন্নয়ন কাজ চলায় সেখানে উজাড় হচ্ছে গাছপালা। ওই গাছের শিকড় যে মাটি আঁকড়ে ধরতো সেটাও আসছে উজানের পানিতে। এতে বর্ষায় পাহাড়ি ঢল বেড়েছে। চাপ বাড়ছে দেশের নদীগুলোর তীরে।

নদী বিষয়ক সংগঠন রিভারাইন পিপল-এর মহাসচিব শেখ রোকন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘পাহাড় থেকে ঢল নেমে বদ্বীপে এলে নদীভাঙন হবেই। আমাদের এখানে নদী সবসময়ই ভাঙতো। ইদানীং বেড়েছে। তবে ডেল্টায় যদি ভাঙন থাকেও সেটা একসময় স্থিতিশীল পর্যায়ে আসার কথা। আমাদের এখানে তা হচ্ছে না। ভাঙন ক্রমাগত বাড়ছে।’

বালু উত্তোলনও বড় কারণ

নদীভাঙনের বড় কারণ- নির্বিচারে বালু উত্তোলন। এমনটা উল্লেখ করে শেখ রোকন বলেন, ‘যেসব অঞ্চল বেশি ভেঙেছে সেসব এলাকা থেকে নির্বিচারে বালু উত্তোলন করা হয়। বন্যার সময় নদীভাঙন হওয়ার কথা। কিন্তু এখন বন্যা তীব্র হওয়ার আগেই ভাঙছে। একটু বৃষ্টি হলেই দেখা যাচ্ছে পাড় ভাঙছে। নির্বিচারে বালু তোলা বন্ধ না হলে এমনটা হবেই।’

শেখ রোকন আরও জানালেন, এ ছাড়া উজান থেকে প্রবাহ স্বল্পতার কারণেও নদী ভাঙছে। উজান থেকে যে স্রোত আসবে সেটা বঙ্গোপসাগরে নেমে যাওয়ার কথা। কিন্তু উত্তরাঞ্চলের নদীগুলোর প্রবাহ কমায় উজান থেকে আসা মাটি ও বালু মাঝপথে আটকে যাচ্ছে। বর্ষায় পাহাড়ি ঢলের পানি আমাদের নদীগুলো ধারণ করতে পারে না। তখন তীরে পানির চাপ বাড়ে।

‘পানির টাকা জলে যাচ্ছে’

নদীভাঙন রোধে দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনার পরামর্শ দিয়েছেন নদী বিষয়ক সংগঠন রিভারাইন পিপল-এর মহাসচিব শেখ রোকন।

তিনি বলেন, ‘পানির টাকা জলে যাচ্ছে। বর্ষাকালের ঠিক আগে শুরু হয় ভাঙন রোধের কাজ। তখন পানিতে ব্লক ও বালুর ব্যাগ ফেলা হয়। চাঁদপুরে যে ভাঙন হচ্ছে, সেখানে এখন ব্লক ফেলা হচ্ছে। কয়টা ব্লক ফেলা হচ্ছে? সেটা কে দেখছে? কীভাবে জানবেন? পুরো পদ্ধতিতে গলদ রয়েছে। বর্ষাকালে ভাঙন প্রতিরোধে তাড়াহুড়ো করে পদক্ষেপ নেওয়া হয়। কিন্তু এটা আগেই শুরু করা উচিত। পানি উন্নয়ন বোর্ড তা করে না। করা হয় শেষ মুহূর্তে।’

শেষ মুহূর্তে কেন করা হয় জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এখানে ঠিকাদারসহ বিভিন্ন মহলের স্বার্থ রয়েছে। কমিশনের ব্যাপার আছে।’

ভাঙন রোধে বর্তমান ব্যবস্থাটি পশ্চিমা দেশগুলোর কাছ থেকে ধার করা উল্লেখ করে তিনি বলেন, “ব্লক, বালুর ব্যাগ ফেলে আমাদের নদীভাঙন ঠেকানো সম্ভব নয়। কোথাও হয়তো কার্যকর হতে পারে, তবে প্রমাণ পাইনি আমরা। চাঁদপুরে সফল হতে দেখিনি, সিরাজগঞ্জেও নয়। রামগতি, চিলমারীতেও এ পদ্ধতি কাজ করেনি। তবে স্থানীয় একটা পদ্ধতি ছিল, যাকে বলে ‘বান্ধাল’। এটা হাজার বছর আগের সংস্কৃতি। ওই ‘বান্ধাল’ দিয়ে ধীরে ধীরে ভাঙন রোধ করা যায়। কিন্তু এটা দেখা যাবে না। কারণ এতে বাজেট কম, মানে কমিশনও কম।”

তিনি পরামর্শ দেন, ‘ভাঙন রোধে সারা বছর কাজ করতে হবে। নদীর প্রবাহ ঠিক রাখতে হবে। নির্বিচারে বালু উত্তোলন বন্ধ করতে হবে। বালুমহল আইনে যেভাবে বলা হয়েছে, সেভাবে উত্তোলন করলে ভাঙন অনেকাংশে কমবে। এ ছাড়া স্থানীয় পদ্ধতি নিয়েও কাজ করতে হবে।’ 

১০৬টি প্রকল্প

অবৈধভাবে বালু উত্তোলন, উত্তরাঞ্চলের নদীর গভীরতা কমে আসা এবং জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে নদীভাঙন হচ্ছে বলে সরকারও একমত।

এসব বিষয় মাথায় রেখে সরকার বিভিন্ন প্রকল্প নিয়েছে উল্লেখ করে পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী জাহিদ ফারুক বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘প্রতিবেশী দেশগুলো থেকে আসা পলি ও বালুর কারণে আমাদের নদী ভরাট হচ্ছে। তাই প্রবাহ ঠিক রাখা যাচ্ছে না। এক বছর ড্রেজিং করলাম তো পরের দু’বছর আবার ভরাট হয়ে যায়। তবে আমরা পরিকল্পনা অনুযায়ী কাজ করছি।’

তিনি বলেন, ‘বিভিন্ন প্রকল্পের ৫৭ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে। ৫১১টি নদী ও খাল খনন করায় নদীর ধারণক্ষমতা বেড়েছে। তাই গতবছর পাঁচবার বন্যা হলেও ক্ষতি কম হয়েছে। চলমান কাজগুলো শেষ হলে ক্ষতি আরও কমে আসবে।’

বর্তমানে ১০৬টি প্রকল্প চলমান আছে উল্লেখ করে প্রতিমন্ত্রী বলেন, ‘এর জন্য প্রায় ৩৪ হাজার কোটি টাকা খরচ হবে। পর্যায়ক্রমে কাজ হবে। অতীতে এত বরাদ্দ রাখা হয়নি।’

 

 
/এফএ/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
বাংলাদেশের উন্নয়ন দেখলে আমাদের লজ্জা হয়: শাহবাজ
বাংলাদেশের উন্নয়ন দেখলে আমাদের লজ্জা হয়: শাহবাজ
৬ ম্যাচ পর জয় দেখলো বেঙ্গালুরু 
৬ ম্যাচ পর জয় দেখলো বেঙ্গালুরু 
সাদি মহম্মদ স্মরণে ‘রবিরাগ’র বিশেষ আয়োজন
সাদি মহম্মদ স্মরণে ‘রবিরাগ’র বিশেষ আয়োজন
‘নীরব এলাকা’, তবু হর্নের শব্দে টেকা দায়
‘নীরব এলাকা’, তবু হর্নের শব্দে টেকা দায়
সর্বাধিক পঠিত
দুদকের চাকরি ছাড়লেন ১৫ কর্মকর্তা
দুদকের চাকরি ছাড়লেন ১৫ কর্মকর্তা
বাংলাদেশ ব্যাংকের চাকরি ছাড়লেন ৫৭ কর্মকর্তা
বাংলাদেশ ব্যাংকের চাকরি ছাড়লেন ৫৭ কর্মকর্তা
স্কুল-কলেজে ছুটি ‘বাড়ছে না’, ক্লাস শুরুর প্রস্তুতি
স্কুল-কলেজে ছুটি ‘বাড়ছে না’, ক্লাস শুরুর প্রস্তুতি
কেন গলে যাচ্ছে রাস্তার বিটুমিন?
কেন গলে যাচ্ছে রাস্তার বিটুমিন?
ধানের উৎপাদন বাড়াতে ‘কৃত্রিম বৃষ্টির’ পরিকল্পনা
ধানের উৎপাদন বাড়াতে ‘কৃত্রিম বৃষ্টির’ পরিকল্পনা