X
শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪
১৩ বৈশাখ ১৪৩১

কবিতা নিয়ে কোনো সন্তুষ্টি নেই, আছে নিরাময়ের অযোগ্য এক অতৃপ্তি : মিনার মনসুর

সাক্ষাৎকার গ্রহণ : জাহিদ সোহাগ
২০ জুলাই ২০২১, ০০:০০আপডেট : ২০ জুলাই ২০২১, ০০:০০

মিনার মনসুর কবি, সম্পাদক ও সংগঠক। তার লেখালেখির শুরু সত্তর দশকের দ্বিতীয়ার্ধে। জন্ম ২০ জুলাই ১৯৬০ সালে চট্টগ্রামের পটিয়া উপজেলার বরলিয়া গ্রামে। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় বাংলা বিভাগ থেকে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে বিএ (সম্মান) এবং এমএ। দীর্ঘদিন সাংবাদিকতা করলেও বর্তমানে তিনি দ্বিতীয় মেয়াদে জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্রের পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেছেন।
প্রকাশিত গ্রন্থ–কবিতা : ‘এই অবরুদ্ধ মানচিত্রে’; ‘অনন্তের দিনরাত্রি’; ‘অবিনশ্বর মানুষ’; ‘আমার আকাশ’; ‘জলের অতিথি’; ‘কবিতাসংগ্রহ’; ‘মা এখন থেমে যাওয়া নদী’; ‘মিনার মনসুরের দ্রোহের কবিতা’। ছড়া : ‘হেলাফেলার ছড়া’। গবেষণা : ‘হাসান হাফিজুর রহমান : বিমুখ প্রান্তরে নিঃসঙ্গ বাতিঘর’ এবং ‘ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত : জীবন ও কর্ম’। প্রবন্ধ : ‘শোষণমুক্তির লড়াইয়ে মধ্যবিত্তের ভূমিকা’; ‘কবি ও কবিতার সংগ্রাম’; ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনার শত্রু-মিত্র’ এবং ‘আমার পিতা নয় পিতার অধিক’। জীবনী : ‘ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত’। সম্পাদিত গ্রন্থ : ‘শেখ মুজিব একটি লাল গোলাপ’; ‘শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত স্মারকগ্রন্থ’; ‘শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের আত্মকথা’; ‘মুক্তিযুদ্ধের উপেক্ষিত বীর যোদ্ধারা’; ‘বাংলাদেশের সমাজ, রাজনীতি ও উন্নয়ন : বিশিষ্টজনের ভাবনা’ এবং ‘চিরকালের নেতা’।



জাহিদ সোহাগ : আপনার প্রথম কবিতার বই ‘এই অবরুদ্ধ মানচিত্রে’ প্রকাশিত হয় মাত্র ২৩ বছর বয়সে। স্বভাবতই জানতে ইচ্ছে করে আপনার লেখালেখির প্রস্তুতি সম্পর্কে। তখন কেমন ছিল পরিবেশ? কী পড়ছেন, কী লিখছেন, কী ভাবছেন ইত্যাদি?
মিনার মনসুর : প্রস্তুতির কথা যদি বলেন সে এক মহাযজ্ঞ। আমার গোটা শৈশবজুড়েই চলছিল সেই যজ্ঞ। লাটাই কার হাতে ছিল জানি না, কিন্তু সবকিছু এমনভাবে সাজানো হয়েছিল যে আমার কলম হাতে নেওয়া ছাড়া গত্যন্তর ছিল না।
আমাদের বড় পরিবার—তারপরও শৈশবে আমি খুব নিঃসঙ্গ ছিলাম। খুব নাজুক ছিলাম। ছিলাম মা-ন্যাওটা। মাকে খুব মিস করতাম। যতদূর মনে পড়ে, চার-পাঁচ বছর বয়স থেকেই আমি মাকে ছাড়া থাকতাম। মা বেশিরভাগ সময় গ্রামের বাড়িতে থাকতেন। শহরের বাসায়—এমনকি মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলোতেও—মাকে ছাড়া থাকার ভীতিকর অভিজ্ঞতা আমার ছিল। খুব সংক্ষেপে যদি বলি, নিঃসঙ্গতার সেই শূন্যতাকে কানায় কানায় পূর্ণ করে দিয়েছিল বই।

বইয়ের জোগান নানাভাবে আমার কাছে আসতো। সেই ষাটের দশক থেকেই বড়ভাই বঙ্গবন্ধুর নিবেদিতপ্রাণ কর্মী ছিলেন। সেই সূত্রে রাজনীতির বই আসত। বড়ভাইয়ের ছাত্রলীগের সহযোদ্ধারা চাইতেন আমাকে বঙ্গবন্ধুর আদর্শের সাচ্চা কর্মী হিসেবে গড়ে তুলতে। অন্যদিকে, বড়ভাইয়ের আরেক বন্ধু ছিলেন ছাত্র ইউনিয়নের কেন্দ্রীয় নেতা। তাঁর মাধ্যমে আসত রুশ বিপ্লবের দুর্দান্ত সব বই ও পত্রপত্রিকা। তিনি চাইতেন আমি ছাত্র ইউনিয়নের কর্মী হই। ফলে শৈশবে রাজনৈতিক প্রেরণাসঞ্চারী বই-ই আমি বেশি পড়েছি। তার মধ্যে ম্যাক্সিম গোর্কির বইগুলোর কথা বেশি মনে আছে।

একইসঙ্গে আমাকে বলতে হবে আরেকটি গুপ্তভাণ্ডারের কথা। সেটি ছিল দুর্লভ সব পুথির সংগ্রহ। আমার মা বিয়ের পর নানাবাড়ি থেকে সেগুলো সঙ্গে নিয়ে এসেছিলেন। তারপর থেকে আমৃত্যু যক্ষের ধনের মতো আগলে রেখেছিলেন। মাকে ঘিরে নানাবয়সী নারীদের একটি পাঠচক্র গড়ে উঠেছিল। মা তাদের সেইসব পুথি সুর করে পড়ে শোনাতেন। আবার তা ব্যাখ্যাও করতেন। আর শ্রোতারা তন্ময় হয়ে তা শুনতেন। কখনো কখনো হু হু করে কাঁদতেন। সেই সুর সেই পুথিও আমার অন্তর জয় করে নিয়েছিল। মার কাছে কোরানের তর্জমাও শুনেছি। মা ছিলেন আগ্রাসী পাঠক। হাতের কাছে যা পেতেন সবই পড়তেন।

আমাদের বাসায় আরও কিছু বই ছিল। তার মধ্যে মীর মশাররফ হোসেনের বিষাদসিন্ধু, জসিমউদ্দীনের হাসির গল্প, আরব্য উপন্যাস বইগুলির কথা আমার মনে আছে। কীভাবে যেন আরও দুটি নিষিদ্ধ বই আমাদের বাসায় ঢুকে পড়েছিল। সেগুলো হলো—আবদুল মান্নান সৈয়দের ‘সত্যের মতো বদমাশ’ ও সৈয়দ শামসুল হকের ‘খেলারাম খেলে যা’। বুঝে না-বুঝে এ দুটি বইও তখন পড়ে ফেলেছিলাম।

একসময় বইয়ের ঘাটতি পড়ে যায়। তখন আমি স্কুলে পড়ি। বইয়ের সন্ধানে ঢুকে পড়ি স্থানীয় একটি পৌর পাঠাগারে। সেই শুরু। আর পরিবেশের কথা যদি বলেন, সমগ্র বাংলাদেশ (তখন পূর্ব পাকিস্তান) তখন টগবগ করে ফুটছে ছয় দফা ও উনসত্তরের গণআন্দোলনের অভূতপূর্ব আগুনে। বড়ভাইদের দেখানো পথ ধরে আমিও সানন্দে তাতে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলাম সেই শিশু বয়সে।


জাহিদ সোহাগ : আপনার কবিতায় প্রেমের প্রকাশ থাকলেও দ্রোহ, সমাজ চেতনা তথা বাঙালির মুক্তিযুদ্ধ প্রবলভাবে আছে। আশার স্বপ্ন ও নিরাশার ক্ষোভও আছে। আপনার শিল্পচিন্তা সম্পর্কে জানতে চাই? যদি আমরা আপনার হাল আমলের কবিতার দিকেও তাকাই এই প্রসঙ্গ দেখি।
মিনার মনসুর : ফ্রানজ কাফকা সম্ভবত এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন যে তিনি তাঁর চোখের সামনে প্রিয়জনের হত্যাযজ্ঞ দেখেছেন। শিশুহত্যা দেখেছেন। দেখেছেন নারীদের চরম অবমাননা। আর দেখেছেন তাঁর অতি প্রিয় গ্রামটি ট্যাংকের চাকায় পিষ্ট হতে। তিনি প্রশ্নকর্তা সেই সাংবাদিককে পাল্টা প্রশ্ন ছুড়ে দিয়েছিলেন, এর পর তাঁর কাছ থেকে তিনি যা লিখছেন তা থেকে ভিন্ন কিছু কি আশা করা উচিত? আমাদের প্রজন্মের ব্যাপারটাও অনেকটা তাই। আপনার মনে রাখতে হবে যে বাঙালি কিন্তু যুদ্ধবাজ জাতি নয়। তারপরও আমরা একটি সশস্ত্র ও রক্তাক্ত মুক্তিযুদ্ধ দেখেছি। গণহত্যা দেখেছি। নারীর সম্ভ্রমহানি দেখেছি। দেখেছি খালে-বিলে-নদীতে নিরপরাধ মানুষের লাশ পড়ে থাকতে।

তারপর এত মূল্য দিয়ে যে স্বাধীনতা আমরা পেলাম, মাত্র সাড়ে তিন বছরের মধ্যে তাঁর স্থপতিকে—জাতির পিতাকে—বাঙালির হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ মানুষটিকে সপরিবারে নৃশংসভাবে হত্যা করা হলো রাতের অন্ধকারে। সেই দৃশ্যও আমাদের দেখতে হয়েছে কাপুরুষের মতো। এখানেই শেষ নয়। দীর্ঘ দুই দশকেরও বেশি সময় ধরে আমরা প্রকাশ্যে ঘাতকদের আস্ফালন দেখেছি। দেখেছি একাত্তর ও পঁচাত্তরের ঘাতকদের গাড়িতে লাখো শহিদের জীবনের বিনিময়ে পাওয়া পতাকা উড়তে।

অতএব, আমিও কাফকার সঙ্গে সুর মিলিয়ে বলতে চাই, আমরা যা হয়েছি, তাছাড়া আপনি আর ভিন্ন কী আশা করতে পারেন আমাদের প্রজন্মের কাছে! জাতি হিসেবে বাঙালি কি তাঁর ইতিহাসে একসঙ্গে এত রক্ত দেখেছে? এত বর্বরতা? এত বিশ্বাসঘাতকতা? সংগত কারণেই আমাদের শিল্পচিন্তার সবটা জুড়ে আছে মানুষ। আছে প্রতিবাদ, আছে দ্রোহ। আছে সমাজবিপ্লবের আকণ্ঠ তৃষ্ণা। সর্বোপরি আছে তীব্র তুমুল এক ভালোবাসা। তবে আমরা যদি আর একটু বিশদভাবে দেখি, তাহলে দেখব, বায়ান্নের ভাষা আন্দোলনের পর থেকে যত পরীক্ষানিরীক্ষাই হোক আমাদের কবিতার কেন্দ্রে স্থায়ীভাবে আসন করে নিয়েছে দেশ ও মানুষ। একাত্তর ও পঁচাত্তরের রক্তবন্যা সেখানে নতুন মাত্রা যুক্ত করেছে মাত্র।

‘হাল আমলের কবিতা’ নিয়ে আমার পর্যবেক্ষণ খানিকটা ভিন্ন। তারা প্রবলভাবে পুরনো বৃত্ত থেকে বেরিয়ে আসার পথ খুঁজছেন—সেটা কী আঙ্গিকে, কী কাব্যভাষায়, কী তার বিষয়বস্তুতে। তাদের কারো কারো জানাশোনার পরিধিটাও রীতিমতো ঈর্ষণীয়। এটা বাংলাদেশের কবিতার জন্য স্বাস্থ্যকর ও সম্ভাবনাময় বলে আমার মনে হয়েছে।


জাহিদ সোহাগ : চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নকালে আপনি প্রত্যক্ষভাবে রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন সে সম্পর্কে এবং তখনকার বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক পরিবেশ কেমন ছিল?
মিনার মনসুর : সংক্ষেপে যদি বলি, তখন সময়টা ছিল অস্ত্র হাতে নেওয়ার। একাত্তর ও পঁচাত্তরের ঘাতক-দালাল ও মীরজাফরদের বিরুদ্ধে আরেকটি মুক্তিযুদ্ধে অবতীর্ণ হওয়ার। আমাদের প্রজন্মের দুর্ভাগ্য যে আমরা সেটা পারিনি। তবে সান্ত্বনা এটুকু যে আমরা যথাসময়ে হাতে কলম তুলে নিতে পেরেছিলাম। সেই কলম আজও হাতছাড়া করিনি।

বস্তত সেটা ছিল ‘আইয়ামে জাহেলিয়াতের’ কাল। খুনিরাই তখন দেশের দণ্ডমুণ্ডের কর্তা। সপরিবারে নিহত জাতির পিতার নামও উচ্চারণ করা যেত না প্রকাশ্যে। ক্ষমতাসীন ঘাতকদের পোষা গুণ্ডারা প্রকাশ্যে অস্ত্র হাতে ঘুরে বেড়াত। আর সাংস্কৃতিক অঙ্গনে চলছিল বাংলাদেশকে আরেকটি ‘মিনি পাকিস্তানে’ পরিণত করার তোড়জোড়। সেই সময়কার পরিস্থিতি বোঝার জন্য বলি, ১৯৮০ সালে অনুষ্ঠিত চাকসু নির্বাচনে ২৭টি পদের মধ্যে ভিপি-জিএসসহ ২৪টিই দখল করে নিয়েছিল শিবির-জামাত চক্র। সেই নির্বাচনে ছাত্রলীগ (কাদের-চুন্নু) থেকে আমি বার্ষিকী সম্পাদক নির্বাচিত হয়েছিলাম বিপুল ভোটে। তার আগে, ১৯৭৯ সালে, আমরা বহুল আলোচিত ‘শেখ মুজিব একটি লাল গোলাপ’ প্রকাশ করেছিলাম যা বঙ্গবন্ধুহত্যার পর প্রকাশিত প্রথম স্মারকগ্রন্থ হিসেবে মুজিবশতবর্ষে বাংলা একাডেমি কর্তৃক পুনর্মুদ্রিত হয়েছে ২০১৯ সালে।

এককথায়, আমরা সেই অন্ধকারের অচলায়তনের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিলাম। বলা বাহুল্য, সংস্কৃতিই ছিল আমাদের মুখ্য হাতিয়ার।


জাহিদ সোহাগ : কবি হিসেবে নিজেকে কীভাবে দেখেন? কবিতা কি আপনাকে সুখী করে?
মিনার মনসুর : অবশ্যই সুখী করে। জীবনের ভঙ্গুরতাই বলেন আর নিরর্থকতাই বলেন—তা প্রতিমুহূর্তেই চাদরের মতো আমাকে জড়িয়ে রাখে। সব সংবেদনশীল মানুষই হয়তো কোনো না কোনোভাবে সেই স্বাদ পান। মানবজীবনের এই যে চিরকালীন সত্য করোনা মহামারি এসে আমাদের হয়তো একটু মোটাদাগে তা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে। জাঁ পল সার্ত্রের মতো আমারও মনে হয় যে জীবনের যা কিছু অর্থ (আদৌ যদি থাকে) তা আছে আমাদের এসব সৃষ্টির মধ্যে। সেটা কবিতা হতে পারে, গান হতে পারে, হতে পারে মোনালিসা বা গোয়েরনিকার মতো কোনো চিত্রকর্ম। বলতে দ্বিধা নেই যে কবিতার মধ্যে আমি আমার এ নগণ্য জীবনের যৎসামান্য হলেও অর্থ খুঁজে পাই। আমার একটি পঙক্তি আছে এরকম : ‘যতক্ষণ তার বাহুলগ্ন থাকি সেটুকু ক্ষণই কেবল আমার মুক্তি’।

এমনিতেই আমি খুব গুটিয়ে থাকা মানুষ। কবিতার ক্ষেত্রে আরও বেশি। বস্তুত গত চার দশকেরও বেশি সময় ধরে আমি একটি কবিতাই লেখার চেষ্টা করছি। আমার মনে হয়, সে-কবিতাটি আমি আজও লিখে উঠতে পারিনি। বুঝতেই পারছেন, নিজের কবিতা নিয়ে আমার কোনো সন্তুষ্টি নেই। আছে কেবল নিরাময়ের অযোগ্য এক অতৃপ্তি।


জাহিদ সোহাগ : আপনি কি আপনার সমসাময়িকদের লেখা পড়েন? তাদের বিষয়ে আপনার মতামত কী? এই প্রশ্ন এজন্য করছি যে, তাদেরও লেখার বড় একটি অংশ জুড়ে আছে মুক্তিযুদ্ধ।
মিনার মনসুর : সবচেয়ে বেশি পড়েছি পঞ্চাশের ও ষাটের দশকের কবিদের কবিতা। আপনাকে অকপটেই বলি, সমসাময়িকদের মধ্যে সবার লেখা আমাকে টানে না। তবে উল্লেখযোগ্যদের প্রায় সবার লেখাই কমবেশি পড়েছি। পড়ি। যে-কথাটা এখানে বলা জরুরি মনে করি তা হলো, সত্তরের কবিদের ‘প্রেম ও দ্রোহের কবি’ বলে ঢালাওভাবে যে অভিধাটি দেওয়া হয় সেটি যথার্থ নয়। সত্তরে দু-একজন খুব ভালো কবি আছেন যারা হাল আমলের কবিদের মতোই নিরীক্ষাপ্রবণ ও আধুনিকমনস্ক। এ নিয়ে আমার প্রকাশিতব্য ‘কালান্তরে কবির মুখ ও মুখোশ’ গ্রন্থে আমি কিছুটা আভাস দিয়েছি। ভবিষ্যতে আর বিশদভাবে লেখার ইচ্ছে আছে।


জাহিদ সোহাগ : মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো লেখকজীবন কি আপনি বরণ করতে পারতেন? উইলিয়াম ফকনার বলেছেন, লেখকের চাই কাগজ ও পেন্সিল। তিনি অর্থ-বিত্তের ধার ধারতেন না। বিষয়টাকে আপনি কীভাবে দেখেন। লেখকরা কি দারিদ্র্যকে উদযাপন করবে?
মিনার মনসুর : এখনকার বাস্তবতায় সে অবকাশ নেই বললেই চলে, যদিও লিখে আয় করার সুযোগ তুলনামূলকভাবে অনেক বেড়েছে। কিন্তু তা দিয়ে বউবাচ্চা নিয়ে জীবনধারণের মতো উদাহরণ আমাদের দেশে কটি আছে? লেখক অর্থবিত্তের পেছনে ছুটবেন না, কিন্তু দুবেলা খাওয়ার মতো, রাতে মাথা গুঁজবার মতো আশ্রয়টুকুই যদি না থাকে তিনি লিখবেন কীভাবে? আমরা বলি বটে যে দারিদ্র্য, তুচ্ছতাচ্ছিল্য, উপেক্ষা আর অবহেলার মতো বিষয়গুলো হলো লেখকের জন্য আশীর্বাদ—কিন্তু আমাদের অভিজ্ঞতা ও বাস্তবতার সাক্ষ্য একেবারেই ভিন্ন। আমার তো মনে হয়, এ কালের লেখকদের জন্য দারিদ্র্য মস্তবড়ো অভিশাপ। কারণ দারিদ্র্য কেবল তার লেখকসত্তাকেই বিপর্যস্ত করে না; একইসঙ্গে মানুষ হিসেবে তাঁর ব্যক্তিত্বকেও ভেঙে গুড়িয়ে দেয়। উদাহরণ অনেক। আমি সেদিকে যাব না। শুধু এটুকু বলব যে এখন মাঝারি মানের লেখক হওয়ার জন্যেও যে প্রস্তুতি ও পড়াশুনা দরকার, দুবেলা অন্নসংস্থানের দুর্ভাবনায় ভারাক্রান্ত কোনো ব্যক্তির পক্ষে সেটি সম্ভব নয় তা তিনি যত প্রতিভাবানই হোন না কেন।


জাহিদ সোহাগ :
কোনো কোনো পাঠক বলেন যে, তারা কবিতা বুঝতে পারেন না। আপনার ক্ষেত্রে কি এমন ঘটেছে? তাদের জন্য আপনার পরামর্শ কী?
মিনার মনসুর : এতে লেখকের কোনো দায় নেই। আমি উচ্চাঙ্গ সংগীত বুঝি না, ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ কিংবা আমজাদ আলী খানের বাদন বুঝি না—এতে তাঁদের কিছু যায় আসে না। অক্ষমতাটা আমার। অতএব, সেই অক্ষমতার ঘাটতি পূরণ করতে হলে আমাকেই সেই স্বর্গীয় সংগীতসুধার স্বাদ গ্রহণের উপযুক্ততা অর্জন করতে হবে। যদি সেটা না পারি তাহলে ক্ষতিটা আমার। এটি হলো প্রথম কথা। দ্বিতীয় কথা হলো, কবিতার নামে যাচ্ছেতাই লেখা যে হচ্ছে না তাও নয়। আমি তো বলব, ফেসবুকসহ অসম্পাদিত অনলাইন মাধ্যমগুলোর কল্যাণে বরং আগাছার চাষই বেশি হচ্ছে। কেউ যদি মনে করেন, জটিল বা ভুলবাক্যে ভরা অযথা দুর্বোধ্য কিছু লিখে ফেললেই ভালো কবি হওয়া যায়—সেই দায় কিন্তু পাঠকের ওপর চাপানো যাবে না।

ব্যক্তিগতভাবে আমি সহজিয়া ধারায় বিশ্বাসী। কঠিন কথাগুলোকে কবিতায় সহজ করে বলার চেষ্টা করি। কিন্তু ‘সহজ’ কথা যায় কি বলা সহজে?


জাহিদ সোহাগ : আপনি তরুণদের লেখা পড়েন? এবং আপনার পড়াশোনার ক্ষেত্র কী? কী কী বিষয় পড়েন? এখন কী পড়ছেন?
মিনার মনসুর : আমি প্রায় সব ধরনের লেখাই পড়ি। তবে যদি আমার আগ্রহের কথা বলেন তাহলে আমি প্রথমেই ইতিহাসের কথা বলব। ইতিহাস-আশ্রিত লেখাই আমাকে বেশি টানে। দ্বিতীয় স্থানটি নিশ্চিতভাবে আত্মজৈবনিক রচনার। শিশুবেলা থেকে আমি এই দুই ধরনের লেখার প্রতি আসক্ত। একসময় রাজনীতির তত্ত্বসংবলিত বইও প্রচুর পড়েছি। রাজনৈতিক লেখার প্রতি এখনো আকর্ষণ অনুভব করি। তবে তত্ত্ব এখন আর আমাকে টানে না। ধর্ম-দর্শন-বিজ্ঞানও আমার পছন্দের বিষয়। আর কবিতা তো সর্বক্ষণের সঙ্গী।

গত এক বছরে যে বইগুলো পড়েছি তার মধ্যে টলস্টয়ের ‘ওয়ার অ্যান্ড পিস’; মুহম্মদ হাবিবুর রহমান অনূদিত ‘কোরানশরিফ সরল বঙ্গানুবাদ’; মাসরুর আরেফিনের উপন্যাস ‘আগস্ট আবছায়া, ‘আন্ডারগ্রাউন্ড’ ও কাব্যগ্রন্থ ‘পরিস্থিতি যেহেতু আগুন হয়ে আছে’; আবুল কাসেমের ‘মৌর্য’; নাজিম হিকমতের ‘লাইফ ইজ বিউটিফুল, ব্রাদার’; আল মাহমুদের ‘কবির মুখ’; ফরিদ কবিরের ‘আমার গল্প’; কামাল চৌধুরীর ‘শ্রেষ্ঠ কবিতা’, ট্রাভেলস অব ইবনে বতুতা’, সিদ্দিক সালেকের ‘উইটনেস টু সারেন্ডার’, অ্যান্থনি মাসকারেনহাসের ‘আ লিগ্যাসি অব ব্লাড’ এবং অরুন্ধতী রায়ের ‘মিনিস্ট্রি অব হ্যাপিনেস’ অন্যতম।


জাহিদ সোহাগ : আপনি কখনও রহস্যগল্প পড়েছেন? বা কমিক?
মিনার মনসুর : কমিক পড়িনি, কিন্তু রহস্যগল্প অঢেল পড়েছি। আমাদের শৈশব ছিল কাজী আনোয়ার হোসেনের ‘কুয়াশা’ ও ‘মাসুদ রানা’ময়। আর দুর্দান্ত সব ওয়েস্টার্ন তো ছিলই। সেবা প্রকাশনীর সব ধরনের বই-ই পড়েছি। দস্যু বনহুর, দস্যু বাহরামও পড়েছি যৎকিঞ্চিৎ। জেমস বন্ডের সিনেমাগুলো এখনো আমার প্রিয়। আর যে-কথাটি বলা খুব জরুরি মনে করি সেটি হলো, কাজী আনোয়ার হোসেনের সেই নির্ভার গদ্য আমাকে এখনো মুগ্ধ করে। আমার নিজের (গদ্য) লেখালেখির ব্যাপারে আমি পরোক্ষভাবে তাঁর কাছে ঋণী।


জাহিদ সোহাগ : ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনার শত্রু-মিত্র’ বিষয়টাকে আপনি কীভাবে দেখেন? প্রায়োগিক দিক থেকে কি বিচার করেন? যেমন : আমরা জানি দীর্ঘসময় ধরে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও বঙ্গবন্ধুর আদর্শের সরকার ক্ষমতায়, কিন্তু মোটাদাগে তাদের কিছু কীর্তিকলাপ, যেমন ব্যাংক দেউলিয়া হয়ে যাওয়া, ঋণখেলাপি, বিদেশে টাকা পাচার এবং যথাযথভাবে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা না হওয়া এবং নির্বাচনী ব্যবস্থা ভঙ্গুর হয়ে যাওয়া এসব কি মুক্তিযুদ্ধের চেতনার স্বরূপ?
মিনার মনসুর : মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে আমি অবশ্যই তার সমগ্রতা নিয়ে দেখি। আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের অবিসংবাদিত নেতা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যেভাবে এ চেতনাকে ধারণ, লালন ও বিবৃত করে গেছেন সেই সমগ্রতার আলোকেই আমি মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে দেখি ও বিচার করি। বঙ্গবন্ধুর চারটি মূলনীতির ভিত্তিতে বাংলাদেশ স্বাধীন করেছিলেন। স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালে গৃহীত আমাদের সংবিধানে দ্ব্যর্থহীন ভাষায় তা লিপিবদ্ধও হয়েছিল। স্বাধীনতা অর্জনের পর প্রদত্ত একাধিক ভাষণে বলেছিলেন, এটা তাঁর প্রথম বিপ্লব। আর দ্বিতীয় বিপ্লব হচ্ছে—শোষণ ও বৈষম্যমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে বাংলার দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটানো। সেই লক্ষ্যেই তিনি দ্বিতীয় বিপ্লবের ডাকও দিয়েছিলেন। খোলনলচে বদলে ফেলতে চেয়েছিলেন ব্রিটিশ শাসকদের প্রবর্তিত এই ঘুণেধরা সমাজ ও রাষ্ট্রকাঠামো। কিন্তু ঘাতকের বুলেট তা আর বাস্তবায়িত হতে দেয়নি। অতএব, সংক্ষেপে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে যদি আমরা সংজ্ঞায়িত করি তাহলে বলা যায় যে বাঙালি জাতীয়তাবাদের ভিত্তিভূমির ওপর শোষণ ও বঞ্চনামুক্ত এমন একটি বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করা যা হবে ধর্মনিরপেক্ষ ও গণতান্ত্রিক। যারা এ আদর্শের বিপক্ষে তারাই মুক্তিযুদ্ধের চেতনার শত্রু।

কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের চেতনা নিয়ে আলাপ করার সময় আমাদের খুব সতর্ক থাকতে হবে। কারণ একটি মহল সুকৌশলে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা নিয়ে এক ধরনের বিভ্রান্তি বা ধোঁয়াশা সৃষ্টি করতে চায়। যেমন তারা বলেন, যারা একাত্তরে পাকিস্তানি হানাদারদের সহায়তা করেছে কেবল তারাই রাজাকার নয়, এখন যারা কোনো গর্হিত কর্ম করবে তারাও রাজাকার। সড়ক দুর্ঘটনার বিরুদ্ধে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে সুকৌশলে রাজাকার শব্দটিকে হাস্যকর ও বিতর্কিত করে তোলার অপচেষ্টার কথা নিশ্চয় আপনার মনে আছে। এই জ্ঞানপাপীরা মজ্জাগতভাবে মুক্তিযুদ্ধের বিরোধী। কিন্তু সরাসরি বিরোধিতা করার সাহস তাদের নেই। তাই নানা কৌশলে তারা বিষয়টি নিয়ে বিভ্রান্তি তৈরি করতে চায়। সংক্ষেপে শুধু এটুকুই বলি, মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে আর কোনো কিছুর তুলনা চলে না। তুলনা করা সমীচীনও নয়। কারণ এখানে লাখো মানুষের আত্মত্যাগের প্রশ্ন জড়িত। এখানে একটি জাতির জন্মের ইতিহাস ও আবেগ জড়িত।


জাহিদ সোহাগ : জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্রকে আপনি কীভাবে দেখতে চান? আপনি নতুন কী কী করেছেন?
মিনার মনসুর : আমি দ্বিতীয় মেয়াদে জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্রের দায়িত্ব গ্রহণ করেছি গত ১৩ জুলাই। অসীম সম্ভাবনাময় একটি প্রতিষ্ঠান এই জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্র। অনেক কিছুই আমাদের করার আছে। প্রাথমিকভাবে আমি একটি লক্ষ্যকে সামনে রেখে অগ্রসর হতে চাই। সেটি হলো সারা দেশে বর্তমানে যে সহস্রাধিক বেসরকারি পাঠাগার আছে পর্যায়ক্রমে সেগুলোকে সচল করে তোলা। আমি মনে করি, এ পাঠাগারগুলোই হলো সমাজের প্রকৃত বাতিঘর। এ বাতিঘরগুলো একসঙ্গে প্রজ্বলিত করা গেলে গ্রামে-গঞ্জে শিকড় গেড়ে বসা সাম্প্রদায়িকতা, উগ্রবাদ ও নারীর প্রতি অবমাননাসহ দেশের আশিভাগ অন্ধকারই দূর হয়ে যাবে বলে আমার দৃঢ় বিশ্বাস।

পাঠাগারগুলো সক্রিয় হলে আমাদের রুগ্ন প্রকাশনা খাতও সরাসরি তার সুফল পাবে। বইবান্ধব সমাজগঠনের কাজ যত জোরদার হবে বইয়ের বাজারও তত প্রসারিত হবে। সর্বোপরি, বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, সোনার বাংলা গড়তে হলে সোনার মানুষ চাই। আমি সেই লক্ষ্যেই এগিয়ে যেতে চাই সুদৃঢ় প্রত্যয়ের সঙ্গে।


জাহিদ সোহাগ : সবগুলো প্রশ্নের উত্তর দেবার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ জানাই।
মিনার মনসুর : আপনাকেও ধন্যবাদ।

/জেডএস/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
সাদি মহম্মদ: ভাইয়ের কান্না, বন্ধুর স্মৃতি, সতীর্থদের গানে স্মরণ…
সাদি মহম্মদ: ভাইয়ের কান্না, বন্ধুর স্মৃতি, সতীর্থদের গানে স্মরণ…
খালি বাসায় ফ্যানে ঝুলছিল কিশোরী গৃহকর্মীর লাশ
খালি বাসায় ফ্যানে ঝুলছিল কিশোরী গৃহকর্মীর লাশ
গরমে রেললাইন বেঁকে যাওয়ার শঙ্কায় ধীরে চলছে ট্রেন
গরমে রেললাইন বেঁকে যাওয়ার শঙ্কায় ধীরে চলছে ট্রেন
মন্দিরে সেলফি তুলতে গিয়ে প্রদীপে দগ্ধ নারীর মৃত্যু
মন্দিরে সেলফি তুলতে গিয়ে প্রদীপে দগ্ধ নারীর মৃত্যু
সর্বাধিক পঠিত
পুলিশের সব স্থাপনায় নিরাপত্তা জোরদারের নির্দেশ
পুলিশের সব স্থাপনায় নিরাপত্তা জোরদারের নির্দেশ
সরকারি না হলেও সলিমুল্লাহ কলেজে অধ্যাপক ১৪ জন
সরকারি না হলেও সলিমুল্লাহ কলেজে অধ্যাপক ১৪ জন
মৌসুমের সব রেকর্ড ভেঙে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা চুয়াডাঙ্গায়
মৌসুমের সব রেকর্ড ভেঙে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা চুয়াডাঙ্গায়
এগিয়েছে ‘ওমর’, চমকে দিলো ‘লিপস্টিক’!
ঈদের ছবিএগিয়েছে ‘ওমর’, চমকে দিলো ‘লিপস্টিক’!
হোটেল রুম থেকে এই ৫ জিনিস নিয়ে আসতে পারেন ব্যাগে ভরে!
হোটেল রুম থেকে এই ৫ জিনিস নিয়ে আসতে পারেন ব্যাগে ভরে!