X
সোমবার, ০৬ মে ২০২৪
২৩ বৈশাখ ১৪৩১

চিকিৎসকদের কোয়ারেন্টিন বাতিল, আর কত হারাবেন তারা?

বাংলা ট্রিবিউন রিপোর্ট
২৩ জুলাই ২০২১, ২২:০০আপডেট : ২৩ জুলাই ২০২১, ২৩:২৩

করোনায় বাবা-মাকে হারিয়েছেন কুমিল্লা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের করোনা ইউনিটে দায়িত্ব পালনকারী চিকিৎসক জাকি উদ্দিন। ছয় মাসের ব্যবধানে করোনায় বাবা-মাকে হারিয়ে ডা. জাকির সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম-ফেসবুকে চিকিৎসা পেশা ছেড়ে দেওয়ার কথা জানান। 

কোয়ারেন্টিনের ব্যবস্থা না থাকায় কুমিল্লার রেসকোর্সের বাসা থেকে হাসপাতালে আসা-যাওয়া করতেন ডা. জাকি উদ্দিন। ছয় মাস আগে মা-বাবা ও ছোট বোনসহ তিনি করোনায় আক্রান্ত হন। এরপর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান তার মা জাহানারা নাসরিন।

করোনা থেকে সুস্থ হলেও তার বাবা মারা যান চলতি মাসে। বাবাকে হারিয়ে ডা. জাকি উদ্দিন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে লেখেন, ‘একদম এতিম হয়ে গেছি ছয় মাসের ভেতর। কোভিড দিয়ে মেরে ফেলছি।’ এরপর ইংরেজিতে যা লেখেন, তার বাংলা অর্থ দাঁড়ায়, ‘কোনও বাবা-মায়ের যেন আমার মতো সন্তান না থাকে, যে তার বাবা-মাকে ছয় মাসের মধ্যে মেরে ফেলেছে। আমার আর এই পেশায় থাকা উচিত না বলে মনে করি।’

ডা. জাকি উদ্দিনের এ স্ট্যাটাস চিকিৎসক মহলে আলোচনার জন্ম দেয়। নতুন করে আবার উঠে আসে করোনা ইউনিটে দায়িত্বপালনকারী চিকিৎসকদের কোয়ারেন্টিন (সঙ্গ নিরোধ) বাতিলের সিদ্ধান্তের বিষয়টি।

ছয় মাসের ব্যবধানে একজন মানুষ এতিম হয়ে গেলো মন্তব্য করে চিকিৎসকদের জাতীয় সংগঠন-বিএমএ’র কুমিল্লা জেলার সাধারণ সম্পাদক ডা. আতাউর রহমান জসিম বলেন, ‘তার (ডা. জাকি উদ্দিন) বন্ধু ও শুভাকাঙ্ক্ষীরা করোনা ডেডিকেটেড ইউনিটে দায়িত্বরতদের জন্য কোয়ারেন্টিন বা আবাসিক ব্যবস্থা না থাকাকে দায়ী করছেন। এ ব্যাপারে (কোয়ারেন্টিন) তাদের জন্য কী উন্নত ব্যবস্থা করা যায় না?’

কুমিল্লা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের কোভিড ইউনিটের চিকিৎসক ডা. আতিক বলেন, ‘প্রণোদনা নেই, কোয়ারেন্টিনের ব্যবস্থা নেই, জীবনের নিরাপত্তা নেই। আবার সরকারি চাকরি করি বলে কিছু বলতেও পারবো না। এ কেমন কথা? আমরা কোয়ারেন্টিনের ব্যবস্থাসহ সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা দেওয়ার জন্য সরকারের কাছে জোর দাবি জানাচ্ছি।’

প্রসঙ্গত, দেশে করোনা মহামারি শুরু হওয়ার পর গত ১২ এপ্রিল রাজধানীর ছয় হাসপাতালের করোনায় আক্রান্ত রোগীদের স্বাস্থ্য সেবাদানকারী চিকিৎসক, নার্স ও স্বাস্থ্যকর্মীদের থাকার জন্য ১৯টি হোটেল নির্ধারণ করে স্বাস্থ্য অধিদফতর। কিন্তু গত ২৯ জুলাই স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় আবাসিক হোটেলের বিল পরিশোধ না করার সিদ্ধান্ত নেয়। সঙ্গে চিকিৎসকদের জন্য বরাদ্দ হোটেলের সুবিধাও বাতিল করে পরিপত্র জারি করে।  

কোয়ারেন্টিনের পরিবর্তে মন্ত্রণালয়ের পরিপত্রে বলা হয়, রাজধানী ঢাকার মধ্যে দায়িত্ব পালনকারী একজন চিকিৎসক দৈনিক দুই হাজার টাকা এবং ঢাকার বাইরে এক হাজার ৮০০ টাকা, একজন নার্স ঢাকার মধ্যে এক হাজার ২০০ ঢাকা এবং ঢাকার বাইরে এক হাজার টাকা এবং একজন স্বাস্থ্যকর্মী ঢাকার মধ্যে ৮০০ টাকা এবং ঢাকার বাইরে ৬৫০ টাকা ভাতা পাবেন।

অথচ চিকিৎসকসহ সংশ্লিষ্টরা বলছেন, চিকিৎসকরা সুপার স্প্রেডার। ১৫ দিন টানা হাসপাতালে ডিউটি করার পর নিজ দায়িত্বে কোয়ারেন্টিন সব দিক থেকেই অবৈজ্ঞানিক। তারা বলছেন, চিকিৎসকরা কোনও পাঁচ তারকা হোটেল চাননি, তারা কেবল ‘লিভিং স্ট্যান্ডার্ড’ অনুযায়ী থাকার জায়গা চেয়েছিলেন; তাদের এবং তাদের পরিবারের সবার সুরক্ষার জন্য।

চিকিৎসকদের কোয়ারেন্টিনের ব্যবস্থা না করলে ফল ভালো হবে না

কোয়ারেন্টিন বাতিলের সিদ্ধান্ত খুবই অমানবিক, অপমানজনক ও অবমাননাকর বলে মন্তব্য করেছেন কোভিড ডেডিকেটেড হাসপাতালগুলোতে কাজ করা চিকিৎসকরা। তারা বলছেন, এই সিদ্ধান্তগুলো আমলাতান্ত্রিক না হয়ে বিজ্ঞানভিত্তিক হওয়া উচিত। কোভিড রোগীদের চিকিৎসা কি মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা করছেন নাকি চিকিৎসকরা করছেন, এমন প্রশ্নও তুলছেন চিকিৎসকরা। একইসঙ্গে চিকিৎসকরা এও বলছেন, কোয়ারেন্টিন আমাদের ছুটি নয়, এটা হাসপাতালে কাজের একটি অংশ। কোনোভাবেই কর্তৃপক্ষ এ সময়ে আমাদের বাড়িতে পাঠাতে পারে না।

কোয়ারেন্টিন বাতিলের সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করে করোনাবিষয়ক জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটিসহ চিকিৎসকদের একাধিক সংগঠন এই কোয়ারেন্টিন সুবিধার দাবি জানিয়ে এসেছে।

কোভিড-১৯ বিষয়ক জাতীয় কারিগরি পরার্মশক কমিটির ২০তম সভায় হাসপাতালে দায়িত্ব পালনরত স্বাস্থ্যকর্মীদের কোয়ারেন্টিনের ব্যবস্থা নিয়ে একাধিকবার আলোচনা হয়েছে। কমিটির সদস্যরা বলছেন, চিকিৎসকসহ স্বাস্থ্যকর্মীদের সঙ্গে তাদের পরিবার পরিজনরাও কোভিড-১৯ সংক্রমণের ঝুঁকিতে পড়েন। তাই ডিউটি শেষে তাদের কোয়ারেন্টিনের জন্য নিরাপদ আবাসনের প্রয়োজন।

গত ৮ জুলাই বাংলাদেশ মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি ডা. মোস্তফা জালাল মহি উদ্দিন ও মহাসচিব ডা. ইহতেশামুল হক চৌধুরী স্বাস্থ্যমন্ত্রীকে লেখা চিঠিতেও চিকিৎসকসহ অন্যান্য স্বাস্থ্যকর্মীদের কোয়ারেন্টিনের বিষয়টি উল্লেখ করেন। চিঠিতে তারা বলছেন, চিকিৎসক ও সহযোগী স্বাস্থ্যকর্মীদের কোয়ারেন্টিন সুবিধা বাতিল করে দেওয়া হয়েছে। এর ফলে চিকিৎসক এবং তাদের পরিবারের সদস্যদের করোনায় আক্রান্তের হার অনেক বেড়েছে।

আবার কোনও কোনও চিকিৎসক দ্বিতীয়বার করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন জানিয়ে বিএমএ’র চিঠিতে বলা হয়, দীর্ঘদিন বিরতীহীনভাবে সেবা ও তাদের কারণে পরিবারের সদস্যদের করোনায় আক্রান্ত হওয়ায় দেশের সব চিকিৎসক চূড়ান্তভাবে মানসিক যন্ত্রণার মাধ্য দিয়ে সময় পার করছেন। 

বিএমএ’র তথ্য অনুযায়ী দেশে মহামারিকালে এখন পর্যন্ত ১৬৯ জন চিকিৎসক করোনায় আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন। আর গত ৮ জুলাই পর্যন্ত করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন আট হাজার ২৮৩ জন স্বাস্থ্যকর্মী। তাদের মধ্যে চিকিৎসক রয়েছেন দুই হাজার ৯৫৪ জন, নার্স দুই হাজার ২৩ জন এবং অন্যান্য স্বাস্থ্যকর্মী রয়েছেন তিন হাজার ৩০৬ জন।

চিকিৎসকরা মানষিকভাবে খুবই বিধ্বস্ত হয়ে গেছেন জানিয়ে বিএমএ’র মহাসচিব ডা. মো. ইহতেশামুল হক চৌধুরী কোয়ারেন্টিন বাতিলের সিদ্ধান্ত কতোটা অযৌক্তিক সেই প্রশ্ন তুলেছেন।

কোয়ারেন্টিন বন্ধ করে দেওয়াতে চিকিৎসকরা হাসপাতাল থেকে বাড়িতে ফিরে যাচ্ছেন, আর বাড়ি গিয়ে তারা অন্যদের সংক্রমিত করছেন। এটা কোনোভাবেই কাম্য হতে পারে না জানিয়ে ইহতেশামুল হক চৌধুরী বলেন, ‘গত দেড় বছর ধরে চিকিৎসকরা বিরামহীনভাবে এই মহামারি সামাল দিয়ে যাচ্ছেন, যেটা আমার চিকিৎসক জীবনে পাইনি।’

তিনি বলেন, ‘বহুসংখ্যক চিকিৎসকের পরিবারের অনেক মানুষ করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন, মৃত্যুবরণ করেছেন। আর তাই কোয়ারেন্টিন ব্যবস্থা জরুরিভিত্তিতে চালু করা উচিত; এটা বলতে বলতে ক্লান্ত হয়ে গেলাম। এভাবে যদি চলতে থাকে তাহলে কেবল মানসিকভাবে বিধ্বস্ত নয়, নানাভাবে তাতে প্রভাবিত করবে, কাজে প্রভাব ফেলবে।’

‘সরকারের প্রতি বিনীত অনুরোধ থাকবে, চিকিৎসকসহ অন্যদের কোয়ারেন্টিন ব্যবস্থা চালু করার’-বলেন ইহতেশামুল হক চৌধুরী।

‘যখন কোয়ারেন্টিন বাতিল করা হয় তখনই আমরা আপত্তি করেছিলাম।’ পরার্মশক কমিটি, বিএমএ, স্বাচিপসহ প্রতিটি সংগঠন, প্রত্যেক চিকিৎসক এর বিরোধিতা করেছেন জানিয়ে কোভিড-১৯ বিষয়ক জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটির সদস্য ও স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদ (স্বাচিপ) এর সভাপতি অধ্যাপক ডা. ইকবাল আর্সলান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘বারবার এ সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ জানিয়ে কোয়ারেন্টিনের ব্যবস্থা করার জন্য জোরালোভাবে বারবার বলেছি। কিন্তু সরকার সেটা করেনি।’

তিনি বলেন, ‘যে পরিস্থিতি এখন দাঁড়াচ্ছে, চিকিৎসকরা কিন্তু এক সময় ক্লান্ত হয়ে যাবে। এটা কেউ গ্রাহ্য করছে না। এখনও সময় আছে, চিকিৎসকদের কোয়ারেন্টিনের ব্যবস্থা করা হোক।’

‘প্রকৃত অবস্থা হচ্ছে, একজন চিকিৎসকের জন্য পরিবার হুমকিতে পড়ছে, যেটা কেউ চায় না। নিজের জীবনের চেয়েও পরিবারের মানুষগুলো বেশি গুরুত্বপূর্ণ। এ কারণে কোনও চিকিৎসক কিন্তু করোনা রোগীদের চিকিৎসা করতে আপত্তি করে না, কেবল চায় হাসপাতাল থেকে চিকিৎসা দিয়ে যেন তাকে তার পরিবারের কাছে ফিরতে না হয়। এটা দায়িত্ববোধের জায়গা, আর এ জন্যই চিকিৎসকদের কোয়ারেন্টিনের ব্যবস্থা সরকারিভাবে করা উচিত, চিকিৎসকদের মনোবল ধরে রাখতে হলে এটা এখনি না করা হলে ফল ভালো হবে না’—বলেন অধ্যাপক ইকবাল আর্সলান।

 

 

/জেএ/আইএ/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
কিশোরকে তুলে নিয়ে চাঁদা দাবির অভিযোগে ৪ পুলিশ সদস্য প্রত্যাহার
কিশোরকে তুলে নিয়ে চাঁদা দাবির অভিযোগে ৪ পুলিশ সদস্য প্রত্যাহার
সুন্দরবনের আগুন দ্রুত নিয়ন্ত্রণে আসায় প্রধানমন্ত্রীর সন্তোষ
সুন্দরবনের আগুন দ্রুত নিয়ন্ত্রণে আসায় প্রধানমন্ত্রীর সন্তোষ
লন্ডনের স্টেডিয়ামে গাইবেন জেমস
লন্ডনের স্টেডিয়ামে গাইবেন জেমস
যাত্রাবাড়ীতে বাস-পিকআপ সংর্ঘষে নিহত ২
যাত্রাবাড়ীতে বাস-পিকআপ সংর্ঘষে নিহত ২
সর্বাধিক পঠিত
অভিযোগের শেষ নেই মাদ্রাসায়, চলছে শুদ্ধি অভিযান
অভিযোগের শেষ নেই মাদ্রাসায়, চলছে শুদ্ধি অভিযান
‘টর্চার সেলে’ নিজ হাতে অপারেশনের নামে পৈশাচিক আনন্দ পেতো মিল্টন, জানালেন হারুন
‘টর্চার সেলে’ নিজ হাতে অপারেশনের নামে পৈশাচিক আনন্দ পেতো মিল্টন, জানালেন হারুন
নিজেদের তৈরি ভেহিকেল পেরুকে উপহার দিলো সেনাবাহিনী
নিজেদের তৈরি ভেহিকেল পেরুকে উপহার দিলো সেনাবাহিনী
চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা নিয়ে যা বললেন জনপ্রশাসনমন্ত্রী
চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা নিয়ে যা বললেন জনপ্রশাসনমন্ত্রী
কোন পথে এগোচ্ছে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ?
কোন পথে এগোচ্ছে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ?