X
শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪
৬ বৈশাখ ১৪৩১
আবদুল মান্নান সৈয়দ

তাঁর যেটুকু জল আঁজলা ভরে রেখেছি

দুর্জয় খান
০৫ সেপ্টেম্বর ২০২১, ০০:০০আপডেট : ০৫ সেপ্টেম্বর ২০২১, ০০:০০

আবদুল মান্নান সৈয়দ ক্রমাগত প্রচেষ্টায় বিশ্বাসী। তবে আশাবাদীর মতো নয়। তাঁর জগৎ প্রতীতি কোনো পরিত্রাতার সান্ত্বনায় উচ্ছ্বসিত হতে দেয় না। কোনো মুক্তিমন্ত্রে নয় বরং গ্রহণ ও সন্ধান করাকে তিনি গ্রহণ করেছিলেন। ক্রমাগত সন্ধান করে যাওয়ার ইচ্ছেশক্তিটাই তাঁকে সবচেয়ে পৃথক করে তুলেছে। আশান্বিত হওয়ার কিছু নেই। নৈরাশ্যে ভেঙে পড়ারও কোনো কারণ নেই। প্রয়োজন শুধু বোধ ও ক্রমপুঞ্জিত প্রচেষ্টার যাপিত জীবন। মান্নান সৈয়দের কাছে মানুষের জীবন উদ্দেশ্যেহীন নয়। কারণ উদ্দেশ্যহীন জীবন নিয়েও মানুষ কোনো না কোনো উদ্দেশ্য নিয়ে জীবন ধারণ করেন। অর্থাৎ, উদ্দেশ্য ব্যতীত কোনো রাস্তা নেই। ক্রমাগত পথ সন্ধান করতে করতেই তাঁর পথচলা। পথ কোথায় পৌঁছবে, কতটা সফল হবে সে চেষ্টা, আদৌ হবে কি না এসব প্রশ্নের উত্তরও তিনি জানবার আগ্রহ দেখাননি কখনো। তিনি বিশ্বাস করতেন বোধ ও আবেগের তুমুল তরঙ্গের সৃষ্টি না হলে জীবনকে ভিন্ন দৃষ্টি দিয়ে দেখা সম্ভব হয়ে উঠে না। আবদুল মান্নান সৈয়দের চিন্তাজগৎ সম্পর্কে মোহাম্মদ নূরুল হকের মতামত উপস্থাপন করা গেল—‘কোনো তত্ত্বের ছাঁচে ফেলে আবদুল মান্নান সৈয়দের কবিতার বিশ্লেষণ করা অবিচারের সমান। কারণ, মান্নান সৈয়দ তাত্ত্বিক নন; মতবাদীদের তত্ত্বের শিকার। এ কারণে তিনি ‘পরাবাস্তববাদী’ উপকবির খণ্ডিত অভিধায়ও অভিষিক্ত। যে অভিধা কোনোভাবেই তার জন্য কোনও সম্মান বয়ে আনে না। বরং একজন সার্বভৌম কবিকে উপগ্রহে পর্যবসিত করে।’

এ প্রসঙ্গে, উনিশ শতকের নন্দনতাত্ত্বিকদের প্রসঙ্গটি চলে আসে, তাঁরা বললেন ‘art for arts sake, বিশ শতকে a.c bradly বললেন, poetry for poetry's sake, আমাদের দেশের এক আলঙ্কারিক ধনঞ্জয় তাঁর ‘দশরূপক’ গ্রন্থে বললেন, 'আনন্দ নিঃস্যন্দিষু রূপকেষু ব্যুৎপত্তিমাত্রং ফলমল্লবুদ্ধিঃ। যোহপীতিহাসাদিবদাহ সাধুঃ তম্মৈ নমঃ স্বাদুপরাঙমুখায়।।’ অর্থাৎ, আনন্দ কিংবা উদ্দেশ্যহীন আনন্দ। অপরপক্ষে আবদুল মান্নান সৈয়দ স্বীকার করলেন, emotion for emotions sake. যেটির প্রসঙ্গে তিনি মূলত বলেছিলেন, ‘আবেগের তুমুল তরঙ্গের সৃষ্টি না হলে কবিতা লেখা যায় না।’ চিত্র, সঙ্গীত, কবিতা যাইহোক না কেন, তা সৃষ্টিকারীর মনে অখণ্ডভাবে প্রতিভাত না হলে, তাড়িত না করলে, প্রকৃত সৃষ্টি করা অসম্ভব। বিষয়ের গূঢ়তার পাশাপাশি প্রকাশভঙ্গির চারুত্বকে তিনি নিয়ে গেছেন উচ্চতর পর্যায়ে। আবেগ, অনুভূতি দীন হলে প্রকাশও দীন হবে এটাই স্বাভাবিক। তিনি প্রকাশভঙ্গিকে সৌন্দর্য বিচারের প্রাণ মনে করেন। তাঁর কবিতায় অনুভূতির অখণ্ড ও প্রকাশের সমগ্রতা ধারণ করে। পরাবাস্তব হোক কিংবা বাস্তব, কবিতায় প্যাশন বিষয়কে বরাবরই অপছন্দ করেছেন। কবিতায় মান্নান সৈয়দ নান্দনিক অভিজ্ঞতার তাৎক্ষণিক অনুভূতি-আলোড়নকে মূল্য দেননি; তিনি মূল্য দিয়েছেন মানুষের মনন ও দৃষ্টিভঙ্গির ভেতর সংগঠনের রূপকে। যেমন—‘জ্যোৎস্না ভূতের মতো দাঁড়িয়ে আছে দরোজায়, সব দরোজায়, আমার চারিদিকে যতগুলি দরজা আছে সময়ের নীলিমার পাতালের; জ্বলছে গাছসকল সবুজ মশাল; বাস একটি নক্ষত্র, পুলিশ একটি নক্ষত্র, দোকান একটি নক্ষত্র: আর সমস্তের উপর বরফ পড়ছে।—এরকম দৃশ্যে আহত হয়ে আমি শুয়ে আছি পথের উপর, আমার পাপের দুচোখ চাদ ও সূর্যের মতো অন্ধ হয়ে গেল, আর যে আমার জন্ম হলো তোমাদের করতলে মনোজ সে অশোক সে: জ্যোৎস্না তার কাছে ভূত কিন্তু একটি গানের উপর, দরজা তার কাছে পুলিশ কিন্তু একটি জন্মের উপর, মৃত্যু তার কাছে দোজখ কিন্তু একটি ফুলের উপর॥’
[অশোককানন// জন্মান্ধ কবিতাগুচ্ছ ]

আবদুল মান্নান সৈয়দের কবিতায় দুঃখবোধের চেয়ে উত্তরণের দুর্বার ছাপ রয়েছে। তাঁর দুঃখবোধ আরো বিধুর, তিক্ত এবং শেষ পর্যন্ত মুক্ত। কবিতায় তিনি মানুষকে শেষ পর্যন্ত বড় নির্জন, অর্থহীন, গাছপালা প্রভৃতি শেষ পর্যন্ত বস্তুজগৎ ছাড়া আর কিছু উপলব্ধি করেননি। জন্মান্ধ কবিতাগুচ্ছের ‘অশোককানন’ কবিতাটি সেই উপলব্ধির শতভাগ ছাপ রেখেছে। এই কবিতায় তিনি বিশুদ্ধ শিল্পমাধ্যম হিসেবে ‘জ্যোৎস্না ভূতের মতো, বাস একটি নক্ষত্র, পুলিশ একটি নক্ষত্র, দোকান একটি নক্ষত্র’ এবং শেষে তিনিই দাঁড়িয়ে আছেন। আবদুল মান্নান সৈয়দের প্রপঞ্জপুঞ্জ ও অন্তঃসারের (বহিরঙ্গ ও তার সারসত্যের) বস্তুগত অবজেক্টিভ ডায়ালেকটিক অনুযায়ী চেতনার ধারণাকে মনে হতে পারে অন্তঃসারের দিকে চলছে। কিন্তু এতকিছুর পরেও ‘অশোককানন’ কবিতার মধ্যে রয়েছে এমন সব অলোকসামান্য দিক, এক স্ট্রেঞ্জনেস যা জীবনের নিগূঢ় বাস্তবতাকে পরিস্ফুট করছে। কবি এখানে বাস্তবতার যে রূপটি দিয়েছেন তা আপনার অনুভবের দাক্ষিণ্যে যেন তখনি ফুটে ওঠার উপক্রম এবং তা দীর্ঘ সংগঠনের মধ্যদিয়ে বিকশিত হচ্ছে। এখানে প্রকৃতির নানা নিয়মাবলি সম্পর্কে জ্ঞান, বহুবিধ বিষয়ীগত ব্যক্তিগত ও আত্মিক সমস্যা ইত্যাদির অনুশীলন ও পরিশীলন করে কবি নিজের সত্তাকে সমৃদ্ধির দিকে ব'য়ে নিয়ে গেছেন। 

দুই
ধ্বনির সুশ্রবণের, অর্থাৎ শ্রবণবিলাস শ্রোত্ররঞ্জক ধ্বনির ভিত্তি যে ধ্বনির সু-উচ্চারণ এমন ইঙ্গিত প্রায়ই শোনা যায় কবিতায়। তবুও ধ্বনির সু-উচ্চারণ মানে কি? তারজন্য আমাদের ফোনিটিকস বা ধ্বনিবিজ্ঞানের স্মরণ নিতে হবে। ধ্বনিবিজ্ঞান আমাদের বলছে, ভাষার সমস্ত ধ্বনির উচ্চারণ প্রক্রিয়া একরকম নয়। এই উচ্চারণ প্রক্রিয়ার মধ্যেই এমন কিছু আছে যার ফলে কোনো ধ্বনি মধুর কিংবা কোনো ধ্বনি কর্কশ শোনায়। ধ্বনি ব্যাপারে কথা বলার কারণ হলো, মান্নান সৈয়দ কবিতায় ধ্বনি ব্যাপারটিকে সবচেয়ে গুরুত্ব দিয়ে দেখেছেন। এটাকে বলা হয় কবিতায় একটি সচেতন নির্মাণ বা artefact। ফলে তাঁর কবিতায় সৌন্দর্যতত্ত্ব তৈরি হয়ে গেছে। আর এও তো ঠিক যে কবিতার সৌন্দর্যতত্ত্বের একটা উপাদান তো তার ধ্বনিপরম্পরায় নিহিত থাকে। মোহাম্মদ নূরুল হকের মতবাদ অনুযায়ী আবদুল মান্নান সৈয়দকে তত্ত্বে না ফেলে, আমি সেই জটিল অনুভবের নন্দনতত্ত্বের ধারণাটিতে ফিরে যেতে পারি। শুধু মধুর ললিত কোমল ধ্বনি নয়, কোমল ও কর্কশ ধ্বনির এমন পরম্পরা তৈরি করা যেতে পারে। যাতে এক ধরনের ঘাত-প্রতিঘাত বা point-count-point-এর ধ্বনিগত প্রতিক্রিয়া তৈরি হয়। আবদুল মান্নান সৈয়দ তাঁর কবিতায় কোমল ধ্বনির ক্লান্তিকর পুনরাবৃত্তির চেয়ে মধুর ও কর্কশের সংঘাত সংঘর্ষের মধ্যদিয়ে ধ্বনির এক অন্য ধরনের নন্দনতত্ত্ব তৈরি করেছেন বা করতে সমর্থ হয়েছেন। আর এর মধ্যদিয়ে কবি আবদুল মান্নান সৈয়দ কবিতার সৌন্দর্যক্ষেত্রে গিয়ে পৌঁছেছেন। যেমনটা ‘পাগল এই রাত্রিরা’ কবিতায় শেষ পঙক্তিতে বলেছেন— ‘পাপের ভিতর গোলাপ থাকে, এমনকি শব্দের পাপে, ও কবিরা যেমন॥’

কাব্যনন্দনত্ত্বে ধ্বনিনন্দনতত্ত্বটি মূলত অর্থসংস্পর্শহীন। এখানে অর্থের সঙ্গে ধ্বনির সৌন্দর্য যোগে কবিতা সৌন্দর্যের কারণ হয়ে উঠেছে। স্পষ্ট হচ্ছে যে, কবিতায় আবদুল মান্নান সৈয়দ প্রাত্যক্ষিক সত্যের অনুকারক নন, বরং 'নির্বাচন' এবং 'রূপায়ণ' করে কবিতার জন্ম দিয়েছেন। উগ্র বস্তুপ্রিয়তা, সরল বর্ণনপদ্ধতি, নৈরাশ্য এসবকিছুকে তিনি সংমিশ্রণ করেননি। প্রত্যেককে নিজ নিজ প্লটে রেখে রচনার পাঠ্যগুণ বৃদ্ধি করেছেন। 

/জেডএস/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসা সীমান্তরক্ষীদের নিতে জাহাজ আসবে এ সপ্তাহেই
মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসা সীমান্তরক্ষীদের নিতে জাহাজ আসবে এ সপ্তাহেই
শিল্পী সমিতির নির্বাচন: কড়া নিরাপত্তায় চলছে ভোটগ্রহণ
শিল্পী সমিতির নির্বাচন: কড়া নিরাপত্তায় চলছে ভোটগ্রহণ
পাকিস্তানে জাপানি নাগরিকদের লক্ষ্য করে জঙ্গি হামলা
পাকিস্তানে জাপানি নাগরিকদের লক্ষ্য করে জঙ্গি হামলা
মাদারীপুরে কলেজছাত্রীকে ধর্ষণের অভিযোগে মামলা
মাদারীপুরে কলেজছাত্রীকে ধর্ষণের অভিযোগে মামলা
সর্বাধিক পঠিত
সয়াবিন তেলের দাম পুনর্নির্ধারণ করলো সরকার
সয়াবিন তেলের দাম পুনর্নির্ধারণ করলো সরকার
ডিএমপির ৬ কর্মকর্তার বদলি
ডিএমপির ৬ কর্মকর্তার বদলি
পিএসসির সদস্য ড. প্রদীপ কুমারকে শপথ করালেন প্রধান বিচারপতি
পিএসসির সদস্য ড. প্রদীপ কুমারকে শপথ করালেন প্রধান বিচারপতি
নিজ বাহিনীতে ফিরে গেলেন র‍্যাবের মুখপাত্র কমান্ডার মঈন
নিজ বাহিনীতে ফিরে গেলেন র‍্যাবের মুখপাত্র কমান্ডার মঈন
পরীমনির বিরুদ্ধে ‘অভিযোগ সত্য’, গ্রেফতারি পরোয়ানা জারির আবেদন
পরীমনির বিরুদ্ধে ‘অভিযোগ সত্য’, গ্রেফতারি পরোয়ানা জারির আবেদন