ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে গত বছরের ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হয়। প্রধানমন্ত্রীর পদ ছেড়ে শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে পাড়ি জমান ভারতে। আত্মগোপনে চলে যান মন্ত্রিপরিষদের সদস্যরা, অনেক সচিব, বিচারপতি ও বায়তুল মোকাররম মসজিদের খতিবসহ আওয়ামী লীগের বিভিন্ন স্তরের নেতাকর্মীরা। বাদ যাননি আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় নিয়োজিত পুলিশ বাহিনীর সদস্যরাও। ২০২৪ সালে ছাত্র-জনতার আন্দোলন দমন করতে গিয়ে পুলিশ নির্বিচারে গুলি চালায়। এতে নারী, শিশুসহ প্রায় দেড় হাজার ছাত্র-জনতা নিহত হন। গুরুতর আহত হয়েছেন অন্তত ৩০ হাজার মানুষ। ফলে সরকার পতনের পর তীব্র গণরোষের ভয়ে দুই লাখের বেশি সদস্যের এই বাহিনীর আইজিপি থেকে কনস্টেবল পর্যন্ত অনেকে গাঢাকা দেন।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ২০২৪ সালের ৫ আগস্টের পর আইনশৃঙ্খলা ও জননিরাপত্তা রক্ষায় নিয়োজিত দেশের সবচেয়ে বড় এই বাহিনীর সদস্যদের কর্মস্থল ছেড়ে পালিয়ে যাওয়া ছিল ইতিহাসে নজিরবিহীন। অনেক পুলিশ সদস্য ইউনিফর্ম খুলে গাঢাকা দেন। কেউ কেউ দেশ ত্যাগ করে পালিয়ে যান। দেশের দুয়েকটি জায়গায় অল্প কিছু পুলিশ সদস্য থাকলেও তারা ছিলেন সম্পূর্ণ নিষ্ক্রিয় ও আতঙ্কিত। গত বছরের ৮ আগস্ট অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর সরকারের ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টায় পুলিশ বাহিনী ধীরে ধীরে কর্মস্থলে ফিরে আসতে শুরু করে। তারপরও কর্মকর্তাদের একটি বড় অংশসহ দীর্ঘদিন দেশের থানাগুলোর পাহারায় থাকেন সেনাবাহিনীর সদস্যরা।
অনেকেই বলছেন, ৫ আগস্টের পর যে ট্রমায় গিয়েছিলেন পুলিশ সদস্যরা, সেই ট্রমা থেকে এখনও সম্পূর্ণভাবে বেরিয়ে আসতে পারেননি তারা। কারণ মানসিকভাবে ভেঙে পড়া পুলিশ সদস্যদের মধ্যে জনতার প্রতিশোধমূলক ‘মব’-এর ভয় এখনও কাজ করছে। যে কারণে পুলিশ এখনও বেশিরভাগ ক্ষেত্রে শক্ত হাতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় কাজ করতে পারছে না।
পুলিশে সংস্কার
২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টের ছাত্র-জনতার গণআন্দোলনে অসংখ্য ছাত্র-জনতা ও পুলিশ হতাহত হয়। তখন রাজনৈতিক দমন-পীড়নসহ পুলিশের নানা কার্যক্রম ও দক্ষতা নিয়ে জনমনে প্রশ্ন ওঠে। পুলিশ সম্পর্কে ব্যাপক নেতিবাচক ধারণা তৈরি হয়। পুলিশ সংস্কার নিয়ে কাজ করা সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পুলিশ সম্পর্কে জনগণের মধ্যে যে নেতিবাচক ধারণা তৈরি হয়েছে, সেটা খুবই উদ্বেগজনক।
২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পরই যে শুধু পুলিশের সংস্কারে কমিশন গঠন করা হয়েছে তা নয়। ১৭৯২ সাল থেকেই বিভিন্ন সময় পুলিশ সংস্কারে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। বাংলাদেশ আমলে এরশাদ সরকার ক্ষমতা নেওয়ার পর তার শাসনামলে চার দফা পুলিশ সংস্কারে কাজ করা হয়।
১৯৮২ সালে ফৌজদারি আইন সংস্কার কমিটির মাধ্যমে কিছু বিষয়ে সুপারিশ করা হয়। পরে ১৯৮৩ সালে ব্রিগেডিয়ার এনাম কমিটি নামে আরেকটি কমিটি করা হয়। সেখানেও কিছু সুপারিশ আসে। তৃতীয় দফায় ১৯৮৮ সালে বিচারপতি আমিনুর রহমান পুলিশ কমিশন নামে একটি কমিশন গঠন করা হয়। তারাও পুলিশ সংস্কারের বিষয় তুলে ধরে ৩২৮ পৃষ্ঠার বিশাল একটি প্রতিবেদন দিয়েছিল। ১৯৮৯ সালে একই উদ্দেশ্যে আবার একজন সাবেক আমলা মাহমুদুল হাসানের নেতৃত্বে একটি কমিটি করা হয়েছিল। ২০২৪ সালের আগে ২০০৩ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচি (ইউএনডিপি) ও যুক্তরাজ্যের উন্নয়ন সংস্থা ডিপার্টমেন্ট ফর ইন্টারন্যাশনাল ডেভেলপমেন্টের (ডিএফআইডি) সহায়তায় পুলিশ সংস্কার কার্যক্রম চলে। ২০০৭ সালে একটি খসড়া পুলিশ অধ্যাদেশও হয়েছিল। সকল কমিশন ও কমিটিই বাংলাদেশে একটি দক্ষ, মানবিক, যুগোপযোগী ও জনবান্ধব পুলিশ বাহিনী গঠনের ওপর জোর দিয়ে বিভিন্ন সুপারিশ করেছিল। কিন্তু ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টে ছাত্র-জনতার আন্দোলনে দেখা গেছে পুলিশের এক ভয়ংকর চেহারা। যার কারণে ওই বছরের ৫ আগস্ট সরকার পতনের সঙ্গে সঙ্গে পুরো বাহিনী অকার্যকর হয়ে পড়ে। বিক্ষোভ দমনে পুলিশের নৃশংসতার বিষয়টি জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক প্রতিবেদনেও তুলে ধরা হয়।
পালিয়ে যাওয়া পুলিশ কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা
৫ আগস্টের পর সরকারের ঘোষণা অনুযায়ী, পুলিশ কর্মকর্তা ও সদস্যদের সময় বেঁধে দিয়ে কাজে যোগদানের কথা বলা হয়। কিন্তু এরপর পুলিশের শীর্ষ শতাধিক কর্মকর্তাসহ ১৮৭ জন আর কাজে যোগদান করেননি। তাদের মধ্যে ৫১ জনকে বিভিন্ন সময় অবসর এবং ১৭ জনকে বরখাস্ত করা হয়। এছাড়াও জুলাই-আগস্টে ছাত্র-জনতার আন্দোলনে গণহত্যার অভিযোগে ১১৬৮ জন পুলিশ সদস্যকে আসামি করা হয়েছে। গ্রেফতার হয়েছেন অনেকে। পলাতকদের অনেকেই দেশের বাইরে পালিয়ে গেছেন বলে সংশ্লিষ্টদের ধারণা।
অন্তর্বর্তী সরকারের গঠন করা পুলিশ সংস্কার কমিশনের সদস্য ও মানবাধিকারকর্মী এএসএম নাসির উদ্দিন এলান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, বর্তমানে পুলিশ অনেক গুছিয়ে নিয়েছে। ৫ আগস্টের পর এ বাহিনীর যে ডিজাস্টারটা হয়েছে সেই ট্রমা থেকে বের হতে তো একটা সময় লাগে। এখন যারা পুলিশের নেতৃত্বে আছেন তারা অনেক দক্ষ। অনেকটা শূন্য থেকে পুলিশকে শুরু করতে হয়েছে। তবে বর্তমানে কিছু ক্ষেত্রে অপপ্রচারও আছে।
পুলিশের পালিয়ে যাওয়া ও ফিরে আসার বিষয়ে জানতে চাইলে পুলিশ সদর দফতরের মুখপাত্র ও মিডিয়া অ্যান্ড পিআর শাখার এআইজি ইনামুল হক সাগর বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘এ কথা অনস্বীকার্য যে ৫ আগস্টের পর আমরা চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হয়েছি। তবে পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা, অন্তর্বর্তী সরকার, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এবং পুলিশের সকল পর্যায়ের সদস্যদের আন্তরিকতার ফলে ধীরে ধীরে পুলিশের মনোবল ফিরে আসে। বর্তমানে পুলিশ সদস্যরা পেশাদারত্বের সঙ্গে নিজ নিজ দায়িত্ব পালন করছেন। দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্থিতিশীল রাখতে পুলিশের সকল পর্যায়ের সদস্যরা নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে। ভবিষ্যতেও জনআকাঙ্ক্ষা পূরণে পুলিশ আন্তরিকতার সঙ্গে কাজ করবে।
স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী বলেন, পুলিশ অনেকটাই স্বাভাবিকভাবে কাজ করছে। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিও আগের তুলনায় অনেক উন্নতি হয়েছে। তবে ৫ আগস্টের আগের পুলিশের চেয়ে বর্তমান পুলিশ অনেক মানবিক। যে কারণে মনে হতে পারে তারা শতভাগ অ্যাকটিভ না।