X
শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪
১৩ বৈশাখ ১৪৩১
সাহিত্যতত্ত্ব : একটি সংক্ষিপ্ত পরিক্রমা

সাইকোঅ্যানালিটিকাল ক্রিটিকাল থিয়রি বা মনঃসমীক্ষণবাদী সাহিত্যতত্ত্ব

মুহম্মদ মুহসিন
২৬ নভেম্বর ২০২১, ১২:০১আপডেট : ২৬ নভেম্বর ২০২১, ১২:১০

পূর্ব প্রকাশের পর

সাইকোঅ্যানালিটিকাল ক্রিটিকাল থিয়রি বা মনঃসমীক্ষণবাদী সাহিত্যতত্ত্ব

সাহিত্য সমালেচানায় সাইকোঅ্যানালাইসিস বা মনঃসমীক্ষণবাদী তত্ত্ব বিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধ থেকে দুনিয়াজুড়ে এক তোলপাড় কাণ্ড ঘটিয়েছে। সাইকোঅ্যানালাইসিস মূলত হলো মনোরোগ চিকিৎসার একটি ডাক্তারি পদ্ধতি। এই পদ্ধতির সাথে জড়িত কিছু বিষয় ও ভাবনা পরবর্তী সময়ে শুধু সাহিত্য নয় বরং জীবনের সবকিছুর ব্যাখ্যায় পারঙ্গমতা দেখাতে শুরু করল। কালে সেই পারঙ্গমতার মধ্যদিয়ে সাইকোঅ্যানালাইসিস হয়ে উঠল জীবন ও জগৎকে ব্যাখ্যার এক জবরদস্ত তত্ত্ব। এই তত্ত্বের আদিমূলে রয়েছে জার্মান (ভাষাগতভাবে) মনোবিজ্ঞানী সিগমুন্ড ফ্রয়েডের এক লজ্জাকর আপ্তবাক্য। ফ্রয়েড অনেক মানুষের মন নিয়ে গবেষণা করে শেষে মানবজাতির মুখে চুনকালি মেখে ঘোষণা করলেন যে, মানুষের মনোজগৎ পুরোটা নিয়ন্ত্রিত হয় তার যৌনাকাঙ্ক্ষা দ্বারা। আর মানুষের বহির্জগতের সবকিছু যেহেতু মন বা মানসিক ইচ্ছা দ্বারা নিয়ন্ত্রিত সেহেতু মানবজগতের সবকিছুই নিয়ন্ত্রিত হয় তার যৌনাকাঙ্ক্ষা দ্বারাই। সেই সবকিছুর মধ্য থেকে সাহিত্য যেহেতু বাদ যায় না সেহেতু তাঁর তত্ত্বমতে সাহিত্য-শিল্পও মূলে বিভিন্নরূপে যৌনাকাঙ্ক্ষা প্রকাশেরই ফসল। আমরা আগের নিবন্ধে দেখেছি কীভাবে এক জার্মান পণ্ডিত দুনিয়ার সবকিছু অর্থনীতি দ্বারা ব্যাখ্যা করেছেন, এবার দেখবো আরেক জার্মান পণ্ডিত কীভাবে দুনিয়ার সবকিছু যৌনাকাঙ্ক্ষা দ্বারা ব্যাখ্যা করেছেন।

এই ব্যাখ্যায় যাওয়ার আগে আমাদের একটু প্রস্তুতির বিষয় আছে। আমাদেরকে এই সাইকোঅ্যানালাইসিস নামক মনোচিকিৎসার সাথে সম্পর্কিত এবং সাইকোঅ্যানালাইটিক তত্ত্বের সাথে বহুলভাবে আলোচিত কতিপয় পারিভাষিক শব্দ বা টেকনিকাল টার্ম সম্পর্কে ধারণা নিতে হবে। শব্দগুলোকে কয়েকটি ক্ষেত্রে ভাগ করে নিয়ে আলোচনা করলে ব্যাপারটা একটু সহজ হতে পারে। ক্ষেত্রগুলো হলো যৌনতার বিকাশ, মনের মানচিত্র ও মনের কার্যাবলি, স্বপ্নজগৎ ও লেখক মানস। এই ক্ষেত্রগুলো নিয়ে ফ্রয়েড কোনো ধারাবাহিক আলোচনা করেছেন ব্যাপারটা এমন নয়। তিনি মনের চিকিৎসক মানুষ। মনোরোগীদের ওপর তাঁর বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষার বয়ান নিয়ে তিনি বিস্তর কিতাবাদি লিখেছেন। সেসব কিতাবাদিতে বিভিন্ন প্রসঙ্গসূত্রে তিনি এসব বিষয়ের ওপর কথা বলেছেন। পরে সাহিত্যতাত্ত্বিকরা তাদের মনঃসমীক্ষণবাদী তত্ত্ব ব্যাখ্যা করতে গিয়ে সেগুলো একত্রে গ্রন্থনার চেষ্টা করেছেন। এখন মনঃসমীক্ষণবাদী তত্ত্বের আলোচনায় তাই আমাদেরকেও প্রথমে সেগুলোকে বুঝে নিতে হয়।

যৌনতার বিকাশ : ফ্রয়েডের তত্ত্বমতে মানুষের যৌনচেতনা বয়ঃসন্ধিকাল থেকে শুরু হয় না, বরং তা শুরু হয় শিশুর জন্ম থেকেই। শিশুকাল থেকে জন্ম নেওয়া এই যৌনচেতনার ফ্রয়েডিয় নাম লিবিডো বা যৌনাকাঙ্ক্ষা। ফ্রয়েডের মতে প্রত্যেকের জীবনে লিবিডোর বা যৌনতার পাঁচটি স্টেজ বা স্তর রয়েছে : ওরাল স্টেজ (oral stage), অ্যানাল স্টেজ (anal stage), ফ্যালিক স্টেজ (phallic stage), লেটেন্ট স্টেজ (latent stage) ও জেনিটাল স্টেজ (genital stage)। আমাদের আলোচ্য থিয়রিরর জন্য প্রথম তিনটি স্টেজ সম্পর্কিত ধারণা আমাদের স্পষ্ট হওয়া দরকার। ওরাল স্টেজে শিশু প্রথমে মায়ের স্তনবৃন্ত এবং পরে যা কিছু হাতের কাছে পায় তা মুখে নিয়ে আনন্দ অনুভব করে। ফ্রয়েড এটিকে যৌন আনন্দ হিসেবেই চি‎হ্নিত করেছেন এবং এই স্টেজের মোটামুটি সময়কাল হলো শিশুর জন্মের পর থেকে একবছর। এরপরে অ্যানাল স্টেজে শিশু মলত্যাগে বিশেষ আনন্দ পায় এবং ফ্রয়েডের মতে এটিও একধরনের যৌনানন্দ। এই স্টেজের মোটামুটি সময়কাল হলো শিশুর বয়সের দ্বিতীয় ও তৃতীয় বছর। শিশুর যৌনতা বিকাশের তৃতীয় স্তর হলো ফ্যালিক স্টেজ অর্থাৎ লিঙ্গভিত্তিক যৌনান্দের স্তর। এর সময়কাল মোটামুটি চতুর্থ থেকে ষষ্ঠ বছর। এটাই মূলত যৌনতার স্বাভাবিকভাবে স্বীকৃত স্তর। 

ফ্যালিক স্টেজে শিশুর লিবিডোর প্রথম লক্ষ্য হলো তার মা। এই লক্ষ্য অর্জনের পথে বিশেষ করে ছেলে শিশুরা প্রথম বাঁধা বা প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে দেখতে পায় তার বাবাকে। সে তাই বাবাকে হত্যার এক গোপন ইচ্ছা ভিতরে লালন করতে শুরু করে। এই বিষয়টিকে ফ্রয়েড নাম দিয়েছেন ইডিপাস কমপ্লেক্স (Oedipus complex)। নামটি ইডিপাসবিষয়ক মিথ থেকে আনা হয়েছে কারণ আমরা জানি সে মিথে ইডিপাস তার বাবা লেয়াসকে হত্যা করেছিল এবং তার মাকে বিয়ে করেছিল। এই কমপ্লেক্সে ছেলে শিশুটি একটু বড় হয়ে যখন বুঝতে পারে যে, তার বাবা তার চেয়ে শক্তিশালী তখন সে একটি আতঙ্কের মধ্যে পড়ে যায়। শিশুটির মনে হয় তার বাবা তাকে নপুংসক করে ফেলবে। ফ্রয়েড এই আতঙ্কের নাম দিয়েছেন ক্যাস্ট্রেশন কমপ্লেক্স (castration complex)। ছেলেটি বড় হয়ে উঠতে উঠতে তার সমাজবাস্তবতায় অনুভব করতে শুরু করে যে, বাবাকে হত্যার ইচ্ছার বিষয়টি বেশ নোংরা এবং সামাজিকভাবে মারাত্মক এক ট্যাবু। ফলে মায়ের প্রতি যৌনাকাঙ্ক্ষামূলক ভালোবাসার ইচ্ছা, বাবাকে হত্যার ইচ্ছা ইত্যাদি সে সচেতনভাবে মনের ভিতরে চাপা দিতে বা গোপন করতে চেষ্টা করে। ফ্রয়েড মনের ইচ্ছাকে এভাবে গোপন করার বা চাপা দেওয়ার কাজকে বলেছেন রিপ্রেশন (Repression) বা অবদমন। ফ্রয়েডের মতে মানুষের সবরকম মনোরোগের কারণ হলো এই রিপ্রেশন বা অবদমন। শিশু তার বাবাকে হত্যার ইচ্ছাটি বা মায়ের প্রতি যৌনাকাঙ্ক্ষা প্রকাশের ইচ্ছাটি অবদমিত করার পরে ইচ্ছাটি তার মনের অচেতন অংশে চলে যায় এবং সেখানে জমা হয়। সচেতনভাবে সে বরং এবার চেষ্টা করে বাবার মতো হতে যাতে মায়ের মতো একজনের সম্পূর্ণ ভালোবাসা সে পেতে পারে যেভাবে তার বাবা পাচ্ছে। এ পর্যায়ে সে মায়ের মতো একজনের ভালোবাসা পেতে চেষ্টা করে। মায়ের মতো বলা হচ্ছে এ কারণে যে, মায়ের প্রতি যৌনাকাঙ্ক্ষামূলক ভালোবাসার প্রকাশ (ফ্রয়েডের মতে সব ভালোবাসাই যৌনাকাঙ্ক্ষামূলক) মারাত্মক ট্যাবু বিধায় এটি সচেতনভাবেই সে পরিহার করে এবং মায়ের পরিবর্তে মায়ের মতো কাউকে সে জায়গায় স্থাপন করাটা বাস্তবসম্মত বলে তার মনে হয়। সাইকোঅ্যানালাইটিক থিয়রির ধারণায় এ থেকে জন্ম নেয় মাদার ফিক্সেশন (Mother fixation)।

মনের মানচিত্র ও মনের কার্যাবলি : ফ্রয়েড মানুষের মনের একখানা মানচিত্র আঁকার জন্য অনেক কসরত করেছেন। মানচিত্রখানা অনেক পরিবর্তন ও পরিমার্জন করেছেন। শেষ পর্যন্ত মোটামুটি সহজ একখানা মানচিত্রই আমরা তাঁর কাছ থেকে পেয়েছি। সে মানচিত্র মোতাবেক মনের দুটি অংশ রয়েছে : একটি সচেতন অংশ (the conscious mind) ও আরেকটি অচেতন অংশ (the unconscious mind)। প্রিকনশাস মাইন্ড (preconscious mind) নামে আরো একটি অংশের কথা ফ্রয়েড মাঝে মাঝে বলেছেন তবে সেটি সাইকোঅ্যানালাইটিক থিয়রির জন্য খুব প্রয়োজনীয় ধারণা নয়। আয়তনে অচেতন অংশ সচেতন অংশের চেয়ে অনেক বড় যেমন সাগরে ভাসমান হিমবাহের ভাসমান অংশের তুলনায় ডুবন্ত অংশের আয়তন অনেকগুণ বড়। এই দুই অংশের কার্যাবলিকে ফ্রয়েড তিন ভাগে ভাগ করেছেন : ইদ (id), ইগো (ego) ও সুপার ইগো (super ego)। আগেই বলা হয়েছে ফ্রয়েডের মতে মানুষের সকল ইচ্ছা যৌনতা বা লিবিডো নিয়ন্ত্রিত। লিবিডো বা যৌনতার সকল আকাঙ্ক্ষার সম্মিলিত নাম ইদ। মানুষের সকল অবারিত আকাঙ্ক্ষা দ্বারাই ইদ নির্মিত। কিন্তু শিশু বড় হতে হতে বুঝতে পারে যে, বাস্তব জগতে এই সকল আকাঙ্ক্ষার অনেক কিছুই নৈতিক ও সামাজিক বাস্তবতায় পূরণীয় নয়। তখন সে সমাজবাস্তবতা ও তার ইদ-ভিত্তিক আকাঙ্ক্ষার মধ্যে একটি সমঝোতা বিধানের চেষ্টা করে, একটি মধ্যবর্তী গ্রহণযোগ্য জায়গায় পৌঁছতে চেষ্টা করে। সমঝোতার মাধ্যমে অর্জিত এই মধ্যবর্তী জায়গাটিই হলো ইগো। ইগোতে পৌঁছতে হলে ইদকে মনের সচেতন অংশ থেকে সরাতে হয়। এই সরানোর অনেকগুলো প্রক্রিয়া আছে যেমন রিপ্রেশন (repression), ডিসপ্লেসমেন্ট (displacement), ডিনায়াল (denial), প্রোজেকশন (projection) ও রিগ্রেশন (regression)। এদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত প্রক্রিয়া হলো রিপ্রেশন। এই রিপ্রেশন প্রক্রিয়ায় সকল অবদমিত ইচ্ছা ও আকাঙ্ক্ষা মনের সচেতন অংশ থেকে সরে গিয়ে অচেতন অংশে জমা হয়। সারা জীবন ধরে জমতে জমতে অচেতন অংশে অবদিমত আকাঙ্ক্ষাদের পাহাড় তৈরি হতে থাকে। ইগোর কাজ হলো সমাজবাস্তবতা ও নীতি নৈতিকতার সাথে নিজেকে খাপ খাওয়ানোর চেষ্টা আর সুপারইগোর কাজ হলো নৈতিকতার পথে আরো এক ধাপ এগিয়ে সমাজবাস্তবতার সকল নৈতিক বিধিনিষেধ সম্পর্কে সচেতন থাকা এবং সে অনুযায়ী নিজের কার্যাবলি নিয়ন্ত্রণের মানসিক প্রয়াস। শিশুর কাছে এই বিধিনিষেধ প্রথম আসে তার বাবার কাছ থেকে। পরবর্তীতে এই বাবার স্থানেই চলে আসেন ঈশ্বর যিনি মানবজাতির সকল বিধিনিষেধের সর্বোচ্চ উৎস। সুপারইগোর সকল কাজকর্মে ঈশ্বর বা ঈশ্বরের মতো পুতপবিত্র একজন হলেন মানুষের পথনির্দেশক।

স্বপ্নজগৎ : ফ্রয়েডের মতে মনের অচেতন অংশে আটকে থাকা ইদ বা অবদমিত আকাঙ্ক্ষারা মাঝে মাঝে বেরিয়ে আসতে চেষ্টা করে। মনের অচেতন অংশ থেকে মানুষের অবদমিত আকাঙ্ক্ষাদের বেরিয়ে আসার সাধারণ পথ হলো স্বপ্ন। তাই স্বপ্ন ফ্রয়েডের সাইকোঅ্যানালিটিকাল কর্মকাণ্ডের একটি কেন্দ্রীয় বিষয়। অচেতনের কোনটুকু কীভাবে স্বপ্নের মধ্যে প্রবেশ করেছে তা দেখানোর চেষ্টাকে ফ্রয়েড বলেছেন ড্রিমওয়ার্ক। সনাতন খোয়াবনামায় স্বপ্নের ব্যাখ্যায় একটি অর্থে পৌঁছার চেষ্টা করা হয়। কিন্তু ড্রিমওয়ার্কে স্বপ্নের কোনো নির্দিষ্ট অর্থ নেই। বরং মানুষের ও স্থানের ভিন্নতায় ড্রিমওয়ার্কাররা একই স্বপ্নের বিভিন্ন বিপরীতমুখী অর্থের ইঙ্গিত দিয়ে থাকেন। ড্রিমওয়ার্কে দুধরনের কাজ থাকে : কনডেনসেশন (condensation) ও ডিসপ্লেসমেন্ট (displacement)। স্বপ্নের মধ্যে অচেতনের বিষয়াবলি সরাসরি প্রকাশিত হয় না। স্বপ্নের মধ্যে ঘটনার বহুবিধতা অন্তর্নিহিত বা অচেতনের বিষয়াবলির সহজ প্রকাশকে ঘোলাটে ও কঠিন করে দেয়। কনডেনসেশন হলো স্বপ্নের সেই বহুবিধতার মধ্যে একটি কেন্দ্রিক ইমেজ খুঁজে বের করা যার মধ্যদিয়ে অচেতনের বিষয়টিকে দেখা যায়। স্বপ্নের দৃশ্যমান বিষয়াবলি দ্বারা অচেতনের যে অদৃশ্য বিষয়াবলি বোঝানো হয় তাদের মধ্যে সম্পর্ক এতই দূরের হয় যে অনেক সময় তা বলতে গেলে কৌতুকের মতো শোনায়। স্বপ্নের দৃশ্যমান বিষয়গুলো থেকে স্বপ্নের ঈপ্সিত অর্থের এমন দূরে সরে যাওয়াকে ফ্রয়েড ডিসপ্লেসমেন্ট বলে আখ্যায়িত করেছেন।

ফ্রয়েডের মতে মনের অচেতনের বিষয়াদি শুধু ঘুমের ভিতরে দেখা স্বপ্নের মধ্য দিয়েই বের হয়ে আসে না। মানুষের জাগ্রত অবস্থায়ও কিছু পথে এদের বের হয়ে আসার সুযোগ রয়েছে। এমন একটি পথের নাম প্যারাপ্রাক্সিস (parapraxis)। ‘দি সাইকোপ্যাথলজি অব এভরিডে লাইফ’ গ্রন্থে ফ্রয়েড বলেন যে, মনের অচেতন অংশের প্রকাশ শুধু স্বপ্নে নয়; আমাদের দৈনন্দিন কর্মকাণ্ডের যে কাজগুলোকে আমরা ‘ভুল’ বলে মনে করে থাকি সেগুলোও মূলত আমাদের মনের অচেতন অংশে জমে থাকা বিষয়াবলির প্রকাশ। এই সব ভুলের মধ্যে রয়েছে যেমন নাম ভুলে যাওয়া, জানা শব্দের ভুল উচ্চারণ করা, জানা সত্ত্বেও ঠিক শব্দের জায়গায় বেঠিক শব্দ ব্যবহার করা ইত্যাদি। মনের অচেতন অংশ থেকে বের হয়ে আসা এই জাতীয় ভুলগুলোকে ফ্রয়েড বলেছেন প্যারাপ্রাক্সিস। ফ্রয়েড বলছেন যে, এগুলো আমাদের মনের অচেতন অংশে জমে থাকা অবদমিত আকাঙ্ক্ষা এবং স্মৃতির জাগ্রত অবস্থায় প্রকাশিত রূপ। মনের সচেতন অংশ এগুলোকে ছিপিবদ্ধ করে আটকে রাখতে চায়। যখন পারে না তখন এরা এভাবে বের হয়ে আসে আর এগুলোকে তখন আমরা ‘ভুল’ বলে বাতিল করে রাখি।

স্বপ্নের মধ্যদিয়ে এবং দৈনন্দিন ভুলের মধ্যদিয়ে অবদমিত ইদের প্রকাশ হয় বিধায় মনোরোগের চিকিৎসকরা সেই স্বপ্নগুলো বা ভুলগুলো বিশ্লেষণ করে বুঝতে পারেন তার রোগীটি ইদ-বিষয়ক কী ঘটনা বা কী বাসনা অবদমন করতে করতে মানসিক রোগীতে পরিণত হয়েছে। সুতরাং, সাইকোঅ্যানালাইসিস নামক মনোচিকিৎসায় ডাক্তারের কাছে রোগীর ‘স্বপ্ন’ এবং ‘ভুল’ হলো রোগের সঠিক ডায়াগনসিসের জন্য বেশ গুরুত্বপূর্ণ দুই উপাদান। অ্যালোপ্যাথিক ডাক্তার যেমন রোগীর রক্ত ও প্রস্রাব পরীক্ষা বা বিশ্লেষণ করে রোগ নির্ণয় করে থাকেন, সাইকোঅ্যানালাইসিস নামক মনোচিকিৎসায় সাইকিয়াট্রিস্টও তেমনি রোগীর ‘স্বপ্ন’ আর ‘ভুল’ পরীক্ষা বা বিশ্লেষণ করে তাঁর রোগীর রোগের কারণ বের করে থাকেন। কিন্তু সমস্যা হলো অ্যালোপ্যাথিক ডাক্তার চাইলেই রোগী রক্ত আর প্রস্রাব দিয়ে দিতে পারে পরীক্ষার জন্য, কিন্তু মনোচিকিৎসক চাইলেই মনোরোগী স্বপ্ন দেখতে বসতে পারে না কিংবা ভুল করে সে ভুল চিকিৎসকের হাতে পীক্ষার জন্য তুলে দিতে পারে না। এই সমস্যা সমাধানের জন্য ফ্রয়েড ফ্রি অ্যাসোসিয়েশন নামে একটি টেকনিক আবিষ্কার করলেন যার মাধ্যমে চিকিৎসক রোগীকে কথা বলাতে বলাতে তার সচেতন মনের নিয়ন্ত্রণ থেকে মুক্ত করে তার মনের অচেতন অংশে প্রবেশ করতে পারেন।   

লেখক মানস : সাইকোঅ্যানালাইটিক তত্ত্বমতে লেখক বা সৃষ্টিশীল মানুষদের মনের অচেতন অংশে আটকে থাকা ‘ইদ’ একটু ভিন্ন কিছু উপায়ে বের হয়ে আসে। এক্ষেত্রে তিনটি পরিচিত উপায় হলো ফ্যান্টাসি (phantasy), ডে-ড্রিমিং (day-dreaming) ও সাবলিমেশন (sublimation)। তিনটিই বেশ পরোক্ষ উপায়। ফ্যান্টাসি হলো কল্পনায় কোনো ঘটনা সৃষ্টি করে তা থেকে আনন্দ পাওয়ার প্রয়াস। যে যৌনাকাঙ্ক্ষা বাস্তবসম্মত নয় তেমন যৌনাকাঙ্ক্ষা মনের অজান্তে লালন করে কল্পনায় তা চরিতার্থ করা সম্ভব হয় ফ্যান্টাসির মাধ্যমে। এতে আকাঙ্ক্ষাও কিছুটা চরিতার্থ হয়, আবার অনৈতিকতার কালিমা থেকেও মুক্ত থাকা যায়। ফ্যান্টাসির আরেকটু ঘনীভূত রূপ হলো ডে-ড্রিমিং বা দিবাস্বপ্ন। দিবাস্বপ্নের বিষয়টি লেখকের চেয়ে বরং সাধারণ মানুষের চর্চায় বেশি থাকে। সাধারণ মানুষেরা তাদের অপূর্ণ আকাঙ্ক্ষাগুলোকে দিবাস্বপ্নের মতো অলীক কল্পনায় পূরণ হতে দিয়ে তার মধ্যে একটু আনন্দ খুঁজে পায়। সাবলিমেশন অবদমিত ইদ প্রকাশের আরো একধাপ মহৎ ও লেখক-সুলভ এক প্রক্রিয়া। সাবলিমেশনের মাধ্যমে অবদমিত আকাঙ্ক্ষাকে অন্যরূপে মহিমান্বিত করে প্রকাশের প্রয়াস থাকে; যেমন, কামজ ও দৈহিক প্রেমাকাঙ্ক্ষাকে ঈশ্বরের প্রতি বা ঈশ্বর রূপ দেবীর প্রতি তীব্র প্রেমের প্রকাশরূপে অভিব্যক্ত করার মধ্যদিয়ে অবদমিত যৌনাকাঙ্ক্ষার সাবলিমেশন ঘটে।

চিকিৎসাবিজ্ঞানের সাইকোঅ্যানালাইসিসের সাথে সম্পর্কিত উপরোক্ত টেকনিকাল টার্মগুলো বা শব্দগুলো সব হয়তো সাইকোঅ্যানালিটিকাল সমালোচনাতত্ত্ব বুঝতে সমানভাবে গুরুত্বপূর্ণ নয়। তবুও সাইকোঅ্যানালিটিকাল সমালোচনাতত্ত্বের আলোচনায় সাধারণত এই শব্দগুলো চলে আসে। এবারে আমরা এই শব্দগুলোর সাহায্য নিয়ে সাইকোঅ্যানালিটিকাল সমালোচনাতত্ত্বের একটি সংক্ষিপ্ত পরিচিতি তুলে ধরতে চেষ্টা করব।  

ফ্রয়েডীয় সাইকোঅ্যানালিটিকাল সমালোচনাতত্ত্ব বলতে চায় যে, সাহিত্য মূলত মানুষের মনের অচেতন অংশে আটকে থাকা অবদমিত লিবিডো বা ইদের এক শৈল্পিক প্রকাশ। বিশেষ করে ফিকশনাল সাহিত্যে অর্থাৎ গল্প, উপন্যাস, নাটক ইত্যাদিতে এই ইদ বিভিন্নরূপে প্রকাশিত হয়। উপন্যাসের চরিত্রদের আচরণ বিশ্লেষণ করলে সেখানে এই ইদ কখনো ইডিপাস কমপ্লেক্স রূপে, কখনো মাদার ফিক্সেশন রূপে আবার কখনো ইলেক্ট্রা কমপ্লেক্স রূপে খুঁজে পাওয়া যায়। উপন্যাসের চরিত্রের ফ্যান্টাসি, প্যারাপ্রাক্সিস ইত্যাদি বিশ্লেষণ করলে বোঝা যায় যৌনাকাঙ্ক্ষা অবদমনের কী ধরনের ছায়াপাত তার চরিত্রে স্থায়ী হয়ে আছে। চরিত্রের কর্মকাণ্ড বিশ্লেষণ করে বুঝে নেয়া যায় ইদ, ইগো ও সুপারইগোর মধ্যে কার বলয়ে চরিত্রটি বিকাশ লাভের চেষ্টা করছে। কবিতার ইমেজ বিশ্লেষণ করে দেখে নেয়া যায় কবির মনোজগতে ইদ কীভাবে সাবলিমেশন রূপে উত্তীর্ণ হচ্ছে। আবার সাহিত্যকর্মটির চরিত্র কিংবা চিত্রকল্প বিশ্লেষণের মধ্য দিয়ে তীর্যক চাহনিতে দেখে নেয়া যায় লেখকের মনের গঠনটি কেমন। দেখে নেওয়া যায় লেখকের মনের অবদমিত ইদের আয়তন কী এবং প্রকরণ কী। সাইকোঅ্যানালিটিকাল সমালোচনাতত্ত্ব মতে লেখকের নিজের মনের চিত্রই মূলত তাঁর লেখার চরিত্র ও চিত্রকল্পের মধ্যদিয়ে প্রতিভাত হয়। তাই সাইকোঅ্যানালিটিকাল সমালোচনাতত্ত্ব মূলত এক লেখক-কেন্দ্রিক তত্ত্ব। এমনকি, চরিত্র বিশ্লেষণের সময় এ-ও ভেবে দেখা হয় যে, লেখক তাঁর চরিত্রদের ওপর মনোচিকিৎসকের মতো কতটা দক্ষতার সাথে ফ্রি-অ্যাসোসিয়েশন টেকনিক প্রয়োগ করতে পেরেছেন। লেখক-কেন্দ্রিক এই তত্ত্বে সমাজ বড় নয়, ব্যক্তি বড়; মানুষ বড় নয়, মন বড়। সাইকোঅ্যানালিটিকাল সমালোচনাতত্ত্ব অনুযায়ী একজন সমালোচকের কর্ম ও ভাবনা কী কী তার একটি ছোট তালিকা প্রদান করা যেতে পারে।

ক) এই তত্ত্ব অনুযায়ী একজন সমালোচক চরিত্রদের কর্মকাণ্ডগুলোকে দুইভাগে ভাগ করে দেখানোর চেষ্টা করেন কোনগুলো অচেতন মন দ্বারা নিয়ন্ত্রিত এবং কোনগুলো সচেতন মন দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। এরপরে আরো দেখাতে চেষ্টা করেন কীভাবে পুরো কর্মকাণ্ডজুড়ে অচেতন মনের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে। দেখাতে চেষ্টা করেন কীভাবে সাহিত্যকর্মটির মূল বক্তব্য মনের ঐ অচেতন অংশের তথা অবদমিত ইদের কর্মকাণ্ডের সাথেই মূলত সম্পৃক্ত।

খ) সমালোচক সাহিত্যকর্মটির সারা টেক্সট আতিপাতি করে খুঁজে খুঁজে দেখান এর অভ্যন্তরস্থ সাইকোঅ্যানালিটিক লক্ষ্মণাদি যেমন : ইডিপাস কমপ্লেক্স, ফাদার অথবা মাদার ফিক্সেশনের চিত্র, ফ্যালিক ও জেনিটাল স্টেজের যৌনতা বিকাশের চিত্র, অবদমনের চিত্র, অবদমন থেকে উদ্ভূত নিউরোসিস, ফ্যান্টাসি বা সাবলিমেশনের চিত্র, প্যারাপ্রাক্সিসের উদাহরণ ইত্যাদি।

গ) শুধু একটি বিশেষ সাহিত্যকর্ম নয়, বরং পুরো সাহিত্যের ইতিহাস ব্যাখ্যায়ও তাঁরা এ তত্ত্বের প্রয়োগ ঘটান, হ্যারল্ড ব্লুম যেমন তাঁর বিখ্যাত ‘অ্যাংজাইটি অব ইনফ্লুয়েন্স’ বিষয়ক ভাবনায় প্রয়োগ ঘটিয়েছেন ইডিপাস কমপ্লেক্সসংক্রান্ত ধারণা। তিনি দেখিয়েছেন কীভাবে উত্তরসূরী লেখকরা পূর্বসূরী মহারথী লেখকদের বিষয়ে আতঙ্কিত থাকেন যেমন ইডিপাস কমপ্লেক্সে শিশু আতঙ্কে থাকে তার বাবাকে নিয়ে।

ঘ) সাহিত্যকর্মের বিশ্লেষণে মার্কসবাদকে পাশ কাটানোর প্রয়োজনেই হয়তো তাঁরা মনোরাজ্যের সংকটকে সকল সংকটের উৎপত্তিস্থল হিসেবে উপস্থাপন করেন এবং সামাজিক ও ঐতিহাসিক সকল প্রসঙ্গকে মনোরাজ্যের সংকটের মাঝে লীন করে দেন। ফলে সাইকোঅ্যানালিটিক ক্রিটিকদের কাছে ব্যক্তিমানসের চেয়ে বড় কোনো প্রসঙ্গ মানবজীবনে নেই। চলবে

/জেডএস/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
প্রতিবন্ধী শিল্পীদের আয়োজনে মঞ্চস্থ হলো ‘সার্কাস সার্কাস’ নাটক
প্রতিবন্ধী শিল্পীদের আয়োজনে মঞ্চস্থ হলো ‘সার্কাস সার্কাস’ নাটক
‘শো মাস্ট গো অন’
চিকিৎসা সুরক্ষা আইন জরুরি‘শো মাস্ট গো অন’
ছাদে আম পাড়তে গিয়ে নিচে পড়ে শিশুর মৃত্যু
ছাদে আম পাড়তে গিয়ে নিচে পড়ে শিশুর মৃত্যু
বেয়ারস্টো-শশাঙ্কে হেসেখেলে ২৬২ রান করে জিতলো পাঞ্জাব
বেয়ারস্টো-শশাঙ্কে হেসেখেলে ২৬২ রান করে জিতলো পাঞ্জাব
সর্বাধিক পঠিত
সরকারি না হলেও সলিমুল্লাহ কলেজে অধ্যাপক ১৪ জন
সরকারি না হলেও সলিমুল্লাহ কলেজে অধ্যাপক ১৪ জন
মৌসুমের সব রেকর্ড ভেঙে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা চুয়াডাঙ্গায়
মৌসুমের সব রেকর্ড ভেঙে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা চুয়াডাঙ্গায়
এগিয়েছে ‘ওমর’, চমকে দিলো ‘লিপস্টিক’!
ঈদের ছবিএগিয়েছে ‘ওমর’, চমকে দিলো ‘লিপস্টিক’!
পুলিশের সব স্থাপনায় নিরাপত্তা জোরদারের নির্দেশ
পুলিশের সব স্থাপনায় নিরাপত্তা জোরদারের নির্দেশ
হোটেল রুম থেকে এই ৫ জিনিস নিয়ে আসতে পারেন ব্যাগে ভরে!
হোটেল রুম থেকে এই ৫ জিনিস নিয়ে আসতে পারেন ব্যাগে ভরে!