বাংলাদেশের সর্ব উত্তরের জেলা পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়া উপজেলা থেকে প্রতিবছরের মতো পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে পৃথিবীর তৃতীয় উচ্চতম পর্বতশৃঙ্গ কাঞ্চনজঙ্ঘার চোখধাঁধানো অপূর্ব সৌন্দর্য। ফলে স্থানীয়দের পাশাপাশি আশেপাশের জেলা ও দূর-দূরান্ত থেকে পর্যটকরা দলে দলে ভিড় করছেন এখানে। কোভিড-১৯ প্রাদুর্ভাবের মধ্যেই তাদের সংখ্যা বেড়ে চলছে।
গত কয়েক বছর ভোর থেকে সকাল ১০টা এবং বিকাল থেকে সন্ধ্যার আগমুহুর্ত পর্যন্ত তেঁতুলিয়ায় খালি চোখে দৃশ্যমান হয়েছিল কাঞ্চনজঙ্ঘা। এবার সাম্প্রতিক বৃষ্টির সুবাদে আকাশ মেঘমুক্ত থাকায় এবং বাতাসে ধূলিকণার পরিমাণ কম বলে ব্যতিক্রম চিত্র।
প্রতিদিন ভোর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত টানা দেখা যাচ্ছে কাঞ্চনজঙ্ঘা। সাধারণত তেঁতুলিয়া থেকে চোখে পড়লেও এবার পঞ্চগড়সহ পার্শ্ববর্তী ঠাকুরগাঁও ও দিনাজপুর জেলার কিছু জায়গা থেকে এর সুউচ্চ চূড়া দৃশ্যমান হচ্ছে।
সূর্যোদয়ের পর ভোরের আকাশের নিচে কাঞ্চনজঙ্ঘার চূড়া প্রথমে কালচে-লাল দেখায়। সময় গড়ানোর সঙ্গে রোদের ঝিকিমিকিতে নৈসর্গিক রূপ বদলাতে থাকে। সোনালি ও রুপালি বিচ্ছুরণের দৃশ্যমান হয় মনভোলানো শুভ্র বরফে আচ্ছাদিত পর্বতমালা। বিকালে কোমল সূর্যকিরণে চূড়াটি অনিন্দ্য সুন্দর হয়ে ধরা দেয়।
পঞ্চগড়ের আলোকচিত্রী আব্দুল্লাহ আল মারুফ মনে করেন, করোনাভাইরাস মহামারিতে আরোপিত লকডাউনের কারণে এমন হতে পারে।
তেঁতুলিয়া আবহাওয়া পর্যবেক্ষণ কেন্দ্রের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. জাহাঙ্গীর হোসেন বাংলা ট্রিবিউনকে জানান, আবহাওয়া অনুকূল থাকলে মেঘমুক্ত আকাশে ডিসেম্বর পর্যন্ত কাঞ্চনজঙ্ঘা স্পষ্ট দেখা যায়। লকডাউনের কারণে বাতাসে ধূলিকণার পরিমাণ কমে যাওয়ায় এবং আকাশে মেঘ না থাকায় পঞ্চগড়সহ আশপাশের জেলা থেকে অন্যান্য বছরের তুলনায় এবার দীর্ঘক্ষণ দৃশ্যমান হচ্ছে কাঞ্চনজঙ্ঘা।
নয়নাভিরাম হিমালয় পর্বত ও কাঞ্চনজঙ্ঘার মায়াবী হাতছানি চোখ জুড়ানো। তেঁতুলিয়া থেকে প্রায় দেড়শ কিলোমিটার দূরে হলেও হাত বাড়ালেই যেন শ্বেত-শুভ্র হিমালয়! গত ২৯ অক্টোবর থেকে এখানে দৃশ্যমান হয়েছে হিমালয় পর্বতমালার পর্বতশৃঙ্গটি।
বাংলাদেশ ও ভারত সীমান্তের বুক চিরে বয়ে যাওয়া মহানন্দা নদীর পাড় থেকে এই প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করতে ভিড় করছেন ভ্রমণপিপাসুরা। ভোরের আলো ফোটার আগে অনেকে তেঁতুলিয়া ডাকবাংলোর আশপাশের এলাকায় জড়ো হচ্ছেন। অপরূপ পর্বতশৃঙ্গের পাশাপাশি চারপাশে সবুজের সমারোহ দেখে মুগ্ধ তারা।
পঞ্চগড় সরকারি মহিলা কলেজের শিক্ষার্থী হালিমা আক্তার সম্পা বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘ভোরের আকাশে বরফে ঢাকা কাঞ্চনজঙ্ঘার সৌন্দর্য মনোমুগ্ধকর। তেঁতুলিয়ায় না এলে এটা বোঝা যাবে না।’
প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের টানে ঠাকুরগাঁও থেকে আসা আরেক শিক্ষার্থী মুশফিরা রহমান উল্লেখ করেছেন, ‘তেঁতুলিয়া থেকে কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখতে দারুণ লাগে। অন্য কোথাও থেকে এত পরিষ্কার দেখা যায় না এটি। এবার এর সৌন্দর্য আরও বেশি মনোরম মনে হচ্ছে।’
বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী জাকারিয়া রহমান এর আগে চারবার তেঁতুলিয়ায় এলেও পর্বতের দেখা পাননি। তবে পঞ্চম যাত্রায় তার সাধ পূরণ হয়েছে। রংপুরের এই তরুণ ভালো লাগার কথা অল্প কথায় জানিয়েছেন, ‘মায়াবী কাঞ্চনজঙ্ঘা অপরূপ।’
সুদূর সিলেট থেকে রংপুরে বেড়াতে এসে সজল দাশ শুভ জানতে পারেন– তেঁতুলিয়া থেকে কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখা যায়। দেরি না করে চলে এসে কাঞ্চনজঙ্ঘার মনোমুগ্ধকর দৃশ্য দেখেছেন। বাংলাদেশের এই এলাকা থেকে পর্বতশৃঙ্গটি দেখতে পেয়ে নিজেকে সৌভাগ্যবান মনে করেন তিনি।
দিনাজপুর থেকে সপরিবারে এসেছেন অতিরিক্ত জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডা. আশিকা আকবর তৃষা। সূর্যোদয়ের সময় বাংলাবান্ধা জিরো পয়েন্ট থেকে কাঞ্চনজঙ্ঘার অপরূপ দৃশ্য উপভোগ করেছেন তিনি। পরে একাধিক স্পটে দাঁড়িয়ে পর্বতশৃঙ্গটির ভিন্ন রূপ দেখেছেন। তার চোখে, ‘এ দৃশ্য অসাধারণ তুলনাহীন। এখানকার প্রকৃতি ও মানুষের আতিথেয়তার জন্যই কাঞ্চনজঙ্ঘা এত সুন্দরভাবে আমাদের কাছে ধরা দিয়েছে।’
সারাবিশ্বের পর্যটকদের অন্যতম আকর্ষণ কাঞ্চনজঙ্ঘা সিকিম রাজ্যের সঙ্গে নেপালের পূর্বাঞ্চলীয় সীমান্তে অবস্থিত। এর উচ্চতা ৮ হাজার ৫৮৬ মিটার বা ২৮ হাজার ১৬৯ ফুট।
ঢাকার আরেক দম্পতি আরিফুল হক সরকার ও ফাতেমা জামান সীমা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে বিভিন্ন ট্রাভেলারস গ্রুপের মাধ্যমে তেঁতুলিয়া থেকে কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখা যাওয়ার খবর জেনেছেন। তারা বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘কাঞ্চনজঙ্ঘা সরাসরি দেখার উদ্দেশে তেঁতুলিয়ায় আসা। সকাল-বিকাল কাঞ্চনজঙ্ঘার দুর্লভ দৃশ্য দেখেছি। এর সৌন্দর্য বলে বোঝানো যাবে না। আমাদের মনের ইচ্ছেটা পূরণ হয়েছে।’
ঢাকা থেকে সস্ত্রীক এসেছেন মো. শোয়েব। মহানন্দা নদীর পাড় থেকে কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখার সাধ ছিল তার। তিনি বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘খুব কাছ থেকে সূর্যোদয় ও সূর্যাস্ত দেখলাম। এ অনুভূতি সত্যিই অসাধারণ। এখানকার রাস্তাঘাট, প্রকৃতি ও আবহাওয়া সবই অনেক সুন্দর। তবে থাকা-খাওয়ার ভালো ব্যবস্থা থাকলে আরও ভালো লাগতো।’
একই মন্তব্য করেছেন ঢাকা থেকে বন্ধুদের সঙ্গে কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখতে আসা সানজিদ। তিনি বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘সকালের অপরূপ কাঞ্চনজঙ্ঘা সত্যিই অসাধারণ। এখানকার সবকিছুই ভালো। তবে ভালো মানের আবাসিক হোটেল নেই। পরিবার নিয়ে এসে এখানে থাকার সুযোগ নেই।’
প্রাকৃতিক সৌন্দর্যমণ্ডিত তেঁতুলিয়ায় আবাসন ও ভালো মানের খাবার হোটেলের অভাবে ভোগান্তিতে পড়েন এমন অনেক পর্যটক। জেলা পরিষদের দুটি ডাকবাংলো, বেরং কমপ্লেক্সসহ সরকারি-বেসরকারি দুয়েকটি আবাসিক হোটেলে স্বল্পসংখ্যক পর্যটকের থাকার ব্যবস্থা আছে।
আলোকচিত্রী ফিরোজ আল সাবাহ মনে করেন, কাঞ্চনজঙ্ঘার টানে তেঁতুলিয়ায় পর্যটকদের রাতযাপনের ইচ্ছা থাকলেও অধিকাংশই সেই সুযোগ পান না। আবাসন সংকট ও ভালো মানের খাবার হোটেলের অভাবে অনেককেই ফিরে যেতে হয় জেলা শহর পঞ্চগড়ে। তার মন্তব্য, ‘পর্যটন মোটেলসহ আবাসন সুবিধা নিশ্চিত করা গেলে এখানে ভ্রমণপিপাসুর সংখ্যা বাড়বে। পর্যটক বাড়লে সরকার যেমন রাজস্ব পাবে, তেমনই সৃষ্টি হবে নতুন কর্মসংস্থান।’
আবাসন সংকটের কথা স্বীকার করেছেন তেঁতুলিয়া উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) মো. মাসুদুল হক। তিনি বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘তেঁতুলিয়ায় সরকারি ১৪টি কক্ষ রয়েছে। এছাড়া বেসরকারি দুয়েকটি হোটেল আছে। যদিও বর্তমান চাহিদার তুলনায় তা অপ্রতুল। তাই পর্যটন করপোরেশনের উদ্যোগে এখানে বহুতল ভবন নির্মাণের প্রস্তাবনা দেওয়া হয়েছে। এর কাজ শুরু হলে আশা করি, তেঁতুলিয়ায় রাতযাপন নিয়ে পর্যটকদের আর সমস্যায় পড়তে হবে না।’
ডিসি’র আশ্বাস, ‘পঞ্চগড়কে পর্যটনবান্ধব হিসেবে গড়ে তুলতে সরকারের বিভিন্ন দফতরে আমরা যোগাযোগ অব্যাহত রেখেছি। পর্যটকদের আবাসন সুবিধার বিষয়টি নিয়ে আমরা যথেষ্ট সচেতন।’
সাবিনা ইয়াসমিন মানছেন, জেলা পরিষদের দুটি ডাকবাংলো ও তেঁতুলিয়া পিকনিক কর্নারে স্থান সংকুলান হয় না। তিনি বলেন, ‘প্রায়ই এখানে ভিআইপি অতিথিরা আসেন। এজন্য পিকনিক কর্নারের পাশে জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে আধুনিক সুযোগ-সুবিধাসহ বেরং কমপ্লেক্স নামে আরেকটি ডাকবাংলো গড়ে তোলা হয়েছে। অনেকে ব্যক্তিগত উদ্যোগে এখানে আবাসন ব্যবস্থা গড়ে তুলেছেন। সব মিলিয়ে পরিবেশটা বরাবরের মতো ভ্রমণ উপযোগী। এখানে যে কেউ এসে মানসিক তৃপ্তি নিয়ে ঘুরে যেতে পারেন।’
একই সুরে ট্যুরিস্ট পুলিশ পঞ্চগড় জোনের ইনচার্জ আমিনুল ইসলামের মন্তব্য, তেঁতুলিয়া শান্তিপূর্ণ উপজেলা। তবুও পর্যটকরা যেন নির্বিঘ্নে বেড়াতে পারেন সেজন্য ট্যুরিস্ট পুলিশ কাজ করছে বলে বাংলা ট্রিবিউনকে জানান তিনি। গত জুলাইয়ে তেঁতুলিয়ায় ট্যুরিস্ট পুলিশের কার্যক্রম চালু হয়েছে। তার কথায়, ‘পর্যাপ্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থা ও আন্তরিক পরিবেশ থাকায় এলাকাটিতে পর্যটনের ব্যাপক সম্ভাবনা রয়েছে।’
অপূর্ব সবুজ নিসর্গ পঞ্চগড়ে রয়েছে সমতল ভূমির চা বাগান। সীমান্ত নদী মহানন্দার পাড়ে বসে সূর্যাস্ত উপভোগের অনুভূতি অন্যরকম। মোগল আমলের স্থাপত্য মির্জাপুর শাহী মসজিদ, বারো আউলিয়ার মাজার, সনাতন ধর্মাবলম্বীদের তীর্থস্থান বদেশ্বরী মন্দির (সীতার ৫১ পীঠের ১ পীঠ), দেশের একমাত্র পাথরের জাদুঘর রকস মিউজিয়াম, জেমকন গ্রুপের কাজী অ্যান্ড কাজী টি এস্টেটের আনন্দধারা, শিশুপার্ক, দেশের অন্যতম বৃহৎ প্রত্নতত্ত্ব নিদর্শন ভিতরগড় দুর্গনগরী, দেড় হাজার বছরের পুরনো সুবিশাল মহারাজার দীঘি চোখ জুড়ানো। এছাড়া দেখা যায় ভূগর্ভস্থ ও নদী থেকে পাথর উত্তোলন।
যেভাবে আসবেন
ঢাকা থেকে পঞ্চগড় কিংবা তেঁতুলিয়া অথবা বাংলাবান্ধায় সরাসরি দূরপাল্লার কোচ (দিবারাত্রি) যাতায়াত করে। ঢাকা থেকে হানিফ এন্টারপ্রাইজ, নাবিল পরিবহন, এনা পরিবহন ও শ্যামলীর এসি/নন-এসি বাস রয়েছে। এসব যানবাহনে চড়ে তেঁতুলিয়ায় চলে আসা যায়।
রেলপথে ঢাকার কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশন থেকে পঞ্চগড় এক্সপ্রেস, একতা বা দ্রুতযান এক্সপ্রেসে চলে আসতে পারেন পঞ্চগড়। রাজশাহী থেকে বাংলাবান্ধা এক্সপ্রেসে করে আসা যায়। বিকল্প হিসেবে ঢাকা থেকে আকাশপথে সৈয়দপুর পর্যন্ত আসা যায়। এরপর বাস, মাইক্রোবাস বা প্রাইভেট কারে যাওয়া যাবে তেঁতুলিয়ার বাংলাবান্ধা।
অ্যাপল ট্যুরিজমের মাহাবুবুল আলম মন্টু বাংলা ট্রিবিউনকে জানান, মাগুরমারী চৌরাস্তা থেকে তেঁতুলিয়া বা বাংলাবান্ধা পর্যন্ত গিয়ে পর্যটকরা কাঞ্চনজঙ্ঘার অপরূপ দৃশ্য উপভোগ করেন। বাংলাবান্ধা ইউনিয়ন থেকে কাঞ্চনজঙ্ঘার দূরত্ব মাত্র ১১ কিলোমিটার।
যেখানে থাকতে পারেন
তেঁতুলিয়ায় সরকারি তিনটি ডাকবাংলোর পাশাপাশি আবাসিক হোটেল আছে। ডাকবাংলোয় থাকতে হলে আগেভাগে উপজেলা বা জেলা প্রশাসনের অনুমতি নিতে হবে। তিনটি ডাকবাংলোর ৯টি বেডে সর্বোচ্চ ১৮ জন থাকতে পারেন। এখানে ডাকবাংলো বা হোটেল ফাঁকা না পেলে পঞ্চগড়ে যেতে হবে। ডাকবাংলো থেকে দেখা যায় দার্জিলিং, শিলিগুড়ি, হিমালয়, এভারেস্ট ও কাঞ্চনজঙ্ঘার অপরূপ দৃশ্য।
আরও পড়ুন-
তেঁতুলিয়ায় দেখা যাচ্ছে বিশ্বের তৃতীয় সর্বোচ্চ পর্বত কাঞ্চনজঙ্ঘা
‘পঞ্চগড়’ নামটি এসেছে যেভাবে