পেঁয়াজে কারসাজি: নেপথ্য সিন্ডিকেটের সন্ধানে গোয়েন্দারা

পেঁয়াজপেঁয়াজের বাজারে অস্থিরতা বিরাজ করছে। ভারত রফতানি বন্ধ করায় অস্বাভাবিক বেড়েছে এই নিত্যপণ্যের দাম। অতিরিক্ত উৎপাদন হওয়ার পরও ঘূর্ণিঝড় বুলবুলের প্রভাবের অজুহাতে বেড়েছে সব ধরনের চালের দামও। এর সঙ্গে তাল মিলিয়ে বেড়েছে তেল ও চিনির দাম। এ পরিস্থিতিতে বাজারে অস্থিরতা সৃষ্টিকারীদের খুঁজে বের করতে মাঠে নেমেছেন কয়েকটি গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যরা। সরকারের ওপর মহলের নির্দেশে গত শুক্রবার (১৫ নভেম্বর) রাত থেকে তারা মাঠে নেমেছেন বলে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একটি সূত্র জানিয়েছে।

নিত্যপণ্যের বাজারের সাম্প্রতিক অস্থিরতা নিয়ে আলোচনা হয়েছে সংসদে। সরকারের ওপর মহলও এ নিয়ে যথেষ্ট সজাগ রয়েছে। পরিস্থিতি সামাল দিতে পেঁয়াজ আমদানি উৎসাহিত করতে এলসি মার্জিনসহ ঋণের সুদহার কমানো এবং টিসিবির মাধ্যমে খোলাবাজারে পেঁয়াজ বিক্রির উদ্যোগও কোনও কাজে আসেনি। উল্টো বেড়েই চলেছে পেঁয়াজের দাম।

অথচ ব্যবসায়ীরা বলছেন, দেশে নাকি কোনও নিত্যপণ্যের দামই বাড়েনি।

সূত্র জানায়, শুরুতে পেঁয়াজ কারসাজির সঙ্গে জড়িতদের খুঁজে বের করা হবে। সাম্প্রতিক সময়ে কারা, কত দামে, কোন দেশ থেকে, কী পরিমাণ পেঁয়াজ আমদানি করেছে, তা খতিয়ে দেখা হবে। আমদানি করা পেঁয়াজ কী দরে বিক্রি করা হয়েছে, সে খবরও নেবেন গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যরা। আমদানি মূল্য ও বিক্রয় মূল্যের মধ্যে সামঞ্জস্য না থাকলেই ব্যবস্থা নেবেন তারা। একই সঙ্গে দেশি পেঁয়াজ কেনাবেচার বিষয়েও খোঁজখবর নেওয়া হবে। দেশি পেঁয়াজের উৎপাদন খরচ, পরিবহন ব্যয় ও সংরক্ষণের কারণে পচে যাওয়ার লোকসান বাদ দিয়ে মুনাফা যুক্ত করে কে কত দামে বিক্রি করেছেন, কেউ মজুত করেছেন কিনা, তাও খতিয়ে দেখা হবে। দামবৃদ্ধির পেছনে কোনও মহলের কারসাজি, সিন্ডিকেট বা ষড়যন্ত্র আছে কিনা, গোয়েন্দারা তা খোঁজ নিয়ে দেখবেন।

সূত্রমতে, কার্গো বিমানে করে পেঁয়াজ দেশে আনা হচ্ছে। এ অবস্থায় শিগগিরই পরিস্থিতির উন্নতির আশা করছেন সরকারের নীতিনির্ধারকরা। তাই সরকারের পক্ষ থেকে নানা সুবিধা দেওয়া ও অতিরিক্ত মুনাফা না করার অনুরোধ উপেক্ষা করে যারা এই অস্থিরতার জন্য দায়ী, তাদের বিরুদ্ধে কঠোর মনোভাব পোষণ করছেন সংশ্লিষ্টরা।  

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন অতিরিক্ত সচিব নাম প্রকাশ না করার শর্তে বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘বাজারে নিত্যপণ্যের মূল্য পরিস্থিতি নিয়ে কেউ অস্থিরতা সৃষ্টি করছে কিনা, এখানে কারও ষড়যন্ত্র আছে কিনা, তা অনুসন্ধান করা হচ্ছে। এর জন্য মন্ত্রণালয়ের একটি টিম কাজ করছে।’ তিনি জানান, সরকারের ওপর মহলের নির্দেশেই টিমটি কাজ করছে। এর সঙ্গে যুক্ত রয়েছে দেশের চারটি গোয়েন্দা সংস্থার শীর্ষ কর্মকর্তারা।

সরকারের এই কর্মকর্তা আরও বলেন, সম্প্রতি পেঁয়াজকে কেন্দ্র করে নিত্যপণ্যের বাজারে সৃষ্টি হওয়া অস্থিরতাকে ভালোভাবে দেখছে না সরকারের নীতিনির্ধারকরা। এ ঘটনায় সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হয়েছে বলেও মনে করেন তারা। 

জানতে চাইলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেন, ‘এটি নতুন কোনও ঘটনা নয়। যেকোনও প্রয়োজনেই মাঠে নামতে পারে গোয়েন্দারা। বাজার মনিটরিংয়ে সারাবছরই গোয়েন্দারা মাঠে কাজ করে। যেহেতু প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, পেঁয়াজ নিয়ে কারও কোনও ষড়যন্ত্র আছে কিনা তা খতিয়ে দেখতে।’ এ কাজটি গোয়েন্দাদেরই কাজ বলে মন্তব্য করেন তিনি। 

বাণিজ্য মন্ত্রণালয় বলছে, কেউ পেঁয়াজের অবৈধ মজুত করলে, কারসাজি করে অতিরিক্ত মুনাফা অর্জনের চেষ্টা করলে বা অন্য কোনও উপায়ে সংকট সৃষ্টির চেষ্টা করলে, তাদের বিরুদ্ধে আইন অনুযায়ী কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে। বাজার মনিটরিংয়ে তাদের ৩১টি টিম কাজ করছে। জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতর বাজার অভিযান জোরদার করেছে। এছাড়া দেশের বিভিন্ন স্থানে উৎপাদিত দেশীয় পেঁয়াজ বাজারে আসতে শুরু করেছে বলেও জানায় মন্ত্রণালয়।

এদিকে ঘূর্ণিঝড় বুলবুলের প্রভাবে দুই থেকে তিন দিন সারাদেশে গুঁড়ি গুঁড়ি থেকে ভারী বৃষ্টিপাত হয়েছে। এই বৃষ্টির অজুহাতে সরবরাহ কম দেখিয়ে সব ধরনের চালের দাম বেড়েছে কেজিতে ৫ থেকে ৬ টাকা। এই সুযোগে বেড়েছে খোলা ও বোতলজাত সয়াবিন ও চিনির দামও। অথচ এসব পণ্যের দাম কোম্পানি বাড়ায়নি। গায়ে লেখা দামের অতিরিক্ত ১০ থেকে ১৫ টাকা বাড়িয়ে বিক্রি করা হচ্ছে পাঁচ লিটারের সয়াবিনের বোতল। চিনিতে দাম বেড়েছে কেজিপ্রতি ৪ থেকে ৮ টাকা। মাছ, ডিম ও সবজির বাজারও চড়া।  

রাজধানীর একটি বেসরকারি ব্যাংক কর্মকর্তা আরিফ হোসেন বলেন, ‘কোনোভাবেই দেশে পেঁয়াজ বা চাল-ডালের ঘাটতি নেই। শুধু ভারতের রফতানিতে নিষেধাজ্ঞা জারির সুযোগ নিয়ে ইচ্ছেমতো পেঁয়াজের দাম বাড়িয়েছেন ব্যবসায়ীরা।’ তার মতে, দাম বাড়ানোর ক্ষেত্রে ব্যবসায়ীদের মনোভাব ছিল যে, কেউ একজন সাহস করে বাড়িয়ে বা ইচ্ছেমতো দাম বলতে পারলেই সেই দরটি বাজারে কার্যকর হয়ে গেছে।

আরিফ হোসেন বলেন, “ব্যবসায়ীদের বক্তব্য হচ্ছে ‘দাম যেটা বলেছি, নিলে নেন, না নিলে রাস্তা মাপেন।’ আর এভাবেই বেড়েছে পেঁয়াজের দাম।” কারও কাছে এর কোনও জবাব নেই বলেও আক্ষেপ করেন এই ক্রেতা।     

তবে পেঁয়াজ আমদানিকারক হাজী এম এ মাজেদ বলেন, ‘এমন অভিযোগ সঠিক নয়। আমদানি পরিস্থিতির ওপরই নির্ভর করছে দেশে পণ্যের দাম কত হবে।’ আর সিন্ডিকেট করার কোনও সুযোগ নেই বলেও দাবি করেন তিনি।

চালের মূল্যবৃদ্ধি প্রসঙ্গে বাংলাদেশ হাস্কিং রাইস মিলস ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক লায়েক আলী বলেন, ‘সরবরাহে ঘাটতির কারণে চালের দাম বাড়তে পারে। বৃষ্টিতে গাড়ি না চলার কারণে উত্তরবঙ্গ থেকে চালবাহী ট্রাক ছাড়েননি ব্যবসায়ীরা।’ তবে এই সংকট সাময়িক বলে মনে করেন তিনি। 

উল্লেখ্য, দাম কম ও সহজ পরিবহনের কারণে প্রতিবেশী দেশ ভারত থেকে বেশি পরিমাণ পেঁয়াজ আমদানি করা হয়। তবে এ বছর ভারতের মহারাষ্ট্রসহ অন্যান্য এলাকায় বন্যা হওয়ায় পেঁয়াজের ফলন ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এর ফলে গত ২৯ সেপ্টেম্বর থেকে রফতানিতে নিষেধাজ্ঞা জারি করে দেশটি।