আজ থেকে কার্যকর হচ্ছে নতুন অর্থবছরের বাজেট

আজ ১ জুলাই মঙ্গলবার থেকে কার্যকর হচ্ছে নতুন ২০২৫-২৬ অর্থবছরের জাতীয় বাজেট। উচ্চ মূল্যস্ফীতি, রাজস্ব আদায় বৃদ্ধি, বিপর্যস্ত আর্থিক খাত সংস্কার ও বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটের মতো চ্যালেঞ্জ বিবেচনায় নিয়ে গত ২২ জুন (রবিবার) এই বাজেট পাস করেছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। এর শিরোনাম দেওয়া হয়েছে, ‘বৈষম্যহীন ও টেকসই অর্থনৈতিক ব্যবস্থা গড়ার প্রত্যয়’। উপদেষ্টা পরিষদে অনুমোদনের পর রাষ্ট্রপতির অধ্যাদেশ আকারে জারি করা এই বাজেট আজ ১ জুলাই থেকে আগামী এক বছরের জন্য কার্যকর হবে। নতুন অর্থবছরে জিডিপির প্রবৃদ্ধি লক্ষ্যমাত্রা মাত্রা ৫ দশমিক ৫০ শতাংশ ধরা হয়েছে। মূল্যস্ফীতির লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৬ দশমিক ৫০ শতাংশ। অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।

২০২৫-২৬ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে অ্যাপার্টমেন্ট বা ভবনে বিনিয়োগের মাধ্যমে ‘অপ্রদর্শিত অর্থ’ বৈধ করার সুযোগ দেওয়া হয়েছিল। তবে বাজেট চূড়ান্ত অনুমোদনের সময় বিশেষ এই সুবিধা প্রত্যাহার করে করে নতুন অর্থবছরের বাজেটে পাস করেছে উপদেষ্টা পরিষদ। এর ফলে অপ্রদর্শিত অর্থ বৈধ করার জন্য বিশেষ সুবিধা আর থাকছে না জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) চেয়ারম্যান আবদুর রহমান খান। গত ২২ জুন সচিবালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে এ তথ্য জানান তিনি। এ সময় অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ উপস্থিত ছিলেন।

ওই সংবাদ সম্মেলনে এনবিআর চেয়ারম্যান বলেন, ‘প্রস্তাবিত বাজেটে বাড়তি কর দিয়ে কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দেওয়া হয়েছিল। তবে বিভিন্ন পক্ষের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে সেই বিধান বাতিল করা হয়েছে। ফলে কালো টাকা সাদা করার সুযোগ আর থাকছে না।’

তবে আয়কর আইন অনুসারে চাইলে যেকোনও করদাতা নিয়মিত করের সঙ্গে আরও বাড়তি ১০ শতাংশ কর দিয়ে অপ্রদর্শিত অর্থ বৈধ করতে পারবেন। এক্ষেত্রে আয়ের উৎস বৈধ হতে হবে।

এর আগে গত ২ জুন বাংলাদেশ টেলিভিশনে ভিডিওর মাধ্যমে ২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেট উপস্থাপন করেন অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ। নতুন বাজেটের আকার ধরা হয়েছে ৭ লাখ ৯০ হাজার কোটি টাকা। যা চলতি ২০২৪-২৬ অর্থবছরের মূল বাজেটের তুলনায় ৭ হাজার কোটি টাকা কম। এটি বর্তমান সরকারের দৃষ্টিতে ‘সংকোচনমূলক’ বাজেট।

একই সংবাদ সম্মেলনে অর্থ বিভাগের সচিব ড. মো. খায়েরুজ্জামান মজুমদার জানান, অপ্রয়োজনীয় ব্যয় কমিয়ে একটি সাশ্রয়ী ও বাস্তবায়নযোগ্য বাজেট প্রণয়ন করাটাই মূল্য লক্ষ্য ছিল। তিনি বলেন, ‘ইতিহাসে প্রথমবারের মতো আমরা আগের বছরের তুলনায় বাজেটের আকার কমিয়েছি। গত মে মাসে আমাদের মূল্যস্ফীতি ৯ শতাংশে ছিল। বর্তমান যে প্রবণতা দেখা যাচ্ছে তাতে চলতি জুন শেষে এটি ৮ শতাংশে নেমে আসতে পারে। আগামী বছর আমাদের মূল্যস্ফীতি যখন ৬ শতাংশে নেমে আসবে তখন আমরা আবার সম্প্রসারণমূলক বাজেটের দিকে যাবো।’

পরে গত ২২ জুন রাজধানীর তেজগাঁওয়ে প্রধান উপদেষ্টার দফতরে অনুষ্ঠিত উপদেষ্টা পরিষদের নিয়মিত বৈঠকে অনুমোদন করা হয়েছে ২০২৫-২৬ অর্থবছরের জাতীয় বাজেট। প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস এই বৈঠকে সভাপত্বি করেন। দেশে বর্তমানে জাতীয় সংসদ কার্যকর না থাকায় এই প্রক্রিয়ায় বাজেট কার্যকর করা হয়েছে।

অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্র জানিয়েছে, ২০২৫-২৬ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেট সুদ পরিশোধে ১ লাখ ১৩ হাজার ৫০০ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে। আগামী অর্থবছরে বেতন, ভাতা ও ভর্তুকির মতো খরচ চলতি অর্থবছরের মতোই অপরিবর্তিত রয়েছে নতুন বাজেটে। বাজেট ঘাটতি জিডিপির ৫ শতাংশের নিচে রাখা হয়েছে। অর্থ উপদেষ্টা তার বাজেট বক্তৃতায় বলেন, ঋণের সুদ পরিশোধে খরচ বেড়ে যাওয়ার পাশাপাশি রাজস্ব আদায় কম হওয়ায় বাজেটের আকার ছোট করতে বাধ্য হয়েছে সরকার।

বাজেটে সব পণ্যে ১৫ শতাংশ মূল্য সংযোজন কর (ভ্যাট) বসানোর সিদ্ধান্ত থাকছে। বর্তমানে অসমভাবে ভ্যাট বসানো রয়েছে। কর ছাড় কমিয়ে রাজস্ব বোর্ড নতুন কর ব্যবস্থা ও প্রশাসনিক উন্নতির মাধ্যমে অতিরিক্ত ৩০ হাজার কোটি টাকা রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে। নতুন অর্থবছরের জন্য প্রস্তাবিত বাজেটে অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে মোট প্রাপ্তি প্রাক্কলন করা হয়েছে ৫ লাখ ৬৪ হাজার কোটি টাকা। এটি জিডিপির ৯ শতাংশ। এর মধ্যে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) নিয়ন্ত্রিত রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা হচ্ছে ৪ লাখ ৯৯ হাজার কোটি টাকা। এটি চলতি অর্থবছরের মূল বাজেটের লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় ১৯ হাজার কোটি টাকা বেশি। এছাড়া এনবিআর-বহির্ভূত কর আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা হচ্ছে ১৯ হাজার কোটি টাকা এবং কর ব্যতীত প্রাপ্তির (এনটিআর) লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৪৬ হাজার কোটি টাকা। এর বাইরে বৈদেশিক অনুদানের প্রত্যাশা করা হয়েছে ৫ হাজার কোটি টাকা।

নতুন বছরের জন্য সরকারের নতুন বাজেটে ঘাটতি ধরা হয়েছে ২ লাখ ২৬ হাজার কোটি টাকা। এটি জিডিপির ৩ দশমিক ৬ শতাংশ। বাজেট ঘাটতি পূরণে আগামী বাজেটে অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে মোট ১ লাখ ২৫ হাজার কোটি টাকা এবং বৈদেশিক উৎস থেকে ১ লাখ ১ হাজার কোটি টাকা ঋণ নেওয়ার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের মূল বাজেটে ঘাটতির লক্ষ্যমাত্রা ছিল ২ লাখ ৫৬ হাজার কোটি টাকা। এটি ছিল জিডিপির ৪ দশমিক ৬ শতাংশ।

প্রস্তাবিত বাজেটে জিডিপি প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৫ দশমিক ৫ শতাংশ। এটি বলবৎ রয়েছে। চলতি অর্থবছরে যা ছিল ৬ দশমিক ৭৫ শতাংশ।  নতুন অর্থবছর শেষে মূল্যস্ফীতি সাড়ে ৬ শতাংশে নামিয়ে আনতে চায় সরকার। চলতি অর্থবছরেও একই লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছিল। 
জানা গেছে, সরকার সব পণ্যে ১৫ শতাংশ মূল্য সংযোজন কর (ভ্যাট) বসানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে। বর্তমানে অসমভাবে ভ্যাট বসানো রয়েছে। কর ছাড় কমিয়ে রাজস্ব বোর্ড নতুন কর ব্যবস্থা ও প্রশাসনিক উন্নতির মাধ্যমে অতিরিক্ত ৩০ হাজার কোটি টাকা রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে। আগামী অর্থবছরের জন্য রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে চার লাখ ৯৯ হাজার কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরের সংশোধিত লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় তা সাত দশমিক ছয় শতাংশ বেশি।

বাজেট বক্তৃতায় অর্থ উপদেষ্টা বলেছেন, বিদ্যমান উচ্চ মূল্যস্ফীতির পরিপ্রেক্ষিতে নীতিগতভাবে সরকার বিদ্যুতের মূল্য আপাতত না বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে। সরকারের এই সিদ্ধান্তকে সাধুবাদ জানিয়েছেন সাধারণ মহল। বর্তমানে বিদ্যুৎ খাতে ভর্তুকির পরিমাণ জিডিপির প্রায় ১ শতাংশ, যা অনেক বেশি। এটি ক্রমে কমাতে বিদ্যুৎ উৎপাদন খরচ ১০ শতাংশ কমানোর পরিকল্পনা হাতে নেওয়া হয়েছে। এটি করতে পারলে ১১ হাজার কোটি টাকা সাশ্রয় করা যাবে। বিদ্যুৎ ক্রয় চুক্তি পর্যালোচনা করা হচ্ছে বলেও জানিয়েছেন তিনি। 

নতুন বাজেট সম্পর্কে অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ জানিয়েছেন, মাত্র অল্প কয়েক মাসে কঠিন চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে দেশকে স্থিতিশীল করার কাজটি প্রায় সম্পন্ন করে আনা সম্ভব হলেও পরিপূর্ণ সাফল্যের দোরগোড়ায় পৌঁছাতে আমাদের এখনও অনেকটা পথ পেরোতে হবে। সাম্প্রতিক মাসগুলোতে মূল্যস্ফীতি হ্রাস পাওয়ার প্রবণতা দেখা গেলেও তা এখনও পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে আসেনি। গত এপ্রিল মাসে মার্কিন প্রশাসন কর্তৃক আরোপিত অতিরিক্ত শুল্কের নেতিবাচক প্রভাবও আমাদের অর্থনীতির ওপর পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। এছাড়া, সম্প্রতি যে বাজারভিত্তিক মুদ্রা বিনিময় হার চালু করা হয়েছে, তার কোনও নেতিবাচক প্রভাব আপাতত বাজারের ওপর পড়ার আশঙ্কা না থাকলেও, এ বিষয়ে আমাদের সতর্ক দৃষ্টি রাখতে হচ্ছে। এসব ঝুঁকি মোকাবিলা করে দেশের অর্থনীতির জন্য একটি বৈষম্যহীন ও টেকসই ভিত্তি নিশ্চিত করা এখন আমাদের সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার।  

‘আপাতত প্রবৃদ্ধির গতি বৃদ্ধির পরিবর্তে অর্থনীতির ভিত মজবুত করার দিকে আমরা অধিকতর মনোযোগ দিচ্ছি’, জানিয়েছে অর্থ উপদেষ্টা। তিনি বলেন, ‘শক্তিশালী ভিতই হবে আগামীর বাংলাদেশ বিনির্মাণের সোপান। আগামীর সেই বাংলাদেশে সবার জন্য মানসম্মত জীবন এবং সবস্তরে বৈষম্যহীন ব্যবস্থার নিশ্চয়তা প্রদান হবে আমাদের মূল লক্ষ্য। এ লক্ষ্য পূরণে আমি আপনাদের সবার সহযোগিতা চাই। ইনশাআল্লাহ্, আমাদের সবার সম্মিলিত প্রয়াসে বাংলাদেশ হবে বিশ্বের সব মুক্তিকামী মানুষের জন্য এক অনুকরণীয় আলোকবর্তিকা।’