'বন্দুকযুদ্ধ' ও জামিন

নাদীম কাদিরপুলিশের বিশেষ অভিযানের মধ্যে সন্ত্রাসী গোলাম ফাইজুল্লাহ ফাহিমের ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত হওয়ার খবরে নানারকম প্রশ্ন উঠেছে, তাতে আমার মনে পড়ে গেল- কিভাবে আদালত থেকে এ ধরনের অপরাধীদের জামিনের নির্দেশ দেওয়া হতো। বাংলাদেশ এখন একটা ক্যাচ-২২ পরিস্থিতিতে রয়েছে। একদিকে নির্দিষ্টভাবে লক্ষ্যবস্তু করে হত্যাকাণ্ড বন্ধ করতে বলা হচ্ছে, অন্যদিকে সুসঙ্গত অভিযানের বিরুদ্ধে আসছে চাপ।
শিক্ষার্থী থেকে জঙ্গি বোনে যাওয়া ১৮ বছর বয়সী ছেলেটিকে যখন মৃত অবস্থায় পাওয়া যায়, তার হাতে ছিল হাতকড়া। ফলে সে বন্দুকযুদ্ধে অংশ নিয়েছিল, এমন যুক্তি ধোপে টেকে না। পুলিশের দাবি, এক অভিযানের মধ্যে সে নিহত হয়েছে, সে সেখানে উপস্থিত ছিল। তার শরীরে দু’টি বুলেট বিঁধেছে, পরে সে প্রাণ হারিয়েছে।
এই গল্পের অন্য একটি দিক রয়েছে। তা হচ্ছে, ফাহিমকে গুলি করে মেরে ফেলা হয়েছে, কেননা পুলিশ ভেবেছে সে একজন বিপদজনক ব্যক্তি। সে যদি সহজে জামিন পেয়ে তার জঙ্গি সংগঠনে ফিরে যেতে পারে, তবে সে আরও ভয়ঙ্কর হয়ে উঠবে, তার চেয়ে সে মরে গেলেই ভালো।
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে, ফাহিমের সঙ্গী জঙ্গিরা কেউই তাকে উদ্ধার করতে এগিয়ে আসেনি, এমনকি তার মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করেনি।
এ থেকে স্পষ্ট বোঝা যায়, ধরা পড়ে গেলে বেঁচে থাকা আর মরে যাওয়া সমান। কারণ শুধু পুলিশ নয়, জনগণও ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানাচ্ছে।
ফাহিম মাদারীপুরে এক হিন্দু শিক্ষককে হত্যা করে পালানোর সময় ধরা পড়ে। সে এইচএসসির টেস্ট চলাকালীন সময়ে বাবা-মাকে বিদেশ যাওয়ার কথা বলে গৃহত্যাগ করে। তথাকথিত ইসলামিক স্টেটের দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে স্বপ্ন পূরণ করতে হিজবুত তাহরিরে যোগ দেয়।
আমাদের পাঠকরা কি জানেন, যুক্তরাষ্ট্র যারা কিনা মানবাধিকারে চ্যাম্পিয়ন, সেখানে প্রায় রোজ এরকম বন্দুকযুদ্ধ হয়ে থাকে।
শুধুমাত্র ২০১৫ সালেই এ ধরনের হত্যাকাণ্ডের সংখ্যা ১ হাজার, যার মধ্যে অধিকাংশই কৃষ্ণাঙ্গ আমেরিকান। 
এবার যদি গ্রেফতার ও জামিনের পরিসংখ্যানের দিকে চোখ ফেরানো যায়, দেখা যাবে বছর জুড়ে প্রচুর জঙ্গি ধরা পড়েছে, কিন্তু জামিন পাওয়ার পর তারা হারিয়ে গেছে। সন্ত্রাসী সংগঠনগুলোর যথেষ্ট টাকা আছে, তারা এই সন্ত্রাসীদের জন্য জামিনের ব্যবস্থা করে ফেলতে পারে।
জঙ্গিদের বিষয়ে আদালতের আরও কঠোর হওয়া উচিত এবং জঙ্গিসংশ্লিষ্ট আইন পরিবর্তন করে জামিন-অযোগ্য অপরাধ হিসেবে বিবেচনা করা উচিত।   

আমার এক বন্ধু যে কিনা ‘বন্দুকযুদ্ধ’ ও ‘ক্রসফায়ার’ এর অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে গিয়েছে। সে বলেছে, তার কোনও পরিতাপ নেই। তিনি বলেন, ‘যতবার আমি কোনও অপরাধীকে হত্যা করেছি, আমি অনুভব করেছি যে আমি দেশকে শত্রুমুক্ত করছি।’

‘আদালতে জামিনের বিষয়টি অত্যন্ত হতাশাজনক। অনেক চেষ্টা করে একজন অপরাধীকে গ্রেফতার করার পর বিষয়টি উদযাপনের আগেই সে জামিনে মুক্তি পেয়ে যায়। ফলে এ ধরনের হত্যাকাণ্ড আপাতদৃষ্টিতে অমানবিক মনে হলেও আমাদের কাছে কোনও বিকল্প নেই। পৃথিবীর অনেক দেশেই এমন ঘটে থাকে’- বেশ গৌরবের সঙ্গেই বললেন তিনি।  

পেছনের গল্প জেনে আমিও তার সঙ্গে সহমত পোষণ করেছি, যদিও আমি মনে করি প্রত্যেকের ন্যায়বিচার পাওয়ার অধিকার রয়েছে। কিন্তু আইন যদি এ ধরনের অপরাধীদের জামিন দেওয়ার পক্ষে থাকে তাহলে আদালতও অসহায় এবং ঘৃণ্য অপরাধীদের সঙ্গে এমনটা ঘটতেই থাকবে।  

অপরাধ বন্ধ করার দাবি তুলে সে জন্য পদক্ষেপ নেওয়া হলে তার বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়া মানায় না। হিউম্যান রাইটস ওয়াচের প্রকাশিত বিবৃতি ও সংসদের বাইরের বিরোধী দল বিএনপির অপরাধ দমন অভিযান বিষয়ক অবস্থান দেখে আমি স্তম্ভিত হয়েছি।

ফাহিমের গ্রেফতার থেকে আরও বোঝা যায়, সে প্রথমে জামায়াতের ছাত্র সংগঠন জামায়াত শিবিরে ছিল, পরে তাহরিরে চলে যায়। তার অভিভাবকও তার কর্মকাণ্ড সম্পর্কে অবগত ছিল না। ফলে সব অভিভাবকের তার সন্তানদের দিকে সতর্ক দৃষ্টি রাখা প্রয়োজন।

আমাদের এখন অপেক্ষা করা ছাড়া আর কিছু করার নেই। নিরাপত্তা বাহিনী অপরাধ বন্ধের চেষ্টা করছে ও ফাহিম সম্পর্কে তথ্যও বের করে এনেছে। অন্যদিকে আদালতেরও এই ধরনের অপরাধীদের জামিন দেওয়ার ক্ষেত্রে সতর্ক হওয়া প্রয়োজন। 

লেখক: সাংবাদিকতায় জাতিসংঘের ড্যাগ হ্যামারসোল্ড স্কলার এবং লন্ডনে বাংলাদেশ হাইকমিশনের প্রেস মিনিস্টার।

 

আরও পড়তে পারেন: গভীর রাতে বাবুল আক্তারকে নিয়ে গেছে পুলিশ

আরও পড়তে পারেন: ‘ডিজিটাল ক্রসফায়ার’!