রক্তবন্যা এবং রক্তাক্ত ঢাকা!

হারুন উর রশীদআমারা কখনও কখনও আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে রক্তবৃষ্টির খবর পাই। আর চীনে নাকি রক্ত নদীও আছে। তবে এবার ঢাকা দেখল রক্তবন্যা। রক্তবৃষ্টি আর রক্তনদী আসলে রক্তের না হলেও ঢাকার রক্তবন্যা আসলেই রক্তের, পশুর রক্তের। আর এটা আমাদের উপহার দিল সিটি করপোরেশন এবং ওয়াসা।
ঈদুল আজহার দিন সকাল থেকেই মুশলধারে বৃষ্টি। আর এই বৃষ্টির কারণে দেশের প্রধান ঈদের জামায়াত শোলাকিয়ায় লাখো নয়, মাত্র হাজার মুসল্লির উপস্থিত ছিলেন। জাতীয় ঈদগায়েরও একই অবস্থা। খোলা মাঠ বা ঈদগায়ের নামাজের এই অবস্থা হতে পারে সে কারণেই মুসল্লিদের  প্রস্তুতি ছিল। মসজিদগুলোতে প্রস্তুতি ছিল একাধিক ঈদের জামায়াতের। কিন্তু প্রস্তুতি ছিল না ঢাকা’র দুই সিটি করপোরেশনের।
আগেই আবহাওয়ার পূর্বাভাস ছিল যে ঈদের দিন ভারীবর্ষণ হতে পারে। তা হয়েছে এবং নগরীর অধিকাংশ এলাকার রাস্তা বৃষ্টির পানিতে ডুবে গেছে। বৃষ্টির পানিতে রাস্তা ডুবে যায়। সড়কে নৌকা চলে এতো পুরনো খবর। সংবাদমাধ্যমে রিপোর্ট হয়। নগরবাসী নানা সমালোচনা করেন নগর পিতাদের। বর্ষা চলে গেলে সবাই আবার তা ভুলে যান। বছর ঘুরে বর্ষা এলে আবারও একই চিত্র।
কিন্তু এবার তা ‘স্মরণীয়’ হয়ে থাকবে। এবারের ঘটনা মানুষের মনে থাকবে বহুদিন। কারণ এবার কোরবানির পশুর রক্তে একাকার হয়ে গেছে জমে থাকা বৃষ্টির পানি। দেখে মনে হয়েছে ঢাকার সড়কে যেন রক্তস্রোত বইছে। কেউ বলছেন রক্তনদী। আবার কেউবা বলেছেন ‘রক্তাক্ত’ ঢাকা অথবা ‘রক্তস্নাত’ ঢাকা। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পশুর রক্তে একাকার ঢাকার মূল সড়কে থেকে গলিপথের ছবিতে ভরে গেছে। আর তাতে নানা মন্তব্যের পাশাপাশি একটি মন্তব্য সাধারণ। আর তা হলো- সিটি করপোরেশন কী করছে।

বকশীবাজার, হোসেনী দালাল, যাত্রাবাড়ী, শান্তিনগর, শান্তিবাগ, মগবাজার, মধুবাগ, মালিবাগ, সিদ্ধেশ্বরী ও মিরপুর মোহাম্মদপুরসহ আরও অনেক এলকার রাস্তা ডুবে যায় রক্ত পানিতে। কোথাও হাঁটু সমান আর কোথাও কোমর সমান। আর এই পানি কোথাও কোথাও জলাবদ্ধতার সৃষ্টি করে। এই পানিতেই চলে যান্ত্রিক যানবাহন, রিকশা। উপায় না থাকায় কেউ কেউ এই রক্তমাখা পানিতেই হাঁটতে বাধ্য হন।

বৃষ্টি দেখে নগরবাসী ভেবেছেন হয়ত বৃষ্টির পানিতে রক্ত ভেসে যাবে। তাই রাস্তার ওপর, খোলা জায়গায় কোরবানির পশু জবাই করেছেন। পশুর রক্ত ভেসে গিয়েছে ঠিকই। কিন্তু তা মিলিত হয়েছে বৃষ্টির পানির স্রোতের সঙ্গে। একাকার হয়ে গেছে রক্ত আর বৃষ্টির পানি। ঢাকার অকার্যকর ড্রেনেজ সিস্টেমের কারণে বৃষ্টির পানি সহজে সরে না। ফলে সড়কে দাড়িয়ে থাকা বৃষ্টির পানির সঙ্গে পশুর রক্ত মিশে একাকার হয়ে সৃষ্টি হয় -‘রক্তাক্ত’ ঢাকা। দেখে মনে হয়েছে ঢাকার রাস্তায় রক্তের স্রোত বইছে। আর এই রক্তপানির জলাবদ্ধতা কমপক্ষে তিন ঘণ্টা স্থায়ী হয়। সড়ক, অলিগলি ছাড়াও কোথাও কোথাও ভবনের নিচতলা পর্যন্ত গিয়ে পৌঁছায় রক্তস্রোত।

এর সঙ্গে যুক্ত হয় বৃষ্টির পানিতে ভেসে ওঠা ময়লা আবর্জনা। আবার কেউ কেউ বৃষ্টিতে ভেসে যাবে ভেবে গরুর নাড়িভুড়ি পানির স্রোতেই ভাসিয়ে দিয়েছেন। পরিস্থিতি যে কতটা ভয়াবহ তা অনুমান করা যায়। কারণ, ড্রেনেজ সিস্টেম এমনিতেই কাজ করে না। তার ওপর এবার ড্রেনে জমেছে পশুর জমাট বাঁধা রক্তের সঙ্গে নাড়িভুড়ি ও পশুর বর্জ্য।

বৃষ্টির পর পশুর রক্তে লাল হয়ে যায় ঢাকার রাস্তা

ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন সর্বমোট ২৫০০ কিলোমিটার খোলা ড্রেন এবং ৪০০০ কিলোমিটার ভূগর্ভস্থ ড্রেনেজ সিস্টেম ব্যবস্থাপনা করে আসছে। গত চার বছরে ৩০৩ কোটি টাকারও বেশি খরচ করা হয়েছে ড্রেনেজ সিস্টেমের উন্নতিতে সাধনে। কিন্তু তার ফলাফল শূন্যই বলা চলে। যদি কোনও উন্নতি হতো, তাহলে বৃষ্টি আর পশুর রক্তে একাকার হয়ে রক্তাক্ত ঢাকা পরিণত হতো না।

বৃষ্টিপাত থেকে যে পানি জমা হয়, তা ‘রানঅফ ওয়াটার’ বলে পরিচিত। রাজধানীর এই পানি ‘স্টর্ম’ ড্রেন দিয়ে নিষ্কাশিত হওয়ার কথা। গতবছর থেকে ঢাকা ওয়াসা ‘স্টর্ম ওয়াটার ড্রেনেজ মাস্টার প্ল্যান’ বাস্তবায়ন করছে।

ঢাকা ওয়াসার একটা প্রধান দায়িত্ব হলো, পানি সরবরাহ এবং শহরের ৩৯% ড্রেনেজ সিস্টেমকে সচল রাখা, যেটা করার জন্য ৬৫ কিলোমিটার খোলাখাল এবং ও বক্সকালভার্ট আছে, এছাড়াও এদের আছে ড্রেনেজ পাম্পিং সিস্টেম। কিন্তু অসময়ে কিছুই কাজে আসে না।

আগেই যেহেতু আবহাওয়ার পূর্বাভাস ছিল। তাই সিটি করপোরেশনের দায়িত্ব ছিল নগরবাসীকে সতর্ক করা যে, বৃষ্টিকে আশীর্বাদ মনে না করে গর্ত করে পশু জবাই করা এবং পশুর রক্ত ও বর্জ্য মাটিচাপা দেওয়া বা ছড়াতে না দেওয়া। সিটি করপোরেশন তা করেনি। সিটি করপোরেশন এবারও পশু কোরবানির জন্য জায়গা নির্ধারণ করে দিলেও তা কাজে আসেনি। কারণ, জায়গা নির্ধারণ করে দিয়েই হাত-পা গুটিয়ে বসেছিলেন তারা।

আর আমার মনে হয়, পশু জবাইয়ের সময় টানা বৃষ্টি হলে কী পরিস্থিতির সৃষ্টি হতে পারে তার কোনও ধারণাও ছিলনা সিটি করপোরেশনের। আর ওয়াসার পাম্পগুলো বরাবরই দেখেছি হঠাৎ বৃষ্টির পানি নিষ্কাশন করতে পারে না বৃষ্টির সঙ্গে সমতা রেখে। ফলে, যা হওয়ার তাই হয়েছে।

পশুর রক্তমাখা এই বিপুল জলরাশি এখন ঢাকার লেকের পানিতে, পাশের নদীতে এবং পুরো ডেনেজ ব্যবস্থায় ছড়িয়ে পড়েছে। এর কী প্রতিক্রিয়া হতে পারে, তা সহজেই অনুমেয়।

ঢাকার চিকিৎসক এবং পরিবেশ বিজ্ঞানীরা বলছেন, এবার বৃষ্টির পানির সঙ্গে পশুর রক্ত মিশে যে পরিস্থিতির সৃষ্টি হলো, সেটা স্বাস্থ্য এবং পরিবেশের জন্য একটি মারাত্মক হুমকি। এখনই তাই প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা না নিলে বিশেষ করে শিশুরা নানা রোগে আক্রান্ত হতে পারে। আর রক্তে একাকার বৃষ্টির পানি ছাড়াবে জীবাণু।

শুরুতেই বলেছিলাম রক্তবৃষ্টির কথা। আর এই ব্লাড রেইন বা রক্তবৃষ্টি আসলে কোনও রক্তবৃষ্টি নয়। মরুভূমির লাল বালু যখন বৃষ্টি বহন করে তখন বৃষ্টির ফোঁটা লালচে রংয়ের হয়। আর তাকেই বলা হয় রক্তবৃষ্টি। গত বছরের এপ্রিলে ব্রিটেনের রক্তবৃষ্টির জন্য দায়ী করা হয়, সাহারা মরুভূমির লাল বালুর ঝড়কে। আর ২০০১ সালে কেরালার রক্ত বৃষ্টির কারণ হয় কোনও উল্কাখণ্ডের বিস্ফোরণ অথবা বৃষ্টির পানিতে এক ধরনের ছত্রাকের উপস্থিতি। আর পরিবেশ দূষণের কারণে চীনের ইয়াংজা নদীর পানি লাল হয়ে নদীটি এখন রক্তনদী হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে।

তবে আমরা চাইনা আগামী কোরবানির ঈদে এভাবে পশুর রক্ত বৃষ্টির পানির সঙ্গে একাকার হোক। চাই না ঢাকা পরিচিতি পাক ‘রক্তাক্ত’ ঢাকা হিসেবে। চাই না ঢাকার পানি, জনস্বাস্থ্য, ঢাকার পরিবেশ কারও  অবহেলার কারণে বিপর্যয়ের মুখে পড়ুক।

লেখক: সাংবাদিক

ইমেইল: swapansg@yahoo.com