স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজ সম্পর্কিত প্রতিষ্ঠানে চাকরি করার সুবাদে বোধহয় আমি একসময় ফিউচার স্টাডিজ বা ভবিষ্যৎ অধ্যয়ন নিয়ে পড়াশোনায় অনেক আগ্রহী ছিলাম। বাসার বুকশেলফ খুঁজলে এখনও অ্যালভিন টফলার এবং হেইডি টফলারের ‘ওয়ার অ্যান্ড অ্যান্টি ওয়ার’ বইটি বা বিজ্ঞানী মিচিও কাকুর দুই একটি জনপ্রিয় বই পাওয়া যেতে পারে। অতীত আমাকে নিঃসন্দেহে কৌতূহলী বা উদ্দীপ্ত করে, কিন্তু আমার মূল আগ্রহ ভবিষ্যৎকে ঘিরেই।
ফিউচার স্টাডিজ হলো একটি বিষয় যেখানে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি ব্যবহার করে সম্ভাব্য দৃশ্যপট, চ্যালেঞ্জ ও সুযোগগুলো বিশ্লেষণ করে পছন্দসই ভবিষ্যতের কৌশল নির্ধারণ করা হয়। ইউনেস্কো তো বেশ আগেই ফিউচার লিটারেসিকে একবিংশ শতাব্দীর নীতিনির্ধারকদের জন্য অতি প্রয়োজনীয় দক্ষতা বলেছে।
বাংলাদেশে অতীত বা ইতিহাস নিয়ে যত গবেষণা করা হয় সে হিসেবে ভবিষ্যতের বাংলাদেশ ততটুকু আলোচিত নয়। ইতিহাস অবশ্যই আমাদের প্রেরণা জোগাবে কিন্তু ভবিষ্যৎ বিনির্মাণে আমাদের যথাযথ প্রশিক্ষিত ও সচেতন নাগরিক সমাজ দরকার।
নীতিনির্ধারক, গবেষক ও উদ্যোক্তাদের এ বিষয়ে দক্ষতা প্রয়োজন। আর এখানেই নিহিত রয়েছে ফিউচার স্টাডিজের গুরুত্ব।
ভবিষ্যৎ নিয়ে যথাযথ ও পদ্ধতিগত আলোচনা না থাকলে একটি দেশ বিভিন্ন সমস্যায় পড়বে। রোহিঙ্গা সমস্যার ক্ষেত্রে আমরা তো একেবারেই ‘অফ গার্ড’ বা অপ্রস্তুত ছিলাম। ভূ-রাজনৈতিক এ ধরনের সমস্যার ক্ষেত্রে আমরা আগে থেকে কোনও কিছু অনুমান করতে পারিনি। কোভিডের ক্ষেত্রে যথাযথ পলিসির অভাব অনুভূত হয়েছে। শিক্ষা ব্যবস্থা এখনও মুখস্থনির্ভর- ভবিষ্যৎমুখী নয়- যেমন এআই, গ্রিন টেকনোলোজি বা ডাটা অ্যানালিটিক্সের বা মিডিয়া এবং ফিউচার লিটারেসির বিষয়গুলো খুব একটা শেখানো হয় না।
অবশ্য বাংলাদেশে একটি স্বতন্ত্র অ্যাকাডেমিক বিষয় ফিউচার স্টাডিজ না থাকলেও বিচ্ছিন্নভাবে বিভিন্ন বিষয়ের সাথে তা পড়ানো হয়। যেমন, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক, অর্থনীতি, ব্যবসায় প্রশাসন, পরিবেশ ইত্যাদি বিষয়ে করপোরেট ফোরসাইট, ফোরকাস্টিং বা স্ট্র্যাটেজিক ফোরসাইট টুল কিছুটা শেখানো হলেও একটি সমন্বিত বা হোলিস্টিক বিষয় হিসেবে ফিউচার স্টাডিজ আলোচিত হয় না। যার প্রতিফলন আমরা সরকারের বিভিন্ন নীতি ও পরিকল্পনার মধ্যে দেখতে পাই।
বিগত সরকারের সময় প্রণীত ভিশন ২০৪১ বা ডেল্টা প্ল্যান ২১০০ ভবিষ্যৎকে মাথায় রেখে প্রণীত হলেও ফিউচার স্টাডিজ এর টুলগুলো খুব একটা ব্যবহার করা হয়েছে বলে মনে হয় না। ভিশন ২০৪১-এর অন্তর্ভুক্ত স্মার্ট বাংলাদেশের ধারণা কিছুটা রৈখিক মনে হতে পারে যেখানে রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা, অটোমেশন, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, জলবায়ুর বিপর্যয় ইত্যাদির কারণে সম্ভাব্য পরিবর্তনশীল ভবিষ্যতের জন্য কোনও প্রস্তুতির কথা বলা হয়েছে বলে আমার জানা নেই।
আরও গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার ডিজিটাল বাংলাদেশ বা স্মার্ট বাংলাদেশের ধারণাগুলো খুব একটা জনসম্পৃক্ততা পায়নি। অথচ এ ধারণাগুলো কাজে লাগিয়ে শিক্ষা ব্যবস্থায় ব্যাপক সংস্কার থেকে শুরু করে দেশের রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে আদর্শগত দূরত্ব কমিয়ে আনার প্রচেষ্টা নেওয়া যেত। আর এভাবেই আমরা একটি আধুনিক ও জ্ঞানভিত্তিক সমাজের স্বপ্ন দেখতে পারতাম।
জ্ঞান-বিজ্ঞানে বাংলাদেশের অবস্থা তো আর বলার অপেক্ষা রাখে না। ইউএনডিপির গ্লোবাল নলেজ ইনডেক্স ২০২৪ অনুসারে ১৪১টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান হচ্ছে ১১৩। নলেজ ইনডেক্স স্কোর হচ্ছে ৩৭.৫, যেখানে দেশগুলোর গড় স্কোর হচ্ছে ৪৭.৮। এই ইনডেক্সে বিভিন্ন সেক্টরের অবস্থান দেখলে আরও হতাশাজনক চিত্র ফুটে ওঠে। হায়ার এডুকেশনে বা উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অবস্থান হচ্ছে ১৪১টি দেশের মধ্যে ১২৩তম! আর এক্ষেত্রে স্কোর হচ্ছে ৩৩.৩!
এ হচ্ছে আমাদের উচ্চশিক্ষার অবস্থা! উচ্চশিক্ষার একজন পর্যবেক্ষক হিসেবে বলতে পারি, সবকিছু যোগ্যতা যদি আমি বাদও দেই, এআই বা প্লাজারিজম ছাড়া রেফারেন্সসহ মাত্র দুই পৃষ্ঠার একটি ইংরেজিতে প্রবন্ধ বা essay লেখার যোগ্যতা দেশের মাস্টার্স পাস সব বিষয়ের শিক্ষার্থীদের মধ্যে খুব কম জনেরই আছে। আমাদের কারিকুলাম পুরনো। বিগত সরকারের সময় ওবিই পদ্ধতিতে কারিকুলাম প্রণীত হয়েছে এবং দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এখনও এই কারিকুলাম মেনে চলতে বাধ্য। অথচ অতি সম্প্রতি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার কারণে বিশ্বব্যাপী শিক্ষাক্ষেত্রে আমূল পরিবর্তন সূচিত হয়েছে।
আবার গ্লোবাল নলেজ ইনডেক্সে রিসার্চ, ডেভেলপমেন্ট এবং ইনোভেশনের ক্ষেত্রে আমাদের অবস্থান ১৪১টি দেশের মধ্যে ১২৪তম। প্রাপ্ত স্কোর হচ্ছে ২০.৩৯ মাত্র! এরকম হওয়াতো অত্যন্ত স্বাভাবিক। কারণ বাংলাদেশ ব্যুরো অব স্ট্যাটিস্টিকস-এর সর্বশেষ জরিপ অনুসারে রিসার্চ এবং ডেভেলপমেন্টের বাংলাদেশের ব্যয় প্রতিবছর জিডিপির মাত্র ০.৩০ শতাংশ। ফান্ডিং ছাড়া কীভাবে মানসম্মত রিসার্চ, ল্যাব বা ইনোভেশন ইকোসিস্টেম গড়ে উঠতে পারে। সেই সাথে একাডেমিয়া এবং ইন্ড্রাস্ট্রির সহযোগিতার কথা বারবার বলে হলেও বাস্তবিক ক্ষেত্রে দুটো আসলে বিচ্ছিন্ন দ্বীপের মতো।
ফলে দেশের হাজার হাজার STEM গ্রাজুয়েটরা প্রতিবছর দেশে ছাড়ছেন। মেধাবীদের অবশ্যই দেশে ফেরত এনে দেশের কাজে লাগাতে হবে। ভারত VAJRA (Visting Advanced Joint Research) ফ্যাকাল্টি স্কিমের অধীনে বিদেশে অবস্থানরত ভারতীয় বংশোদ্ভুত মেধাবী বিজ্ঞানীদের ও অধ্যাপকদের দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ও সরকারি থিংকট্যাংকে চাকরি প্রদানের মাধ্যমে দেশে ফেরত আনছে। একই ধরনের প্রোগ্রাম রয়েছে চীনে যা Thousands Talents Plan নামে পরিচিত। মূলত বিদেশে অবস্থিত মেধাবীদের দেশে নিয়ে এসে গবেষণা ও অধ্যাপনার কাজে ব্যবহারের জন্য।
দেশে যেভাবে সরকারি ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা বাড়ছে তাতে বিদেশ থেকে অবশ্যই মেধাবীদের দেশে এনে নিয়োগ দেওয়া ছাড়া উপায় নেই। আমাদের দেশের অনেক মেধাবী সন্তান বিদেশে বিশেষ খ্যাতি অর্জন করেছেন। তাদের অবশ্যই দেশের কাজে লাগাতে হবে।
আমার ফেসবুকে আমি এরকম অনেক প্রবাসী লেখক, সাংবাদিক, বুদ্ধিজীবী বিজ্ঞানী আছেন যাদের জ্ঞান আমাকে চমৎকৃত করে। যেমন, ফয়েজ আহমদ তৈয়্যবের ‘চতুর্থ শিল্পবিপ্লব ও বাংলাদেশ’ চমৎকার ফিউচারিস্ট একটি গ্রন্থ, যা আমাকে আকৃষ্ট করেছিল। তিনি এখন তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগে প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী। আমি খুবই আশাবাদী এবং আনন্দিত হয়েছি ওনাকে অন্তর্বর্তী সরকারের অন্তর্ভুক্ত করার জন্য।
আমি জানি না কেন আমাদের একশ্রেণির বুদ্ধিজীবীদের উন্নাসিকতা আছে প্রবাসী বাংলাদেশিদের দেশের কাজে ব্যবহারের ক্ষেত্রে। অনেক ক্ষেত্রেই তাদের অনর্থক সমালোচনা করা হয়। ভারত ও চীনের মতো দেশ তাদের দেশে ডেকে চাকরি দিতে পারলে আমাদের এত অনীহা কেন তা আসলেই আমার বোধগম্য নয়।
এটা অনস্বীকার্য যে আমাদের দরকার শিক্ষা ব্যবস্থায় ব্যাপক পরিবর্তন। শিক্ষার ক্ষেত্রে মিডিয়া লিটারেসি, ফিউচার লিটারেসি, সিনারিও প্ল্যানিং ইত্যাদি ধারণা সংযুক্ত করতে হবে, যাতে শিক্ষার্থীরা ভবিষ্যতের চাকরির জন্য প্রস্তত হতে পারে। সেই সাথে দেশে থিংকট্যাংক, ফোরসাইট ইনস্টিটিউট ইত্যাদির সংখ্যা বাড়াতে হবে নীতি নির্ধারকদের সঠিক পরামর্শ দেওয়ার জন্য।
লেখক: কলামিস্ট, বিভাগীয় প্রধান, সাংবাদিকতা বিভাগ, স্টেট ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ।
[email protected]
*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।