দুই.
আমার এক মারমা বন্ধুকে তার বাবার নাম জিজ্ঞেস করছিলাম কোনও এক কারণে। জানালো, তার বাবার নাম জীবন চৌধুরী। আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করেছিলাম, জীবন চৌধুরী কিভাবে মারমা নাম হয়? তখন সে জানালো স্কুলে ভর্তির সময় বাঙালি স্কুল শিক্ষক বলেছেন, ‘এই সব কঠিন নাম তিনি উচ্চারণ করতে পারবেন না, তাই তিনি তার বাবার মারমা নাম পাল্টে বাংলা নাম দিয়েছেন।’ এই ঘটনা ঘটেছে হয়তো আরও ষাট বছর আগে কিন্তু এখনও চলছে সেই নাম পরিবর্তনের মাধ্যমে সংখ্যাগরিষ্ঠের দেমাগ চর্চা। আর এই আধিপত্য বিস্তারের অন্যতম হাতিয়ার হলো ভাষা। তাই যে কারণে খাগড়াছড়ির ত্রিপুরা অধ্যুষিত এলাকা খাগড়াপুর হয়ে যায় ইসলামপুর, চাকমাদের বসতি মা'জন পাড় হয়ে যায় মহাজন পাড়া, খবংপুইজ্যে হয়ে যায় খবংপড়িয়া, বেবোনছড়া হয়ে যায় ভাইবোন ছড়া, মারমাপাড়া পাড়া কালাক হয়ে যায় লম্বা পাড়া, উত্তদাছড়ি পরিবর্তিত হয়ে বর্তমান নাম হয় রসুলপুর, পাঅংকার্বারী পাড়া হয়ে গেছে ফাতেমানগর। কেন এই নামের পরিবর্তন? এটা কী ইঙ্গিত করে? এটা ইঙ্গিত করে রাষ্ট্রভাষা বাংলার জন্য জীবন দেওয়া বাঙালির ভাষার আধিপত্যের মাধ্যমে অন্যান্য জাতির ভাষাকে তুচ্ছ করা, অপমানিত করার প্রশ্নহীন অদম্য ইচ্ছা। আর এই ইচ্ছার কাছেই আত্মাহুতি দিয়েছিল আমার আরেক চাকমা বন্ধু ছোটবেলায় স্কুল পালানোর মধ্য দিয়ে। সেই স্কুল যাওয়া বন্ধ করেছিল শিক্ষকের বেদম প্রহার সহ্য করতে না পেরে। তার অপরাধ ছিল সে শিক্ষককে 'তুই' করে সম্বোধন করেছিল। চাকমা ভাষায় যে 'তুই' তুমি আপনি' সম্বোধনের তিন ধারা নেই। আছে কেবল 'তুই'। বাঙালি শিক্ষকও হয়তো জানেন না সেই ভাষায় সম্বোধনের টার্মেনলজি। শিক্ষকদের হয়তো দোষ নেই তাতে। তাকে বলা হয়নি আদিবাসী সংস্কৃতি শিখতে, সে শুধু আর্দিস্ট হয়, মতাদর্শিকভাবে তাড়িত হয় সংখ্যাগরিষ্ঠের ভাষা ও সংস্কৃতি শেখাতে।
তিন.
আমরা সবাই জানি পার্বত্য চট্টগ্রামের তিনটি জেলা বাংলাদেশে সবচেয়ে শেষে মোবাইল নেটওয়ার্কের আওতায় এসেছে। এর কারণ হিসেবে রাষ্ট্র আমাদের বার বার বলেছে পার্বত্য চট্টগ্রাম ‘অনিরাপদ এলাকা’। অথচ এই ঢাকা শহরে দিনে প্রায় তিনটির মতো খুন ঘটলেও ঢাকা এখনও কী কারণে অনিরাপদ শহর হিসেবে নাম খাতায় ওঠলো না সেই রাজনীতি বোঝার জন্য চোখ ঘষতে হয় না। রাষ্ট্রীয়ভাবে তৈরিকৃত 'বাংলাদেশ ভ্রমণ' করার বিজ্ঞাপনে সবচেয়ে বেশিবার ব্যবহৃত আদিবাসীরা সরব কণ্ঠ হলেই রাষ্ট্র দাম্ভিক গলায় বলছে ‘বাংলাদেশে কোনও আদিবাসী নেই’। আর চাকমা ভাষায় তৈরি হওয়া প্রথম চলচ্চিত্র ‘মোর ঠেনগাড়ী’ এখনও ছাড়পত্র পায়নি। তাই সবার রাষ্ট্র যথাযথভাবে পৃষ্ঠপোষকতা না দিলেও বাংলাদেশে নিজ ভাষায় আদিবাসীরা তাদের সাহিত্য সংস্কৃতি চর্চা তাদের মতো করেই অব্যাহত রাখছে। এরই ধারাবাহিকতায় মনিপুরী সাহিত্য নিয়ে মনিপুরি ভাষাতেই বের হয় তাদের ছোট কাগজ 'পৈরী'। পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে চাকমা ভাষায় বের হয় আরেক ছোট কাগজ 'আলাম'। বম এসথেটিকস কাউন্সিল বের করে তাদের নিজস্ব ছোট কাগজ। ময়মনসিংহ কালচারাল একাডেমি থেকে বের হতো 'জানিরা'। এছাড়াও ককবরক ভাষায় ত্রিপুরা জনগোষ্ঠী তাদের সাহিত্য চর্চা করছেন। বিখ্যাত ঔপন্যাসিক আখতারুজ্জামান আরও প্রায় বিশ বছর আগে দাবি করেছিলেন 'চাকমা উপন্যাস চাই'। কিন্তু আজও আমরা চাকমা ভাষায় লিখিত উপন্যাস পাইনি।
চার.
বছর কয়েক আগে বাংলাদেশের বিভিন্ন চ্যানেলে প্রচারকৃত একটি বিজ্ঞাপনচিত্রে বাংলাদেশের একজন বরেণ্য কবি এবং সাহিত্যিক বলেছেন, মানুষ বেঁচে থাকে তার ভাষায় আর ভাষা বেঁচে থাকে লেখনীতে। কিন্তু আমাদের সেই আদিবাসী ভাষাগুলোর বেঁচে থাকার সুযোগ তাহলে নেই। এদেশের সাহিত্যে আদিবাসী ভাষা নেই, পত্রিকাগুলো বাংলাবাদে অন্য ভাষায় গল্প কবিতা উপন্যাস ছাপায় না। তাহলে কিভাবে বেঁচে থাকবে এক একটি ভাষা? ভাষা বিজ্ঞানীরা বলছেন ২০৫০ সালের মধ্যে পৃথিবী থেকে হারিয়ে যাবে ৫০০০ এরও বেশি ভাষা। বাংলাদেশে আদিবাসী ভাষাগুলো এই ঝুঁকিতে আছে। এদের বাঁচানোর দায়িত্বতো আমাদেরই। তাই প্রত্যেক সংস্কৃতির উপাদানসমূহ তার মতো করেই তার ভাষায় বেঁচে থাকুক। বাংলা কবিতা চাকমা বা মারমা ভাষায় অনুবাদ নয়, আমরা চাই চাকমা শিশুরা তাদের গল্প, কবিতা ছড়া শিখুক, যেখানে তার জীবন আছে।
লেখক: শিক্ষক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
ইমেইল: zobaidanasreen@gmail.com