X
শুক্রবার, ২৭ জুন ২০২৫
১২ আষাঢ় ১৪৩২

লিঙ্গবৈচিত্র্য ও পুরুষতন্ত্রের মেনে নেওয়া-না নেওয়া

জোবাইদা নাসরীন
২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১৫:৩২আপডেট : ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১৫:৩২

সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশে লিঙ্গবৈচিত্র্যের মানুষরা সবচেয়ে বেশি আলোচনায় এবং আক্রান্তও হচ্ছেন বিশেষ করে এ বছরের প্রথম দিক থেকে পাঠ্য বইয়ে শরীফা-শরীফ গল্পকে কেন্দ্র করে ব্র্যাক  বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষকের পাঠ্যবই ছেঁড়া নিয়ে। এই বিষয়ে ভুল ব্যাখ্যা মূলত এই আলোচনাকে সামনে নিয়ে আসে। শুরু হয়ে যায় ফেসবুকসহ নানান ধরনের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এই বিষয়ে বিদ্বেষ ছড়ানো। আতঙ্ক শুরু হয় লিঙ্গবৈচিত্র্যপূর্ণ মানুষদের মধ্যে। কয়েকজন শিকার হন আক্রমণ এবং হেনস্তার।

বর্তমানে ‘রূপান্তর’ নামক একটি  নাটককে কেন্দ্র করে আবারও আলোচনায় লিঙ্গবৈচিত্র্যের মানুষেরা। কিন্তু এটি যে শুধু আলোচনায় থেমে আছে তা নয়, বরং লিঙ্গবৈচিত্র্যের প্রতি জারি থাকা বিদ্বেষ এবং তাদের অগ্রহণের রাজনীতি ক্রমশই জোরদার হচ্ছে। এর পাশাপাশি আরও হাজির হচ্ছে বয়কট থেরাপি। এখন সেই নাটকের বিজ্ঞাপন দেওয়ার জন্য বাণিজ্যিক একটি প্রতিষ্ঠানের পণ্য বয়কটের ঘোষণা দেওয়া হয়েছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। অপরাধ, তারা রূপান্তর নাটকটিতে বিজ্ঞাপন দিয়েছিল। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সেই বিদ্বেষের মাত্রা এমন পর্যায়ে পৌঁছেছিল যে শেষ পর্যন্ত ওই প্রতিষ্ঠানের কর্তৃপক্ষ এই নাটকে বিজ্ঞাপন দেওয়ার জন্য প্রজ্ঞাপন দিয়ে দুঃখ প্রকাশ করেছেন। কিন্তু এই বিষয়টি কীভাবে এই পর্যায়ে পৌঁছালো এবং বাংলাদেশে এই লিঙ্গবৈচিত্র্য মানুষদের নিয়ে পর পর ঘটে যাওয়া ভীতি এবং অস্পৃশ্যতার কারণ কী? এর রাজনীতির মূলেই বা কি কাজ করছে?
দেশের মানুষজন হঠাৎ কেন এত বেশি ট্রান্স ফোবিক (লিঙ্গবৈচিত্র্য ভীতি) হয়ে উঠেছেন? কী ধরনের প্রপঞ্চ হঠাৎ করে মানুষকে এই রোগে আক্রান্ত করেছে? মফস্বলে বড় হওয়া আমি ছোটবেলায় লিঙ্গবৈচিত্র্যের মানুষদের যখন এলাকায় দেখতাম তখন কিন্তু এই ধরনের পরিস্থিতি কখনোই দেখিনি। বরং তাদের অনেককেই বৈদ্যুতিক মিস্ত্রি এবং খাবার দোকানে কাজ করতে দেখেছি। তাদের প্রতি খুব বেশি মফস্বলের কারোরই বিদ্বেষ ও ঘৃণা দেখিনি। কিন্তু এই সময়ে দাঁড়িয়ে হঠাৎ বাংলাদেশে কেন এই বৈচিত্র্যভীতি তৈরি হলো সেটি তালাশের জন্যই এই লেখা।

আমাদের দেশে বেশ কয়েক বছর ধরে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতের কথা আমরা শুনছি। এবং এটিকে কেন্দ্র করে যে রাজনৈতিক চর্চা হয় সেটি শেষ পর্যন্ত বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সাম্প্রদায়িক হামলায় গিয়ে থামে। এ দেশে ধর্মীয় অনুভূতি, জাতীয়তাবাদী অনুভূতি, শ্রেণি অনুভূতিতে আঘাতের কারণে নানা ধরনের নিপীড়ন হয় এবং সেগুলো নানাভাবে বৈধতাও দেওয়া হয়। কিন্তু অধিপতিশীল লিঙ্গীয় অনুভূতিতে আঘাত কীভাবে এই লিঙ্গবৈচিত্র্যকে অগ্রহণযোগ্যতার রাজনীতি তৈরি করে, সেটি বিশ্লেষণ খুবই জরুরি।

এখানে বলে রাখা প্রয়োজন যে সমাজ এবং রাষ্ট্রে  জারি থাকা ক্ষমতা কাঠামো কখনও এককভাবে ক্রিয়াশীল থাকে না, একটি আরেকটির সঙ্গে অনেক বেশি জড়িত। তাই সমাজের অন্যান্য ক্ষমতাচর্চার যে ধরন-ধারণ হচ্ছে সেই সঙ্গে পাল্লা দিয়ে এগোচ্ছে এই পুরুষতন্ত্র।

এখন প্রশ্ন হলো লিঙ্গবৈচিত্র্যদের সমাজ এবং রাষ্ট্র গ্রহণ-অগ্রহণের পেছনে পুরুষতন্ত্র কীভাবে ক্রিয়াশীল থাকছে। পৃথিবীর সব সমাজ রাষ্ট্রেই লিঙ্গবৈচিত্র্যপূর্ণ মানুষ রয়েছে। এই উপমহাদেশে মোগল আমলে এদের অত্যন্ত সম্মান করা হতো। ঔপনিবেশিক অভিঘাত এই লিঙ্গীয় পরিচিতি শুধু নারী-পুরুষের মধ্যে সীমাবদ্ধ করায় এই মানুষজন ছিটকে পড়ে আইন এবং রাষ্ট্রের অন্যান্য নীতি থেকে, যেখানে শুধু নারী-পুরুষের স্বীকৃতিই মিলেছে। এখানে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য হলো, বাংলাদেশ সরকার ২০১৩ সালে নারী এবং পুরুষের পাশাপাশি ‘হিজড়া’ লিঙ্গের স্বীকৃতি দিয়েছে, তখন দেশে এত প্রতিক্রিয়া হয়নি। যদিও সেই সংজ্ঞায়নও ত্রুটিপূর্ণ এবং সেখানেও রয়েছে নানা বোঝাপড়াজনিত সমস্যা, কিন্তু এই দশ বছর পরে তাহলে কেন এমন হচ্ছে। তাহলে আলাপের জায়গাটা এখানে হলো, বিষয়টি কি শুধু টার্মজনিত সমস্যা, নাকি মানুষের এই বিষয়ে তথ্য জানা নেই সেই অজ্ঞানতার সমস্যা, নাকি শুধুই পুরুষতন্ত্রের আগ্রাসনে ট্রান্স নারীদের (যারা ‘হিজড়া’ হিসেবে পরিচিত) নারী হিসেবে মানতে সমস্যা। কারণ পুরুষতন্ত্র যে নারীকে গ্রহণ করতে চায় সেটি হলো শরীরকেন্দ্রিক নারী। পুরুষের দেহে নারীর মন নিয়ে আছেন তাদের নারী হিসেবে মেনে নিতে পারছেন না। কাঙ্ক্ষিত ‘হিজড়া’ হলে যাদের নির্দিষ্ট কোনও যৌনাঙ্গ নেই এবং তাদের নিয়ে এক ধরনের আহাজারি এবং ‘দয়া’ সমাজে জারি থাকবে। কিন্তু সেই মানুষরা যখন তাদের পরিচিতদের স্বীকৃতি চায়, অন্যান্য অধিকার নিয়ে হাজির হয় কিংবা তাদের অস্তিত্বের খোলাসাকরণ নিয়ে কথা বলে, গণমাধ্যমে হাজির হয়, তখন আর টনটনে পুরুষতন্ত্র সেটি মেনে নিতে পারে না। আর তখনই শুরু হয় তাদের প্রতি নানান ধরনের বিদ্বেষ ছড়ানো এবং অগ্রহণযোগ্যতার রাজনীতি।

এখন আমাদের দেখতে হবে সমাজ রাষ্ট্রে জারি থাকা পুরুষতান্ত্রিক দাপট আসলে কীভাবে এত ভয়াবহ রূপ নিলো?

পুরুষবাদে অন্যান্য লিঙ্গর মানুষজনের প্রতি বিদ্বেষের মাধ্যমে আসলে কী কী ধরনের বিষয় পুরুষতন্ত্র হাজির করতে চায়? এর মূলে রয়েছে পুরুষতন্ত্রের বিরুদ্ধে যে ঝাঁকুনি তৈরি হয় মাঝে, সেটি নিয়ে শঙ্কিত হয়ে পড়েন পুরুষতন্ত্রের ধারক এবং বাহকেরা। তারা নানা ধরনের তরিকা খুঁজতে থাকে এর ভিত মজবুত করার এবং যার কারণে সমাজ এবং রাষ্ট্রের অপরাপর ক্ষমতার খুঁটির সঙ্গে একাত্ম হয়ে তার কার্যকারিতা জারি রাখে। এবং সেই ক্ষমতার বহিঃপ্রকাশ ঘটানোর জন্য তারা সমাজের বিভিন্ন মাধ্যমকে ব্যবহার করে এবং তার পক্ষে জনমত তৈরি করে এর মাধ্যমে তার ক্ষমতাকে আরও বেশি বৈধ করার অভিপ্রায় ব্যক্ত করে। ব্যবহার করে ধর্ম, আইন এবং সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গির নানান খানাখন্দ। আর এভাবেই নির্মিত হয়ে যায় বিদ্বেষ এবং অস্পৃশ্যতার অনেক বড়সড় পরিসর।

তাই পুরুষতন্ত্রের বিরুদ্ধে লড়াই আসলে সব লিঙ্গের প্রতি সম্মান এবং অধিকার নিশ্চিত করার গুরুত্বপূর্ণ পথ। আরও জরুরি লিঙ্গবৈচিত্র্য নিয়ে তথ্য জানা। আমাদের সমর্থনের পাটাতন অনেক বেশি অন্যের দেখাদেখি এবং অনেক সময় জিইয়ে থাকা ভ্রান্ত ধারণার ওপরও। বিদ্বেষ সংস্কৃতি থেকে বের হতে না পারলে আমরা এভাবে আসলে অন্যের অস্তিত্বকে খারিজ করার দিকেই যাচ্ছি। তাই হুজুগে সমর্থনের চেয়ে জেনেশুনে সমর্থন বন্ধ করতে পারাটাই মানুষ হিসেবে অন্যদের সম্মান করার বড় পথ।

লেখক: শিক্ষক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

ইমেইল: [email protected]

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
স্বতন্ত্র ইবতেদায়ি মাদ্রাসার জন্য নতুন এমপিও নীতিমালা জারি
স্বতন্ত্র ইবতেদায়ি মাদ্রাসার জন্য নতুন এমপিও নীতিমালা জারি
জাতীয়করণ নয়, এমপিওভুক্তির আওতায় আসছে স্বতন্ত্র ইবতেদায়ি মাদ্রাসা
জাতীয়করণ নয়, এমপিওভুক্তির আওতায় আসছে স্বতন্ত্র ইবতেদায়ি মাদ্রাসা
দুই বছর পর রিজার্ভ ছাড়ালো ২৪ বিলিয়ন ডলার
দুই বছর পর রিজার্ভ ছাড়ালো ২৪ বিলিয়ন ডলার
ইরান প্রত্যাগত বাংলাদেশি দল শিগগিরই করাচি পৌঁছাবে
ইরান প্রত্যাগত বাংলাদেশি দল শিগগিরই করাচি পৌঁছাবে
সর্বশেষসর্বাধিক