X
মঙ্গলবার, ৩০ এপ্রিল ২০২৪
১৭ বৈশাখ ১৪৩১

ভ্রান্তি নয়, লিঙ্গবৈচিত্র্য নিয়ে পরিষ্কার বোঝাপড়া জরুরি

জোবাইদা নাসরীন
২৮ জানুয়ারি ২০২৪, ১৮:১৩আপডেট : ২৮ জানুয়ারি ২০২৪, ১৯:২১

সাম্প্রতিক সময়ে লিঙ্গবৈচিত্র্যের মানুষদের নিয়ে নানা ধরনের হইচই হচ্ছে। খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, গত এক মাসে বাংলাদেশে এই বিষয়টি একটি জাতীয় ইস্যুতে পরিণত হয়েছে। প্রথমে নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ে লিঙ্গবৈচিত্র্যের একজন বক্তাকে বক্তৃতা দেওয়ার সুযোগ না দেওয়া এবং সেটি নিয়ে হট্টগোল,  তারপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গত বছর থেকে চালু হওয়া ‘হিজড়া ও ট্রান্সজেন্ডার কোটা’র বিরুদ্ধে  আন্দোলন  এবং সর্বশেষ সপ্তম শ্রেণির পাঠ্যপুস্তকে  ‘’শরীফার গল্প’কে কেন্দ্র করে ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষকের  বইয়ের পাতা ছিঁড়ে ফেলা মূলত অনেক প্রশ্নকে সামনে এনে দিলো।

তবে এর মধ্যে একটি আশা জাগানিয়া সংবাদ ছিল বাংলাদেশে একজন কূটনীতিক তার নিজের লিঙ্গবৈচিত্র্যকে সামনে এনেছেন।

মূলত এই সাম্প্রতিক ঘটনাগুলোকে সামনে রেখেই এই লেখা। বাংলাদেশ সরকার ২০১৩ সালে নারী এবং পুরুষের পাশাপাশি ‘হিজড়া লিঙ্গ’ পরিচয়ে এই  লিঙ্গবৈচিত্র্যের মানুষদের স্বীকৃতি দিয়ে একটি গেজেট প্রকাশ করে। এবং পরবর্তীতে সমাজ সেবা অধিদফতর থেকে তাদের জীবনমান উন্নয়নের জন্য প্রকল্প নেওয়া হয়।

এখানে কয়েকটি সমস্যা রয়েছে। প্রথম সমস্যা হলো– হিজড়া লিঙ্গের মধ্যে কারা অন্তর্ভুক্ত হবে সেই বিষয়ে একেবারেই খোলাসা করা হয়নি। এটি খোলাসা করার প্রয়োজন ছিল। কারণ, বাংলাদেশে এই বিষয় নিয়ে বেশিরভাগ সাধারণ মানুষদের ভ্রান্ত ধারণা রয়েছে।

দ্বি‌তীয়ত সমস্যা হলো– সরকারি এই বোঝাপড়ায় আন্তলিঙ্গ (Inter sex), (অর্থাৎ যাদের শরীরে নারী এবং পুরুষের অঙ্গ বিদ্যমান)-এর সঙ্গে লিঙ্গবৈচিত্র্যর মানুষদের তালগোল পাকিয়ে ফেলা। ‌

এখানে স্পষ্টই জানান দেওয়া প্রয়োজন যে লিঙ্গবৈচিত্র্য কোনও শারীরিক বিষয় নয়। এটি পুরোটাই মানসিক বিষয়। কিন্তু এ বিষয়ে পরিষ্কার বোঝাপড়া না থাকার কারণে আমরা দেখেছি সরকারের এই জনগোষ্ঠীর জন্য নেওয়া অনেক পরিকল্পনাই ভেস্তে গেছে। সরকার ২০১৩ সালে এই লিঙ্গের স্বীকৃতি দেওয়ার পাশাপাশি নারী-পুরুষের কাছে তাদের গ্রহণযোগ্যতা তৈরি করার খুব বেশি পদক্ষেপ গ্রহণ করেনি।

গত বছর করের ক্ষেত্রে একটি উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছিল, যেসব প্রতিষ্ঠান ‘হিজড়া’দের কর্মসংস্থান করবে তাদের করের ক্ষেত্রে কিছুটা ছাড় দেওয়া হবে। কিন্তু আমরা এখন পর্যন্ত এই উদ্যোগের খুব বেশি প্রভাব দেখিনি। তার মানে হলো, এই জনগোষ্ঠী নয়, সমাজের বিরাজমান নেতিবাচক মনোভাব থাকার কারণে তাদের কর্মসংস্থানে সমস্যা হচ্ছে। তবে ব্যক্তিগতভাবে অনেকের সহযোগিতায় এই জনগোষ্ঠীর অনেকেই চাকরি করছেন এবং উদ্যোক্তা হয়েছেন।

এখানে বলে রাখা প্রয়োজন, সাম্প্রতিক সময়ে বিতর্কগুলো অনেকটাই টার্ম নিয়ে স্পষ্ট ধারণা  না থাকা জনিত। তবে মজার বিষয় হলো, এসব বিষয়ে কোনও ঘটনা হলে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এবং গণমাধ্যমের প্রকাশিত সংবাদের নিচে যেসব মতামত দেয় এবং এতটাই জোর দিয়ে ভুল তথ্য প্রচার করেন এবং লিখেন, সেগুলো পড়ে মনে হবে এসব বিষয়ে সবাই অনেক বেশি জানেন। আমি জানি না কী কারণে লোকজনের এসব বিষয়ে আলোচনায় মনে হয় তিনি যা জানেন তাই-ই ঠিক।

হিজড়া সম্পর্কে বেশিরভাগ মানুষের ধারণাও কম। অনেকে মনে করেন, এদের যৌনাঙ্গ অপরিণত কিংবা স্পষ্ট নয়। এটি একটি ভ্রান্ত ধারণা। হিজড়া আসলে কোনও পরিচয় নয়। এটি একটি সংস্কৃতি, একটি গুরু-পরম্পরা সংস্কৃতি।

এই সংস্কৃতিতে বিভিন্ন যৌন এবং লিঙ্গীয় পরিচয়ের লোকজন বেড়ে ওঠে। বাংলাদেশ এবং ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে নারী এবং পুরুষদের বাইরে লিঙ্গীয় বৈচিত্র্যের জনগোষ্ঠী ‘হিজড়া’ হিসেবে পরিচিত।

তৃতীয় লিঙ্গ বা ‘থার্ড জেন্ডার’ টার্মও পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে প্রচলিত। আমাদের দেশে মিডিয়ায় এই টার্মটি জনপ্রিয়। তবে যেহেতু বাংলাদেশের সংবিধান কোনও লিঙ্গকে প্রথম এবং দ্বিতীয় লিঙ্গ হিসেবে অভিহিত করেনি, তাই তৃতীয় লিঙ্গ পরিচয় অনেকটাই সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক।

এবার আসি ট্রান্সজেন্ডার প্রসঙ্গে। সাম্প্রতিক সময়ে এই টার্মটির ব্যবহার নিয়েও ভ্রান্ত ধারণা তৈরি হচ্ছে। অনেকের ধারণা, যারা অপারেশন করে লিঙ্গ পরিবর্তন করে তারা ট্রান্সজেন্ডার। আসলে এটিও ভ্রান্ত ধারণা। ট্রান্সজেন্ডার হলেন যাদের জন্ম থেকে প্রাপ্ত যৌন পরিচয় এবং লিঙ্গীয় পরিচয় এক নয়। ইংরেজিতে বললে হয়তো বিষয়টি আরও ভালোভাবে বোঝা যাবে। যেমন, পুরুষ (Male) হয়ে জন্মগ্রহণ করলেই সবাই ’ম্যান’ ( Man) হবে তা নয়। পুরুষ ( Male) হয়েও কেউ কেউ ’ওমেন’ (Woman) বোধ করতে পারেন। ঠিক একইভাবে  নারী ( Female) হয়ে জন্মগ্রহণ করেও কেউ  ‘ম্যান’ (Man ) ভাবতে পারেন।

ট্রান্সজেন্ডার বোঝাপড়ার মূল যুক্তই হলো Male  আর  Man-এর পার্থক্য বুঝতে পারা। এই উদাহরণটি ইংরেজিতে দেওয়ার কারণ হলো বাংলাভাষায়  ’Sex’ এবং ’Gender’- এর অনুবাদ একই। তাই পার্থক্যটা অনেক সময়ই বোঝা যায় না।

তাই রাস্তায় আমরা যাদের পুরুষের শরীরে শাড়ি বা নারীর পোশাক পরা এবং নারীদের চালচলনে দেখি তারা শারীরিকভাবে পুরুষ। কিন্তু মানসিকভাবে নারী। একাডেমিকভাবে এদের ট্রান্সওমেন বলা হয়। অর্থাৎ পুরুষের দেহে যারা নিজেদের নারী মনে করবেন তারা ট্রান্সওমেন। এর বিপরীতে যারা নারীর দেহে নিজেদের পুরুষ মনে করবেন তরা ট্রান্সম্যান। এদের অনেকেই (সবাই নয়) হিজড়া সংস্কৃতিতে বড় হয় বলে আমরা ‘হিজড়া’ বলি। আরও একটি জোরালো ধারণা হলো, হিজড়া হয়ে জন্মগ্রহণ করে জন্মগ্রহণ করার পরই বাবা মায়েরা সন্তানটিকে হিজড়া গুরুর কাছে রেখে আসে। এই ধারণাও ঠিক নয়।

আমাদের অনেক নাটক এবং সিনেমাতেই এই ধরনের বিষয় দেখানো হয়। আমাদের মনস্তত্ত্বে এগুলো ঢুকে যায়। এক শরীরে আরেক লিঙ্গের বোধ জন্ম থেকে বোঝার উপায় নেই। বড় হওয়ার পরই হয়তো অনেকেই নিজ পরিবারে বৈষম্য এবং তাচ্ছিল্যের শিকার হওয়ার কারণে নিজেই বাড়ি ছাড়ে এবং হিজরা গুরুর কাছে আশ্রয় নেয়, তার শিষ্যত্ব গ্রহণ করে।

তাই ট্রান্সজেন্ডার মানেই হলো স্বেচ্ছায় লিঙ্গ পরিবর্তন করা– এই বিষয়টি একেবারেই ঠিক নয়। আবার অনেকেই বলছেন ট্রান্সজেন্ডার মানে সমকামিতা। এটিও ঠিক নয়।  যারা লিঙ্গ পরিবর্তন করে তারা ট্রান্সসেক্সচুয়াল। তাই যারা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ট্রান্সজেন্ডার শব্দটি বাতিলের পক্ষে কথা বলছেন তারা ভ্রান্ত ধারণার বিষয়টি সম্পর্কে বুঝতে পারবেন। আবার কেউ কেউ বলছেন, ট্রান্সজেন্ডার পাশ্চাত্য থেকে আসা। এখানে স্পষ্টতই জানান দিতে চাই যে আমাদের এই অঞ্চলে নারী পুরুষের বাইরে বিভিন্ন ধরনের যৌন এবং লিঙ্গীয় বৈচিত্র্যের মানুষদের অস্তিত্ব ছিল। এবং মোগল আমলে তাদের বিশেষ মর্যাদা দেওয়া হতো এবং পরামর্শক হিসেবে বিভিন্ন দফতরে নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল। ইসলামি দেশ হিসেবে পরিচিত পাকিস্তান অনেক আগে থেকেই ট্রান্সজেন্ডার হিসেবে এই জনগোষ্ঠীকে স্বীকৃতি দিয়েছে।

এমনকি ২০১৬ সালে পাকিস্তান শরিয়া বোর্ড ট্রান্সজেন্ডার বিয়ে বৈধ বলে ঘোষণা দেন। যদিও কয়েকটি ইসলামি দল এই বিষয় রিট করার কারণে এটি এখনও কার্যকর হয়নি।

সর্বশেষ আসি পাঠ্যবই বিষয়ে। সেখানে তৃতীয় লিঙ্গ শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে। সম্ভবত এর আগে থাকা ট্রান্সজেন্ডার বিষয়টি নিয়ে এরকম ভ্রান্ত ধারণার জন্য বিতর্ক ওঠায় টার্মটির পরিবর্তন করে থার্ড জেন্ডার বা তৃতীয় লিঙ্গ করা হয়েছে। তবে এখানে পরিষ্কার দাবি হলো– কোনও পক্ষ-বিপক্ষের চাপে কোনও টার্মের পরিবর্তন কোনোভাবেই আকাঙ্ক্ষিত নয়, বরং বিষয়গুলো সবার কাছে খোলাসা করাই জরুরি ছিল।

যৌনতা, যৌন পরিচয়, লিঙ্গীয় বৈচিত্র্য এগুলো নিয়ে যত বেশি আলোচনা হবে ততই এগুলো নিয়ে সবার একটি সহজ এবং স্পষ্ট ধারণা হবে। তখনই আমরা থামাতে পারবো এই বিষয়ে তেড়ে আসা ঝড়। লিঙ্গীয় বৈচিত্র্য কখনই নেতিবাচকতা নয়। এই বিষয়ে পাঠ্যপুস্তক বোর্ড এবং সংশ্লিষ্ট সবার আরও জোরালো ভূমিকা থাকা প্রয়োজন। আরও গুরুত্বপূর্ণ হলো, কোনও ধরনের পরিচয়ের কারণেই যেন অন্যের অধিকার হরণ না হয় সেটি নিশ্চিত করা।

লেখক: শিক্ষক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

ইমেইল: [email protected]

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
দুই আনক্যাপড ক্রিকেটারকে নিয়ে প্রোটিয়াদের বিশ্বকাপ দল 
দুই আনক্যাপড ক্রিকেটারকে নিয়ে প্রোটিয়াদের বিশ্বকাপ দল 
লাশের সুরক্ষায় আইন প্রণয়ন ও কঙ্কাল চুরি প্রতিরোধে ব্যবস্থা নিতে রুল
লাশের সুরক্ষায় আইন প্রণয়ন ও কঙ্কাল চুরি প্রতিরোধে ব্যবস্থা নিতে রুল
চার মামলায় বিএনপি নেতা সোহেলের জামিন, তবে কারামুক্তি মিলছে না
চার মামলায় বিএনপি নেতা সোহেলের জামিন, তবে কারামুক্তি মিলছে না
বানসালির ওপর ক্ষুব্ধ এই বাঙালি অভিনেত্রী
বানসালির ওপর ক্ষুব্ধ এই বাঙালি অভিনেত্রী
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ