বিয়ে একটি সামাজিক প্রথা। ধারণা করা হয়, এর ওপর ভিত্তি করেই একটি সমাজ টিকে আছে। একটা সময় ছিল যখন চাইলেই স্ত্রীকে ত্যাগ করা যেতো না। এখন তো মানুষ সচেতন হচ্ছে এবং অর্থনৈতিকভাবে সবাই সমৃদ্ধ হচ্ছে। একটা সময় পরস্পরের কাছে থাকার জন্য চিন্তা করতো, কিছুটা মেনে নেওয়া বা কিছুটা মানিয়ে নেওয়া। সবসময় সবকিছু যে মনের মতো হবে তাতো নয়। তাই কথায় বলে, দোষে-গুণে মানুষ। কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে, পারিবারিক সহিংসতাগুলো ব্যাপক আকার ধারণ করেছে। স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে দূরত্ব বাড়ছে, একই ছাদের নিচে বসবাস করলেও নিজেদের মধ্যে কথা হচ্ছে কম, আন্তরিকতার ঘাটতি সৃষ্টি হচ্ছে। আবার দেখা যাচ্ছে প্রাইভেট চাকরির ক্ষেত্রে আটঘণ্টা অফিসে আর যানজটে যাওয়া আসায় প্রায় তিনঘণ্টা চলে যায়। এরপর মানসিক অবসাদ, যন্ত্রণা নিয়ে বাড়ি ফিরে কতটা আর আন্তরিক থাকা যায়। আর এরই ফাঁক গলে ফেসবুকসহ বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ঢুকে যাচ্ছে অপর কোনও নারী বা পুরুষ। কিন্তু সেটা যে সমসময় সঠিক সিদ্ধান্ত হচ্ছে তা নয়। হয়তো সাময়িকভাবে মনে হচ্ছে বেটার। ঢাকা সিটি করপোরেশনের গবেষণা বলছে, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বাংলাদেশে পরকীয়া আসক্তির সংখ্যা আশঙ্কাজনকভাবে বেড়েছে। তারা যেসব আবেদন ইতোমধ্যে নিষ্পত্তি করেছে তার ৮৭ শতাংশ বিচ্ছেদের ঘটনা ঘটছে কেবলমাত্র পরকীয়ার জের ধরে। একইসঙ্গে ইয়াবাসহ মাদকের সহজলভ্যতাও সংসারে ডেকে আনছে অশান্তি। এছাড়া যৌন জীবনে অসুখী হওয়া, নতুন-পুরনো সম্পর্ক, স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে বয়সের তারতম্য, স্ত্রীকে রেখে স্বামীর বিদেশ যাওয়া, একাকিত্ব, যৌতুকসহ নানা কারণে বাড়ছে বিবাহ বিচ্ছেদ। একটা সময় ছিল সামাজিকভাবে বিয়ে হলে এর দায়ভার দুই পরিবার নিতো। দুই পরিবার মিলে সব ঠিক করা হতো। এখন যেহেতু বেশিরভাগ বিয়েই প্রেমের সম্পর্কের সে কারণে পরিবার সম্মতি দিলেও দায়ভার নিতে চাওয়ার মধ্যে একটু গড়িমসি ভাব দেখা যায়। এছাড়া আরও একটি বিষয় বিবাহ বিচ্ছেদে প্রভাব ফেলে, সেটি যৌনজীবন। অতৃপ্ত যৌনজীবনও ডেকে আনতে পারে বিয়ে বিচ্ছেদের মতো ঘটনা।
সেসব কথা বলা হলো এগুলো হয়তো একসময় সংবাদমাধ্যমে পড়া হতো। আর ভাবতাম আহা। কিন্তু আশেপাশে যখন হরহামেশাই এসব ঘটে তখন বুঝে নিতে কষ্ট হয় না সত্যিইতো এসব বাড়ছে এবং আজ যাকে আত্মীয় সম্বোধন করছি সেই হয়তো দু’দিন পর ‘পরিচিত’ হয়ে যাচ্ছে। একটা সময় ছিল যৌথ পরিবারে সবাই হেসে খেলে বড় হয়েছে। একজন অপরজনের বিপদে এগিয়ে এসেছে। সামাজিক বন্ধনগুলো ছিল জোরালো। পারিবারিক মূল্যবোধের প্রশংসা ছিল। কথায় যেমন বলা হয়, বর্তমান বিজ্ঞান দিয়েছে বেগ, কেড়ে নিয়েছে আবেগ। এই আবেগ না থাকার ফল হচ্ছে ভয়াবহ। বিশেষ করে শহরাঞ্চলে দেখা যায়, কেউ কারও বিপদে এগিয়েই আসছে না। মানুষের ছোটখাট ভুলগুলোও এখন আর কেউ ক্ষমা করছে না। চাকরি জীবনে বাড়ছে মানসিক অবসাদ। কেউ কাউকে একচুল ছাড় দিতে রাজি নয়। সম্পর্কের ক্ষেত্রে শ্রদ্ধাবোধের জায়গা কেড়ে নিয়েছে অর্থ সম্পদ। সে কারণে অনেকের দাম্পত্য টিকে গেলেও সেখানে প্রেম বলে কিছু নেই। অনেক পরিবারে দেখা গেছে পরিবারের সবাই আলাদা আলাদা রুমে থাকছে, কে কী করছে কোনও খেয়ালই নেই। ফলে মানসিক দূরত্ব তৈরি হচ্ছে। তবে সবকিছু ঠিক করতে হলে প্রথমেই প্রয়োজন পারিবারিক মূল্যবোধ, যৌথ পরিবার, শ্রদ্ধার সম্পর্কগুলো ফিরিয়ে আনা। পরস্পরের খবরাখবর নেওয়া। সমাজবদ্ধ জীব হিসেবে মানুষের যে পরিচয় রয়েছে সেটাকে মজবুত করা। নইলে আগামীতে হয়তো আরো বিপর্যয় ডেকে আনবে। নষ্ট হবে সামাজিক শৃঙ্খলা।
লেখক: সাংবাদিক ও সাহিত্যিক