X
মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল ২০২৪
১০ বৈশাখ ১৪৩১

এলো এলো দুর্গা এলো

শান্তনু চৌধুরী
০৩ অক্টোবর ২০২২, ১৭:২৩আপডেট : ০৩ অক্টোবর ২০২২, ১৭:২৩

সময় বদলেছে, বদলানই নিয়ম। কিন্তু বদলে গেলো আত্মার সম্পর্কগুলোও। স্কুলে পুজোর ছুটিতে বন্ধুদের সাথে দেখা হতো না বলে কত না অভিমান। কিন্তু পুজোর দিন সবাই দলবেঁধে চলে যেতাম মণ্ডপে। সেখানে কে হিন্দু, কে মুসলমান, কে বৌদ্ধ এসব খেয়ালই করেনি কেউ। এখন অবশ্য বন্ধুরাও বদলেছে। ‌‘হারাম’ ‘হালাল’ এসব নিয়ে বেশ চর্চা হয় সেটা ফেসবুক দুনিয়া থেকে বাস্তব দুনিয়ায়। ছেলেবেলার অনেক বন্ধুকে এখন আর ঠিক চিনতে পারি না। কারণ তারা আর একসাথে উৎসবে সামিল হতে চায় না। যাও দু’একজন যান তাদের শুনতে হয় নানা কটুকথা। এরপরও শরৎ আসে। সাদা সাদা মেঘ যেন দুর্গাপুজোর বেয়ারিং চিঠি। প্রকৃতি সাজে, মানুষও সাজে। কেউ বা অসুর কেউবা মর্দিনী, পদ্মীনি।

ভয় আর শঙ্কা নিয়ে এবারো এলো শারদীয় দুর্গোৎসব। কাজ থেকে একটু ছুটি। একটু অবসর। একটু সময় সবাইকে নিয়ে আনন্দ উদযাপন। তবে অর্থনৈতিক টালমাটাল এই বিশ্বে হিসেবটা বড্ড গোলমেলে। পুজোর স্মৃতি মানেইতো আমাদের সেই গ্রামের মায়া জড়ানো সময়। পুরনোকে দেখা নতুন আলোয়। শরতের এই সময়ে কুয়াশা বা ভোরের শিশির যখন একটু একটু লোভ দেখাচ্ছে ততোক্ষণে কাব্য প্রতিভাটাও যেন জেগে ওঠে। স্মৃতির ঝাঁপি খুলে নাড়িচাড়ি। দূর বিজনে যে চলে গেছে তার কথাও মনে পড়ে।

মহালয়ার ভোরে বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের উদাত্ত আহবান শুনে আসছি সেই ছেলেবেলা থেকে। এখনও যেন চির নতুন। এই উষালগ্নে, হে মহাদেবী, তোমার উদ্বোধনে বাণীর ভক্তিরসপূর্ণ বরণ কমল আলোক শতদল মেলে বিকশিত হোক দিকে দিগন্তে; হে অমৃতজ্যেতি, হে মা দুর্গা, তোমার আবির্ভাবে ধরণী হোক প্রাণময়ী। জাগো! জাগো, জাগো মা! প্রতিটি বাড়িতে আলোর রেখা, ‘বাজল তোমার আলোর বেণু, মাতল যে ভুবন…’। আশ্চর্য প্রাণের মধ্য দিয়ে দেবীপক্ষের শুরু। কত মানুষের সাথে সরাসরি দেখা হয় না কতকাল। আশায় থাকি এবার হয়তো দেখা হবে কারো সাথে, হয়তো দেখাই হবে না। গ্রামে গিয়ে শুনবো সেই কাকাটা আমার শৈশবে পুজোর আগে বাজি পোড়ানো নিয়ে তেড়ে আসতেন তিনি বিছানায় শুয়ে আছেন, তেড়ে আসার শক্তি তার নেই। পুজোর গানে ছন্দে ছন্দে নাচতো যেই মানুষটি। তিনি আজ পৃথিবীতেই নেই। স্মৃতির জাবর কাটতে কাটতে ফিরি কত কত বছর আগে। বাসায় টাঙানো দুর্গা প্রতিমা বিষন্ন হাসেন! নিজেও বিষন্ন হয়ে পড়ি। অতীতের এমনই এক গুণ হয়তো সুখস্মৃতির চেয়ে বিষন্ন সময়গুলোকে মনে পড়ে বেশি। জানালা দিকে তাকিয়ে দেখি সত্যি সত্যি আকাশে তুলে মেঘ ভাসছে। তবে ইদানিং দেখছি মানুষের কাশফুল প্রীতি বেড়েছে। এর কারণ এটাও হতে করোনায় পরে দীর্ঘদিন ঘরবন্দি থাকার পর মানুষ যেই একটু ছাড়া পেয়েছে তেমনি মেতে উঠেছে শরতের উৎসবে। আর কে না জানে বাঙালি উৎসব প্রিয় জাতি।

কাশফুল দেখিনি তখনও। শুধু বইপুস্তকে পড়েছি, একধারে কাশবন ফুলে ফুলে সাদা। কল্পনায় কাশফুলের নরম ছোঁয়ার বিছানায় হঠাৎ ঢাকের শব্দে ঘুম ভেঙে যায়। ঘুম ভেঙে জেগে উঠেছে পুরো গ্রাম। হঠাৎ করেই যেন ফুরিয়ে গেছে বর্ষাকাল। আমিও জেগে উঠি। শিশির মাখা ঘাসে পা রাখি। সেখানে খেলা করে সোনারোদ। সেই রোদ ছড়িয়ে পড়ে এখানে সেখানে। নারিকেল ফেটে বের হওয়া সদ্য চারাগাছে, আয়েশি ভঙিতে শুয়ে থাকা গৃহস্থ বাড়ির কুকুরের গায়ে, সদ্য বিবাহিতার সকালে স্নান শেষে শুকাতে দেওয়া শাড়িতে, কিশোরীর তুলতুলে নরম গালে খেলা করে সোনারোদ। রবি ঠাকুরের কথা স্মরণ করে একটি ঘাসের ডগার ওপর একটি শিশির বিন্দু দেখি। নানা রঙের প্রজাপতির উড়োউড়ি দেখি। এরপর আকাশটা দেখব বলে মাথা উঁচু করি। শরতের আকাশে হাওয়াই মিঠাইয়ের মতো মেঘ। মনে হয় এই বুঝি টান দিয়ে চকলেটের মতো খাওয়া যাবে। তাহলে কি এই হাওয়াই মেঘ কৈলাস থেকে নিয়ে এসেছে দুর্গাপূজার আগমনী চিঠি। শুরু হলো কি উল্টোপুরাণ! বাল্যবেলায় পাওয়া স্বাধীনতার স্বাদ! এ বাড়ি ও বাড়ি ঘুরে খবর নেওয়া প্রতিমা বানানোর কাজ কতদূর এগুলো। স্কুল বন্ধ! সারাদিন টো টো কোম্পানির ম্যানেজারি করে সাঁঝ বেলায় ঘরে ফিরি। সাঁঝের বাতাসে হিমেল পরশ। হালকা কুয়াশা। বাড়ির সামনের তালগাছে ভূতের ভয়! কিন্তু আজ ভয় কেটে গিয়ে ওর জন্য করুণা হয়। কেমন যেন দাঁড়িয়ে আছে। একাকী! নিঃসঙ্গ!

যখন ঠিক শরৎকে বুঝতে শিখলাম। শহুরে জীবনে? নীলাকাশে সাদা মেঘের ভেলা। নদীতীরে ঠাসাঠাসি কাশবন। অমল ধবল পাল উড়িয়ে নদীতে, খালে ভেসে বেড়ায় এক মাল্লার কোষা নৌকা। বিলের জলে শাপলার হালকা দুলুনিতে স্থির বসতে পারে না গঙ্গাফড়িং। হেলিকপ্টারের মতো এক ফুল থেকে আরেক ফুলে উড়ে উড়ে ক্লান্ত সে। ভোরের শিশিরমাখা ঘাসে সোনা রং রোদ পড়ে অপূর্ব বর্ণচ্ছটা ছড়ায় চারদিকে। কমলাবরণ বোঁটার শ্বেত শেফালি ছড়িয়ে-ছিটিয়ে ঝরে পড়ে আছে উঠোনময়। টুকরো টুকরো মেঘের ভেলাগুলো যেন দুর্গাপূজার বেয়ারিং চিঠি, যা কৈলাস থেকে ডাকহরকরা বাতাস বয়ে নিয়ে এসেছে। এরপর একদিন আসে বোধন। মাইকে বেজে উঠে, ‘যদি হই চোরকাঁটা ওই শাড়ির ভাঁজে...। সন্ধ্যা, লতা, সতীনাথ, হেমন্ত একের পর এক বাজতে থাকে। মাইক বন্ধ হওয়ার পরও কানে জঁ জঁ আওয়াজ হয়। বিলের জলে দুলুনি উঠলে যেমন স্থির থাকতে পারে না গঙ্গা ফড়িং, মনও তেমনি স্থির থাকে না। জিপার লাগানো পকেট থেকে জমানো টাকাগুলো বের করি। গুণে দেখি বার বার। দু’এক টাকা বাড়লো নাকি!

দীনেন্দ্রকুমার রায়ের পল্লীচিত্র বইয়ে অসাধারণ বর্ণনা রয়েছে দুর্গাপূজার। ‘নদীজলে অনেক দূর পর্যন্ত মশালের আলো প্রতিফলিত হইতেছে। প্রতিমার নৌকার একপ্রান্তে দেওয়ানজী গললগ্নীকৃতবাসে কৃতাঞ্জলিপুটে গম্ভীরভাবে দন্ডায়মান। পুরোহিত ঠাকুর দক্ষিণ হস্তে পঞ্চপ্রদীপ ও বাম হস্তে ঘণ্টা নাড়িয়া ঠাকুরের আরতি করিতেছেন, দর্শকবৃন্দ নির্র্ণিমেষ নেত্রে চাহিয়া আছে। শরতের ধুসর সন্ধ্যায় পল্লীপ্রান্তবাহিনী তরঙ্গিনীবক্ষে এক অপূর্ব দৃশ্য’।

তবে দুর্গাপূজোর প্রেমটা বেশ অসাধারণ। একদিক নাচ-গান আর আরতির ধূপের গন্ধে ম ম করে প্রতিটি পূজামণ্ডপ। বাড়িতে বাড়িতে নাড়ু, মোয়া আর নানা রকম মিষ্টান্ন তৈরির ধুম। অন্যদিকে প্রেম করার অবাধ স্বাধীনতা। বাবা-মায়ের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে কিছুটা স্বাধীনতা। তাই পুজো এলেই বেশ স্মৃতিকাতরও হয়ে পড়ি। ফেলে আসা তোমাকে বেশ মনে পড়ে। হেলাল হাফিজের ভাষায়,

‘শুনেছি সুখেই বেশ আছো । কিছু ভাঙচুর আর

তোলপাড় নিয়ে আজ আমিও সচ্ছল, টলমল

অনেক কষ্টের দামে জীবন গিয়েছে জেনে

মূলতই ভালোবাসা মিলনে মলিন হয়, বিরহে উজ্জ্বল ।

তুমি জানো, পাড়া-প্রতিবেশী জানে পাইনি তোমাকে,

অথচ রয়েছো তুমি এই কবি সন্ন্যাসীর ভোগে আর ত্যাগে’ ।

 

লেখক : সাংবাদিক ও সাহিত্যিক

/এসএএস/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
বিএনপির ৭ আইনজীবীর আদালত অবমাননার বিষয়ে আদেশ বুধবার
বিএনপির ৭ আইনজীবীর আদালত অবমাননার বিষয়ে আদেশ বুধবার
২০১৬ সালের নির্বাচনে দুর্নীতি করেছিলেন ট্রাম্প: প্রসিকিউটর
ঘুষ কেলেঙ্কারি মামলার বিচার২০১৬ সালের নির্বাচনে দুর্নীতি করেছিলেন ট্রাম্প: প্রসিকিউটর
যে পুরস্কার জিতে ফেদেরারকে ছুঁলেন জোকোভিচ 
লরিয়াস অ্যাওয়ার্ড যে পুরস্কার জিতে ফেদেরারকে ছুঁলেন জোকোভিচ 
একাডেমিক মান উন্নয়নে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘মাস্টার প্ল্যান’
একাডেমিক মান উন্নয়নে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘মাস্টার প্ল্যান’
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ