আর নিতে পারছি না...

জোবাইদা নাসরীনমাননীয় স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম ইতোমধ্যেই ঘোষণা দিয়েছেন রুপার বোনকে চাকরি দেওয়া হবে। ধর্ষণের ঘটনায় সরকারিভাবে দফারফা এই প্রথম নয়। কিন্তু ধর্ষণ থামে না। এই ধরনের ঘটনার পর কোনও মন্ত্রী বা রাজনৈতিক নেতার সেই ভিকটিমের বাড়িতে যাওয়া রাষ্ট্রীয় কোনও প্রতিকার কঠোর শাস্তি নিশ্চিত করে না। ধর্ষণের শিকার নারীর বোনকে চাকরির আশ্বাস কোনোভাবেই ধর্ষণের রাজনৈতিক অর্থনীতিকে দূরে ঠেলে দেয় না বরং ঘটনাটি সেখানেই থেমে থাকার জন্য উৎসাহ দেয়।
কেন বললাম এই বিষয়টি তা স্পষ্ট হবে গত কালকের একটি ঘটনা আপনাদের জানালে। আগেরদিন রাস্তা ফাঁকা হওয়ায় রামপুরা রিকসা করে যাবো বলে মনস্থির করলাম। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইন্টারন্যাশনাল হলের সামনে রিকসা পেলাম। রিকসা চালক কয়েকদফা অন্য রিকসার সঙ্গে ধাক্কা লাগালেন। মালিবাগ মোড়ে এসে অন্য রিকসার ধাক্কায় তার হাতের কিছুটা অংশ ছিড়ে গেলো বলে তিনি রিকসা থামিয়ে অন্য রিকসা চালককে মারতে গেলেন। আমি বললাম, আপনি এই রকম ধাক্কা লাগাচ্ছেন কেন? সে হঠাৎ বিদ্যুৎ গতিতে চলতে শুরু করলো এবং আমি বারবার পড়ে যাচ্ছিলাম। মালিবাগ মোড় থেকে রামপুরার রাস্তা বেশ খারাপ হওয়ায় আমি তাল না সামলাতে পেরে রিকসার হুড ধরে প্রথমে কোনোরকম টিকে থাকার চেষ্টা করলাম, এরপর একটি প্রাইভেট কারের সঙ্গে লাগিয়ে দিলে আমি চিৎকার শুরু করলাম।  রিকসা থামানোর জন্য জোরে জোরে চিৎকার শুরু করলাম। সে রিকসা না থামিয়েই বললো, অন্য রিকসা ধাক্কা দেওয়ায় আমি কেন তার পক্ষ নিলাম না। সে আমাকে বললো- আমাকে রিকসা থেকে ফেলতে চেয়েছিলো এবং আমার ভাগ্য ভালো যে সে আমাকে সেদিনের বাসের মতো করেনি। আমি বললাম, সেদিনের বাস কী? সে দাঁত মুখ খিচে পরিষ্কারভাবে বললো বুঝেন নাই, ‘নষ্ট কইরা মাইরা ফালাই নাই’।

রাস্তায় লোকজন দাঁড়িয়ে আমার আর সেই রিকসা চালকের কথাবার্তা শুনছিলো। কেউ হাসছিল। আমি জানি আমি তাকে মারলে সেও আমাকে মারবে, এবং রাস্তার কেউ আসবে না। আমি পুলিশ ফোন করলে পুলিশ আস্তে আস্তে সে চলে যাবে। এই ধরনের একটি ঘটনা একজন কিভাবে সামলাবে? হয়তো আপনারা বলবেন, ‘আমি কথা বলতে কেন গেলাম?’

মিডিয়ার আলোচনার কারণে সবাই ঘটনাটি জানে এবং তাহলে একদিকে তারা উৎসাহ পাচ্ছে এবং এই ঘটনা তাদের জন্য ভয় তৈরি না করে অন্যকে ভীতি প্রদর্শনের ক্ষেত্রে হাতিয়ার হচ্ছে। আবার না জানালেও কেউ জানতে পারছে না এবং আসামিরা ধরা পড়ছে না এবং তাদেরকে আইনের আওতায় আনা যাচ্ছে না।এর আগেও এই বিষয়টি হয়েছে। মিডিয়ায় কোনও একটি বিষয়ে  আলোচিত হলে সেই ধরনের আরও কয়েকটি ঘটনা তার কাছাকাছি সময়ে ঘটে। মাননীয় মন্ত্রী আপনি এই বিষয়ে কী পদক্ষেপ নেবেন সেই বিষয়ে স্পষ্ট কথা শুনতে চাই। চাকরি দেন ভালো কথা কিন্তু আমি কাল রুপা হবো না, সেটির ব্যবস্থাই দেখতে চাই।

দুই.

ঘনিয়ে আসছিলো ঈদ। সেদিন সকলে ক্রিকেট জেতার আনন্দে উদ্বেলিত ছিল। আর কেউ কেউ ছিল ভারতের ধর্মীয় গুরু রাম রহিমকে নিয়ে আলোচনায়। মায়া, মমতা আর হাহাকার নিয়ে মানুষের মনে স্থান করে নিয়েছিলো রোহিঙ্গা শিশুরা। মন্ত্রী থেকে শুরু করে সবাই কম বেশি এই আলোচনায় সরব ছিলেন। বন্যার আলোচনাও ছিল হাতে গোনা। মনে আছে, খুব মনে আছে বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাবের আড্ডা তখনও আঞ্জুমানে মফিদুল ইসলামের বদৌলতে বেওয়ারিশ লাশ হিসেবে দাফনকৃত রুপার আলোচনা যখন আমি পাড়ছিলাম, আমার এক সহকর্মী বলেছিলেন, ‘তার রাতের গাড়িতে আসার কী দরকার ছিল?’ আমি বেশিরভাগই রাতের গাড়িতে যাতায়াত করি দিনের যানজট, গরম আর বিরক্তি এড়ানোর জন্য। এই মাসেও আমি রাতের গাড়িতে করেই আমার শৈশবের শহরে গিয়েছি। আমিও হয়তো রুপা হয়ে যেতে পারতাম। কিংবা হয়ে যাবো? তখন আমার সহকর্মীরাই বলবেন, ‘রাতের গাড়িতে যাওয়ার কী দরকার ছিল আমার?’ ভাবখানা এমন রাতের গাড়িতে ওঠার আগে সমাজকে আমার বলতে হবে, কারো জন্মদিনে যাওয়ার আগে সমাজকে সে জন্মদিনে যাওয়ার দরকার জানাতে হবে, ড্রেস পরার আগে আমাকে জানাতে হবে কোন ড্রেস আমি কেন পরছি?

রুপা আমার মাথা বসতি গড়ে নড়াচড়া করছিলো। নিজেকে বাঁচাতে সেই ধর্ষকদের নিজের টাকা এবং মোবাইল ফোন দিতে চেয়েছিলো। ধর্ষকরা শুধু ধর্ষণ করেই নয়, তার ঘাড় মটকে দিয়েছে, তাকে হত্যা করেছে। তাতেও শেষ হয়নি তাদের পুরুষতান্ত্রিক ক্ষমতার দাপট। তারা রুপাকে বনে ফেলে রেখেছে, পরের দিন আবার গাড়ি নিয়ে বের হয়েছে।

তিন.

আমরা যারা ক্রিকেট জয়ের আনন্দে মাতোয়ারা, বার বার খালি সেই ছবি শেয়ার  দিচ্ছি, ঈদে কে কত বড় গরু কিনলাম তার আলোচনা করছি। দাম বেশি হলো কী কম হলো, জিতলাম না ঠকলাম তা নিয়ে আলোচনায় ব্যস্ত, তাদের জন্যই তারাই এই সব ঘটনাকে পরোক্ষভাবে আস্কারা দিই। উন্মাদনা থাকে দেশ জিতলে সেই একই উন্মাদনা নিয়ে আমরা প্রতিবাদে নিজেকে নিয়ে যাই না। আমাদের অবহেলা, চুপ থাকা, নিজেকে নিরাপদ ভেবে সেটিকে উপভোগ করাই ধর্ষকদের উৎসাহ দেয়। তাই হয়তো তাদের চেয়ে আমাদের অপরাধ কম না।

আমাদের সমষ্টিগত নির্বিকারত্বের  কারণেই একের পর এক তনু-রুপাদের এভাবে জীবন দিতে হচ্ছে। কিছুদিন আগে দিল্লিতে নির্ভয়ার মৃত্যু পুরো ভারতকে নাড়িয়ে দিয়েছিল, সেটি আমরা সবাই জানি। এদেশেই ১৯৯৫ সালে ইয়াসমিনও রাতের গাড়িতে চড়ে মায়ের কাছে যেতে চেয়েছিল, কিন্তু সেদিন সে পুলিশ কনস্টেবল দ্বারা ধর্ষণের শিকার হন। হত্যার পরবর্তী প্রতিক্রিয়ার কথা আমরা নিশ্চয় সবাই ভুলে যাইনি। কিন্তু আমাদের মনে থাকাটাও কী কোনও কাজে আসে? নিশ্চুপতার রাজনীতিই আমাদেরকে প্রতিদিনই পত্রিকার পাতায় গুম-খুন ও গণধর্ষণের খবর পড়েও নির্বিকার থাকার প্ররোচনা দেয়। আমাদের নারী সংগঠনগুলোর দেন দরবারও পত্রিকায় বিবৃতি দিয়ে আর মানববন্ধনের মধ্যে আবদ্ধ।

মাননীয় মন্ত্রী, ধর্ষণের শিকার নারীর পরিবারকে টাকা বা কারো চাকরির ব্যবস্থা করায় হয়তো আপনি ব্যক্তিগত বাহবা পাবেন কিন্তু আপনি বুক টান টান করে বলুন ধর্ষণের শাস্তি মৃত্যুদণ্ড এবং এটির জন্য বিশেষ আদালতের ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

লেখক: শিক্ষক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
ইমেইল: zobaidanasreen@gmail.com