থার্টি ফাস্ট নাইটে রাত ১০টার দিকে নৈশ ভ্রমণ শেষে ফিরে এসেছি বাসায়। না জানি বাইরে কোনও বিপদে পড়ি সেই ভয়ে। পরদিন শুভ সকালে উঠে অন্তর্জালে দেখতে লাগলাম সংবাদপত্র, অনলাইন বা ফেসবুকসহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলো। আশা কোথাও হয়তো আনন্দ আয়োজনের খবর পাবো। এসব খবর শুনলেও ভালো লাগে। এমনিতে নানা মাধ্যমে তারকা হোটেলগুলোর আয়োজনের খবর জেনেছিলাম। কিন্তু ১ জানুয়ারি ইন্টারনেট দুনিয়া ঘেঁটে হতাশ হতে হলো বাংলাদেশ নিয়ে। পেলাম পৃথিবীর বড় বড় দেশে কতো জমকালো আয়োজন হয়েছে তার স্থির ও ভিডিও চিত্র। আর বাংলাদেশের যে খবরটি পেলাম সেটি হলো, রাতে ঢাকা মহানগরীতে নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করতে প্রথমবারের মতো র্যাবের হেলিকপ্টারে সার্চ লাইট দিয়ে টহল দিতে দেখা গেছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি এলাকায় ছাত্ররা কিছুটা আনন্দ করতে পারলেও সেখানে ছাত্রীরা বেরুতেই পারেনি, অগত্যা যথারীতি তাদের ভরসা হলো-এর ব্যালকনি। পুলিশ কমিশনার সেখানে ভিসির সঙ্গে দেখা করে সাংবাদিকদের কাছে স্বীকার করলেন, নিরপত্তার কারণে উৎসবে কিছুটা বিঘ্ন ঘটছে। তবে তার ভাষ্য, ‘জনস্বার্থের কারণেই এই ধরনের নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।’ এর আগে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছিলেন, ‘থার্টি ফার্স্ট নাইটে কিছু লোক খামোকাই হৈ চৈ করে। সেটা যাতে করতে না পারে সে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
এসব কথা শুনে রস সাহিত্যিক শিবরাম চক্রবর্তীর সেই কথাটি মনে পড়ে গেলো। তিনি লিখেছেন, ‘নতুন বছর, নতুন বছর বলে হৈচৈ করার কিছু নেই, যখনই কোনও নতুন বছর এসেছে, সেটা এক বছরের বেশি টেকেনি!’ তাই তো! এবার বাবা-মায়েরা চেষ্টা করেছেন তরুণ ছেলেটি যাতে বাড়ির বার না হয়। সদা সতর্ক। রাত বাড়ার সাথে সাথে যেহেতু আতঙ্কে বাড়ি ফেরার তাড়া ছিল সে কারণে অনেকে ঘুমিয়ে পড়েছেন দ্রুত। বলা যেতে পারে, মোটামুটি অবরুদ্ধ একটা পরিবেশেই কেটেছে থার্টি-ফার্স্ট নাইট। যে ধরনের পরিবেশ অন্তত ঢাকা শহরে সৃষ্টি করা হয়েছিল তাতে আনন্দ ঠিক জমে না। আতঙ্কই জমে বেশি। এরপরও পাড়া, মহল্লায় যে বাজি ফোটেনি, ফানুস উড়েনি, আলো জ্বলেনি তা নয়! কিন্তু সেগুলোতে কোনও উৎসবের সমন্বিত প্রয়াস বা অনাবিল আনন্দ নেই বললেই চলে। কেউ কেউ হয়তো ঘরোয়া আয়োজন করেছে। এসব দেখে বরং বুকের ভেতর থেকে গভীর দীর্ঘশ্বাসই বেরিয়ে এসেছে।
আমার আলোচনায় অনেকের মনে হতে পারে, আমি হয়তো রাত বিরাতে ছেলে-মেয়েদের রাস্তায় উদ্দাম নাচানাচি সমর্থন করছি বা মদ খেয়ে মাতাল হওয়ার কথা বলছি। মোটেই তা নয়। আমি চাই মানুষ যার যার মতো করে বাঁচবে। আনন্দ-উৎসব উদযাপন করবে। অবশ্যই অন্যের ক্ষতি না করে। কেউ সারারাত উচ্চস্বরে গানবাজনা করবে, ওয়াজের নামে হিন্দু সম্প্রদায়কে গালাগাল করবে, মেয়েদের দেহের অশ্লীল বর্ণনা করবে, দেশপ্রেমের নামে এলাকার কমিশনারের গুনগান চলবে সারারাত- এটাও মেনে নেওয়া যায় না। বাইরের দেশগুলোতে যারা ঘুরেছেন তারা দেখেছেন, একটা সময়ের পর সবাই মিলে মেতে উঠেন আনন্দে হুল্লোড়ে। সেখানে পুলিশ পর্যটক থেকে শুরু করে সবাইকে নিরাপত্তা দেয়। আর আমাদের এখানে সবাইকে বাড়ির মধ্যে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়। সরকার চাইলে একটা নির্দিষ্ট জোন করতে পারে, সেখানেই না হয় আনন্দ উৎসব হবে। এমনিতে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানকে ঘিরে সাংস্কৃতিক বলয় গড়ার কথা শুনছি সেই কবে থেকে! কোনও কিছুর ওপর অবরোধ আরোপ করে সেটি বন্ধ করা যায় না। যার যেটা অভ্যাস সেটা সে করবেই। হয়তো থার্টি ফার্স্টে চুপ রাখা গেলো, কিন্তু বাকি দিনগুলোতে? মুশকিলটা হচ্ছে, ধীরে ধীরে আমরা যে মধ্যযুগের দিকে এগুচ্ছি সেটা বোধহয় টেরই পাচ্ছি না। এখন চারদিকে যেন মৌলবাদীদের জয়জয়কার।
সম্প্রতি একটা মজার বিষয় পড়লাম। পাঠকদের শেয়ার করছি। হত্যা মামলা থেকে বাঁচতে বাকপ্রতিবন্ধী হওয়ার ভান করেছিলেন চীনের ঝেজিয়াং প্রদেশের বাসিন্দা জেং। খুন করে পালিয়ে গিয়েছিলেন অন্য জায়গায়। দীর্ঘ ১২ বছর এই ভান ধরে থাকার পর সত্যি সত্যিই কথা বলার শক্তি হারিয়ে ফেলেছিলেন জেং। টাইমস অব ইন্ডিয়ার প্রতিবেদনে বলা হয়, জেংকে গ্রেফতার করে পুলিশ। কিন্তু জেরায় কোনও কথা বলতে পারেননি তিনি। শেষে নিজের অপরাধের কথা কাগজে লিখে স্বীকার করেছেন। আমরাও হয়তো এক সময় এমন হবো। অবরুদ্ধতার কাল আর পেরুতে পারবো না। চোখে অন্যায় সয়ে যাবে। মুখ বন্ধ থাকবে। গাধার মতো দিনযাপন করবো। কিন্তু এতে যেটা হবে সেটা হলো, একটি উদার রাষ্ট্রের মৃত্যু হবে।
লেখক: সাংবাদিক ও সাহিত্যিক