এসব বক্তব্যের ব্যাখ্যা কী!

রেজানুর রহমানকিছুদিন ধরে ফেসবুকে ওয়াজের নামে সম্মানিত অনেক ‘হুজুরের’ বক্তব্য শুনে আমি দ্বিধাগ্রস্ত। একটা কথা স্পষ্ট করতে চাই– আমি মুসলমান। আমার ধর্মের বিরুদ্ধে কেউ কোনও আপত্তিকর কথা বললে অথবা অপব্যাখ্যা করলে আমি কখনোই তো মেনে নেবো না। অবশ্যই তার প্রতিবাদ করবো। কিন্তু যাদের কথা শুনে আমরা অনুপ্রাণিত হবো তাদেরই কেউ কেউ যদি ধর্মকে ঘিরে অপব্যাখ্যা দেন, অযৌক্তিক মন্তব্য করেন তাহলে, আমরা কার কাছে যাবো?
কয়েকদিন আগে ফেসবুকে দেখলাম এক সম্মানিত মাওলানা পহেলা বৈশাখ সম্পর্কে অযৌক্তিক, অসত্য, অপমানজনক বক্তব্য দিচ্ছেন। তার শারীরিক অঙ্গভঙ্গি খুবই আপত্তিকর। যারা পহেলা বৈশাখ পালন করে তারা নাকি কাফের। কারণ, পহেলা বৈশাখ হিন্দুদের সংস্কৃতির অংশ– এমন মন্তব্য জোর দিয়েই করলেন তিনি। সঙ্গে সঙ্গে কুরুচিপূর্ণ শারীরিক অঙ্গভঙ্গি করে মহিলাদের টিপ পরা নিয়ে এতটাই কদর্যপূর্ণ বক্তব্য প্রদান করলেন,যা ভাষায় প্রকাশ করতে লজ্জা হচ্ছে। মন্তব্যটি করে তিনি অপেক্ষমাণ জনতার উদ্দেশে প্রশ্ন ছুড়লেন– ‘ঠিক কিনা... কী হইলো কথা বলেন না ক্যা...।’ সাথে সাথে সেই ওয়াজ মাহফিলে উপস্থিত কয়েকশ মানুষ সমস্বরে তোতাপাখির মতো বুলি আওড়ালেন– ‘হ্যাঁ, হ্যাঁ ঠিক... ঠিক...।’ মনের ভেতর প্রশ্নটা তখনই উঁকি দিতে শুরু করলো– রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে যেখানে সাড়ম্বরে পহেলা বৈশাখ পালন করা হয়, পহেলা বৈশাখকে ঘিরে গোটা দেশ যেখানে আনন্দে উদ্বেল হয়ে ওঠে, সেখানে পহেলা বৈশাখের বিরুদ্ধে ফতোয়া জারি করা রাষ্ট্রের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে যাওয়া নয়কি? অথচ যারা এ ধরনের মন্তব্য করছেন তাদের সম্পর্কে কোনও কথাই বলা হচ্ছে না। ফলে পহেলা বৈশাখের ঐতিহ্যমণ্ডিত সংস্কৃতির বিরুদ্ধে অনেকেই আপত্তিকর বক্তৃতা-বিবৃতি দিয়েই চলেছেন।

ছোটবেলা থেকেই ওয়াজ শুনে শুনে আমি বড় হয়েছি। আমাদের গ্রামের এক মসজিদের ইমামকে খুবই শ্রদ্ধা করতাম। তার মুখের কথা শোনার জন্য মসজিদে ছুটে যেতাম। তিনি এমনভাবে আমাদের ধর্মের ব্যাখ্যা তুলে ধরতেন তা শুনে দেহ-মনে শ্রদ্ধা আর প্রশান্তি আসতো। অথচ ইদানীং ওয়াজ মাহফিলে কারও কারও মুখে ধর্মের ব্যাখ্যা শুনে অবাক হই। অধিকাংশ ক্ষেত্রে মেয়েদের প্রতি আক্রমণাত্মক ব্যাখ্যা প্রদান করা হয়। ইদানীং দেখছি ‘শিশু মাওলানারা’ও ওয়াজ মাহফিলে বক্তব্য দিচ্ছেন। শিক্ষার কোনও বয়স  নেই। দশ বছরের শিশুর কাছেও আমার শেখার অনেক কিছু আছে। কিন্তু তা হতে হবে বাস্তবের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ। কয়েকদিন আগে ফেসবুকে দেখলাম দেশের একটি স্থানে একজন শিশু মাওলানা উঁচু চেয়ারে বসে ওয়াজ করছেন। তার ডানে বামে বসা লোকজন বেশ বয়স্ক। ‘শিশু মাওলানা’ বড়দের স্টাইলে ওয়াজ নছিহত করছেন। মহিলাদের শালীন-অশালীন বিষয় নিয়ে নানান মন্তব্য করছেন তিনি, যা তার বয়সের সঙ্গে যায় না। তিনি এক একটা বিষয়ের অপব্যাখ্যা দিচ্ছেন আর উপস্থিত দর্শকদের উদ্দেশে চিৎকার দিয়ে বলছেন–‘ঠিক কিনা, আরে কথা বলেন না ক্যা...।’ সাথে সাথে দর্শক সমস্বরে চিৎকার দিচ্ছেন–‘হ্যাঁ ঠিক ঠিক…।’

আরেকটা ভিডিও দেখে শঙ্কিত হলাম। বোধকরি ধর্মীয় সভা শেষের পথে। মঞ্চের  সম্মানিত ব্যক্তিরাসহ জমায়েতের লোকজন ধর্মীয় জিকির করছেন। হঠাৎ দেখা গেল বেশ কয়েকজন মুসল্লি টাইপের তরুণ জিকির করতে করতেই মঞ্চে উদভ্রান্তের মতো উঠে গেল। তারা কখনও মঞ্চের খুঁটি বেয়ে বাদরের মতো উপরে ওঠার চেষ্টা করছে। কখনও মঞ্চে বসা হুজুরদের শরীরের ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়ছে। সে এক উন্মাতাল দৃশ্য। তখন বারবার মনে একটাই প্রশ্ন জেগেছে– আমাদের ধর্মে এভাবেই কি জিকির করার বিধান আছে?

আরেকটি ভিডিওতে একজনকে দেখলাম ধর্মীয় সভার মঞ্চে আইয়ুব বাচ্চুর গান নকল করে অশোভন স্টাইলে বক্তৃতা করছেন তিনি। তরুণ ছেলেমেয়েরা কীভাবে সিগারেট খায় তার সমালোচনা করতে গিয়ে তুখোড় অভিনেতার মতো তা নকল করে দেখাচ্ছেন এবং অবশেষে জনতার উদ্দেশে চিৎকার দিয়ে বললেন–কথা ঠিক কিনা…। দর্শক নিশ্চুপ। এবার তিনি আরও জোরে চিৎকার দিয়ে জানতে চাইলেন­–কী হলো…? কথা বলেন না ক্যা...।  সাথে সাথে জনতার গগনবিদারী চিৎকার ভেসে এলো– হ্যাঁ ঠিক ঠিক...।

আরেকটি ভিডিওতে দেখলাম একজন সম্মানিত মাওলানা গানবাজনা, নাটক সিনেমার বিরুদ্ধে কুরুচিপূর্ণ বক্তব্য দিচ্ছেন। সিনেমা দেখা হারাম বলছেন। নাটক সিনেমা নিয়ে আপত্তিকর প্রসঙ্গ টানছেন আর চিৎকার করে জানতে চাইছেন–কথা ঠিক কিনা...। কী হইলো কথা বলেন না ক্যা...? সাথে সাথে দর্শক চিৎকার দিয়ে বলছে—হ্যাঁ, হ্যাঁ ঠিক…। আরেকটি ভিডিওতে দেখলাম একজন উত্তেজিত ‘হুজুর’ চিৎকার দিয়ে বলছেন, ‘মুসলমানকে ছাড়া সবাইকে হত্যা করা যাবে। কোনও মুসলমান গণতন্ত্রে বিশ্বাস করতে পারে না...।’

এসব ভিডিও দেখে দেখে আমি বিভ্রান্ত। আমি ধর্মীয় শিক্ষাগুরুদের কথা শুনতে চাই। তাদের কথা মানতে চাই। কিন্তু তারা যদি ধর্মের অপব্যাখ্যা করেন তখন করণীয় কী? ইসলাম শান্তির ধর্ম। আমাদের ধর্মে নারীকে অনেক সম্মান দেওয়া হয়েছে। অথচ আমাদের অনেক ধর্মীয় শিক্ষাগুরু নারীর স্বাধীনতার বিরুদ্ধে কুরুচিপূর্ণ বক্তব্য দিয়েই চলেছেন। তারা বলছেন, নাটক, সিনেমা দেখা পাপ। অথচ যে দেশটিকে আমরা ইসলাম ধর্মের পীঠস্থান বলে মানি সেই সৌদি আরবে নতুন করে সিনেমা হল চালু হয়েছে। সৌদি আরবের নারীরা দলে দলে সিনেমা হলের দিকে ছুটছেন। ধর্মীয় ক্ষেত্রে এর ব্যাখ্যা কী?

সবার আগে দেশ। কাজেই দেশের বর্তমান উন্নয়ন-অগ্রযাত্রায় ধর্মীয় শিক্ষাগুরুরা অনেক বেশি অবদান রাখতে পারেন বলে আমার বিশ্বাস। সেখানে ধর্মীয় বিধিবিধানের অপব্যাখ্যা নয়, সঠিক ব্যাখ্যা প্রদানের মাধ্যমেও কার্যকর দায়িত্ব পালন করা সম্ভব।

লেখাটি শেষ করি। তার আগে আমার স্কুল জীবনের এক শিক্ষাগুরুর কথা বলতে চাই। তিনি আমাদের আরবি পড়াতেন। এতো সুন্দর করে কথা বলতেন, আমরা তার কথা শোনার জন্য ব্যাকুল হয়ে থাকতাম। তিনি যেমন ধর্মের কথা বলতেন তেমনি প্রগতির কথাও বলতেন। মেয়ে শিক্ষার্থীদের মায়ের মতো স্নেহ দিয়ে বলতেন– মায়েরা ভালো করে লেখাপড়া করো। ভবিষ্যতে তোমাদেরও দেশের ভার গ্রহণ করতে হতে পারে। সাইকেল চালানো নিয়ে এক ছাত্রীর বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছিল। আমাদের সেই ধর্মীয় শিক্ষক ওই ছাত্রীর পাশে দাঁড়িয়েছিলেন। বলেছিলেন, আজ তো ওরা সাইকেল চালাচ্ছে, আগামীতে ওরা প্লেন চালাবে। কাজেই প্রগতির পথে বাধা দেবেন না।

বর্তমান সময়ে ফেসবুকে যখন ধর্মীয় শিশু গুরু অনেকের বিভ্রান্তিকর ওয়াজ শুনি তখন আমার সেই  ধর্মীয় শিক্ষকের কথা মনে পড়ে। তিনি বেঁচে নেই। তাকে কেন মনে পড়ে জানি না। তবে এতটুকু বুঝি, বর্তমান সময়ে তাঁর মতো শিক্ষক, শিক্ষাগুরুর খুব বেশি প্রয়োজন। সবার জন্য রইলো শুভ কামনা।

লেখক: কথাসাহিত্যিক, নাট্যকার, সম্পাদক আনন্দ আলো