X
রবিবার, ২৮ এপ্রিল ২০২৪
১৪ বৈশাখ ১৪৩১

রক্তে ভেজা শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস

রেজানুর রহমান
১৪ ডিসেম্বর ২০২৩, ১২:১৫আপডেট : ১৪ ডিসেম্বর ২০২৩, ১২:১৯

মনে পড়ে কি শহীদ বুদ্ধিজীবীদের কথা? ১৯৭১ সালের ডিসেম্বর মাস। মহান স্বাধীনতা আন্দোলনে বিজয়ের দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়েছে গোটা দেশের মানুষ। প্রায় প্রতিদিনই হানাদারমুক্ত হচ্ছে দেশের বিভিন্ন এলাকা। জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু... তোমার দেশ আমার দেশ বাংলাদেশ, বাংলাদেশ, তোমার আমার ঠিকানা পদ্মা মেঘনা যমুনা... দীপ্ত শ্লোগানে মুখর গোটা দেশ। এমনই আনন্দের মুহূর্তে এলো বেদনার সংবাদ। ১৪ ডিসেম্বর ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় দেশের শ্রেষ্ঠ সন্তান বুদ্ধিজীবীদের ধরে ধরে হত্যা করলো পাক হানাদার বাহিনী ও তাদের এদেশীয় দোসররা।
 
কী নির্মম, কী নিষ্ঠুর, হৃদয় বিদারক এই হত্যাকাণ্ড। ঢাকা শহরে রাতের অন্ধকারে বুদ্ধিজীবীদের বাসা-বাড়িতে হাজির হয় পাক হানাদার বাহিনীর লোকজন। দরজায় ঠক্ ঠক্ শব্দ। এত রাতে কে এলো? গভীর আতংকে দরজা খুলে দিতেই যমদূতের মতো বাসার ভিতরে ঢুকে পড়ে জল্লাদরা। পরিবারের প্রধান ব্যক্তিকে ক্যান্টনমেন্টে জিজ্ঞাসাবাদের কথা বলে এক কাপড়েই ধরে নিয়ে যায়। আর ফিরে আসেননি তিনি। ১৪ ডিসেম্বরের ভয়াল রাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সহ ঢাকা শহরের বিভিন্ন এলাকা থেকে শিক্ষক, চিকিৎসক, কবি, সাহিত্যিক সহ বিভিন্ন পেশার জ্ঞানী গুণী ব্যক্তিদের ধরে নিয়ে যায় পাক হানাদার বাহিনী। পরের দিন অনেকের গুলীবিদ্ধ লাশ পড়েছিল রায়ের বাজার সহ ঢাকা শহরের বিভিন্ন এলাকায় পচা নর্দমায়। প্রিয় পাঠক, একবার কল্পনা করুন তো, ভাবুন তো একবার। রাতে বাসায় ঘুমিয়েছিলেন একজন মানুষ। তিনি একজন বুদ্ধিজীবী। সেই পরিচয় না-ই বা বললাম। একজন মানুষকে তার পরিবারের সদস্যদের সামনেই ভয়-ভীতি দেখিয়ে ধরে নিয়ে গেলো একদল মানুষ। পরের দিন তার লাশ পাওয়া গেলো পচা নর্দমায় লাশের স্তুপে। পৃথিবীর আর কোনও দেশে পরিকল্পনা মাফিক বুদ্ধিজীবী নিধনের এমন নির্দয়, নিষ্ঠুর ঘটনা ঘটেছে কিনা আমার জানা নেই। বাংলাদেশে বুদ্ধিজীবী হত্যার এই ঘটনা ছিল সুদুর প্রসারী পরিকল্পনার অংশ। ডিসেম্বরের শুরুতেই পাক হানাদার বাহিনী বুঝতে পারে বাংলাদেশের স্বাধীনতা এখন সময়ের ব্যাপার মাত্র। তাই তারা শেষ মুহূর্তে মরণ কামড় দেওয়ার পরিকল্পনা নেয়। তারা ভেবেছিল এই দেশের বুদ্ধিজীবীদের ধরে ধরে হত্যা করতে পারলে ভবিষ্যতে দেশ পরিচালনায় বুদ্ধি-পরামর্শ দেওয়ার মতো নির্ভরযোগ্য কোনও লোক থাকবে না। স্বাধীন বাংলাদেশ বিপদে পড়ে যাবে, মানুষ দিশেহারা হয়ে যাবে। কী কুটিল ষড়যন্ত্র...
 
বাংলাপিডিয়ার হিসাব মতে মুক্তিযুদ্ধের সময় ১ হাজার ১১১ জন বুদ্ধিজীবীকে হত্যা করেছিলো পাক হানাদার বাহিনী ও তাদের এদেশীয় দোসর রাজাকার, আলবদরেরা। এই সংখ্যার বিরাট অংশ ছিল ঢাকায়, ১৪৯ জন। যাঁদের মধ্যে ১৪ ডিসেম্বর রাতে বেশির ভাগই হত্যাকাণ্ডের শিকার হন। বাংলাপিডিয়ার হিসাব মতে, মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় কুমিল্লায় ৮৬, যশোরে ৯১, রংপুরে ৭২, দিনাজপুরে ৬১, পাবনায় ৫৩, ময়মনসিংহে ৭৫, ফরিদপুরে ৪৩, চট্টগ্রামে ৬২, খুলনায় ৬৫, বরিশালে ৭৫ এবং রাজশাহীতে ৫৪ জন বুদ্ধিজীবীকে হত্যা করা হয়। তবে এখনও শহীদ বুদ্ধিজীবীদের প্রকৃত তালিকা প্রণয়ন সম্ভব হয়নি।  আর মাত্র ১ দিন পর বিজয়ের ৫২ বছর পালন করবে গোটা জাতি। অথচ আজ শোকের দিন। কী নির্দয়, নিষ্ঠুর পরিকল্পনা ছিল পাক হানাদার বাহিনীর। পরাজয়ের অন্তিম মুহূর্তের বাঙালি জাতিকে মেধাশূন্য করার জন্য মরণ কামড় দিয়েছে। বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করেছে। পাক হানাদার বাহিনীর এদেশীয় দোসর রাজাকার আলবদর বাহিনী প্রকাশ্যে তাদেরকে সহায়তা করেছে। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, তাদের অনেকে এখনও বহাল তবিয়তে বেঁচে আছে। ইতিপূর্বে জনপ্রতিনিধি হিসেবেও ভূমিকা পালনের সুযোগ পেয়েছেন কেউ কেউ। আরও দুঃখজনক সংবাদ হলো, শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস সম্পর্কে সাধারণ মানুষ তো দূরের কথা শিক্ষিত অগ্রসর অনেক মানুষ তেমন কোনও ধারণা রাখেন না। তরুণ প্রজন্মের মধ্যেও দিবসটি খুব একটা স্পষ্ট নয়। বছরে ১টা দিন ১৪ ডিসেম্বর বুদ্ধিজীবী দিবস পালন হলেও রাজধানী ঢাকা ছাড়া দেশের অন্যান্য অঞ্চলে সেভাবে দিনটি গুরুত্ব পায় না। শহরের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সমূহে ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে বুদ্ধিজীবী দিবস সম্পর্কে কিছুটা ধারণা পাওয়া গেলেও মফস্বল অর্থাৎ গ্রামের স্কুল, কলেজের শিক্ষার্থীদের মধ্যে দিনটির সেভাবে গুরুত্ব নেই। দুভার্গ্যজনক হলেও সত্য, অনেক স্কুল-কলেজে শিক্ষক-শিক্ষিকাদের মধ্যেও দিনটি সেভাবে আলোচিত হয় না।
 
আমাদের জাতীয় জীবনে ২৬ মার্চ, ১৬ ডিসেম্বর, ২১ ফেব্রুয়ারি, ১৪ ডিসেম্বর খুবই গুরুত্বপুর্ণ দিন। অথচ স্কুল, কলেজ-মাদ্রাসা এমনকি বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের অনেক শিক্ষার্থী কোনটা বিজয় দিবস, কোনটা স্বাধীনতা দিবস বলতে গিয়ে দ্বিধায় পড়েন। প্রশ্ন উঠতেই পারে কেন এই দৈন্যতা? ২৬ মার্চ স্বাধীনতা দিবস ১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবস, ২১ ফেব্রুয়ারি শহীদ দিবস এবং ১৪ ডিসেম্বর শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস-বাঙালির আন্দোলন সংগ্রামের প্রেরণা। অথচ দিবস ৪টির ব্যাপারে অনেকেরই কম বেশি অনীহা চোখে পড়ে।
 
একটি গুরুত্বপুর্ণ প্রসঙ্গ উল্লেখ করতে চাই। জাতীয় সঙ্গীত একটি দেশের অস্তিত্বের অংশ। মানব শরীরের রক্তের মতো। রক্ত ছাড়া মানুষ বাঁচে না। তেমনই জাতীয় সঙ্গীত ছাড়া একটি দেশের অস্তিত্বই কল্পনা করা যায় না। আমাদের একটি হৃদয় ছোঁয়া জাতীয় সঙ্গীত আছে। ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি।’ স্কুল, কলেজ মাদ্রাসায় ক্লাস শুরুর আগে প্রতিদিন এসেম্বলিতে জাতীয় সঙ্গীত পরিবেশনের নিয়ম থাকলেও দেশের অধিকাংশ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এব্যাপারে মোটেই আন্তরিক নয়। এব্যাপারে সংশ্লিষ্টদের জবাবদিহি করার নজীরও নেই। একটি দেশের জন্য এটি সুখকর সংবাদ নয়।
 
আরও একটি জরুরি প্রসঙ্গ উল্লেখ করতে চাই। সারাদেশে প্রায় ২৮১টি বধ্যভূমি শনাক্ত করা হয়েছে। এই বধ্যভূমিগুলোতে মহান স্বাধীনতা আন্দোলনে পাক হানাদার বাহিনী কর্তৃক নৃশংস হত্যাকাণ্ডের শিকার অসহায় মানুষের লাশ বালির বস্তার মতো ছুঁড়ে ফেলা হয়েছিল। দেশজুড়ে ২৮১ টি বধ্যভূমি সংরক্ষণ ও স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ শেষ হওয়ার কথা ছিল ২০২১ সালে। কিন্তু এখন পর্যন্ত মাত্র ৩৫টির কাজ শেষ হয়েছে। তবে কোথাও কোথাও অযত্ন অবহেলার ছাপ স্পষ্ট। নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার না থাকায়, বিশেষ করে নজরদারির অভাবে দেশের অনেক বধ্যভূমি নেশাখোরদের আড্ডার স্থলে পরিণত হয়েছে। কোনো কোনো এলাকায় ২৬ মার্চ, ১৪ ডিসেম্বর, ১৬ ডিসেম্বর স্থানীয় প্রশাসন নজরদারি দৃশ্যমান করার উদ্যোগ নিলেও সেটা হয়ে ওঠে অনেকটা লোক দেখানো ব্যাপার। নির্ধারিত দিনের পর আবার অযত্ন অবেহালায় অসহায়ের মতো পড়ে থাকে বধ্যভূমিগুলো। একটা ছোট্ট উদাহরণ দিতে চাই। নীলফামারী জেলার সৈয়দুপর উপজেলায় একটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সামনে একটি শহীদ মিনার নির্মাণ করা হয়েছে অনেক বছর আগে। নিয়ম অনুযায়ী শহীদ মিনার ঘিরে ফুলের বাগান থাকার কথা। অথচ সেখানে স্থান পেয়েছে বিশাল একটি ডাস্টবিন। যেখানে প্রতিদিন এলাকার মানুষ ময়লা, আবর্জনা ফেলে। দুর্গন্ধে ভরে থাকে গোটা শহীদ মিনার এলাকা। এ নিয়ে প্রচার মাধ্যমে অনেক লেখালেখি হলেও ডাস্টবিনটি সরেনি। দেশের বিভিন্ন স্থানে বধ্যভূমি গুলোর ক্ষেত্রেও কমবেশি একই দুর্দশার চিত্র দৃশ্যমান। এর একটা বিহীত প্রয়োজন।
 
আশা করি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ বিষয়টির প্রতি গুরুত্ব দিবেন। কবি আসাদ চৌধুরী লিখেছেন ‘তোমাদের যা বলার ছিলো বলছে কি তা বাংলাদেশ’? আজকের এই শহীদ দিবসে কবিতার এই লাইনটি বিশেষভাবে মনে পড়ছে। আমরা কি আদৌ মহান স্বাধীনতা আন্দোলনে প্রাণ বিসর্জনকারি শহীদদের মর্যাদা রক্ষায় আন্তরিক পদক্ষেপ নিতে পেরেছি?    

শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস অমর হোক।

লেখক: কথাসাহিত্যিক, নাট্যকার, সম্পাদক আনন্দ আলো

/এসএএস/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
কর্মক্ষেত্রে স্বাস্থ্য ও সুরক্ষাবিধি নিশ্চিতে সম্মিলিতভাবে কাজ করতে হবে: রাষ্ট্রপতি
কর্মক্ষেত্রে স্বাস্থ্য ও সুরক্ষাবিধি নিশ্চিতে সম্মিলিতভাবে কাজ করতে হবে: রাষ্ট্রপতি
দিনাজপুরে একসঙ্গে ২০ হাজার কণ্ঠে গীতা পাঠ
দিনাজপুরে একসঙ্গে ২০ হাজার কণ্ঠে গীতা পাঠ
উপজেলা নির্বাচন আগের যে কোনও নির্বাচনের চেয়ে ভালো হবে: ইসি হাবিব
উপজেলা নির্বাচন আগের যে কোনও নির্বাচনের চেয়ে ভালো হবে: ইসি হাবিব
জেসি অনভিজ্ঞ বলেই আপত্তি ছিল মোহামেডান-প্রাইম ব্যাংকের
জেসি অনভিজ্ঞ বলেই আপত্তি ছিল মোহামেডান-প্রাইম ব্যাংকের
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ