সম্প্রতি বিজ্ঞান লেখক অধ্যাপক জাফর ইকবাল স্যারের কোটা আন্দোলন এবং ‘আমি রাজাকার’ একটি ছবি একটি লেখাকে কেন্দ্র করে এই বিষয়টি আরও গুরুত্ব নিয়ে হাজির হয় এবং আলোচনায় আসে। এই লেখাটি নিয়ে যে অধ্যাপক জাফর ইকবালের যে পরিমাণ মিডিয়া ট্রায়াল হয়েছে তা বিশ্লেষণ করে মনে হয় এই মিডিয়া ট্রায়ালের বিষয়টি নিয়ে আমাদের গভীরভাবে ভাবতে হবে। কারও একটি বিষয়ে কিংবা মতামতের বিপরীতে অন্য কারো ভিন্নমত কিংবা কারো স্বার্থবিরোধী হলেই সেখান থেকে শুরু হয় মিডিয়া ট্রায়াল এবং সামাজিকভাবে হেয় করার মানসিকতা। সেই সীমানাহীন মানসিকতার কুশপুত্তলিকা পোড়ানো, গালিগালাজ থেকে কোনও কোনও সময়ে অনেক বড় ধরনের কর্মসূচি পর্যন্ত চলমান থাকে। গত এক বছরে এই ফেসবুক ট্রায়াল বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় যে এই ট্রায়ালের মূল লক্ষ্য থাকে ব্যক্তিগত আক্রমণ এবং সামাজিকভাবে হেয় করার প্রবণতা, কখনও কখনও থাকে মেরে ফেলার হুমকি।
প্রত্যেকটি মানুষই রাজনৈতিকভাবে আলাদা। কারও সঙ্গে কারও মত মেলে না, চাল-চলন মেলে না, মেলে না আদর্শ। আমাদের প্রাত্যহিক জীবনে যেমন একে অন্যের সঙ্গে বনিবনা না হওয়ার চর্চা আছে, সেই ধরন জারি আছে মত প্রকাশের মধ্যেও। কিন্তু কারও সঙ্গে কারও মতামত কেন্দ্রিক বনিবনা না হলে সেটি প্রকাশের নানা সুযোগ আছে। মত প্রকাশের স্বাধীনতা সকলেরই আছে। তবে সেটি যুক্তি দিয়ে, নিজের ভাবনা দিয়ে কিংবা অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে প্রকাশ করাই কাঙ্ক্ষিত ধরন। এবং এগুলো প্রকাশ করার পাটাতন হিসেবে ফেসবুক নিশ্চয়ই একটি সহজ, সাশ্রয়ী এবং অতি গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম। কিন্তু বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এটির বহিঃপ্রকাশ ঘটে অত্যন্ত কদর্যভাবে। সেখানে ব্যক্তিগত আক্রমণের সঙ্গে অনেক সময়ই পরিবারের বিভিন্ন সদস্যদেরও হেয় করার ঝোঁক থাকে।
ফিরে আসি অধ্যাপক জাফর ইকবালের লেখায়। শিক্ষক, লেখকের বাইরে তাঁর আরও একটি পরিচয় আছে। সেটি হলো তিনি শহীদ পরিবারের সন্তান। ১৯৭১ সালে তাঁর বাবাকে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী হত্যা করে। তরুণ জাফর ইকবাল নিজে তার শহীদ বাবার লাশ খুঁজতে গিয়েছিলেন এবং মাটি খুঁড়ে সেই মৃত বাবাকে নিয়ে এসেছিলেন নিজেদের কাছে। আবার কবর দিয়েছেন। মুক্তিযুদ্ধে যারা স্বজন হারিয়েছেন তাঁদের কাছে মুক্তিযুদ্ধ নিঃসন্দেহে আট দশজনের চেয়ে ভিন্ন রকম। স্বজন হারানোর বেদনা, দুঃখ, কষ্ট, আবেগ, অনুভূতি তাঁরা অন্যদের থেকে ভিন্নভাবে অনুভব করবেন এটাই স্বাভাবিক। রাজাকারের প্রতি তাঁদের তীব্র ঘৃণা এবং এলার্জি থাকাটাও যৌক্তিক। এবং তাঁর বিভিন্ন সময়ের লেখায় সেটি স্পষ্টও হয়েছে। তাই অধ্যাপক জাফর ইকবাল যখন মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে লিখবেন তখন সেটি ভিন্ন হবে মেজাজে, আবেগে, অনুভূতিতে। কিন্তু সেই আবেগ, অনুভূতিতে কেউ যদি আহত হন কিংবা কারও স্বার্থকে আঘাত করে, তাহলে সেটির প্রতিবাদ লেখনীর মাধ্যমেই প্রকাশিত হওয়া প্রয়োজন। ভিন্নমত সমাজ প্রগতির আবশ্যিক একটি বিষয়। একটি সমাজ বা রাষ্ট্র কত বেশি ভিন্নমতকে পরিসর দেয়, তার ওপর নির্ভর করছে সেই রাষ্ট্রের গণতন্ত্রের চর্চা। তবে এখন প্রশ্ন আসতে পারে মত প্রকাশের স্বাধীনতা আর মিডিয়া ট্রায়াল কি এক? মত প্রকাশের স্বাধীনতার জন্য আমরা সব সময় লড়াই করে আসছি, বিশ্বজুড়েও চলছে এটির জন্য আহাজারি। কিন্তু এই মতের অমিল হলেই গালিগালাজ, বিভিন্ন তকমা দেওয়া, তাকে হেয় করার বিভিন্ন কর্মসূচি নেওয়া– এই চর্চিত সংস্কৃতির বিষয়ে আমাদের দৃষ্টি দেওয়া দরকার। মত প্রকাশে আমাদের যুক্তি, তর্ক, পড়াশোনা এগুলো এখন আর আমাদের অস্ত্র নয়। এখন আমাদের অস্ত্র ভিন্ন, আমরা সেই ভিন্ন অস্ত্র নিয়েই বসে আছি। আমাদের সবার হাতেই এখন অন্যকে মাপার স্কেল। আমরা অন্যকে মাপি, নিজেদের স্কেলের মাপ অনুযায়ী তাদের তকমা দিই, তাদের হেয় করি। এই স্কেলে আছে অন্যকে চূড়ান্তভাবে অসম্মান করার মানসিকতা। আর মিডিয়া ট্রায়াল একভাবে বলতে গেলে মানুষের প্রতি সর্বোচ্চ অসম্মান প্রদর্শন করা হয়।
এই অসম্মান প্রদর্শনের চর্চা থেকে আমরা কি নিজেদের ফেরাতে পারি না। বাংলাদেশ গত দুই বছরে বিভিন্ন সংকট অবস্থায় ফেসবুক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। বিশেষ করে হলি আর্টিজান হামলায় অপরাধীদের তথ্য মূলত ফেসবুকের মাধ্যমেই হয়েছে। আমরা সোশ্যাল মিডিয়াকে সেই গুরুত্বর্পূণ ভূমিকাতেই দেখতে চাই। কাউকে হেয় করা, অসম্মান করা কিংবা ট্রায়াল দেওয়ার মানসিকতা এবং অসহিষ্ণুতার সংস্কৃতি থেকে নিজেদের সরিয়ে রাখা আমাদের দায়িত্ব হওয়া উচিত বলে আমি মনে করি।
লেখক: নৃবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
ইমেইল: zobaidadanasreen@gmail.com